এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  উপন্যাস

  • ফেরারি ফৌজঃ  পর্ব এক

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ২৭ জুলাই ২০২৫ | ৫৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • পর্ব ১
    ফেরারি ফৌজ 
                                                         
    গৌরচন্দ্রিকা
     
      “মাঝরাতে একদিন বিছানায় জেগে উঠে বসে
    সচকিত হয়ে তারা শুনেছে কোথায় শিঙা বাজে,
     সাজো সাজো ডাকে কোন  অলক্ষ্য আদেশ।
     জনে জনে যুগে যুগে বার হয়ে এসেছে উঠানে,
    আগামী দিনের সূর্য দেখেছে আঁধারে
     গুঁড়ো গুঁড়ো করে সারা আকাশে ছড়ানো”।
    1. প্রেমেন্দ্র মিত্র , ‘ফেরারি ফৌজ’।
        
                                                 

    হ্যাঁ, সে ও ছিল এক ঝোড়ো সময়।
     
    ষাটের দশকের শেষ। চাল চেয়ে কেরোসিন চেয়ে পুলিশের গুলিতে মরেছে দুই বালক—স্বরূপনগর আর বাদুড়িয়ায়। 
    খাদ্য আন্দোলন দমন করতে গান্ধীবাদী মুখ্যমন্ত্রীর লাঠি-গুলি-কাঁদানে গ্যাস ব্যর্থ। 
     
    দেশদ্রোহী বলে যে বিরোধী দলের নেতাদের ভারত রক্ষা আইনে জেলে পোরা হল, গণ-আন্দোলনের চাপে তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হল সরকার। 
    শুধু তাই নয়, প্রাক্তন রাজবন্দীরা ভোটে জিতে সরকার গঠন করলেন।
     আর সেই শপথ গ্রহণের আনন্দোৎসব হল মনুমেন্ট ময়দানে সদ্য মুক্তি পাওয়া  নাট্যকর্মী উৎপল দত্তের কল্লোল নাটকের জাহাজের সেটের উপর দাঁড়িয়ে। ওঁর দলের অভিনেতা শান্তনু ঘোষ লিখলেন স্বরূপনগরের শহীদ বালক নুরুল ইসলামকে নিয়ে গান—নুরুলের মা। গাইলেন গণশিল্পী অজিত পান্ডে।
    আমরা যারা তখন ‘ঘুমের মধ্যে কাঁদতে কাঁদতে যুবক’ হচ্ছিলাম, তারা স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম। 
     
    আমাদের পায়ে স্ট্র্যাপ ছেঁড়া হাওয়াই চপ্পল, গায়ে ময়লা শার্ট, রুক্ষ্ম চুলে ধূলো। আমরা একটা চারমিনার চারজনে ভাগ করে খেতাম। 
    আমাদের তখন ‘বর্তমান মুক্তকচ্ছ, ভবিষ্যৎ হোঁচটেতে ভরা’। 
    আমাদের উপর ভরসা করে কোন মেয়ে ভবিষ্যতের সোনালী স্বপ্ন দেখতে সাহস করত না।
    আমরাই কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ‘চতুর্থ সন্তান’।
    কিন্তু তখন খোদ আমেরিকাতে ছাত্র-ছাত্রীরা ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে। জোন বেইজ, পীট সিগার ও বব ডিলানের গানে তারই অনুরণন। 
    নাপামে ঝলসে যাচ্ছে ভিয়েতনাম কাম্বোডিয়া ও লাওসের ধানক্ষেত।
     বার্ট্রান্ড রাসেল মার্কিন সরকারকে যুদ্ধ-অপরাধী ঘোষণা করে সেই অপরাধের বিচার করতে আন্তর্জাতিক ওয়ার ট্রাইব্যুনাল বসিয়েছেন।
    পারীর রাস্তায় ব্যারিকেড, তাতে রয়েছে সরবোর্ন বিশবিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও সিত্রোঁ কারখানার মজুর—পাশে পেয়েছে সার্ত্র ও সিমোন দ্য বোভোয়াকে।
    আমরা খুশি, ঝড় আসছে। 
    আমাদের বামপন্থী সরকার আর অন্ততঃ ১১টি প্রদেশে এতদিনের বিরোধীদের যুক্তফ্রন্ট সরকার হয়েছে। 
    আমরা স্বপ্ন দেখছিলাম যে এবার চালের দাম কমবে। আমাদের মাস্টারমশাইদের মাইনে বাড়বে। গ্রামে-গঞ্জে রাস্তাঘাট তৈরি হবে। 
    পানীয় জল, ডাক্তারখানা সবার ঘরের কাছে আসবে।
    আমরা চাকরি পাব। 
    কোন রাজাগজার চাকরি নয়, বাড়ি গাড়ি নয়; তবে দু’বেলা পেটভরে খাওয়া, একটু ধুতি শার্ট, গোটা তিন প্যান্ট, কিছু বই এবং পত্রিকা কেনা, মা-বাবাকে নিশ্চিন্তে রাখার মত আলোহাওয়াযুক্ত ঘরের ভাড়া দেওয়ার ক্ষমতা এই টুকুই।
     আর মাঝে মাঝে যদি বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে সিনেমা দেখার রেস্ত জোটে—তবে তো সোনায় সোহাগা!
     
