এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • ছত্তিসগড়ের গেঁয়ো ব্যাংকঃ স্মৃতির কোলাজ ২৩

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ২৯ মে ২০২৫ | ৪৬ বার পঠিত
  • ছত্তিসগড়ের গেঁয়ো ব্যাংকঃ স্মৃতির কোলাজ ২৩

    চেয়ারম্যান এবং ওয়াটারম্যান
    গোড়ার দিকে গ্রামীণ ব্যাংকে চাপরাশি বা মেসেঞ্জারের কোন পদ ছিল না। তবে ম্যানেজার স্থানীয় কাউকে আট ঘন্টার কড়ারে সপ্তাহে ছ’দিন ডেইলি ওয়েজে নিযুক্ত করত। সে কিন্তু ব্যাংকের জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব করত। 
     
    সকালে কুঁজো বা মাটির হাঁড়িতে খাবার জল ধরে রাখা, ম্যানেজারের স্নানের জন্য দূরের কুয়ো থেকে বাঁকে বয়ে জল আনা। ব্যাংক ঝাঁটপাট দেয়া এবং মোছা, লেজার এক টেবিল থেকে অন্য টেবিলে পৌঁছে দেয়া, নিরক্ষর গ্রাহকের জন্য ভাউচার লিখে দেয়া, পোস্ট অফিস থেকে ডাক দেয়া-নেয়া, সমস্ত লেজার গুছিয়ে রাখা, ডিফল্টার গ্রাহকদের  বাড়িতে নোটিস পৌঁছে দেয়া।এছাড়া  রয়েছে স্টাফের জন্য চা বানানো, কোন কোন পাণ্ডববর্জিত জায়গায় স্টাফের জন্যে দু’বেলা রান্না করা।
     
    বদলে জুটত প্রতি সপ্তাহে নগদ নারায়ণ, মিনিমাম ওয়েজের থেকে সামান্য কম। পরে অন্য কমার্শিয়াল ব্যাংকের মত রেগুলার চতুর্থ শ্রেণীর পোস্ট সৃষ্টি হল। 
    ওদের জীবনে স্থায়িত্ব এবং নিরাপত্তা এল। কাঁচা মাটির বাড়ির বদলে লোন নিয়ে পাকা বাড়ি এবং সাইকেলের জায়গায় মোটর বাইক হল।    

    তবে পুরনো দিনেও ওরা খুব খারাপ ছিল না। কারণ, গাঁয়ে ওদের নিজস্ব বাড়ি ছিল, বদলি হবার ভয় ছিল না। 
    এছাড়া গ্রামে নগদ টাকার অভাব। ওরা সপ্তাহান্তে নগদ টাকা পেত। 
    ওদের পদের নাম ছিল সুইপার-কাম-ওয়াটারম্যান।    

    কিন্তু গোড়ার দিকে যারা ম্যানেজার ছিলেন তাঁরা ওদের দিয়ে ঘরের চাকরের মত কাজ করাতেন। শুধু ব্যাংকের  অংশ নয়, নিজেদের থাকার দুটো ঘরের ঝাড়-পোঁছও করাতেন।  মেমসায়েবের  ফরমাশ খাটতে হত। বাচ্চা সামলাতে হত। 
    বিশেষ স্থিতিতে  রান্না করাও বাদ যেত না। কিন্তু এর জন্য ওরা কোন অতিরিক্ত পয়সা পেত না।  
     
    তখন বেশির ভাগ গ্রামীণ ব্যাংকের ম্যানেজারের দল ব্যাচেলর, সদ্য কলেজ থেকে বেরিয়েছে। তবে রিজার্ভ ব্যাংক থেকে অডিটর এলে একজন লিখে নালিশ করল যে ম্যানেজার ওকে দিয়ে চাড্ডি ধোয়ায়, নইলে কাজ থেকে বের করে দেবে ধমকি দেয়!
     
