ডেভিড লিভিংস্টোন। আফ্রিকায় বেপাত্তা। কিংবদন্তি মানুষটির খোঁজে আফ্রিকা পৌঁছেছেন মার্কিন সাংবাদিক হেনরি মর্টন স্ট্যানলে। জাঞ্জিবার থেকে শুরু হল আফ্রিকার গভীরে অভিযান। প্রথম লক্ষ্য বাগামোয়ো শহরে পৌঁছে পাক্কা দেড় মাস আটকে সেখান থেকে একে একে রওনা হয়েছে অভিযানের মোট পাঁচটি কাফেলা। চলছে অভিযানের মূল কাহিনী। স্ট্যানলের সেই বিখ্যাত সফরনামা ‘হাও আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন’। এই প্রথম বাংলায়। চলছে টাঙ্গানিকা হ্রদে স্ট্যানলে ও লিভিংস্টোনের নৌযাত্রার কথা। এই পর্বে মধ্য আফ্রিকার বিবিধ প্রাণী, বিশেষ করে মাছের বিবরণ। তরজমা স্বাতী রায়
এখানকার উপজাতিরা ধাতুর মধ্যে চেনে বলতে তামা আর লোহা। তামা আসে রুয়া থেকে, আর উপকূলের থেকে। আর রট আয়রন আসে উসুকুমা বা উন্যামওয়েজির উত্তরের এলাকা থেকে, ও উভিরা থেকে। আফ্রিকার অন্দরের বাসিন্দারা যে সমস্ত পিতলের অলঙ্কার পরে, কাফেলাগুলোর সঙ্গে আনা মোটা পিতলের তার থেকে স্থানীয়রা সেই সব গয়না তৈরি করে। যদিও লৌহ আকর প্রচুর পরিমাণে রয়েছে, এমনকি উন্যামওয়েজি ও উজিজির মধ্যে অনেক জায়গায় মাটির উপরে দেখাও যায়-তবুও তা খুব কমই কাজে লাগে; যদিও উকোনঙ্গো ও উভিনজাতে, স্থানীয়রা আকরিক লোহা গলিয়ে নিজেদের দরকারের লোহা তৈরি করে এমন উদাহরণ আছে।
উন্যানয়েম্বের পশ্চিমের লোকেরা তীব্র আমাশয়, দীর্ঘকালীন আমাশয়, কলেরা মর্বাস, রেমিটেন্ট জ্বর, পালাজ্বর, বা অ্যাগ, টাইফয়েড জ্বর, ঘুষঘুষে জ্বর, হৃদরোগ, বাত, প্যারালাইসিস, গুটি বসন্ত, চুলকানি, চক্ষু, গলা ব্যথা, যক্ষ্মা , কলিকের ব্যথা, ফোঁড়া, আলসার, সিফিলিস, গনোরিয়া, খিঁচুনি, অর্শ, নাভির হার্নিয়া এবং নেফ্রাইটিস রোগেই সাধারণত আক্রান্ত হয়।
তবে পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার সবচেয়ে ভয়ানক ব্যাধি হল গুটিবসন্ত। প্রতিটি কাফেলার চলাচলের পথের ধারে এই দুর্দম রোগে আক্রান্তদের ফ্যাকাশে মাথার খুলি পড়ে থাকে, প্রতি বছর যে এই রোগ শুধু বণিকদের দলে নয়, বিভিন্ন উপজাতিদের গ্রামেও কেমন বিপর্যয় সৃষ্টি করে, এই দৃশ্য তাকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখায়। কিছু কিছু কাফেলা এই রোগে ধ্বংস হয়ে গেছে, গ্রামগুলোর লোকজন অর্ধেকেরও কম হয়ে গেছে। ডঃ লিভিংস্টোন আফ্রিকার অনেক গরীব মানুষকে টিকা দিয়ে বাঁচিয়েছেন; মানুষের মধ্যে নিত্য বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করার যন্ত্রণাই তাকে বাধ্য করেছিল কিছু টিকা তার কাছে পাঠানোর জন্য আবেদন করতে।