    আর বান্ধবী! ওইটুকু ক্ষমতায়ন হলে জুটবে, নিশ্চয় জুটবে।
    কিন্তু কেউ কথা রাখে নি ।
    আমাদের সরকারের পুলিশের গুলিতে উত্তরবঙ্গের গাঁয়ে মারা গেছে বেশ কিছু আদিবাসী কৃষকবধূ ও তাদের পিঠে বাঁধা দুই শিশু।
     মনে হচ্ছিল ঠকে গেছি। ভুল ঠিকানায় কড়া নেড়েছি। কোন অবনী বাড়ি নেই । আবার যেন সেই আমড়াতলার মোড়ে পৌঁছে গেছি।
    এমন সময় শুনতে পেলাম ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ’।
     
     পুলিশ ইন্সপেক্টর সুনাম ওয়াংদি তিরবিদ্ধ হয়ে নিহত। জানলাম, জনগণ ‘মারার একচেটিয়া অধিকার’ পুলিশের হাত থেকে কেড়ে নিয়েছে। পিকিং রেডিও সার্টিফিকেট দিল ভারতের বুকে আছড়ে পড়েছে বিপ্লবের ঝড়। ব্যস, -- কোন কথা হবে না!
     
    আমরা সত্তর দশকের গোড়াতেই বুঝে গেলাম—এই ব্যবস্থায় যে যত পড়ে সে তত মূর্খ হয়। 
    এ ও শুনলাম যে আগামী বসন্তেই বঙ্গের বিস্তৃত সমতল দিয়ে বিপ্লবী গণফৌজ মার্চ করবে!
    আমরা আর ঘরে থাকি?
    ‘এসেছে আদেশ
    যাত্রা কর, যাত্রা কর যাত্রীদল
    বন্দরের কাল হল শেষ।‘
    আমাদের তখন আঠেরো বছর বয়স।
    তাই স্কুল-কলেজে খিল,
    রাস্তায় মিছিল
    ক্র্যাকারের শব্দে কাঁপে রাজপথ
    কিনু গোয়ালার গলি।
    আমরা মরিয়া।
     ‘দাঁতে-নখে ছিনিয়ে নিতে হবে জয়,
     কিছুই আমরা ক্ষমা করব না’।
    তারপর?
    কত লোক যে পালিয়ে গেল ভয়ে
    কত লোকের মাথা পড়ল কাটা!
    হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর কারও মূর্তি বাদ পড়ে নি ।
    সমস্ত ঝড় একদিন থেমে যায়। সব পাখি একসময় ঘরে আসে।
     কিন্তু কেউ কেউ ঘরে ফেরেনি। কেউ কেউ স্বপ্নভঙ্গের বেদনা বুকে নিয়ে জীবনভর অপেক্ষা করে। 
     হয়ত কোন একদিন ঘুর্ণি হাওয়ায় উড়ে আসা শালপাতায় ভর করে ডাক আসবে ফেরারি ফৌজের ।
    আমার সত্তরের বুড়িছোঁয়া দিনে এই উপন্যাস সেই সব সাথীদের স্মরণের প্রয়াস মাত্র।
                                                                      রঞ্জন রায়
    ভিলাইনগর, ২০১৯

                          

                                উৎসর্গ
    আজীবন নিজের ভাবনার প্রতি বিশ্বস্ত থেকে আজকের পৃথিবীর জন্যে এক বুক অভিমান নিয়ে চলে যাওয়া বিজয়গড় -পল্লীশ্রী নিবাসী শ্রী স্বপন রায়কে।

