ছত্তিশগড়ের গেঁয়ো ব্যাংকঃ স্মৃতির কোলাজ ২২
আমি জেনে শুনে বিষ করেছি পান
বোসস্যার চলে গেছেন। হেড অফিস ছুরি ব্র্যাঞ্চের চার্জ আমাকে দিয়েছে। চেয়ারে বসার পরে বুঝতে পারছি-- কত ধানে কত চাল।
উনি দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন করতে গিয়ে কিছু মোসাহেব তৈরি করে গেছেন, আর কিছু নিন্দুক। মোসাহেব ক’জন যখন তখন ব্র্যাঞ্চে এসে চেয়ার দখল করে বসে থাকে। খবরের কাগজ পড়ার ভান করে দেখে আমি কী করছি।
পরে নিঘঘাৎ গাঁয়ের পাওয়ার লবির কাছে গিয়ে চুকলি করে। আর নিন্দুকের দল চেঁচায় কৃষি ঋণ না দেয়ায়।
তবে বোসস্যার ছুরি গ্রামের যে রাজবাড়ি (আদিবাসী রাজা-- মেটে রঙের প্রাসাদের সিংহদ্বারের মাথায় কোট অফ আর্মস), তাদের বিশেষ পাত্তা দেন নি।
অবশ্য ওনার একটা সুবিধে ছিল। এই এলাকার সবচেয়ে বড় রাজপরিবার হল কোরবা রাজের। যুবরাজ জ্যোতিভুষণ প্রতাপ সিং বিলাসপুরের কলেজে বোসস্যারের সহপাঠী।
বিলাসপুর শহরে প্রতাপ টকিজ সিনেমাহল এবং প্রতাপ ভবন প্যালেস ওঁদেরই।
কিন্তু ছুরির কুমারদের মধ্যে কোন এক ভাইয়ের কাজ সেজেগুজে পান মুখে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা। কেউ শ্রদ্ধাপূর্বক যদি একটা পানামা সিগ্রেট বা এক কাপ চা খাইয়ে দেয়!
এসেছিলেন লোন চাইতে।
বাসস্ট্যান্ডে হোটেলের মালিক ঘিসু হল গ্রামের সর্বমান্য ভাঁড়। ও সেই কুমারের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করায় নাক দিয়ে হুঁঃ করে বলল—দেখে মা শ্যামসুন্দর, পাদে মা ঢেমকাউয়া!
দেখলে লাগে কেষ্ট ঠাকুর,
পাদলে পরে ঘেয়ো কুকুর।
বুঝতে পারি গোড়ার দিকে এদের সাহায্য নেয়া জরুরি ছিল। আসলে বোস স্যার স্টেট ব্যাংকে থাকতে কখনও বিলাসপুর, ভোপাল আর ইন্দোরের বাইরে কাজ করেন নি। গ্রামে তো কদাপি নয়।
সেখানে দুটো বাচ্চা মেয়ে এবং গিন্নিকে নিয়ে আদিবাসী এলাকার ছুরি ব্যাংকের দোতলায় থাকা—যেখানে খাটা পায়খানা একতলায়, আর চান- টান ব্যাংক খোলার আগেই পেছনের বারান্দায় সেরে ফেলতে হয়--- কম কথা নয়।
এটা আরও বোঝা যায় ওঁর দেয়া লোনগুলো দেখলে। বেশিরভাগ দোকানদার এবং তাঁতি, ছুতোর গোছের কারিগর বা হস্তশিল্পী।