এখানকার লোকেরা কয়েকটা সাধারণ ভেষজকেই প্রতিকার হিসেবে ব্যবহার করে। "ওয়াগঙ্গা" বা ওঝারা ভেষজ, বা ভেষজগুলির ক্বাথ খেতে দেয়। ক্যাস্টর অয়েল গাছের ঔষধি ব্যবহার জানে না; বীজ পেষা তেল শুধুমাত্র রোগীদের গায়ে-মাথায়- মালিশ করে। সেই সঙ্গে একটা বিশেষ গাছের ছালের থেকে তৈরি একটা বমি করার ওষুধও দেয়। আরবদের মতে সেটা খুবই কড়া দাওয়াই। নেফ্রাইটিস জাতীয় রোগের জন্য ওয়াগাঙ্গা একটা গাছের গোড়া থেকে আর উন্যামওয়েজির কাছে গজানো একটা ঝোপের পাতা থেকে একটা ওষুধ তৈরি করে। কিন্তু তার নাম তারা আমাকে কিছুতেই বলেনি। মায় আমি একটা কাপড় দিয়ে এটা কেনার চেষ্টা করেও পারিনি। তবে আমি একজনকে এই ওষুধ এক মাস ধরে প্রতিদিন ব্যবহার করতে দেখেছি, কিন্তু কোন কাজ হতে দেখিনি। আরবদের মধ্যে এ রোগের ওষুধ হল মাস্টিক গাছের আঠা। সেই আঠা জলে সেদ্ধ করে প্রতি সন্ধ্যায় ঘুমনোর আগে এক কাপ তরল পান করা বা প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় এক কাপ করে কাঁচা দুধ পান করা। বাত রোগের জন্য প্রতিষেধকটি হল রোদে শুয়ে থাকা বা দ্রুত মালিশ করা। কলিক সারানোর উপায় হল, গলায় আঙুল দিয়ে বমি করা। আমাশয় রোগের জন্য, পেটের উপরে, পিছনের অংশে উষ্ণ পাথর দিয়ে সেঁক দেওয়া হয়। মায়াজম্যাটিক জ্বরে আক্রান্ত রোগীরা কাঁথা মুড়ি দিয়ে, ঘাম না হওয়া পর্যন্ত রোদে শুয়ে থাকে; তবে আমার দলের লোকদের ক্ষেত্রে অন্তত দেখেছি আমৃত্যু এই চিকিৎসা চলেছে। গুটিবসন্তের ক্ষেত্রে, রোগীকে আলাদা করে রাখার নীতি কঠোরভাবে প্রয়োগ করা হয়, আগে একবার এই রোগে ভুগে উঠেছে এমন লোক ছাড়া আর কেউ রোগীদের কাছাকাছি যায় না। কাফেলার যাদের গুটিবসন্ত হয়, তাদের ধারেকাছে সুস্থ লোকেরা ঘেঁষে না। শিবিরের বাইরে তাদের জন্য ছাউনি বানানো হয়। তবে পরের পরের কাফেলাতে কয়েকজন বেপরোয়া ছেলে থাকেই, যারা ভাবনাচিন্তা না করে সেই আস্তানার ভিতরে প্রবেশ করে আর কিছু দিনের মধ্যেই তারা অসুস্থ বোধ করতে শুরু করে। খিদের অভাব, পিঠে ব্যথা আর ঘুষঘুষে জ্বরের অভিযোগ করতে শুরু করে; আর অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা বুঝে যাই যে তারাও রোগের শিকারে পরিণত হয়েছে, আর এবার তাদের একঘরে হওয়ার পালা, তারা