
ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হবে আফ্রিকার গভীরে অভিযান। চলছে জোর প্রস্তুতি। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। তরজমায় স্বাতী রায়। আফ্রিকা মহাদেশের ভিতরের জায়গাগুলো সম্পর্কে আমার কিছুই জানা ছিল না। ফলে মধ্য আফ্রিকা অভিযানে যেতে যে ঠিক কী কী লাগবে, গোড়ায় সেটা বুঝে ওঠাই একটা বড়ো সমস্যা ছিল। এদিকে হাতে সময় খুব কম, খোঁজখবর করতে খুব বেশি সময় দিতে পারব না। ক্যাপ্টেন বার্টন, স্পেক বা গ্রান্ট১—এরা কোনো একজনও যদি এই বিষয়ে কিছু খবরাখবর দিতেন, ‘কীভাবে মধ্য আফ্রিকার অভিযানের জন্য তৈরি হবেন’ গোছের একটা অধ্যায় লিখতেন, তাহলে বড্ড উপকার হত। তাই এই অধ্যায়ে আমি কীভাবে অভিযানের প্রস্তুতি নিয়েছিলাম তা বলছি—আমার পরে অন্য যারা এই পথে আসবেন, তাঁদের কাজে লাগতে পারে।
রাত্রে বিছানায় ছটফট করতে করতে যে প্রশ্নগুলো আমার মাথার মধ্যে ঘুরত, তার মধ্যে কয়েকটা এইরকম—
কত টাকা লাগবে?, ক-জন পাগাজি২ বা কুলি? ক-জন সৈন্য? কতটা কাপড়? কতখানি পুঁতি? কত তার? এত যে বিভিন্ন উপজাতি, এর মধ্যে কাদের জন্য কোন্ ধরনের কাপড় নেব? মাথার মধ্যে এত এত প্রশ্ন ঘুরলেও, ঠিক যেখানটাতে পৌঁছাতে চাইছিলাম, তার ধারে কাছেও গিয়ে উঠতে পারিনি। অনেক অনেক কাগজের উপর আঁকিবুকি কাটলাম, সম্ভাব্য কেমন খরচ হতে পারে সে হিসেব করলাম, কী কী নিতে হবে তার তালিকা তৈরি হল, একশোজন লোককে এক বছর ধরে বহাল রাখতে বা বিভিন্ন ধরনের কাপড়ের কোন্টা কত গজ করে কিনতে কীরকম টাকা লাগবে ইত্যাদি বিভিন্ন অঙ্কও কষে ফেললাম! বার্টন, স্পেক ও গ্রান্টের লেখাগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করলাম—কোনো কাজে এল না। আফ্রিকার গভীরের ভৌগোলিক, নৃতাত্ত্বিক এবং অন্যান্য বিষয়ের অনেক খবরাখবরই মেলে সেখানে। তবে কোনো বইতেই অভিযানের প্রস্তুতি নিয়ে তথ্য ছিল না। জাঞ্জিবারের ইউরোপীয়রা এ বিষয়ে প্রায় কিছুই জানেন না। গোটা জাঞ্জিবারে এমন একজনও সাদা মানুষ ছিলেন না যিনি বলতে পারেন যে রাস্তায় একশোজন লোকের খাবার কেনার জন্য প্রতিদিন ক-ডটি৩ লাগতে পারে। অবশ্য এসব জানা তাঁদের কাজের মধ্যেও পড়ে না। কিন্তু তাহলে আমার আদৌ কী করা উচিত? এটাই বড়ো প্রশ্ন।
ঠিক করলাম যে-কোনো একজন হাতির দাঁতের আরবি ব্যবসায়ীকে, বা সদ্য আফ্রিকার ভিতরে অভিযান করে ফিরে এসেছেন এমন কাউকে ধরতে হবে।

জাঞ্জিবারের বিখ্যাত আরব ব্যবসায়ী টিপ্পু টিপ।