    সব বন্ধ হল দু’বছর পরে ইউনিয়ন গঠিত হয়ে পাঁচবছরে মজবুত হলে। 
     ছোট ব্যাংক, একই ইউনিয়নের পতাকা তলে অফিসার, ক্লার্ক ও চাপরাশি।
     ইউনিয়নের চেষ্টায় নাবার্ড সার্কুলার দিয়ে বলল—ওদের চার ঘন্টার জন্য হাফ ওয়েজে বা আট ঘন্টার জন্য ফুল ডেইলি ওয়েজে নিযুক্ত করা যেতে পারে।  এবং সরকারি মিনিমাম ওয়েজ দিতে হবে।  
    এইসব করে ওরা বাড়ি যেত রাত নটায়। যদিও কাগজে কলমে ওরা আট ঘন্টার জন্য ডেইলি ওয়েজে কাজ করত। 
    এরপরে এল স্থায়ী পদ, তাতে ক্লাস এইটের বোর্ড পাশ করা আবশ্যক শর্ত। এবার গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন স্কুলে পরীক্ষা দেয়া এবং গুরুজিকে (টিচার) কয়েকশো টাকা দক্ষিণা দিয়ে পেপার বদল করে পাশ হওয়ার হিড়িক পরে গেল।  
     
    সেইসব দিনে আমার গেওরা রোড শাখার চাপরাশি নেতরাম যাদব একদিন ঘোষণা করল—গ্রামীণ ব্যাংকে শুধু দু’জন সুখী, চেয়ারম্যান এবং ওয়াটারম্যান!   
     
    কিন্তু  তিনবছরের জন্য স্টেট ব্যাংক থেকে গ্রামীণ ব্যাংকে ডেপুটেশনে এসে চেয়ারম্যানরা কতটুকু সুখি হতে পারেন? যেমন নতুন সরকারি ডাক্তার গাঁয়ে যাবার‘কমপালসারি’ পোস্টিং পেলে হতেন। এবার ওঁদের একজনের মুখ থেকে শোনা যাক।  

    তিনটে খামের রহস্য
    এই গল্পটি শুনিয়েছিলেন আমাদের জনৈক চেয়ারম্যান রাজিন্দর লাল বিগ, স্কেল ৬। জানতে চেয়েছিলাম স্টেট ব্যাংকের সিনিয়র গ্রেডের অফিসারদের জন্যে--ধরুন স্কেল ৫, ৬ বা ৭—গ্রামীণ ব্যাংকের পোস্টিং তো বনবাস, যদিও তিন বছরের মেয়াদ। তাঁরা সেটা কীভাবে কাটানোর কথা ভাবেন?    

    --শোন, ডেপুটেশনে নতুন চেয়ারম্যান এসে যখন পুরনো চেয়ারম্যানের কাছ থেকে চার্জ বুঝে নেয়, তখন শেষদিনে তাঁকে তিনটে বন্ধ খাম ধরিয়ে দেয়া হয়, তাতে ১, ২ এবং ৩ চিহ্ন দেয়া।
    বলা হয় এই হল নির্বিঘ্নে তিনটে বছর কাটানোর চাবিকাঠি।  চেম্বারে বসে  বছরের প্রথম দিন একনম্বর লেখা খাম খুলবেন। যা বীজমন্ত্র লেখা আছে সেটা পালন করবেন।
    দ্বিতীয় বছরের প্রথম দিন ২নং খাম খুলবেন এবং শেষ বছরে ৩ নং।
     
    কিন্তু এই ভদ্রলোক  অধৈর্য হয়ে একবারে তিনটেই খুলে ফেলেছিলেন। যা নির্দেশ পেলেনঃ

    ১ নম্বরঃ এটা তোমার প্রথম বছর। কিস্যু করবে না। খালি বলবে মাত্র এসেছি, নতুন সংস্থা। এদের ব্যাপারে কিছুই জানা ছিলনা । আগে বুঝে নিই।
     
    ২ নম্বরঃ এবার বলে দাও-- হ্যাঁ, গ্রামীণ ব্যাংক কী জিনিস বুঝতে পেরেছি। এখন প্ল্যানিং করছি। অনেক কিছু বদলাতে হবে। আমার প্রপোজাল উপরে গেছে, স্যাংশন হলেই--।
     
    ৩ নম্বরঃ শেষ বছর। নতুন কিছু করবে না। যত ছুটি জমেছে সেগুলো খরচ কর আর নতুন যিনি চার্জ নিতে আসবেন তাঁর জন্যে আগের মত নম্বর লেখা তিনটে খাম বানাও।
     