সরকার পরিচালিত একটি সমবায় সমিতিকে উনি তসরের চাষ করার জন্যে একটা বড় লোন দিয়েছিলেন। ওরা সিকিউরিটি হিসেবে কিছু ফিক্সড ডিপোজিট দিয়েছিল।
ওদের কাজ হল অর্জুন গাছে রেশমের গুটিপোকা ছেড়ে সেগুলো বড় হয়ে নিজের মুখের লালা দিয়ে কোকুন তৈরি করা অব্দি অপেক্ষা করা এবং সেগুলো ছুরি ও আশপাশের গ্রামের কোস্টা সমাজকে (তাঁতিদের) বিক্রি করা ।
এই ক্যাশ ক্রেডিট অ্যাকাউন্টে রিকভারি ছিল ১০০%, তবে আটমাস পরে পরে। ইন্টার্নাল অডিটের অনভিজ্ঞ ছোকরা না বুঝে রিপোর্টে এ নিয়ে এক প্যারাগ্রাফ মন্তব্য করল। উনি চটে গিয়ে ওই অ্যাকাউন্ট বন্ধ করিয়ে দিলেন। স্টেট ব্যাংকে ফেরত যাবার আগে পেছনে কোন , ওনার ভাষায়, গু রেখে যেতে চান না।
ওনার কৃষি ঋণ বলার মত নয়।
ফলে আমাদের সে ব্যাপারে কিছুই শেখান নি। এই কথাটা সারদা স্যারকে বলতে উনি আমাদের কয়েক জনকে বিলাসপুরে হেড অফিসে এসে তিনদিনের ক্লাস করতে বললেন।
শেখাবেন ম্যানেজার অফ ইন্টার্নাল ব্যাংকিং পাস্তৌর স্যার এবং কৃষি বিভাগ থেকে লিয়েনে স্টেট ব্যাংক তথা গ্রামীণ ব্যাংকে আসা অগ্নিহোত্রী স্যার।
দুজনেই চমৎকার শিক্ষক।
চাষিদের কত লোন দিতে হবে সেটা কী ভাবে বুঝতে হবে? ফসল চক্র কী?
আউশ ও আমনে বীজ বোনা এবং ধান কাটার সময় কী? কোন কোন সার দিতে হয়? কী ধরণের পোকা লাগে?
ধান বোনার দুরকম পদ্ধতি—রোপা এবং ছিড়কাউ—কাকে বলে? কোনটায় কী রকম জল লাগে, সার লাগে?
কখন থেকে লোন ফেরত দেবার জন্য তাগাদা করতে হবে, লোন দেয়ার সময় কোন কোন ডকুমেন্ট দরকার—সব শিখলাম।
আর শিখলাম-- কেন ব্যাংকের টেবিলে বসে জমির কাগজ দেখে লোন না দিয়ে চাষিদের গ্রামে যাওয়া দরকার, কার খেত কোথায় সেটা সরেজমিনে দেখা দরকার, পড়শিদের সঙ্গে কথা বলা দরকার এবং বৃষ্টি নামলে সাইকেল থেকে নেমে ভিজে আল ধরে খেতে বেড়িয়ে আসা কত দরকারি!
একই কথা ধান পেকে উঠলে।
আরও আছে। কেন বিচ্ছিন্ন ভাবে এই গ্রামে দুটো লোন, দশ কিলোমিটার দূরে ওখানে দুটো—এরকম ছড়িয়ে ছিটিয়ে কাজ না করে বেস লাইন সার্ভে করে ক্লাস্টারে কিছু গ্রাম বেছে নেয়া দরকার। তাতে সময়, পরিশ্রম দুই বাঁচবে। আর রিকভারি ভাল হবে।
শেষে পস্তৌর স্যার জানতে চাইলেন—কেমন বুঝছ তোমরা? কনফিডেন্স পাচ্ছ?
গ্রামীণ ব্যাংক যদি বর্ষার মরশুমে চাষিদের কৃষি ঋণ না দেয় তো কে দেবে? সুদখোর মহাজন?