     ফেরারি ফৌজ

    প্রথম ভাগ

    (১)

    রিক্রুট


    -- এই বাড়িটা?
    -- না, না। ওই হলদে দোতলা বাড়িটার পরেরটা, কোল্যাপসিবল গেটওলা ছাইরঙা।
    গ্রিলঘেরা বারান্দায় বসে একা একা গিটার নিয়ে টুং টাং করতে থাকা ভদ্রলোক বিরক্ত হন নি। বাইরে বেরিয়ে এসে বাড়ি দেখিয়ে দিয়ে স্মিত হেসে ফিরে গেলেন। 
    আমি কিন্তু কিন্তু করে ধন্যবাদসূচক কিছু বলার উপক্রম করতেই মাথা নেড়ে ভেতরে চলে গেলেন।
    এবার আমার অবাক হওয়ার পালা। 
     
    এই বাড়িটা? এতবড় পেল্লায় বাড়ি? ভদ্রলোক ভুল করেন নি তো?
    খাড়া চারতলা উঠে যাওয়া বাড়িটার গায়ে কোন সাইনবোর্ড নেই, কোল্যাপসিবল গেটটি ভেতর থেকে তালাবন্ধ।দেয়ালের গায়ে বাড়ির নম্বর লেখা। 
    হাতেধরা চিরকুট থেকে সেটা মিলিয়ে নিয়ে বেল টিপে দিই। 
    ওপাশে একটি সদ্য- গোঁফের- রেখা- দেখা- দেওয়া মুখ।
    -- কাকে চাই?
    --- বিমলেন্দুবাবু আছেন?
    ও গেটের ফাঁক দিয়ে একটি স্লিপ ও পেনসিল বাড়িয়ে দেয়।
    ---  নাম পরিচয় লিখে দিন।
    বিনাবাক্যব্যয়ে বড় বড় করে লিখে দিই, নীচে বন্ধনীর মধ্যে  লিখি--বাল্যবন্ধু। ছেলেটি মিলিয়ে যায়।

    অপেক্ষা করতে করতে চারদিক দেখতে থাকি। দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর পর দক্ষিণ শহরতলীর এই পাড়াতে পা রেখেছি। ভিন রাজ্যের চাকরি থেকে রিটায়ার করে। 
     
    এত বদলে গেছে এলাকাটা? আগে ঢাকুরিয়া পুল পেরোলে কোলকাতা বলা হত। 
    আর দেদার মাঠঘাট পানা পুকুরে ভরা এই পাড়াগুলো ছিল উদ্বাস্তুদের জবরদখল কলোনি। এখন কোথাও সবুজের চিহ্ন নেই।
     বিমলেন্দুর এই বাড়িটাও ছিল জবরদখল জমিতে রাংচিতের বেড়া, চাটাইয়ের দেওয়াল ও টালির ছাদ দেওয়া একফালি ঘর। সেখানে এই?
    মনে পড়ে এক ধু ধু রোদ্দূর -ঘেমো দুপুরে ওদের বেড়ার গায়ে গাছের ডাল দিয়ে তৈরি আগড়টা আস্তে আস্তে খুলে ওদের ঘরে উঁকি মেরেছিলাম।
     একটা তক্তপোষ, তাতে শুয়ে ওরা তিন ভাইবোন। একপাশে বড়দা, মাঝে বিমলেন্দু আর এপাশে ছোট বোন আশা। তিনজনে গায়ে গায়ে জাদুঘরের মমির মত শুয়ে। 
    কেউ পাশ ফিরতে পারে না, তাহলে একজন ঠিক গড়িয়ে মাটিতে পড়ে যাবে।
     
     ঘরে পাখা নেই। তিনজনের মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আমি মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকি। সেই বিকেল ঘনিয়ে আসা আবছা অন্ধকারে চোখে পড়ে সদ্য কৈশোরের চৌকাঠ ডিঙোনো মেয়েটির বুক, নি;শ্বাসের সঙ্গে উঠছে নামছে।
    আমার কেমন ভয় ভয় করছিল। পা টিপে টিপে পালিয়ে আসি। 
     
