ছবি: ঈপ্সিতা পাল ভৌমিক
১
আচ্ছা, যদি ছেলে জন্মালে জানতে পারেন যে ও বড় হয়ে হিটলার হবে, তখন কী করবেন?
মানে ওর মুখে নুন দিয়ে গঙ্গায় ভাসিয়ে দেবেন? নাকি আদরে বাঁদর পুষবেন?
না না, ভুল বুঝবেন না। আমার ছেলের নাম অ্যাডলফ হিটলার নয়। আর আমি কোন নর্ডিক আর্য নই, নেহাৎ ছাপোষা বাঙালি। একেবারে কালোকোলো। আমাকে দেখলে কেউ জার্মান বলে ভুল করবে না। কিন্তু দ্রাবিড় জাতি, মানে মদ্র বা মালয়ালি, ভাবতে পারে। একবার ছত্তিশগড়ের সায়েন্স কলেজে এক মালয়ালি ভদ্রলোক নিজের মেয়েকে ভর্তি করাতে এসে চেনাজানা লোক খুঁজছিলেন। আমাকে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে এসে ঝড়ের মত কী কী সব বলে গেলেন।
আমি অবাক হয়ে ভাবলাম –গাল দিচ্ছেন নাকি? দু’একবার তাঁর সঙ্গের লবঙ্গলতার দিকে তাকিয়েছি বটে, কিন্তু সেটা এমনকি অপরাধ? মেয়েটা বরং লাজুক হেসে প্রতিদান দিয়েছে। নিরুপায় হয়ে ভাঙা ইংরেজিতে ‘এক্সকিউজ মী, এবং পার্ডন পার্ডন কয়েকবার আওড়ালাম। সত্যিই কিছু বুঝতে পারছিলাম না। শেষে ওঁর ভেতরের টিউবলাইট জ্বলে উঠল। চোখ বড় বড় করে বললেন- নট ফ্রম কেরালা?
- নো স্যার। ফ্রম ক্যালকাটা।
উনি একগাল হেসে হাত বাড়িয়ে বললেন- আমি অ্যালেক্স রাজন। ঠিক আছে, আমার মেয়েকে ভর্তি করাতে এসেছি, বায়োলজি স্ট্রিম। একটুর জন্যে মেডিক্যালে চান্স পায় নি। ফের ট্রাই করবে। কিন্তু এ’বছর বিএসসি ফার্স্ট ইয়ারে পড়লে ওর ভালই হবে। আপনি কিছু সাহায্য করতে পারেন? মানে, কার সঙ্গে দেখা করতে হবে? কোন ডোনেশন লাগবে কিনা।
আমি তক্ষুণি মেয়েটির বড়দা হয়ে যাই এবং বলি- এটা সরকারি কলেজ এবং প্রিন্সিপাল সিনহা স্যার অত্যন্ত অনেস্ট, নো ডোনেশন! ওর ভাল রেজাল্ট, সহজেই হয়ে যাবে। চলুন, আমি হেড ক্লার্কের সঙ্গে কথা বলিয়ে দিচ্ছি যাতে ওর ফর্ম তাড়াতাড়ি প্রসেস করা হয়।
উনি বিগলিত হয়ে আমার হাত ঝাঁকাতে থাকেন এবং বলেন- বেঙ্গল এবং কেরল, দুটোর কমন ফ্যাক্টর আছে। দু’ রাজ্যেই বামপন্থী কালচার এবং ওই দুই রাজ্যের মেয়েরা ভারতের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর।
আমি এবার খোলাখুলি ওঁর মেয়ের দিকে তাকাই- সে কথা আর বলতে!
জানিনা, আজ দেখা হলে উনি কী বলতেন।
কিন্তু এর মধ্যে হিটলার কোথায়?
দাঁড়ান, দাঁড়ান, - আসছে, হিটলার আসছে।
কালের নিয়মে কলেজের পাট চুকলো, চাকরি পেলাম, বিয়ে হল। এবার তো ছেলে হবার কথা! মানে, আমার তো মেয়ে হলেই ভাল। কিন্তু কিছু একটা হোক। দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘোরে—তবু তোমার দেখা নাই রে তোমার দেখা নাই। ডাক্তার দেখানো হোল, আপাতদৃষ্টিতে শরীরের কলকব্জা, কেমিস্ট্রি সব ঠিক। তাহলে?