    কিন্তু এসব চুটকি শোনালেও উনি দুটো বড় কাজ করেছিলেন।   
    এক, স্টেট ব্যাংককে বলে ওদের বাতিল কম্পিউটারগুলো (প্রায় দশটা) আমাদের হেড অফিসে বিনে পয়সায় নিয়ে এলেন। 
    তাতে কাজের কাজ খুব কিছু না হোক, গ্রামীণ ব্যাংকের ছেলেগুলো কম্পিউটার ছুঁতে শুরু করল, গেম খেলতে লাগল। নতুন জিনিসের ভয় কেটে গেল।
     তারপর এল নাবার্ড থেকে কোন যোজনা অনুয়ায়ী নতুন কম্পিউটার কেনার পয়সা। আমরা নিয়মমাফিক তিনটে কোটেশন নিয়ে ভাল কম্পিউটার কিনলাম। এরপর স্টেট ব্যাংক থেকে অনুমতি এল --আগে ব্যাক অফিস কম্পিউটারাইজেশন কর।
     
    দুই, উনি আমাকে ডেকে বললেন—এসব কী? তোমার লোন পোর্টফোলিওতে এত চড়া সুদের হার রেখেছ কেন? এই কম্পিটিশনের বাজারে কে তোমার থেকে লোন নেবে? চটপট স্টেট ব্যাংকের চার্ট এনে কোথাও ০.৫% বা ১ % বেশিতে , কোথাও কমে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্টেটব্যাংকের সমান করার প্রস্তাব বোর্ডে পাশ হল।
    আমরা ছিলাম যাকে বলে flush with fund. তাই সমানে লোকসান হচ্ছিল। 
    এবার লোনের অনুপাত বাড়তে থাকায় প্রথমে লোকসান কমা শুরু হল, আর এইভাবে ছত্তিসগড় গ্রামীণ ব্যাংক নিয়মিত লাভের মুখ দেখল।

    চরিত্রবতী গাভী
    যেটা ওনাকে বলতে পারি নি, কিন্তু উনি ঠিক বুঝে গেছলেন—ওঁর আগের দু’জন চেয়ারম্যান চাইতেন না যে লোন বেড়ে যাক। ওঁদের খালি ভয়, লোন বাড়লে বড় বড় লোন দিনে ম্যানেজারদের ঘুষ খাওয়া বেড়ে যাবে। তার চেয়ে বাবা খালি ডিপোজিট নিয়ে এস। আমরা ক্লীন স্লেট নিয়ে ফেরত যেতে চাই।
    ওঁরা ব্যাংকিং বুঝতেন না। ব্যাংকিং মানে বিজনেস, মানে কিছুটা রিস্ক, কিন্তু ক্যালকুলেটেড। পাঁচ থেকে দশ পার্সেন্ট লোন খারাপ হতে পারে। কিন্তু বাকি নব্বই প্রতিশত লোনের আয়ের তুলনায় এটুকু নস্যি।  

    বিয়ের পরে , সে লাভ ম্যারেজ হলেও, বৌয়ের সঙ্গে খটাখটি লাগবে না, মতভেদ হবে না, রাগারাগি হবে না—এমন কোন গ্যারান্টি আছে? কিন্তু তাতে মধুচন্দ্রিমার স্বর্গীয় অনুভূতি ম্লান হয়ে যায় কি?
     
    ফলে ওঁদের সময়ে লোকসানের পাহাড় বাড়তে বাড়তে একটা অস্বাভাবিক চেহারা নিল। চিন্নাস্বামী কমিটি  গ্রামীণ ব্যাংকের চার রকম গ্রেডেশন করলঃ

    এক, খুব ভাল চলছে, নিয়মিত লাভের মুখ দেখছে।
    দুই, মাত্র লাভ করেছে, কড়া নজর দরকার।
    তিন, এখনও লাভ দূর অস্ত্‌; তবে একটু হাত ধরাধরি করে বৈতরণী পার করা যেতে পারে।
    চার, উদ্ধারের আশা নেই। এরা রবে ‘নিস্ফলের হতাশের দলে’।
     
     দেখা গেল, আমাদের ব্যাংকের স্থান হয়েছে চার নম্বরে। অর্থাৎ কোন আশা নেই, এদের  দোকানের ঝাঁপ নামিয়ে দিয়ে তালা লাগাও! 
    বুড়ো বয়সে চাকরি খোয়াব?
     