আমি বরাবরই একটু ডেঁপো টাইপ। বললাম—বাকি সব ঠিক আছে, কিন্তু রিকভারি নিয়ে যা বললেন সেগুলো অবাস্তব। এরকম হয় না।
নির্ঘাত হ্যান্ড আউটগুলো ব্যাংকের চেয়ার টেবিলে বসে আরাম করে লেখা। নট প্র্যাক্টিক্যাল।
উনি হাসলেন।
বললেন –আমাকে দশ মিনিট সময় দাও, আমি তোমাকে কনভিন্স করে দেব যে এগুলো আমার স্টেট ব্যাংকের এগ্রিকালচারাল ডেভলপমেন্ট ব্র্যাঞ্চে পাঁচ বছর হাতে কলমে করে দেখা অভিজ্ঞতার সংকলন।
(জনান্তিকে বলে রাখি—এসব আমার প্রথমবার লোন দিতে গিয়ে হাত পোড়ানোর পর। সে গল্প শেষে বলব।)
সেসব চুকলে আমরা গেলাম চেয়ারম্যানের চেম্বারে ধন্যবাদ দিতে।
গিয়ে দেখি শ্রীমান হকলারাম সাহু, মানে সেই পসান শাখার ‘সাতদিন জেনারল লেজার না লিখে স্যাঙাৎ জুটিয়ে রামি খেলতে বসা’ ম্যানেজার, স্যারের মুখোমুখি বিরাজমান।
কানাঘুষোয় শুনেছিলাম যে ও স্যারের সামনে নাকখত দিয়ে নিজেকে শুধরে নেবার প্রতিজ্ঞা করেছিল।
আর স্যার গলে জল হয়েছিলেন। ওকে ওড়িষ্যা সীমান্তের কোন শাখায় ছুঁড়ে ফেলেন নি।
সবাইকে বললেন—একমাসের মধ্যে বর্ষা নামবে। তাই কৃষিলোনের স্টেশনারি নিয়ে যাও। এবার ভাল করে খরিফ ফসলের জন্য লোন দিতে হবে।
এখানে বলা দরকার যে তখন ‘কিষাণ ক্রেডিট কার্ড’ ধারণাটির অস্তিত্ব ছিল না। থাকবে কোত্থেকে?
সত্তরের দশকের শেষে সরকারি বা বেসরকারি ব্যাংকেও গ্রাহক বা ক্লায়েন্টের জন্য ক্রেডিট কার্ড নামক আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ যন্তরটি কেবল মার্কিনি নভেলের পাতায় দেখতে পেতাম।
তাই জমির পরিমাণ এবং সে কী কী ফসল কতটুকু জমিতে নেয়—এসব দেখে চাষির লোনের সীমা ঠিক করতে হত, আর তাতে দুটো ভাগ—ক্যাশ এবং কাইন্ড।
ক্যাশ মানে যতটুকু নগদ ওকে হাল-বলদ না থাকলে ভাড়া হিসেবে এবং খেতে বীজ রোপণ এবং আগাছা নিড়ানো ও ফসল কাটার সময় মজুরকে দিতে খরচ হবে।
সেটা চাষিকে নগদে দাও।
কাইন্ড মানে বীজধান, সার, কীটনাশক ইত্যাদির খরচ। এগুলো কখনই কৃষককে নগদ দেয়া যাবে না।
সোজা সাপ্লায়ারকে অর্ডার দিয়ে দাও। মাল এসে গেলে তাকে ব্যাংকার্স চেকে পেমেন্ট কর।
এখন এত লফড়া নেই। কৃষককে ক্রেডিট কার্ড দাও। সেই টাকা ও যেমন ইচ্ছে খরচ করুক। ওর পাঁঠা ও ল্যাজে কাটুক কি মাথা থেকে—তাতে তুমি আমি বলার কে!