    আচ্ছা, ওই পাশটায় একটা বড় তালগাছ ছিল না? 
    আর এক দুপুরে স্কুলে না গিয়ে আমরা ওই গাছটার তলায় ওদের বাড়ি থেকে আনা মাদুর পেতে শুয়ে বসে গল্প করে কাটিয়ে ছিলাম। 
    গাছটা বোধ্হয় কাটা পড়েছে।আমরাও তো তাই।
    আমরা সেই সত্তরের দশকের আঠেরো বছর বয়স। আমরা সেই সময়ের কাটা সৈনিক। 
    আমি আর বিমলেন্দু। আমি অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে কলমপেষা চাকুরিজীবি। 
    কিন্তু বিমলেন্দু?
    সত্তরের দশকে সিপিআই(এম-এল) এর বাংলা -বিহার-উড়িষ্যা সীমান্ত কমিটির প্রমিজিং অর্গানাইজার বিমলেন্দু? বাঁকুড়া ডিস্ট্রিক্ট জেল এর দেয়াল টপকে দু'দিন বাদে ধরা পরা বিমলেন্দু?
    ও আজ পোষাক তৈরির কারখানার মালিক।
     টালির বাড়ির জায়গায় পাকা চারতলা।
    ,
    আমরা একই ক্লাসে পড়েছি, ফুটবল খেলেছি, নানান ছেলেমানুষি ঝামেলায় জড়িয়েছি, মনে মনে এর-ওর-তার প্রেমে পড়েছি। 
    তারপর আঠেরো বছর বয়সে সত্তরের কালবৈশাখীর ঝাপটায় ছিটকে পড়েছি। 
    ও রাঢ় বাংলার দক্ষ সংগঠক। আমি হিন্দি বলয়ে। ওর ধরা পড়ার খবর যুগান্তর পত্রিকায় পড়েছি। ৭৭ এর জরুরি অবস্থা উঠে গেলে সমস্ত রাজবন্দীদের সঙ্গে ছাড়া পাওয়ার খবরও পেয়েছিলাম।
    প্রকৃতির নিয়মে ঝড় থেমে গেলে এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে ভাঙা ডাল, শুকনো পাতা, পাখির বাসা।
    আমি হিন্দিবলয়ে ব্যাংকের কর্মচারী। 
    ও লক্ষী কাটরা গণেশ কাটরা,কাটা কাপড় নিয়ে বসার শেষে মঙ্গলাহাটের পথ পেরিয়ে এখন রেডিমেড পোষাক বানায় বলে খবর পেয়েছি। 
    আমি কি ওকে হিংসে করি? জানিনা।
    কিন্তু অদম্য কৌতূহলে দেখতে এসেছি একদা বিপ্লবের পথে পা বাড়ানো প্রান্তিক খেটেখাওয়া মানুষের দক্ষ সংগঠক কমরেড বিমলেন্দু কেমন করে একটি ছোটখাট পোষাক তৈরির ফ্যাক্টরির মালিক হয়ে উঠলেন।
     
    গেট খুলে গেল। 
     
    চশমা চোখে দীর্ঘদেহী সুদর্শন সাফারি স্যুট পরা ভদ্রলোকটি একগাল হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন, দামী সুগন্ধির অস্তিত্ব টের পাই, একটু যেন গুটিয়ে যাই।
    --আয়, আয়!
    --- তোর অফিসটাকে জেলখানা বানিয়েছিস কেন?
    --- আর বলিস না! সেলট্যাক্সের লোকজন এসে বড্ড বিরক্ত করে। আমি অনেস্ট ব্যবসা করি। ওদের খাঁই কী করে মেটাবো?
    উৎসাহের সঙ্গে ও দেখিয়ে চলে এক একটা বিভাগ। নীচের তলায় র' মেটেরিয়াল। কাটা কাপড়ের স্টক। দোতলায় ফিনিশড গুড্স। 
    তিনতলায় ডিসপ্লে আর প্যাকিং। চারতলায় খাতাপত্তর হিসেবনিকেশ।
    আর তিনতলায় ওই ছোট্ট ঘরটায় আমার অফিস। 
     
    এখানে গরম, চল ওখানে আরাম করে বসি, এসি চলছে। পরিচয় করিয়ে দেয় ছেলের সঙ্গে । জানায় ওর ব্র্যাণ্ডের নাম। পোষাক যায় কোলকাতার মলে, বেঙ্গালুরুতে, মুম্বাই, আমেদাবাদে আর বাংলাদেশে। 
     