    এই ফাঁকে চরিত্রবতী গাভীর গল্পঃ
    সরকারি স্কীমে ডেয়ারি ইউনিটের জন্য প্রথমে একজোড়া গাই দেয়া হত—দেশি নয়, জার্সি, হলস্টেইন, রেড সিন্ধি ইত্যাদি হাইব্রীড প্রজাতির। তারজন্যে ম্যানেজারকে ঋণীর সঙ্গে পশুবাজারে যেতে হত, সঙ্গে ভেটারিনারি ডক্টর। সেখানে গরুবিক্রেতাকে দুইয়ে দেখাতে হত একবারে কত দুধ দেয়। 
    কারণ, সে হিসেবে দুগ্ধবতী গাভীর দাম ঠিক হবে। যেমন, বাজার দর চলছে প্রতি লিটারে এক হাজার। তার মানে পাঁচ লিটার দুধ দিলে গাভীর দাম পাঁচ হাজার, দশ লিটার দিলে দশ হাজার।

    কিন্তু একটা গরুর চার দিকে ভীড় জমেছে। কত দাম? পঁয়তাল্লিশ হাজার মালিক।
     
    --সেকী? এ পঁয়তাল্লিশ লিটার দুধ দেয়?
    --না হুজুর! একফোঁটাও নয়।
    --তাহলে এর দাম এত বেশি কেন?
    --এর ক্যারেকটার খুব ভাল, কোন ষাঁড়কে কাছে ঘেঁষতে দেয় না, তাই।

    তা আমাদের সেই চরিত্রবান চেয়ারম্যানের সময় স্টেট ব্যাংকের লোক্যাল হেড অফিস থেকে সার্কুলার এল সোনা-রূপো বন্ধক রেখে লোন শুরু করার জন্য। আমি ট্রেনিং সেন্টারে ৬০ জন ম্যানেজারকে একটি ব্যাচে গোল্ড লোন দেয়ার প্যাঁচ-পয়জার, মায় স্যাকরা ডেকে কী করে সোনা আর পেতলের তফাৎ কষ্টিপাথর ও নাইট্রিক অ্যাসিড সহযোগে চিনতে হয় তার ওয়ার্কশপ করালাম।   
    তারপর, যখন শাখাওয়ারি বাজেট আর টার্গেট ঠিক করার জন্যে সমস্ত মহকুমা স্তরে মিটিং করতে গেলাম তখন হল বিপদ। 
    আমি উৎসাহের সঙ্গে ব্যাখ্যা করি –গোল্ড লোন দেয়া কত সহজ, কেন রিস্ক নেই। যেমন গয়নার গ্রস ওয়েটের মাত্র ৭৫% নেট ওয়েট ধরে গয়নার বৈশিষ্ট্য বুঝে আরও মার্জিন কেটে নেট লোন দেয়া ইত্যাদি। সঙ্গে থাকবে স্যাকরার সার্টিফিকেট।

    কিন্তু তারপরই চেয়ারম্যান দু’লাইন  টিপ্পনি যুক্ত করেন—একটা কথা স্পষ্ট বলে দিচ্ছি। এই লোন ব্যাড হলে সেটা ম্যানেজারের ব্যক্তিগত দায়িত্ব হবে।  

    ব্যস্‌ আর কোন বাপের সুপুত্তুর বন্ধকী লোন দেয়? আমার স্বপ্নের “লছমীবাবুকা আসলী সোনা চাঁদী কী দুকান” আর বাস্তবে দেখা দিল না। 
    শুধু তাই নয়, এরপর এল রাহুগ্রাসের দিন।
     
    কলমের ঢাকনা খুলতে হবে! খুলতে হবে!
    প্রথমবার জেনারেল ম্যানেজারের পদে এলেন এক বাঙালি অফিসার, স্কেল ফাইভ। তবে কিহুদিন চেয়ারম্যানের দায়িত্ব সামলাবেন। 
    উনি চার বিষয়ে এম এ, আবার আইনের স্নাতক। কয়েক বছর ভিজিল্যান্সের চিফ হয়ে গুজরাতে কাটিয়েছেন।   