অর্ধাঙ্গিনী প্রতি শনিবারে উপোস রাখলেন। আমি শনি-মঙ্গল দু’দিন নিরামিষ খেতে লাগলাম।
কার আজ্ঞে? হাড়িপ বাবার আজ্ঞে। সেই বাবা আর কেউ নয়, গিন্নির বড়দা। উনি রেভিনিউ অফিসের বড়বাবু। মাইনে ছাড়া উপরি আছে। ভাল রোজগার। কিন্তু ভাল’র কোন শেষ নেই। বিদ্যার বিষয়ে ছোটবেলায় পড়েছিলাম—দানেন ন ক্ষয়ং যাতি বিদ্যারত্নং মহাধনম্!
‘যতই করিবে দান, তত যাবে বেড়ে’!
বড় হয়ে দেখলাম সব ফালতু কথা। নইলে যে স্যারেরা গাদাগুচ্ছের টিউশনি করেন বছর বছর—তারা সবাই এতদিনে বিদ্যাদিগগজ মহাধনুর্ধর হয়ে যেতেন। বরং ‘যতই খাইবে ঘুষ তত লোভ বাড়ে’- এটা একেবারে মোক্ষম। একবার খাওয়া শুরু করলে থামা যায় না—রোলার কোস্টার। কেউ বলতে পারে না যে অত টাকার ঘুষ হয়ে গেলে বা একটা গাড়ি এবং বাড়ি হয়ে গেলে খাওয়া বন্ধ করে দেব।
আমার বড়শালা শুরু করেছে ভাগ্যগণনা। স্থানীয় পত্রিকায় টাক মাথায় টুপি পড়ে দাড়ি রেখে একটা ছবি সহ বিজ্ঞাপন দেয়—সব জ্যোতিষ বার বার, চাঁদু শাস্ত্রী একবার। হ্যাঁ, চন্দ্রমোহন দাস এখন চাঁদু শাস্ত্রী। রোজ সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ স্নান টান করে তিলক লাগিয়ে আমার বাড়ির গ্যারেজের পাশে অ্যাসবেসটস এর ছাতওলা একটা কামরায় টেবিল সাজিয়ে টেলিফোন নিয়ে বসে থাকে। দু’ঘন্টা। হাত দেখে, কোষ্ঠিবিচার করে, পাথর ধারণ করতে দেয়। তাঁর পরামর্শের আওতায় - বিবাহ এবং বিচ্ছেদ, জন্ম ও মৃত্যু, চাকরি এবং সন্তান প্রাপ্তি, জমি কেনা, মারণ-উচাটন-বশীকরণ, সবই আছে। নিজের বোনকেও মাদুলি দিয়েছে, আমাকে দিয়েছে আংটিতে বসানো পাথর। দামটা আমিই দিয়েছি, নইলে ফলে না।
বুঝলাম ভাগ্যদেবীর দরবারেও নো ফ্রি লাঞ্চ।
তা শাস্ত্রী মশায়ের পরামর্শ মেনে চলার ফল হোক বা আমাদের কপাল- ছ’বছরের মাথায় আমাদের একটি সন্তান হল, এবং পুত্রসন্তান। ব্যস্ আমার স্ত্রীর হিস্টিরিয়া সেরে গেল। সংসারে সুখ-শান্তি ফিরে এল। আর বন্ধুদের সঙ্গে পুকুরে চান করতে গিয়ে আমার আঙটি হারিয়ে গেল। কোন মাছের পেটে গেছে কে জানে!