শেখ হাশিদ জাঞ্জিবারের একজন নামকরা মানুষ। ধনবানও। তিনি নিজেই বেশ কয়েকটি কাফেলা আফ্রিকার অভ্যন্তরে পাঠিয়েছেন। তাঁর পরিচিত কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ীও আছেন—শেখ হাশিদের বাড়িতে মাঝে মাঝেই তাঁরা আড্ডা জমান; অভিযানের বৃত্তান্ত, লাভ-ক্ষতি নিয়ে গল্প হয়। এদিকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ক্যাপ্টেন ওয়েব যে বিশাল বাড়িতে থাকেন, সে বাড়িরও মালিক শেখ হাশিদ; আর তিনি থাকেন দূতাবাসের ঠিক উলটো দিকে, একটা সরু রাস্তার ওপারে। পরামর্শ নেওয়ার জন্য সবার মধ্যে শেখ হাশিদই উপযুক্ততম। সেইমতো তাঁকে দূতাবাসে ডাকা হল, আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য।
ধুসর দাড়ি-ওয়ালা শেখ হাশিদকে দেখলে মনে শ্রদ্ধা-ভক্তি জাগে। আফ্রিকার প্রচলিত বিনিময়-ব্যবস্থা, কীভাবে কী করতে হবে, কোন্ জিনিস কী গুণমানের, কতটা করে লাগবে সেসব সম্বন্ধে তিনমাস ধরে মধ্য আফ্রিকার উপর বই পড়ে যা কিছু জেনেছিলাম তার থেকে অনেক বেশিই শেখের থেকে জানতে পারলাম। বৃদ্ধ শেখ আমাকে অন্যান্য যেসব আরব বণিকদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন, তাঁদের থেকে বহু মূল্যবান পরামর্শ আর বিভিন্ন বিষয়ে আভাস পেয়েছি। তার জোরেই আমি শেষ পর্যন্ত অভিযানের আয়োজনে সক্ষম হয়েছিলাম।
পাঠককে মনে রাখতে হবে যে-কোনো পর্যটককে কেবল সেই পরিমাণের মালপত্রই সঙ্গে নিতে হয় যা তার ভ্রমণ-অভিযানের জন্য পর্যাপ্ত; বাড়তি জিনিস সঙ্গে থাকা জিনিস কম থাকার মতোই মারাত্মক। জিনিসপত্রের গুণমান ও পরিমাণ ঠিক করাই পর্যটকের প্রথম বিচারবোধ ও বিচক্ষণতার প্রয়োগ।
আমার তথ্যদাতারা আমাকে বুঝিয়েছিলেন যে একশোজন লোকের খাবারের জন্য প্রতিদিন দশ ডটি বা দিনপ্রতি চল্লিশ গজ কাপড়ই যথেষ্ট। আমি দেখলাম যে ২০০০ ডটি আমেরিকান শিটিং৪ , ১০০০ ডটি কানিকি৫ আর সেই সঙ্গে ৬৫০ ডটি বিভিন্ন রঙিন কাপড় যেমন উন্যামওয়েজিদের ভীষণ প্রিয় বারসাতি৬ কাপড়, উগোগোদের পছন্দের সোহারি৭, আরও সব জায়গার জন্য ইস্মাহিলি৮, তাউজিরি৯, জোহো১০, শাশ, রেহানি১১, নীল ও গোলাপি জামদানি বা কুঙ্গুরু-কচ্ছ১২ ইত্যাদি কিনলেই হবে। বারো মাস ধরে একশো লোকের টিকে থাকার জন্য এই পরিমাণই যথেষ্ট বলে মনে করা হয়েছিল। এই হারে দু-বছরের জন্য লাগবে ৪০০০ ডটি অর্থাৎ ১৬০০০ গজ আমেরিকান শিটিং, ২০০০ ডটি মানে ৮০০০ গজ কানিকি আর ১৩০০ ডটি মানে ৫২০০ গজ বিভিন্ন রঙের রঙিন কাপড়। খুবই যথাযথ ও দামি তথ্য। শিটিং, কানিকি আর রঙিন কাপড়ের গুণমান সম্পর্কে তেমন কিছু পরামর্শ না পেলেও মোটামুটি এই পর্যায়ে আমার যা জানা দরকার ছিল, তা জেনে গেলাম। কাপড়ের পরিমাণের পরেই যে তথ্যটি দরকারি তা হল কত পুঁতি লাগবে আর কী মানের লাগবে। আমি শুনেছিলাম আফ্রিকার গহনের কোনো কোনো উপজাতি বিনিময়-মাধ্যম হিসেবে কাপড়ের বদলে পুঁতি ব্যবহার করে। এক এক গোষ্ঠীর কেউ কালো পুঁতির থেকে সাদা বেশি পছন্দ করে, কেউ বাদামির থেকে হলুদ বেশি পছন্দ করে, লালের থেকে সবুজ কারও বেশি পছন্দ, কারও আবার সবুজের থেকে সাদা বেশি পছন্দসই ইত্যাদি ইত্যাদি।
সুতরাং, উন্যামওয়েজিতে লাল (সামি-সামি১৩) পুঁতির মালা লোকে খুব খুশি হয়ে নেবে, অন্য কিছু সেখানে চলবে না; উগোগোদের এলাকায় যে কালো (সোয়াহিলি ভাষায়, বুবু) পুঁতির মালা চলে, সে আবার অন্য উপজাতিদের কাছে নেহাতই অচল, উজিজি আর উগুহায় মূল্যবান হলেও পায়রার ডিমের মতো (সুনগোমাজি১৪) পুঁতির মালা অন্য সমস্ত জায়গায় মোটে চলবে না; সাদা (মেরিকানি১৫) পুঁতি উফিপার সব জায়গায় আর উসাগারা, উগোগোর কিছু কিছু জায়গায় চললেও উসেগুহ্হা ও উকনংগতে লোকে সেটা ঘোর অপছন্দ করবে। এত সব ঝামেলা থাকায়, আমাকে খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কোন্খানে সম্ভাব্য কতদিন থাকতে হতে পারে তার হিসেব করতে হল, যাতে সব কিছুই ঠিকঠাক পরিমাণে নিতে পারি, কমও না হয় আবার অনেক বেশিও না হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে বার্টন ও স্পেক কয়েকশো ফান্ডোর১৬ পুঁতি মূল্যহীন হিসাবে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন।

যে বিভিন্ন ‘বাণিজ্য-পুঁতি’ বা Trade Beads ঊনবিংশ শতকের শেষ অবধি ব্যবহৃত হত আফ্রিকায় বাণিজ্যের জন্য। (ছবি সৌজন্য http://usslave.blogspot.com/2011/10/african-slave-trade-beads.html)
ধরা যাক যে ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশের নিজের নিজের মুদ্রা থাকলেও তাদের মধ্যে বিনিময়ের কোনো বন্দোবস্ত নেই, আরও ধরা যাক যে একজন মানুষ পায়ে হেঁটে ইউরোপের মধ্যে দিয়ে ঘুরতে যাচ্ছে, রওনা হওয়ার আগে তাকে হিসেব করতে বসতে হবে যে তার ফ্রান্সে কতদিন লাগবে, প্রুশিয়া, অস্ট্রিয়া বা রাশিয়ায় কত দিন লাগবে আর তারপর একটা আন্দাজ করতে হবে যে প্রতিদিন তার মোটামুটি কীরকম খরচ হতে পারে। যদি প্রতিদিন এক নেপোলিয়ন১৭ খরচ হবে বলে ধরা হয় আর ফ্রান্সের মধ্য দিয়ে যেতে তিরিশ দিন লাগে, তবে যেতে আর ফেরত আসতে মোটমাট ষাট নেপোলিয়ন লাগবে। সেক্ষেত্রে যেহেতু প্রুশিয়া, অস্ট্রিয়া বা রাশিয়ায় নেপোলিয়ন চলে না, মানুষটার পক্ষে কয়েক হাজার সোনার নেপোলিয়নের বোঝা বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না।
এই নিয়ে আমি খুবই দুশ্চিন্তায় ছিল। বারবার করে কঠিন কঠিন নাম এবং মাপগুলো খতিয়ে দেখছিলাম, নামের পদাংশগুলো বারবার মুখস্থ করছিলাম; আশায় ছিলাম যে শব্দগুলোর একটা যুক্তিসম্মত মানে একটা সময় নিশ্চয় বুঝতে পারব। মুকুনগুরু১৮, গুলাবিও১৯, সুনগোমাজি, কাডুনডুগুরু২০, মুটুন্ডা২১, সামিসামি, বুবু, মেরিকানি, হাফদে২২, লুঙ্ঘিও-রেগা২৩ এবং লাখিও২৪ এইসব শব্দগুলি বার বার মনে মনে আওড়াচ্ছিলাম, যতক্ষণ না প্রায় মাথা খারাপ হয়ে যায়। শেষ অবধি, ঠিক করলাম যে যদি ধরে নিই, দু-বছরে আমার দিনে পঞ্চাশটি ‘খেটে’ বা পাঁচটি ‘ফান্ডো’ লাগবে, আর যদি শুধু এগারো রকমের পুঁতির মালা কিনি, তাহলেই আমার কাজ চলার জন্য যথেষ্ট। সেই মতোই কেনাকাটা করলাম আর বাইশটি বস্তা-বোঝাই সেরা মানের পুঁতির মালা ক্যাপ্টেন ওয়েবের বাড়িতে আনা হল। বাগামোয়োয় নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।
পুঁতির মালার পরে আসে তারের কথা। অনেক ঝামেলার শেষে আবিষ্কার করলাম যে ৫ ও ৬ নম্বর তার, যেগুলো প্রায় টেলিগ্রাফের তারের মতো মোটা, সেগুলোই ব্যাবসায়িক বিনিময়ের জন্য সবচেয়ে ভালো বলে ধরা হয়। আফ্রিকায় পুঁতির মালাকে যদি তামার মুদ্রা বলে ধরা হয়, তাহলে কাপড়কে প্রায় রুপোর সমান ধরতে হবে আর তান-জা-নি-কার২৫ ওপারের দেশগুলিতে তারকে সোনা বলেই ধরা যায়। আমার আরব পরামর্শদাতাদের মতে, দশ ফ্রাসিলা, বা ৩৫০ পাউন্ড পিতলের তারই যথেষ্ট।
কাপড়, পুঁতি ও তার কেনা শেষ হলে, বিশাল বিশাল গাঁটরি আর পোঁটলাগুলো ক্যাপ্টেন ওয়েবের বিশাল গুদামঘরে সার দিয়ে, একের উপর আর-এক স্তুপাকার করে রাখা হল। সেসব দেখে আমার বেশ অহংকারই হল। তবুও আমার কাজ শেষ তো হয়ইনি, সবে শুরু বলা যায়; রান্নার জিনিসপত্র, রান্না করার পাত্র, নৌকা, দড়ি, সুতো, তাঁবু, গাধা-ঘোড়ার জিন, থলেপত্তর, ক্যানভাস, আলকাতরা, সূঁচ, যন্ত্রপাতি, গুলি, বন্দুক, সরঞ্জাম, ছোটো কুঠার, ওষুধপত্র, বিছানাপত্র, উপজাতির প্রধানদের জন্য উপহার—ছোটো করে বললে, এখনও হাজারটা জিনিস কেনা বাকি।
আমি এতদিনে পড়লাম এটা। একসাথে সবকটা পড়লাম। চমৎকার হচ্ছে।
অনবদ্য।তর্জমা ও টীকাতে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
Sujata Ganguly | ২৮ অক্টোবর ২০২০ ১৫:৫৩99265সব পর্ব গুলো একসাথে পড়লাম। চমৎকার হচ্ছে। আচ্ছা, কাপড়ের ধরনের মধ্যে জামদানি কথাটাও পেলাম। তখনও আফ্রিকায় জামদানি রপ্তানি হতো !
Ved | 2409:4060:2e09:7c35:32e9:199a:6d01:***:*** | ১৮ অক্টোবর ২০২২ ২১:১৯512961