    প্রথম প্রথম অবাক লাগছিল। একটা জীপের লোন আড়াই লাখ। লোকটি ব্যাংকে দু’লাখ ফিক্সড ডিপোজিট রেখেছে, আবার জীপগাড়িটাও হাইপোথিকেটেড! কিন্তু উনি রাজি হলেন না। চটপট সুন্দর হস্তাক্ষরে আট পয়েন্ট আপত্তি লিখে দিলেন। আমিও চটপট সেগুলোর জবাব লিখে ফের নোটশীট পেশ করলাম।
    আমাকে ডেকে বললেন—আপনার পয়েন্টগুলো ঠিক; কিন্তু আমি চাই এই জবাবগুলো ব্র্যাঞ্চের থেকে আসুক।
    গ্রাহক খেপে গেল।
    --বলুন তো, আপনার ব্যাংক আমাকে লোন দিচ্ছে? নাকি আমি আপনার ব্যাংককে লোন দিচ্ছি? কেসটা কী?
      
    আমি স্টেটব্যাংকের বন্ধুদের  থেকে জানতে চাইলাম –কেসটা কী? ওনার কিসের অসুবিধে?

    ওরা প্রথমে হেসে গড়ালো। তারপর বলল—উনি এইচ কে বিশ্বাস, হারান কান্তি বিশ্বাস।  
    স্টেট ব্যাংকে ওনার নিকনেম হারামখোর বিশ্বাস। উনি কলমের ঢাকনা খুলতে চান না। মাসের শেষে স্যালারি শিটেও নয়।
     আড়চোখে দেখতে থাকেন—অ্যাকাউন্ট অফিসার গোটা ব্র্যাঞ্চের স্যালারি তৈরি করছে কিনা।
     
    ঠিক দু’মিনিট আগে উঠে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান—রিজিওনাল অফিস থেকে ডাক এসেছে।
    সবাই তিতিবিরক্ত, বাড়ি যেতে হবে। মাইনে জমা হোক। 
    শেষ মুহুর্তে অ্যাকাউন্ট অফিসার ওনার অপেক্ষা না করে নিজের দায়িত্বে সবার মাইনে জমা করে দেয়, উনিও বাদ পড়েন না।
     ওনার গুপ্তচর খবর দিলে উনি হাসিমুখে ফিরে এসে নিজের চেয়ারে বসে পড়েন, গোটা ব্র্যাঞ্চ শুনতে পায় ওনার উচ্চকণ্ঠে হাসি,--হাঃ হাঃ হাঃ!  

    যখন রিজিওনাল ম্যানেজার ছিলেন তখন একটু ছোট লোনের প্রপোজাল এলে বলতেন—এতটা দেওয়া যাবে না। একটু কম কর। যেই কম করা হত অমনই সেটা তাঁর ডেপুটিকে ধরিয়ে বলতেন—এ তো তোমার পাওয়ারে, তুমি করে দাও!
    হাঃ হাঃ হাঃ!  
     
    আবার বেশ বড় প্রপোজাল এলে বলতেন—খুব ভাল কেস, এত কম কেন? আরও বেশি করে চাও। নতুন বানিয়ে নিয়ে এস। তারপর বলতেন এটা আমার হাতের বাইরে, লিখে ডিজিএম সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দিচ্ছি, উনি করে দেবেন। হাঃ হাঃ হাঃ!  
    কলম বন্ধই থাকতো।
     
    আমাদের অবস্থা বলার মত নয়। সব কাজ আটকে গেছে। রিজার্ভ ব্যাংক, নাবার্ড এবং ব্যাংকের বোর্ডের অনুমতি পাওয়ার পরও ব্র্যাঞ্চ ভাল জায়গায় শিফট হচ্ছে না। ব্যাংকের টোটাল লোন ক্রমশঃ নিম্নগামী।
    একদিন ক্লার্ক ইউনিয়ন ওনার বিরুদ্ধে শ্লোগান দিল—“গ্রামীণ ব্যাংক হতাশ হ্যায়, 
                                                                                  হারামখোর বিশ্বাস হ্যায়। 
                                                            কলম কা ঢাক্কন ----খোলনা পড়েগা! খোলনা পড়েগা”!
     