যদি আর হাঁটতে না পারে তো তারা মারাই যায়, কারণ কোন বসতি তাদের নিজেদের দরজার কাছেও যেতে দেবে না, আর একটি কাফেলা কখনো ফাঁকা মাঠে থামতে পারে না। যখন এইভাবে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়, তখন সে তার খাবার আর জল নিয়ে জঙ্গলে যায়। নিজের কুঁড়েঘর বানিয়ে নেয়, আর যতক্ষণ না সেরে ওঠে বা মৃত্যু ঘনিয়ে আসে, সেখানেই বিশ্রাম নেয়।
উন্যামওয়েজির অপূর্ব ঘাস জমি ও জঙ্গল ছেড়ে যাওয়ার পরে, আমরা উকোনঙ্গোতে পৌঁছলাম। এই জায়গাটা বন্য কাঠ-পীচ গাছ, দারুণ সেগুন গাছের জন্য বিখ্যাত। এছাড়া এখানে পথে-ঘাটে বিশাল টানা লোহার আকরিকের পাত মেলে, যতই দক্ষিণ আর পশ্চিমে যাই, ততই সেগুলো হেথায় হোথায় জমি ফুঁড়ে ওঠে। উকোনোঙ্গোর পূর্ব দিকটা আসলে উন্যামওয়েজির ঘাস জমিরই একটা অংশ, তবে যতই এর পশ্চিম সীমান্তের কাছে যাই, উকাওয়েন্দির সীমানা ঘেঁষে, বিশাল থ্যাবড়া চূড়াগুলো চোখের সামনে পরিষ্কার ফুটে ওঠে। এখানকার সব জল গিয়ে পড়ে সিয়েরা নদীতে আরও রিকওয়া সমতল-মুখো অজস্র প্যাচপেচে জলাভরা গিরিখাতে।
জায়গাটা বেশ নয়ন-জুড়ানো, মনোরম। এখানকার সুদূরপ্রসারী সমতলটি শুনেছিলাম রুংগওয়া নদী পেরিয়ে সেই দক্ষিণ ওয়াতুতার চারণভূমিতে গিয়ে মিশেছে। সেই সমভূমির থেকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে নীল ত্রিকোণাকার পাহাড়-চূড়া, কোথাও একা, কোথাও বা তিনটে চূড়া মিলে। প্রথমটা যখন চোখে পড়ে সে যেন একটা ছবির মতন সুন্দর দৃশ্য। যেখানে উকোনঙ্গো এবং উকাওয়েন্দি মিলেছে, সেই জায়গা থেকে অনেক রুংগওয়ার শাখা নদী বেরিয়েছে। কাসেরা থেকেও বেশ কিছু শাখানদী বেরিয়েছে। শুনেছি যে রুংওয়া নদী নাকি মালাগারজির মতোই বড় এবং এর মূল ধারাটি এসেছে মধ্য উরোরি থেকে। বর্ষাকালে এই নদীটি তার দুপাশের সমভূমিকে ভাসিয়ে দেয়, ঠিক যেমন মুকুন্ডোকওয়া নদী মাকাতা সমভূমিকে প্লাবিত করে। তাই, স্পেক, তার মানচিত্রে, রিকওয়া লেগুন বোঝাতে একটা নীল রঙের ছোপ বসিয়েছেন। কিন্তু এই বিষয়ে অনেক প্রশ্ন করেও আর কিছু জানতে পারেননি, শুধু এইটুকুই জানা গেছে যে, বর্ষার মৌসুমে পুরো জায়গাটা জলে ভরে যায় রুংওয়া নদী যদি সত্যিই সেন্ট্রাল উরোরি থেকে জন্মে থাকে, তবে এটাও সত্যি বলে ধরতে হবে যে রুফিজি বা রুহওয়া নদীর সম্ভাব্য উৎস উবেনার দক্ষিণ-পশ্চিমে, একদল পাহাড়ের থেকে। খুব সম্ভবত চাম্বেজির জন্মও এখানেই।