    ওর এসি অফিসে আয়েশ করে বসি। কফিতে চুমুক দিই।
    কথায় গল্পে বিকেল ফুরিয়ে কখন সাঁঝবাতি জ্বলে উঠেছে। ওর ছেলে এসে ঢোকে, হাতে পিতলের জ্বলন্ত প্রদীপ। 
    খেয়াল হয় ঘরের কোণায় স্টিল এজ কোম্পানির তৈরি মজবুত সিন্দুক, তার উপরে গণেশ ও লক্ষ্মীঠাকুর। 
    ছেলেটি ধূপকাঠি ধরিয়ে মূর্তিগুলোর সামনে গুঁজে দেয়। প্রদীপ তিনবার ঘুরিয়ে নীচুগলায় কিছু বিড়বিড় করে।
    তারপর ওর বাবার সামনে এসে দাঁড়ায়। 
     
    বিমলেন্দু আমাকে দেখে , একমুহুর্ত থমকায়, ইতস্ততঃ করে।তারপর দুহাতের অঞ্জলি দীপশিখায় ছুঁইয়ে মাথায় ঠেকায়। 
    ছেলেটি আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আমি একটু হেসে মাথা নাড়ি। ওর চোখ দপ্‌ করে জ্বলে ওঠে।
    --আপনি চান না আমাদের কল্যাণ হোক? আমাদের কোম্পানির মঙ্গল চান না?
    বিমলেন্দু লজ্জা পেয়ে ওকে নিরস্ত করার চেষ্টা করে।
    আমি কথা না বাড়িয়ে বিমলেন্দুর অনুকরণ করি।
     ছেলেটির মুখের ভাঁজ মিলিয়ে যায়।

    এবার বিমল ছেলের সঙ্গে চোখের ইশারায় কিছু বলে। তারপর আমাকে বলে-- চল। আজ পার্ক স্ট্রিটে আমার সঙ্গে ডিনার খাবি। মোকাম্বোয়। তারপর তোকে বাড়ি পৌঁছে দেব।
    পার্ক স্ট্রিট? তাহলে তো মেট্রো ধরতে হবে। এখান থেকে রিকশ করে যাবো?
    তুই না আজীবন একই রকমের ল্যাবেন্ডিশ রয়ে গেলি। আমার গাড়িতে যাবি।
    তোর ছেলে?
    ওর আলাদা গাড়ি আছে, বন্ধুদের ঠেকে যাবে। ওকে ভুল বুঝিস না। ও ওইরকম, কিন্তু মনটা ভাল। 
    আসলে বিজনেস অন্তঃপ্রাণ। আর আমি আজও ঠাকুরদেবতা মানি না। ভাগ্য মানি না। পুরুষকারেই বিশ্বাস করি।
     কিন্তু ওকে কষ্ট দিতে চাই না। একটাই ছেলে। শুধু ছেলে নয়, আমার বন্ধুও বটে। 
    জানিস, আমরা নতুন নতুন ডিজাইনের খোঁজে প্রতি বছর ব্যাংকক যাই। সেখানে একটা পাড়া আছে। ওঃ, তুই তো এসব খবর রাখিস না। হিন্দিবলয়ের গাঁয়ে ছিলি? 
    আচ্ছা, 'বাই বাই ব্যাংকক' সিনেমাটা দেখেছিস? আমার কাছে ডিভিডি আছে, নিয়ে যাস।
    ওর গাড়ি চলতে থাকে। অনেক গল্প শোনায়। কঠিন জীবনসংগ্রামের গল্প। কাঠুরে থেকে বণিকপুত্তুর হয়ে ওঠার গল্প। আমার একটু শীত শীত করে। 
    কত কথা যে জিজ্ঞেস করব ভেবেছিলাম।
    সুখাদ্য-সুবচনের সঙ্গে দামী পানীয় আসে। লজ্জা পাই।
    --অ্যাই, আমার জন্যে এত খরচ করতে হবে না।
    --- ওরে! এটা হল গুরুদক্ষিণা। তুইই তো আমাকে ওপথে এনেছিলি, বুঝিয়েছিলি। আমি ছিলাম তোর প্রথম রিক্রুট!
    -- যত ফালতু কথা! আচ্ছা, বল তো আমরা কি ভুল করেছিলাম? আজ তোর কী মনে হয়?
    ও চুপ মেরে যায়। নখ খোঁটে।
    -- তা বোধহয় নয়। আমাদের মধ্যে কোন ফাঁকি ছিল না। তবে বড্ড বেশি আবেগ ছিল, যুক্তি আর বিশ্লেষণের ধার ধারেনি কেউ। 
    জানিস, কানু সান্যালের সুইসাইডের খবরটা পড়ে হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলেছিলাম; বউ--ছেলে অবাক।
    --- সে কী রে!
    -- হ্যাঁ, বিপ্লবী আত্মহত্যা করবে? কেমন যেন হেরে গেছি মনে হল।
    দামী পানীয় এবার খেল দেখাচ্ছে। ও নাক টানছে।
    --আচ্ছা, তোর সেই বনবাসের দিনগুলোতে সবচেয়ে স্মরণীয় গল্প কোনটা ?
    -- কী রে শ্লা! চ্যানেলের রিপোর্টার হয়ে গেলি?
    --- আঃ, বল না!
    --চল, ফেরার পথে বলব।

    বাঁকুড়ার সাঁওতাল গ্রামে আছি। 
     
    একদিন খারাপ খবর এল। এলাকার প্রভাবশালী বাম দলের দাপুটে সাঁওতাল নেতা জনা পঞ্চাশেক সশস্ত্র লোক নিয়ে আমাদের গ্রামের সীমানায় ডেরা লাগিয়েছেন। একটাই দাবি-- কোলকাতা থেকে আদিবাসী ক্ষেপিয়ে এলাকাকে অশান্ত করতে আসা দিকু ছেলেটিকে ওদের হাতে তুলে দিতে হবে। 
    গাঁয়ের মোড়ল ওদের সঙ্গে তর্ক করছেন, কিন্তু আর কতক্ষণ?
    মেঝেনরা বলল- শোন, দিকু! তুর ভয় নাই। উয়াকে বুইলেছি আগে দিকুর কথা শুন। যদি বেঠিক লাগে তবে উকে ছেড়ে দিব। আগে শুন।
    আমি ওদের সামনে গেলাম। ভয় পেয়েছিলাম। অগত্যা। 
    কী বলেছিলাম আজ মনে নেই। তবে কোন মার্ক্স-লেনিন নয়। বলেছিলাম আমরা গরীবের জন্যে কাজ করি। তোমরাও কর। 
    তোমাদের সঙ্গে কোন শত্রুতা নেই।চল, একসঙ্গে কাজ করি। সুযোগ দিয়ে দেখ টুকুন।
    আমরা আন্দোলন না করলে কোলকাতায় লালবাড়িতে দিকুদের সরকার আমাদের মাঝি-মেঝেনদের কথা শুনবে কেনে?
    ওরা মারতে এসে বন্ধু হয়ে গেল।

    ড্রাইভার ঘ্যাঁচ করে ব্রেক কষেছে। সামনে একটা ছোটখাট জটলা। জানলা দিয়ে চোখে পড়ছে দুটো মেয়েকে মারছে জনা পাঁচেক লোক। 
    কেউ কিছু বলছে না।
    আমি দরজা খুলে নামার চেষ্টা করতেই বিমলেন্দু হাত চেপে ধরে।
    --- পাগলামি করিস নে। ফালতু ঝামেলায় জড়াস না।
    -- সে কী! তুই একথা বললি?
    --- হ্যাঁ, দিনকাল পালটেছে।আমরা এখন আঠেরো নই, ষাটের দলে। 
    যা করার আজকের আঠেরো করবে। ওদের কাজ আমরা কেন করব?

    বাড়ির দরজায় নামার সময় ওকে ধন্যবাদ দিতেই হাত চেপে ধরে বিমলেন্দু।
    -- ওকথা বলিস না রে! আমি যে তোর প্রথম রিক্রুট!
    আমি হেসে ফেলি। স্খলিত গলায় বলি-- সেসব কখনো হয়েছিল। দু'কুড়ি বছরেরও আগে। 
     
    আজ আমি তোর রিক্রুট।

                                                                                                                                                                                             (চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    পর্ব ১
  • ধারাবাহিক | ২৭ জুলাই ২০২৫ | ৫৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • হীরেন সিংহরায় | ২৭ জুলাই ২০২৫ ০১:১৪732740
  • ম‍্যাগনাম ওপাসের প্রারম্ভ । বাতাসে বিদ্যুৎ । 
  • অরিন | 2404:4404:4405:700:1de3:9506:21e2:***:*** | ২৭ জুলাই ২০২৫ ০২:৫২732743
  • আহা! 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত মতামত দিন