    উনি পরে আমাকে ডেকে বললেন—কী জানেন রায়বাবু, সেই যে গুজরাতে গিয়ে ক’বছর ভিজিল্যান্সের দায়িত্বে ছিলাম তাতে আমার হিম্মত চলে গেছে। 
    ওরা কী যে করে, কোথাকার পয়সা কোথায় পাঠায়, কীভাবে সরায়—তার হদিশ পেতাম না!
    হাঃ হাঃ হাঃ!  
     
    কিন্তু ভগবান আছেন তার প্রমাণ বহুবার পেয়েছি।
    স্টেটব্যাংকে এল স্বেচ্ছা-অবসরের লোভনীয় স্কীম—চালু শব্দে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক।
     বিশ্বাস স্যার একমুহুর্ত দেরি করেন নি। প্রথম ব্যাচেই লুফে নিলেন। তখনও তাঁর তিন বছর চাকরি রয়েছে।
     
    তারপর ফেয়ারওয়েলের দিন উনি গাইলেন হেমন্ত কুমারের “ইয়ে রাত ইয়ে চাঁদনী পিউ কহাঁ, সুন যা দিল কী দাস্তাঁ”!  
    সাফারি স্যুট পরা মোটাসোটা মানুষটি,  সুরে এবং লয়ে  বেশ আবেগ দিয়ে  দারুণ গাইলেন। আমরা চমৎকৃত, আমরা হতবাক! এই প্রতিভার পরিচয় এতদিন কেন পাইনি!
    সব দুঃখ, সব রাগ গলে জল।
     
    আমরা সমবেত সিদ্ধান্তে এলাম সৎ এবং দিলখোলা মানুষটি ভুল চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন।

    হ্যাঁ, রাহুমুক্তি ঘটল।
    এলেন মুম্বাই সেন্ট্রাল অফিস থেকে বীরেন্দ্র কুমার শ্রীবাস্তব, হায়দ্রাবাদের অডিট অফিস থেকে রামচন্দ্র ওলী –দুজনেই স্কেল ৬। 
    ওনাদের সুদক্ষ পরিচালনায় আমাদের  গ্রামীণ ব্যাংকের অহল্যামুক্তি ঘটল। ব্যাংক স্থায়ী লাভের মুখ দেখল। 

    তারপর স্টেটব্যাংকের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ স্টাফ কলেজ, হায়দ্রাবাদ থেকে এলেন শেখর শ্রীবাস্তব। ওনার ম্যান্ডেট --এই ব্যাংকে কোর ব্যাংকিং চালু করতে হবে। 
    তার ফলে এখন স্টেটব্যাংকের সহযোগে আমাদের ব্যাংকের এটিএম কার্ড দিয়ে দেশের যে কোন শহর থেকে ক্যাশ তোলা যায়।
    আমরা এখন পুরোপুরি রাহুমুক্ত।
     
    আমার রিটায়ারমেন্টের ছ’মাস বাকি।
    অফিসের কাজে রায়পুরের ইউনিভার্সিটি ব্র্যাঞ্চে গেছি। সেখানে আমার পরিচিত বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলছি। 
    কানে এল পরিচিত উচ্চকণ্ঠে হাসি,--হাঃ হাঃ হাঃ!
    স্টেটব্যাংকের বন্ধুটি মুখ বাঁকালো।
     
    --ওই দেখ , এসে গেছে। তোদের বিশ্বাস স্যার।  সপ্তাহে দু’দিন করে আসে।
     রিটায়ার করে যত পয়সা পেয়েছে সব এই ব্র্যাঞ্চে ফিক্সড ডিপোজিট করেছে। এসে চা খাবে তিনবার, ভ্যাজর ভ্যাজর করবে। 
    ডিপোজিটগুলো কিছু প্রি-ম্যাচিওর, কিছু রিনিউ করাবে। তারপর বিদেয় হবে।
     