আরে ভাই, ওর বুদ্ধি-বিবেচনার উপর ভরসা রাখো।
সবাই উঠে গেলে উনি আমাকে বললেন—সাহুকে ম্যানেজারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে তোমার কাছে পাঠাচ্ছি ছ’মাসের জন্য। তুমি ওর চালচলন এবং ব্যাংকের কাজে ডেডিকেশন নিয়ে প্রতিমাসে রিপোর্ট পাঠাবে। যদি ঠিকমত চলে এবং ব্যাংকের কাজ দায়িত্ব নিয়ে করে তাহলে ফের ম্যানেজার হবে।
শোন সাহু, রায়ের কাছে তোমাকে পাঠাচ্ছি। ও তোমার এক ব্যাচ সিনিয়র, কোন অসম্মান হবে না।
আমি চাই –তুমি কলেজ জীবনের ছেলেমানুষি কাটিয়ে উঠে ভাল ব্যাংকার হও। দেবাঙ্গনকে চার্জ দিয়ে এসেছ তো! যাও, কাল দিনের বেলায় ছুরি শাখাতে রিপোর্ট কর।
এই শেষ সুযোগ, শুধরে যাও। নইলে?
নইলে “যা ভৈঁস নদী পার, মেরে তরফ সে এক ধাক্কা আউর সহী”।
“যা রে মোষ পেরিয়ে নদী , মারব ঠেলা লাগে যদি”।
সাহু বেরিয়ে গেলে আমাকে বললেন—শোন, তোমাকে কঠিন দায়িত্ব দিচ্ছি। ওর মাথায় শয়তান চেপেছে। ওকে এই কয়মাসে একবারও ওর আগের ব্র্যাঞ্চে যেতে দেবে না। ওখানে এক মহিলা চক্রে ফেঁসেছে। ও নানান অজুহাতে পসান যেতে চাইবে। তুমি দেবে না। ও শাতির, খুব ধূর্ত, ইমোশনাল অ্যাপিল করবে।
তুমি বলবে—হেড অফিসে টেলিগ্রাম কর, ওখান থেকে পারমিশন এলে তবে।
কেটে গেল দুটো মাস। সাহু বেশি ঝামেলা করেনি। দু’একবার পসানে কাজ আছে বলেছিল, আমি পাত্তা দিইনি।
দু’মাসের ভাল রিপোর্ট হেড অফিসে পাঠিয়ে দিলাম।
তৃতীয় মাসের গোড়ায় মাইনে পাওয়া মাত্র সাহু একটা ইনল্যান্ড লেটার দেখিয়ে বলল—পসান ব্র্যাঞ্চে মুদি দোকানে ১৭০০ টাকা বাকি পড়ে আছে।
ওরা চিঠি পাঠিয়ে ধমকাচ্ছে—এমাসে শোধ না দিলে হেড অফিসে কমপ্লেন করবে। আপনি তো জানেন ব্যাংক অফিসারকে তার ক্লায়েন্টের থেকে ধার নিতে নেই।
কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট! জানতে পারলে সাসপেন্ড করবে।
--তা ঠিক, সবাই ধার নেয়—মুদি দোকানে, কাপড়ের দোকানে। কিন্তু কমপ্লেন হলে চিত্তির!
--এগজ্যাক্টলি! তাই বলছিলাম আমাকে শনিবার দুপুরে পসান যেতে দিন। রাত্তিরে পৌঁছে রবিবার সকালে ধার শোধ করে ওর থেকে লিখিয়ে নেব।
তারপর সেদিনই রওনা হয়ে এখানে রাত্তিরে ফিরে এসে সোমবার থেকে ডিউটি করব।
কোথাও কিছু একটা খটকা লাগছিল। কিন্তু ওর যুক্তিকে উড়িয়ে দিতে পারলাম না। সত্যিই তো, আমরা সবাই মুদি দোকানে ধারে জিনিস নেই। মাসের গোড়ায় শোধ করি।
কখনও নালিশ হয় না। তবে সাহু তো আর ওখানকার ম্যানেজার নয়, হবেও না। নাড়ির বন্ধন কাটা হয়ে গেছে। দোকানদার বিশ্বাস করবে কেন?
--যা তাহলে। দেখিস, কথার খেলাপ করিস না। রবিবার শেষ বাস ফিরে আসে রাত সাড়ে নটায়। এসে যাস।
সাহু অনেক ঠাকুর দেবতার দিব্যি গেলে টাকা তুলে রওনা দিল।
পসান এখান থেকে নব্বই কিলোমিটার দূর। তবে দু’বার বাস বদলাতে হয়। সতপুরা রেঞ্জের পাহাড়ি পথ। সময় লাগে বেশ কয়েক ঘন্টা।
সোমবার সকাল। সাহু আসেনি, বিকেলেও না। তখন ব্র্যাঞ্চে টেলিফোন আসে নি।
কী করে খবর নেব বুঝতে পারছি না।
মঙ্গলবার দুপুরে হেড অফিস থেকে টেলিগ্রাম এল। আমাকে পত্রপাঠ হেড অফিসে যেতে হবে।
সারদা স্যার চেম্বারে একা। আমাকে দেখে খানিকক্ষণ চুপচাপ, তারপর গর্জে উঠলেন।
--তুমি এত বোকা জানতাম না। এতবার করে বললাম ওকে যেতে দিও না।
আমার পায়ের তলায় মাটি নেই। মিনমিন করে জানতে চাই সাহু কোথায়?
--পসান থানায়, লক আপে। এখান থেকে জীপ গেছে। বন্ড ভরে ছাড়িয়ে আনবে। তারপর অফিসে এলে ওকে সাসপেনশন লেটার ধরিয়ে দেয়া হবে। অডিট রিপোর্টে অনেক ইরেগুলারিটি। চার্জশীট দিয়ে বের করে দিতে কয়েক মাস যথেষ্ট।
--লক আপে কেন স্যার?
--শোন, ওখানে একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক। সাহু ধার শোধ করতে যায় নি। তোমাকে ফলস্ চিঠি দেখানো হয়েছে, ওই মেয়েটির লেখা। আগেই সাবধান করেছিলাম।
সাহু রাত্তিরে ওখানকার ম্যানেজারকে মেরেছে। জোর করে একটা কামরায় তালা বন্ধ করে আটকে রেখে সারারাত ম্যানেজারের কোয়ার্টারে ওই মেয়েটির সঙ্গে কাটিয়েছে।
সকালে বন্ধ কামরার তালা খুলতেই অপমানিত ম্যানেজার সোজা থানায় গিয়ে নালিশ করেছে। তারপর বিলাসপুর এসে আমাদের জানিয়েছে।
কিন্তু রায়, তুমি আমাদের হতাশ করেছ।
প্রথম লোন-- চিৎপটাং
হতাশ তো আরও অনেককে করেছি। কথা দিয়ে কথা রাখতে পারি নি।
সেই যে গেওরা শাখায় চাপরাশি সেজেছিলাম, সেখানে মিশ্র ছিল ম্যনেজার। আমি অফিসার অন স্পেশ্যাল ডিউটি।
ছুরি শাখায় বোস স্যার ফেরত যাবার দিন গুনছেন। অর্থাৎ আমি তখনও কাউকে লোন দিইনি। তাহলে আর কিসের ব্যাংক ম্যানেজার?
যত গরীবদের লোন দেয়ার কথা বলি, মিশ্র উড়িয়ে দেয়। ও আগে অন্য একটি ব্যাংকে চাকরি করে এসেছে।
বলে—গরীব মানেই ব্যাংক লোনের যোগ্য হবে—এমন নয়।
হেড অফিস জেনে গেল বাঙালী রঞ্জন রায় বাম রাজনীতির লোক। কেউ ছেঁড়া জামাকাপড়ে এলেই ওর দুঃখ উথলে ওঠে, খালি বলে লোন দিয়ে দাও।
নামল বর্ষা, দরকার কৃষি ঋণ বিতরণের। কিন্তু মিশ্রের মেয়ে জন্মেছে। সাতদিনের ছুটি নিয়ে বিলাসপুর গেছে, আমি এবার চার্জে—মানে পুরোদস্তুর ম্যানেজার।
ভিলাইবাজার গ্রাম থেকে এল নতুন সরপঞ্চ রামাধীন কাশ্যপ এবং তার তিন বন্ধু। বিশ বছরের ছেলে, কিন্তু জয়সওয়াল পরিবারের তিন দশক ধরে জিততে থাকা মৌরসীপাট্টা ভেঙে বিজয়ী হয়েছে। গ্রামের সমস্ত তরুণ সম্প্রদায় ওর সঙ্গে।
ওরা আমায় জানাল যে জয়সওয়াল পরিবারের এত ভূসম্পত্তি , কোরবা শহরে ওষুধের পাইকারি দোকান, বিশাল বাড়ি, মোটর গাড়ি সব হয়েছে গরীবের রক্ত চুষে।
আমি শ্রেণী ঘৃণায় উদ্দীপ্ত!
ওরা পান থেকে চূণ খসলে চাকরকে গরুবাঁধার কাছি দিয়ে পেটায়, তাতে লঙ্কাবাটা লাগায়।
আমার ঘৃণা এবার ক্রোধে বদলে গেল।
এই নতুন তারুণ্য ওদের শিক্ষে দিতে পারবে।
হ্যাঁ, আমি বিশ্বাসে অটল। তা কী করতে হবে?
--ওরা জানুয়ারি মাসে হোলসেল দরে সার কিনে গোদামে ভরে রাখে। তারপর কৃষকদের ঠকায়, চড়াদামে ব্ল্যাক করে। এটা আটকাতে হবে।
নিশ্চয়ই ! তা আমি এই পবিত্র বিপ্লবে কী কাজ করতে পারি? কাঠবেড়ালি না হনুমান?
আপনি বজরঙবলী! রামাধীনকে কুড়িহাজার ক্যাশ ক্রেডিট দিন। ও হোলসেল দরে কিনে সরকারি খুচরো দরে গরীব কৃষকদের বিক্রি করবে। সামান্য মার্জিন রাখবে।
এই কথা? কিন্তু আমার যে এখনও লোন দেয়ার পাওয়ার নেই।
স্যার, মৌসম বিতা জায়ে!
দিয়ে দিলাম। চারদিকে ধন্য ধন্য।
মিশ্র ফিরে এসে বলে করেছিস কী? সমস্ত নিয়ম ভেঙেছিস। ওর লোন অ্যাকাউন্ট ডেবিট করে সারের সাপ্লায়ার কোম্পানিকে ব্যাংকার্স চেক দেওয়ার কথা। সেটাও সাপ্লাই এলে গোডাউন ইনস্পেকশন করার পর।
চল গিয়ে দেখি গোডাউন।
কোথায় কি! সব ভোঁ ভাঁ। গোডাউনে একটি দানাও নেই। এমনকি কখনও এই গোডাউনে সার এসেছিল তারও চিহ্ন নেই।
সব রামাধীন বেচে খেয়েছে এবং ফুর্তি করে উড়িয়েছে।
কাকে বেচেছে?
কেন? ওই গরীবের রক্তচোষা জয়সওয়াল পরিবারকে, সামান্য মার্জিন রেখে!
একটাই ঠিক কাজ করেছিস। ওর বাবাকে গ্যারান্টর বানিয়েছিস।
এবং ওঁর নামে রামাধীন সার বিক্রির কিছু টাকা বারো হাজার যে ফিক্সড ডিপোজিট করেছে, তাতে লিয়েন নোট করিয়েছিস।
এখন রামাধীন ও তার বাবাকে নোটিস দে লোন রিকল করে।
তথাকরণ।
কলীগের বিয়েতে বিলাসপুর গিয়ে দেখি চেয়ারম্যান সারদা এসেছেন। দেখেই লুকিয়ে পড়লাম। উনি আমার দিকে এগোলেন। আমি খানিকক্ষণ টু-উ-কি খেললাম।
উনি শেষে একজনকে বললেন—যাও, রায়কে বল এখানে আসতে। ভয়ের কিছু নেই। খেয়ে ফেলব না।
বাসরঘরে নববধূর মত ব্রীড়াবনত হয়ে পা টিপে টিপে হাজির হলাম।
উনি হাসছিলেন, ‘আরে প্রথমগ্রাসে মক্ষিকাপাত! ভাতে পড়ল মাছি? শোন, ভুল করেছ, কিন্তু তোমার ইন্টেনশন খারাপ নয়। এবার লোন দেবে সমস্ত প্রসিডিওর জেনে। আগামী সোমবারে দু’দিনের জন্য হেড অফিসে এস। ফের লোন দেবে। ভয় পাবে না। কিন্তু ডিউ প্রসেস অ্যান্ড ডিউ কশন মেনে।
আর হ্যাঁ, এখন থেকেই ওই রামাধীনের পেছনে লেগে পড়। ব্যাংকের পয়সা আদায় করতে হবে।
সেই প্রথম লোনটি আদায় করতে কালঘাম ছুটে গেছল। প্রথমে কোর্ট।
বাজে উকিল, স্রেফ হেড অফিসে ব্রাহ্মণ সন্তানের আত্মীয় বলে কেস পায়, কিস্যু জানে না।
আমাদের উকিল তিওয়ারিজি লোনের ডিমাণ্ড প্রমিসরি নোট (অরিজিনাল) পিটিশনে লাগিয়েছিলেন। কড়া ম্যাজিস্ট্রেট সেটা দেখে পুরো ফাইল ছুঁড়ে ফেলে দিলেন।
--এভাবে? কী ম্যানেজার মহাশয়? এক্ষেত্রে কোন আইন মেনে ডকুমেন্ট দিতে হয়? প্রমিসরি নোট অরিজিনাল দেয়া যায়?
-- না ধর্মাবতার। ব্যাংকার্স বুক অফ এভিডেন্স অ্যাক্ট অনুযায়ী শুধু সার্টিফায়েড কপি দিতে হবে। লোন লেজারের পাতা অরিজিনাল দেয়া যেতে পারে।
--গুড।
পেছনের ঘুর্ণায়মান র্যাক থেকে ওই অ্যাক্টের বই বের করে তাচ্ছিল্যভরে উকিলকে দিয়ে বললেন—আগে বাইরে গিয়ে আইনটা পড়ে একঘন্টা পরে পিটিশন শুধরে আনুন।
ব্যাংক ডিক্রি পেল।
একবছর পরে রামাধীনের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার আদেশ দেয়া হল।
খরচাপাতি করে কোর্টের লোক নিয়ে গেলাম। সে গিয়ে দেখল রামাধীনের নামে কিছুই নেই। সব ওর বৌয়ের নামে। এমনকি বাড়ি এবং জমিজমা ওর বাবা উইল করে বৌমাকে দিয়েছেন। রামাধীন হাসছে।
তবু কিছু টাকা আদায় হল -সে নেহাত নিয়মরক্ষা, যাকে বলে ‘ঊট কা মুঁহ মেঁ জিরা’।
শেষে ওর বাবার লিয়েন করা টার্ম ডিপোজিট সময় পূর্ণ হলে সোজা লোন খাতায় জমা করা হল। ইতিমধ্যে রামাধীন উপরে চলে গেছে।
শেষ ২০৭৮ টাকা বাকি, সেটা রাইট অফ করতে হল। হিন্দিতে বাট্টা খাতায় গেল।
এইভাবে আমার প্রথম লোন এবং ম্যানেজারগিরির ফ্লপ ইনিংস শেষ হল।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।