আঙটি হারানোর ফল হাতেনাতে পেলাম।
একমাসের মধ্যে আমার ট্রান্সফার হয়ে গেল অন্য জেলায়, ঘর থেকে অনেকটা দূর। গোড়ার দিকে প্রত্যেক শনিবারে বাড়ি আসতাম। কিছুদিন পরে সেটা মাসে একবার হয়ে গেল। বুঝে গেছি আমি যতই বিরহে জ্বলেপুড়ে ছাই হই না কেন, গিন্নির তাতে খুব একটা যায় আসে না। উনি তাঁর নতুন খেলনা আমাদের শিশু সন্তানকে নিয়ে ব্যস্ত। যখনই ফোনে কোন কথা বলি, সংসারের খোঁজখবর নিই ওনার মুখে খালি ছেলের কথা।
- জানো, আজ আমাকে মাম্মা বলেছে। আজ দুটো দাঁত উঠেছে, তাতে কী সুন্দর হাসে। আমায় দেখলে কোলে ঝাঁপিয়ে আসে।
গণ্ডগোল বাঁধল খোকার অন্নপ্রাশন দেবার সময়। মুখে ভাত দেবে কে? কেন মামা আছেন তো! সেটাই নিয়ম। সেসব হল। এবার বোনের আবদারে মামা বসলেন নবজাতকের কোষ্ঠী বিচার করতে, এতে সময় লাগে অনেক।
জন্মলগ্ন, গ্রহনক্ষত্র, সুতহিবুক যোগ, সাড়ে সাতি, বুধ কোথায় বক্রী, মঙ্গল কোন ঘরে বসেছে, সেই সময় শনি কী করছিলেন? কেতু দেবতার কতটুকু প্রভাব এই সব দেখে অনেক অংক কষে তবে না। বললে হবে? খর্চা আছে।
২ হিটলারের উদ্ভব
পরের মাসের গোড়ায় মাইনে পেয়ে সংসারের খরচা দিতে বাড়ি এলাম। হ্যাঁ, খোকাকে দেখব সেটাও একটা কারণ বটে। তাই দু’দিন সিএল নিয়ে এসেছি। রাত্তিরে খাওয়াদাওয়ার পর আমার খোকার ধর্মবাপ , মানে ওর মামু, ধোঁয়া গেলার অছিলায় আমায় ছাদে নিয়ে গেল। তারপর হাতের সিগ্রেট নিভিয়ে দু’বার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল- শোন রাজীব, একটা সিরিয়াস কথা।
আমি ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে। জানি, উনি সবসময় সিরিয়াস। কখনও হালকা কথা বলতে বা কোন চুটকি শোনাতে দেখি নি। হাসলে মুখটা একটু ফাঁক হয়, পুরো দাঁত দেখা যায় না।
- তোমার ঘরে এক অসাধারণ প্রতিভার জন্ম হয়েছে। খোকা বড় হয়ে এমন কিছু করবে যে ইতিহাসে ওর নাম থেকে যাবে।
আমার হাঁ-মুখ বন্ধ হয় না। আমার ঘরে কোন মহাপুরুষ! কী ভাবে? আমি তো খোকার জন্মের আগে আপনার বোনকে কাজু কিসমিস বা পুষ্টিকর কোন কিছু খাওয়াতে পারি নি। প্রোটিন বলতে ওই চারাপোনা আর তেলাপিয়া। পনের দিনে একবার পোলট্রির চিকেন, ফল বলতে কলা আর ডাঁসা পেয়ারা । নাঃ, আপেল, বেদানা, আঙুর, পেস্তাবাদাম ওসব আমার সিলেবাসের বাইরে ছিল। এরকম সাধারণ খাওয়া দাওয়ায় কি মহাপুরুষের জন্ম হয়?
- বাজে বোকো না। মহাপুরুষ নয়, ইতিহাসপুরুষ। ওর কপালে দুই ভুরুর মাঝখানে একটু উপরে একটা দাগ দেখেছ? ওটা রাজতিলকের চিহ্ন। ও হোল লীডার বাই বার্থ! ওর মধ্যে রয়েছে স্বাভাবিক নেতৃত্বের ক্ষমতা আর আর বীরত্ব।
- সে কী? ও কি আর একজন গান্ধীজি কি নেতাজি হবে? না না, আমি অমন চাইনে। এঁরা সবাই অপঘাতে মারা গেছেন- আততায়ীর পিস্তলের গুলিতে এবং প্লেন ক্র্যাশ হয়ে। আমি একজন ছাপোষা সাধারণ নিম্ন মধ্যবিত্ত। আমার ছেলে দীর্ঘদিন বেঁচে থাক। ভাল করে লেখাপড়া শিখে চাকরি করে খেয়ে পরে বাঁচুক এবং আমার বুড়ো বয়সে ওর বাবা মায়ের সহায় হোক। আর কিচ্ছু চাই না।
ও ভাল মানুষ হলেই যথেষ্ট। ইতিহাসের পাতায় নাম তোলার কোন দরকার নেই।
- শোন, সব পিতা চাইবেন যে তাঁর সন্তান তাঁকে ছাড়িয়ে যাক। গুরু চাইবেন- শিষ্যাদ্মিচ্ছেৎ পরাজয়ম্! শিষ্যের হাতে পরাজয়। এটাই সনাতন ভারতের পরম্পরা। আর ভারত কেন, গোটা বিশ্বেও তাই। দেখ, সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটো, তাঁর শিষ্য অ্যারিস্টটল। আবার অ্যারিস্টটলের শিষ্য আলেকজান্ডার হলেন কর্মযোগী, বিশ্ববিজয়ী।
এভাবেই সভ্যতা এগিয়ে চলে। তোমার ছেলেকে তোমারই মত ভেতো বাঙালি করে বড় করতে চাও?
বুঝে ফেললাম আমার বিশ্ববিজয়ী পুত্রের গুরু অ্যারিস্টটলটি কিনি? খালি গুরুর দক্ষিণা কত সেটা ক’দিন পরে জানা যাবে। একদিকে ভালই হোল। আমার বদলির চাকরি। খোকাকে সময় দেয়া, ওকে অংক, ইংরেজি শেখানো এবং হোমটাস্ক করিয়ে দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
তা খোকাকে কি এনসিসি করাতে চান? গাড়ি ও বন্দুক চালানো?
- তোমার যত ছোট চিন্তা! ও কি পুলিশ হবে না সাধারণ সৈনিক? ও হবে কম্যান্ডার। ওকে নিজে হাতে বন্দুক চালাতে হবে না। ও স্ট্র্যাটেজি বানাবে, প্ল্যানিং করবে। তার জন্য দরকার উর্বর মস্তিষ্ক এবং চরিত্রনির্মাণ। ও তোমার যত বদ অভ্যেস সব এড়িয়ে চলবে। সিগ্রেট খাবে না, মদ ছোঁবে না, মেয়েদের পেছনে ঘুরঘুর করবে না। যাবনিক আদবকায়দার বদলে আমাদের সনাতন রীতিনীতি আত্মস্থ করবে।
যেমন, “মাতৃবৎ পরদারেষু পরদ্রব্যেষু লোষ্ট্রবৎ”। ও ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের মাতৃবৎ ভাববে এবং নির্লোভ হবে।
- মরেছে! সব মেয়েদের মা ভাবলে ও বিয়ে করবে কী করে? আপনি কি চান ও আজীবন ব্রহ্মচারী থাকুক, আনন্দমঠের সন্ন্যাসীদের মতন? তাহলে আমার বাড়িঘর কার জন্যে? বুড়ো বয়সে আমাদের দেখবে কে?
- এখন থেকেই নাকে কান্না শুরু করলে? আরে বড় হয়ে নিশ্চয়ই বিয়ে করবে কোন মেয়েকে। কিন্তু বাকি সব মেয়ে ওর জন্যে মাতা অথবা ভগিনী হবে। কোন গার্লফ্রেন্ড-ট্রেন্ড নয়। একটা বয়সে ল্যাঙোট কষে বাঁধতে হয়। তোমার মতন ঢিলেঢালা হলে---।
এবার আমার রাগ হোল। উনি আমার মধ্যে বেচাল কী দেখলেন? ওনার বোনকে কখনও ঠকিয়েছি? বেপাড়ায় গেছি? হ্যাঁ, বিয়ের আগে একটু টুং টাং ফুং ফাং কার না থাকে?
যাক গে, সবাই জানে যে ম্যান প্রোপোজেস্ , ওম্যান ডিস্পোজেস্। কাজেই গিন্নির বড়দার অভিভাবকত্বে ‘নন্দের আলয়ে কৃষ্ণ দিনে দিনে বাড়ে’- এমনটাই হবে।
কিন্তু বড়দা, আপনার কল্পনা তো ঠিক আলেকজান্ডারের সঙ্গে মিলছে না। উনি তো নিজে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতেন, হাতিয়ার চালনায় পারঙ্গম ছিলেন। তাহলে আপনার ভাগ্নের জন্যে রোল মডেল কাকে ভেবেছেন? অবশ্যি নরাণাং মাতুলঃ ক্রমঃ। আপনি থাকতে--।
বড়দা মিটিমিটি হাসেন। সবুরে মেওয়া ফলে।
হায়, তখন যদি একটু খতিয়ে দেখতাম। আমার কুলপ্রদীপ!
৩ হিটলারের বিকাশ
রাশি নক্ষত্র মিলিয়ে খোকার নাম রাখা হল রামচন্দ্র। ভর্তি করা হোল কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে- সোজা কথা! কোন প্রাদেশিকতার ছাপ ওর মামাবাবুর অপছন্দ।
- কিন্তু দুদিনে ও পাড়ার লোকের মুখে রামু হয়ে গেল, আর বন্ধুরা ডাকল রেমো বলে। স্কুলে কিছু হিন্দি অঞ্চলের ছেলে এসেছে। ওরা ওকে দেখলেই “রাম নাম সত্য হ্যায়” বলে আওয়াজ দিচ্ছিল। তখন খোকাকে ভর্তি করা হল গুরুকুলে, তার অন্যতম ট্রাস্টি হলেন ওর মামাবাবু। ওর স্কুলের খাতায় নাম হল বিজয়প্রতাপ।
আমি বললাম বাঙালিদের অমন নাম কখনও শুনিনি।
- অনেক কিছুই শোননি। এবার শুনবে, একদিন এই নাম ইতিহাসের পাতায় উঠবে। একদা বিজয় সিংহ হেলায় লংকা জয় করে পাঠ্যবইয়ের কবিতায় জায়গা পেয়েছেন।
মামাবাবু ভুল বলেন নি। ক্রমে ক্রমে খোকার মধ্যে শৌর্য বীর্য নেতৃত্বের ক্ষমতা সব প্রকট হোল। কয়েক বছর পরে এক শনিবারে বাড়ি ফিরে দেখি খোকা নেই। গিন্নি কাঁদছেন। কী হল রে বাবা!
- ওকে পুলিশে ধরেছে। তুমি কিছু কর।
জানলাম, ওকে থানায় আটকে রেখেছে। তবে আমাকে কিছু করতে হয় নি। খানিকক্ষণ পরে ও ফিরে এল সঙ্গে ওর দ্রোণগুরু। মামাবাবু বন্ড ভরে ওকে ছাড়িয়ে এনেছেন। হাজার হোক ও জুভেনাইল, এখনও গোঁফ গজায় নি।
ছেলে ফিরল বীরদর্পে, যেন কিছুই হয় নি। একেবারে ‘হেলায় লংকা করিল জয়’ মোডে। মামাবাবুর মুখ গর্বে উদ্ভাসিত। শিষ্য একটা কাজ করেছে- কাজের মতন কাজ!
- বুঝলে! কাল রাত্তিরে বিজয়প্রতাপ পাঁচটা ছেলের সঙ্গে গিয়ে ঢিল ছুঁড়ে পাশের পাড়ায় যে মসজিদ রয়েছে তার কাঁচ ভেঙেছে, বারান্দায় নোংরা ফেলেছে।
আমি স্তম্ভিত, কেন করলি খোকা? এসব কী পাগলামি!
- খোকা নয়, ও বিজয়প্রতাপ। উচিত শিক্ষা দিয়েছে ম্লেচ্ছদের।
মানে? ওদের অপরাধ?
- বাঃ , ওরা বাংলাদেশে আমাদের মন্দির অপবিত্র করেনি? ভাঙচোর চালায় নি? এবার বুঝুক কত ধানে কত চাল!
- বেশ, ওরা গু খেলে তুই গু খাবি? ওরা কুয়োয় ঝাঁপ দিলে তুইও তাই করবি? এ বুদ্ধি তোদের কে দিল?
খোকা বিপন্ন মুখে গুরুর দিকে তাকায়।
- ছেলের সঙ্গে ভদ্রভাবে কথা বল। ও আর দশটা ছেলের মত নয়। লুকিয়ে ধোঁয়া গেলে না, পানু পড়ে না। বরং সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে।
- কী করতে? ঢিল ছুঁড়ে মসজিদের কাঁচ ভাঙতে?
- আরে এটা সামান্য ব্যাপার। ও সবাইকে শেখাচ্ছে ধর্মযুদ্ধের জন্য তৈরি হতে।
ধর্মযুদ্ধ?
- হ্যাঁ বাবা। যুদ্ধ তো চলছে, কয়েক শতাব্দী ধরে। তোমার মত বাঙালিরা চোখ বুঁজে থাকলে কী হবে?
- সেরেছে! তা তোর যুদ্ধ কাদের বিরুদ্ধে?
- যারা আমাদের মানে হিন্দুদের অসম্মান করে, আমাদের ধর্ম নিয়ে ইয়ার্কি করে তাদের সবার বিরুদ্ধে। হিন্দুস্থান দেশটা আমাদের, মানে হিন্দুদের- সেটা ভুলে যাচ্ছ কেন?
- ওরে বাবা! দেশটার নাম ভারত, ইংরেজিতে ইন্ডিয়া। সংবিধানের প্রথম লাইন, প্রথম আর্টিকল।
- ওসব আইনের কচকচি। দেশ চলে জনগণের আবেগে, ভালবাসায়। আমরা কি সাধারণ কথাবার্তায় দেশকে হিন্দুস্থান আর কালোয়াতি গানকে হিন্দুস্থানি সঙ্গীত বলি না? জ্যোতিবাবু কি হিন্দুস্থান পার্কে থাকতেন না? আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের বইয়ের নাম কি ‘হিন্দু কেমিস্ট্রি’ নয়?
এবার গুরু ময়দানে নেমেছেন। মামাভাগ্নের যুগলবন্দীতে আমি কুপোকাৎ। আমাকে চুপ করতে দেখে খোকার উৎসাহ বেড়ে যায়।
- আচ্ছা বাবা, তুমিই বল। সংবিধানে মন্ত্রীদের শপথ নেবার সময় ঈশ্বরের নামে শপথ নেবার নির্দেশ রয়েছে না? তাহলে। কোন আল্লা বা যীশুর নাম তো নেই?
--এবার তুই একটু শোন। ইংরেজিতে ‘গড’ বলা হয়েছে যার মানে ভগবান, আল্লাহ্ যীশু সবই হতে পারে, যার যেমন বিশ্বাস।
--ওসব তো নেহরুদের বিলিতি কায়দার ফল। কিন্তু কোন না কোন ভগবানের নাম তো নিতেই হবে। সেকুলার শব্দটা ইন্দিরা জরুরী অবস্থার সময় জোর করে ঢুকিয়েছিলেন।
--না বড়দা। শপথ নেবার আর্টিকলে একটা ‘অথবা’ রাখা হয়েছে। তাতে বলা আছে কেউ চাইলে “ঈশ্বরের নামে শপথ করছি” না বলে বলতে পারেন “I solemnly affirm that”, মানে আমি দৃঢ় নিশ্চয় হয়ে বলছি।
তাই সুপ্রীম কোর্ট সেকুলার শব্দটা খারিজ না করে বলেছে আমাদের সংবিধান এবং রাষ্ট্র গোড়া থেকেই ভাবনায় ‘সেকুলার’।
এবার খোকা কেমন মিইয়ে গিয়ে মামাবাবুর দিকে তাকিয়ে চোখ নামালো। আমার ওর জন্য কষ্ট হল। কথা ঘোরাতে বললাম- ওসব কচকচি থাক। বল, তুই ছাড়া পেলি কীভাবে?
- পুলিশের তদন্তে বেরিয়েছে ও আসলে ইঁট ছোঁড়েনি, ভাঙচুর করেনি। ইন ফ্যাক্ট, ওতো মসজিদের আঙিনায় ঢোকেনি। ও তখন সামনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল।
- তাহলে ভাঙচুর করল কারা?
- কেন, বাকি চারজন। ওরা দোষ স্বীকার করেছে।
- বুঝলাম, ওদের নিয়ে গেল কে?
- কেউ নয়। ওরা নিজে থেকেই দল বেঁধে গেছে। ওরা স্টেটমেন্ট দিয়েছে তো, সাইন করে।
- খোকার নাম নেয়নি? একজনও না?
- কেন নেবে? ও হোল লীডার, ওকে ঝামেলা থেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ওকে পদাতিকদের সঙ্গে এক করে দেখলে চলবে? যুদ্ধ চলবে নিরন্তর।
- ওরা ছাড়া পেয়েছে?
- এখনও পায় নি। কাল জুভেনাইল কোর্ট বিচার করবে। বাবা মা জামিন হয়ে ছাড়িয়ে আনবে। ওদের জন্য চিন্তা করতে হবে না।
- আমি এখনও বুঝতে পারছি না। ওই বাচ্চাছেলেগুলো মুখ বুঁজে রইল? বিজয়প্রতাপ শব্দটা একবারও বলল না? এমন আনুগত্য?
- উফ, নাথুরাম গোড়সে, গোপাল গোড়সে, কারকারেরা কি সাভারকরের নাম নিয়েছিল? উনি যে কম্যান্ডার! আরও আগে লন্ডনে ছাত্র অবস্থায় সতেরো বছরের মদনলাল ধিংড়া যখন কার্জন-উইলি এবং একজন পার্শি ডাক্তারকে হত্যা করে ফাঁসিকাঠে চড়ল তখন কি একবারও সাভারকরের নাম উচ্চারণ করেচিল? উনি ওকে পিস্তল দিয়ে বলেছিলেন- মেরে এসো; ব্যর্থ হলে আর আমাকে মুখ দেখিও না।
এই হোল লীডারশিপ কোয়ালিটি- প্রশ্নহীন আনুগত্য সবাই পায় না। আমার ভাগ্নের মধ্যে রয়েছে।
- বড়দা, আপনি ওকে সাভারকর বানাতে চান? কী দরকার?
- শোন, এ’কথা যেন পাঁচ কান না হয়। ও আরও বড় কাজ করবে। সাভারকরের অসমাপ্ত মিশন সম্পূর্ণ করবে।
- কী সেই মিশন?
- হিটলারের জার্মানি ১৯৩৮ সালের মার্চ মাসে অস্ট্রিয়া দখল করায় সাভারকর হিটলারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এটা ওনার চোখে জার্মানির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার উদাহরণ। মনে করলেন এই ভাবেই ‘হিন্দু ভারত’ ঐক্যবদ্ধ হতে পারে ।
- খেয়েছে, আপনি ওকে মেইন ক্য্যাম্ফ ধরিয়েছেন। অত মোটা বই!
- না না। প্রথম দু’শ পাতা পড়িয়েছি। এখন ওতেই চলবে। আচ্ছা, এখন খেতে বস। বিজয়প্রতাপের খিদে পেয়েছে।
৪ জয়-পরাজয়
রাতে খেতে বসে ফের লেগে গেল বড়দা, থুড়ি অ্যারিস্টটলের সঙ্গে। দোষের মধ্যে আমি বলেছিলাম ওকে নিজের মত বড় হতে দিন না! কেন নিজের পছন্দের ছাঁচে গড়ে তুলতে চাইছেন? এইসব ইতিহাসপুরুষ, সিদ্ধপুরুষ হ্যানো পুরুষ ত্যানো পুরুষ হওয়া অনেক চাপ। শেষে ওর ব্যক্তিত্ব দড়কচ্চা মেরে না যায়! এমন কি বীর হওয়ার চেষ্টায় কোন অপরাধ --!
আর হিটলারের আত্মজীবনী?
সবটা পড়ান। পাঁচশ পাতার পর দেখুন হিটলার কী অবজ্ঞার চোখে ভারতীয় জাতি এবং বিপ্লবীদের দেখতেন। ওদের বৃটিশ সাম্রাজ্যের অধীন হওয়াই ভবিতব্য বলেছেন এবং নেতাজির প্রতিবাদ ও অনুরোধ সত্ত্বেও ওই লাইনগুলো বাদ দেওয়া হয় নি।
ব্যস্ ফুটন্ত তেলে জলের ছিটে পড়ে চিড়বিড় শব্দ।
আমি খাওয়া ছেড়ে উঠে পড়লাম।
ঘুম আসছে না। ভাবতে লাগলাম এসব কী হচ্ছে? আমার খোকা হিটলারকে রোল মডেল ভাবছে? ও বড় হয়ে ভারতে হিটলারের ক্লোন হবে! আমার কী করা উচিত? আচ্ছা, ওই মামাবাবু যদি হঠাৎ টেঁসে যান!
হার্টের সমস্যা আছে। সুগার এবং প্রেসার দুটোর ওষুধ খান নিয়মিত। ভগবানের কোন ভুলে যদি এক দিন প্রেসারের ওষুধের ডোজ বেশি হয়ে যায়! অথবা ওনার ওষুধের শিশিতে ট্যাবলেটগুলো বদলে দেয়া হয়? অনেকটা একইরকম দেখতে অনেক ট্যাবলেট আছে। মেডিকোপিডিয়া ঘাঁটতে লাগলাম। দেখতে একইরকম, বিস্বাদ নয় অথচ হার্টফেল হতে পারে এমন ওষুধ?
আছে আছে। পাওয়া গেছে।
কিন্তু নেটফ্লিক্সের সিনেমা হয়ে যাচ্ছে না? তাতে তো শেষ মুহুর্তে অপরাধী ধরা পড়ে যায়। আমি জেলে গেলে গিন্নি ও খোকার কী হবে? সংসার ছারেখারে যাবে। তারচেয়ে বড় কথা হোল খোকার চোখে ওর গুরু শহীদ হয়ে যাবে, আর আমি ভিলেন।
নাঃ এ চলবে না।
ভোরের দিকে ঘুম এল এবং ঘুমের মধ্যে সমাধান। কেউ হিটলার হয়ে জন্মায় না। ওসব বাজে কথা। শিশু শিশুই থাকে। কাঁথায় শুয়ে হিসু করে, ওঁয়া ওঁয়া করে কাঁদে এবং ফোকলা মুখে খিলখিলিয়ে হাসে।
উপসংহার
সকালে রওনা হবার আগে স্ত্রী-পুত্রকে ডেকে পাশে বসালাম। বললাম- আমি আর হাত পুড়িয়ে খেতে পারছি না। বয়েস হচ্ছে। একটা দু’কামরার ভাড়াবাড়ি ঠিক করেছি। তোমাদের আগামী সপ্তাহে এসে নিয়ে যাব। খোকাকে ওখানকার ভালো সরকারি স্কুলে ভর্তি করে দেব। আমরা একসঙ্গে থাকব, আর আলাদা নয়। তোমরা গোছগাছ শুরু করে দাও। টিসি’র ব্যবস্থা বড়দা করে দেবেন। আমি নতুন ভর্তির ব্যাপারটা দেখছি।
সাতদিন পরে বাড়ি যাওয়া হয় নি, অফিসের চাপ। কিন্তু পরের মাসের মাইনে পেয়ে ভাড়াবাড়ি ঠিক করে ওদের আনতে গেলাম। গিয়ে দেখি কোথায় কী? কোন গোছগাছ হয় নি, সব আগের মত চলছে। খোকা বাড়িতে নেই।
গিন্নি চায়ের কাপ নিয়ে এসে বললেন- শোন, আমাদের খোকাকে এখন এক ডাকে সবাই চেনে। শুধু এ তল্লাটে নয়, পুরো মহকুমায়।
- কেন?
- ওদের স্কুলে একজন মাস্টারমশাই আছেন না? আরে তোমার বন্ধু, যিনি বিয়ে করেন নি। তাকে বেধড়ক ঠেঙিয়েছে। উনি নাকি চরিত্রহীন। মানে ওই হোমো না কীসব বলে। আর কেমিস্ট্রির সুধীনবাবু ও ইংরিজির ফিরদৌসি লাভ ম্যারেজ করেছিল। খোকা সমস্ত ছাত্রদের নিয়ে আন্দোলন করে- এমন লুজ ক্যারেক্টার টিচারদের গুরুকুলে রাখা হলে ওরা পড়বে না। এসব সনাতন আদর্শের সঙ্গে বেমানান।
- সর্বনাশ! ফের পুলিশের খাতায় নাম? ওর ভবিষ্যৎ অন্ধকার। এইজন্যেই বলেছিলাম যে-
- আরে না না। ওসব কিছু হয় নি। পুলিশ ফুলিশের ঝামেলা নেই। কেউ নালিশ করেনি তো। সেই দু’জন টিচার গত সপ্তাহে গুরুকুল থেকে রিজাইন করে এখান থেকে চলে গেছে। আর খোকাকে এখন সবাই বিজয়প্রতাপ নামে চেনে।
- খোকা কোথায়? ওর সঙ্গে কথা বলব।
- কেন? ও তোমার সঙ্গে যাবে না। স্কুল বদলাবে না। ওদের প্রভাত ফেরি শুরু হয়েছে। ওরা জিতে গেছে তো! চল ছাদে গিয়ে দাঁড়াই। ওরা আসছে।
একশ’ জন ছেলে হেঁটে চলেছে। সামনে দু’জন ড্রাম বাজাচ্ছে। সমবেত কন্ঠে একটা গান বাতাসে ভেসে আসছে।
“ধাও ধাও সমরক্ষেত্রে, গাহ উচ্চে রণজয় গাথা,
রক্ষা করিতে পীড়িত ধর্মে ওই শোন ডাকে ভারতমাতা।
চল সমরে দিব জীবন ঢালি, জয় মা ভারত, জয় মা কালী।”
হ্যাঁ, হিটলারের মৃত্যু নেই।