    --সে তো ভাল কথা, অনেকখানি ডিপোজিট পেলি। ওনার স্ত্রী ইউনিতে ফিজিক্স পড়ান। টাকার চিন্তা নেই। এত খেপচুরিয়াস হচ্ছিস কেন?
    --ধেত্তেরি! তোদের ওখানে তিনবছর ছিল, কিছুই চিনিস নি? 
    অন্ততঃ ষাট খানা শর্ট টার্ম ডিপোজিট করেছে, ১৫ দিন, ২১ দিন , ৪৫ দিনের জন্য।
    --সে কী? কেন? এতে তো সুদের হার অনেক কম। কী কেস?
    --তোদের এক্স, তুই জিজ্ঞেস কর।
     
    গিয়ে নমস্কার করে বলি— বাইরে কফি হাউসে চলুন স্যার। একসঙ্গে কফি খাবেন। আপনাকে মিস করি।
     
    কফির পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে বলেন—শুনুন রায়, আপনাদের ব্যাংকে যে পাঞ্জাবি লোকটা চেয়ারম্যান হয়ে এসেছে সে মহা করাপ্ট! বাস্তুঘুঘু একটি। 
    এসেই লোন বাড়াতে বলবে। সবাইকে বকবে। সুদের হার কম করে বড় বড় লোন! 
    আপনি সিধেসাদা লোন ম্যানেজার, ফেঁসে যাবেন।

    এক কাজ করুন। রবিবার রবিবারে প্রপোজালের কাগজপত্র নিয়ে রায়পুরে আমার বাড়ি চলে আসুন। দুটি মাছভাত এখানেই খেয়ে নেবেন। 
    আমি আপনাকে শিখিয়ে দেব কী করে লোন রিজেক্ট করতে হয়! 
    হ্যাঁ, এমন নোটশীট লিখে দেব যে বাছাধন ছটফট করবে, কিন্তু স্যাংশন করতে পারবে না।
    আরে , আপনার ভয় কিসের! কী করে নেবে?
     আমরা বাঙালী। আমাদের টেক্কা দেবে? খুব বেশি হলে ব্র্যাঞ্চে ট্রান্সফার।
     সে হোক গে, হাত নোংরা করার থেকে বেঁচে যাবেন। কম কথা? 

    --ঠিক আছে স্যার, আপনি যা বলবেন। তবে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
    আপনি এতগুলো ছোট ছোট টার্ম ডিপোজিট করেছেন কেন?  তাও সবগুলো অল্প দিনের জন্যে? এত কম সুদে?
    --আপনি খেয়াল করেছেন? হাঃ হাঃ হাঃ!
     
     শুনুন রায়, ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েহি। দাদা ছিলেন রেলের ক্লার্ক, বিয়ে করেন নি। 
    আমাকে আর বোনকে কষ্ট করে বড় করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন।
    এই যে এত টাকা পেলাম, প্রভিডেন্ট ফান্ড আর গ্রাচুইটি তো নস্যি,— আসলে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক থেকে! 
    এখন এই টাকা যদি গায়েব হয়ে যায়?
     
    --মানে? গায়েব হয়ে কোথায় যাবে  স্যার? সব তো ব্যাংকেই জমা আছে। 
    --বুঝছেন  না। আছে মানে কোথায়? আগে লেজার ছিল, পাতা ওলটালেই দেখা যেত। 
    এখন কম্পিউটার। সব কম্পিউটারে জমা, চোখে দেখা যায় না। পাসওয়ার্ড দেয়া।
     কিন্তু কম্পিউটার তো ক্র্যাশ হয়, ডেটা উড়ে যায়, গায়েব হয়, নষ্ট হয়।

    ধরুন যদি এই ব্র্যাঞ্চেও অমনটি হয়? তাহলে তো আমি পথে বসব!  যাকে বলে ধনে প্রাণে মারা! 
    হাঃ হাঃ হাঃ!  
     
    কোথায় কত টাকা আছে কী করে জানা যাবে? তাই আমি ডিপোজিট ম্যাচিওর হওয়া এবং রিনিউ করার অজুহাতে নিয়মিত ব্র্যাঞ্চে আসি। 
    এই সুযোগে আমার সমস্ত ডিপোজিট ওলট পালট করে দেখে নিই—সব ঠিক আছে তো?
    টের পাই, ছোকরা স্টাফগুলো বিরক্ত হয়, বিদ্রূপ করে।
     
     কিন্তু ওদের কি? আমার তো সারাজীবনের সঞ্চয়! 
    বললে হবে?
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৯ মে ২০২৫ | ৪৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন