ছবি: ঈপ্সিতা পাল ভৌমিক
সারা বর্ষা গ্রীষ্ম বসন্তে কেউ দেখতে পায়না লোকটাকে। শুধু এই শীতের সকালে একটু একটু করে সূর্যের রশ্মি যখন ছড়িয়ে পড়ে সারা পাড়ায়, দরমার বেড়ার একপাশে উইধরা খয়াটে বাতার দরজাটা ঠেলে আস্তে আস্তে সে বাইরে আসে। মাথা থেকে পা পর্যন্ত নানা কাপড়ে ঢাকা শরীর। ছেঁড়া শার্টের ওপর ময়লা ধূসর পাঞ্জাবি, মাফলার দিয়ে মাথা ঢেকে তার ওপর একটা শাড়ি পাগড়ির মত করে প্যাঁচানো। যা কাপড় যেখানে পেয়েছে তাই চাপিয়ে, একটা রিলিফের কম্বল সারা গায়ে জড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে বাইরের ধারিটায় এসে রোদে বসে। পেছন পেছন ছোট ছেলেটা আসে একটা এলুমিনিয়ামের তোবড়ানো পিকদানী আর চটের আসন নিয়ে। থুতু রাস্তায় ফেলত আগে, সারাবেলার শ্লেষ্মা ধুলোয় মাখামাখি হয়ে ছোপ ছোপ পড়ে থাকত সামনের চলাফেরার রাস্তা জুড়ে। মোটের ওপর পরিচ্ছন্ন ভদ্র পাড়া, চলাচলের সদর পথ এরকম নোংরা হয়ে থাকে বলে অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করতে থাকে, বেখেয়ালে পায়ে লেগে গেলে ঘেন্নার একশেষ। সবার অভিযোগে শেষে এই পিকদানীর বন্দোবস্ত করতে হয় বাড়ির লোককে। আসন পেতে বাপকে পিকদানী দিয়ে বসিয়ে, ছেলেটা বাড়ির ভেতরে অন্য কাজে চলে যায়।
দুই ছেলে, এক মেয়ে আর আধ পাগলা এক বিধবা বোনকে নিয়ে হারু পালের সংসার। বউ অনেককাল হল শহরের এক বড় বাড়িতে রান্নার কাজ নিয়ে বাড়িছাড়া। সংসার তার টাকাতেই চলে ইদানীং। হারু নিজে তো কোনকালেই কোনো রোজগার করেনি তেমন। বয়সকালে এদিক সেদিক করে যাও পয়সা করত কিছু তা সংসারে ঢুকত না কখনো, নিজের বড়োমানুষিতেই চলে যেত সেসব। তার সাজের ভারী ঘটা ছিল, এছাড়া সবরকমের নেশা ভাং বদ সঙ্গের যা দোষ সবই তার ছিল ষোলোআনা। তার কারণেই সংসারের আজ হাঁড়ির হাল। এপাড়ায় মোটামুটি সবারই স্বচ্ছল অবস্থা, তার মাঝে পাড়ার একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে ভাঙ্গা বেড়া আর ইটের পাঁজর বের করা এই বাড়িটা কেমন যেন বেমানান লাগে, সবার থেকে আলাদা। ঋতুরঙ্গে, শোকে উৎসবে, পাড়ার কোনো কিছুতেই এদের কারোকে অংশ নিতে দেখা যায়না।
অর্ধেক ইঁট আর অর্ধেক ছিটেবেড়ার জীর্ণ পুরনো বাড়ি, তার সংলগ্ন মাটির ধারি। পাড়ার মূল যাতায়াতের পথের ধারে এই ধারির ওপর শীতভর দিনের বেলা হারুকে বসে থাকতে দেখা যায়। এইসব দিনে লোকজন ওই জায়গাটুকু না দেখা করেই পার হয়ে যায়। বিরক্তিতে তাদের কারুর ভ্রু কুঁচকে থাকলেও থাকতে পারে, মুখে কেউ কিছু এ নিয়ে খুব একটা বলেনা। যতই হোক, যেমনই হোক, পাড়ার জ্ঞাতি গোত্রর মধ্যে, ফেলে তো দেওয়া যায়না। আর যায়না বলেই মাথারা কেউ কেউ পার্টির লোকেদের বলে কয়ে বোনটাকে প্রাইমারী স্কুলে মিড ডে মিলের রাঁধুনির কাজ করে দিয়েছিল। তখনো বউটা কাজে বেরোয় নি, ছেলেমেয়ে ছোট, হারু কী এক রোগ বাধিয়ে শয্যাশায়ী প্রায়।প্রথমে ওর বউকেই কাজে লাগিয়ে দেওয়ার কথা হয়েছিল। কিন্তু ছেলেমেয়েগুলো একেবারেই ছোট, কোলেরটা তো দুধের শিশু তখন, তারওপর বউটা ছিল খুব মুখচোরা, হারুর ভয়ে সিটিয়ে থাকত সবসময়। বোনটা একটু খামখেয়ালী, কিন্তু এরকম পাগলাটে তা তখন কেউ বুঝতে পারেনি, তাই শেষমেশ পরামর্শ করে তাকেই কাজটা দেওয়া স্থির হয়েছিল।
তা সে বোন তো অর্ধেকদিন কাজেই যেতনা, গেলেও উল্টোপাল্টা কান্ড করে বসত, নুন দিতে চিনি দেয়, ভাত পুড়িয়ে ফেলে। শেষে অন্য ঠিকে বদলি লোককে দিয়ে কাজ চালাতে হত বেশিরভাগ দিন। এখনো সেই ব্যবস্থাই চলছে, পয়সাকড়ি সব তারাই নিয়ে নেয়। শুধু চেষ্টা চরিত্র করে খাতায় নামটা এখনো হারুর বোনের আছে।দু একজন একটু নরম মনের প্রতিবেশি যারা আছে তারাই এ ব্যবস্থাটুকু করেছে, এই আশায় যে বড়মেয়ে দুর্গা সেয়ানা হয়ে পিসির কাজটা ধরে নেবে একদিন।
এরই মধ্যে দেখা গেল যে বউটা তার বাপের বাড়ির কাকে ধরে লোকের বাড়ির রান্নার কাজ যোগাড় করে শহরে চলে গেল। ততদিনে দুর্গা অনেকটাই সংসার আর ভাইয়েদের দেখতে শিখে গেছে, তার মা মেয়ের ভরসায় ছেলেদের রেখে গেল। হারু এ নিয়ে শুরুতে কিছুদিন তড়পে ছিল খুব, তবে মাস গেলে টাকা আসতে শুরু করলে, সেও আস্তে আস্তে ব্যবস্থাটা মেনে নিল। আর যাই কিছু হোক এখন অন্তত দু বেলার ভাতটা ঠিকঠাক জুটছে ওই রোজগারের কারণে।
পথ চলতি লোকেদের কারুর সাথে হারুকে তেমন কথা বলতে দেখা যায় না। চিরকাল সবার ওপরেই তার রাগ, কেউ তার মেলামেশার যোগ্য নয়। একরকম বলতে গেলে লোকেও তাকে এড়িয়েই চলে, সেও লোকজন সইতে পারেনা। আর কথা বলবে কী, সারাবেলার বেশিরভাগ সময়টাতেই তো সে কাশতে আর কফ ফেলতেই ব্যস্ত থাকে। গোপন কাশরোগের খবরটা যদিও এতকাল অসমর্থিতই রয়ে গেছে, ভবেশ ডাক্তার এ নিয়ে আজ অবধি কারু কাছে মুখ খোলেনি, সরাসরি জিজ্ঞেস করলেও এড়িয়ে যায়। তবু পাড়ার ছেলেপিলেদের মায়েরা তাদের বাচ্চাদের, ওই ধারি আর বাড়ি দুই থেকেই দূরে দূরে রাখে, সব কালেই। অন্যরাও এ বাড়িতে সচরাচর পা দেয় না এক ওই ভবেশ ডাক্তার ছাড়া।
হারু ভবেশের ছেলেবেলার বন্ধু, মাঝে মাঝে সেই ঢোকে দরমার বেড়ার ওপারে অন্ধকার ঘরের অন্দরে। দরকারী ওষুধপত্রও দিয়ে যায় নিয়মিত, বিনাপয়সায়। হারুর রোগ সম্পর্কে সাধারণ লোকে জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে না। তবে পাড়ার মাতব্বরেরা কখনো জানতে চাইলে, আকাশের দিকে তাকিয়ে দার্শনিকের মত নির্লিপ্ত গলায় জবাব দেয়,
“এতকালের অনাচারের ফল, নানা ব্যাধি বাসা বেঁধেছে ওর দেহে, রোগ কী আর একটা খুড়ো!”
ভদ্রলোকের পাড়া, গ্রামের প্রাচীন ডাক্তার, ভরসার জন, তাকে আর এ নিয়ে কেউ জেরা করে কথা বাড়াতে সাহস করে না।এতকাল ধরে তাই ক্ষয়রোগের ব্যাপারটা অমীমাংসিতই থেকে গেছে, সঠিক প্রমাণের অভাবে। এ নিয়ে পক্ষে বিপক্ষে নানা সময়ে নানা আলোচনা বিফল হলেও, মহিলাদের তরফ থেকে কিছু সাধারণ নিয়ম বেঁধে দেওয়া আছে, বিশেষ করে ছোট ছেলেমেয়েদের জন্যে। যথা, ওদের বাড়ি থেকে কোনো খাবার দিলে কেউ খাবেনা, অথবা খেলতে গিয়ে হারু পালের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আম কুল আচার ইত্যাদি ভাগ করে খাওয়া বা তাদের এঁটো যেন ভাগ করে না খায়, ইত্যাদি।
যদিও এসব সাবধানতা অবলম্বন করার খুব একটা দরকার ছিল না, ওবাড়ির ছেলেমেয়েদের কখনো দলে খেলতে আসতে কেউ দেখেনি। ছোটবেলা থেকে তাদের, খেলার সময় বা শক্তি কোথায়? ঠিকমত খাওয়া না জুটে অপুষ্টিতে রোগাভোগা বাচ্চা তিনজন। বেশিরভাগ সময় মা বা পাগলি পিসির সঙ্গী হয়ে খাবার বা জ্বালানি জোটাতেই কেটে গেছে তাদের খেলার বেলা। আর যাদের নিজেদেরই খাবারের সংস্থান অনিয়মিত, তারা অন্যদের খাবার ভাগ দেবে কোত্থেকে!
তবে ওদের মা যে করেই হোক বড় দুটোকে ইস্কুলে পাঠিয়েছে। দুজনেই শেষ অবধি মাধ্যমিক পাস করেছে, পাস ফেলের কড়াকড়ি আজকাল আর তেমন নেই বলেই বোধহয় সম্ভব হয়েছিল। হারু তাও আগে মাঝেমাঝে শহরে গিয়ে টুকটাক রোজগার করত, তবে সে তার নিজের ওপরেই খরচ হয়ে যেত, সংসারে কোনো সুরাহা হত না।দেখতে একসময় খুবই সুপুরুষ ছিল, লোকজন প্রথম দর্শনে তাই বিশ্বাস করে কাজ দিয়ে ফেলত, যতদিন না তার অকর্মণ্যতার পরিচয় প্রকাশ পেত।
শেষবারের অসুখের পর হারু যবে থেকে পাকাপাকি ঘরে বসে গেছে, তবে থেকে ছোট ছেলেটার তার ফাইফরমাস খেটেই দিন কাটে। এই সময়টাতেই ওদের মাও কাজ নিয়ে চলে গেল, তাই ইস্কুলে যাবার তাড়া দেবারও কেউ রইল না। দুর্গার ওপর মা ভার দিয়ে গিয়েছে ছোট ভাইকে ঠিকঠাক দেখে পড়িয়ে ইস্কুলে পাঠানোর। দুর্গা এমনিতে খুবই ভালো মেয়ে, শান্ত স্বভাবের, বাধ্য। সে জানে তার ভরসাতেই মা ভাইয়েদের রেখে বাইরে কাজে বেরিয়েছে, কিন্তু সমস্যা হল সে বাপের অন্ধ ভক্ত। বাপ যদিও তাকে তেমন পাত্তা দেয়না, মেয়ে দেখতে মায়ের মত, অসুন্দর, স্বভাবেও একইরকম, সাত চড়ে রা কাটেনা। এরকম মিনমিনে স্বভাবের মানুষ হারুর পছন্দ নয়। বড় ছেলে কাজল তার পছন্দের, ছেলেরা দুজনেই বাপের রূপ পেয়েছে, কাজল আবার কিছুটা মেজাজও।
বাবা ছোট ভাইকে ইস্কুল যেতে না দিলে, দুর্গা বাবার ওপর কথা বলতে পারে না। ক্লাস সেভেন থেকে এইটে উঠল না গতবার, পাস ফেল নেই তবুও, স্কুলেই যায় নি সারা বছর, মাস্টারেরা রাজী হল না ক্লাসে ওঠাতে। কাজল এখন শহরে থাকে, মামাবাড়ির ভানুমামা, যে মাকে বাবুদের বাড়ি কাজে লাগিয়েছে, সেইই কাজলকে নিয়ে শহরে তার কাছে রেখেছে। মায়ের বাবুরা বলেছে কাজল বারো ক্লাস পাস করলে তাকে ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি হওয়ার স্কুলে ভর্তি করে দেবে। সেখান থেকে কাজ শিখে একবার বেরোলে কোনোদিন আর রোজগারের অভাব হবে না। হারু পাল কাজলকে ছাড়তে চায়নি, কিন্তু কাজল একরকম জোর করেই কাউকে কিছু না বলে মায়ের কাছে চলে গেল। এখানে থাকলে বাবা আর পড়তে দিত না যেমন দুর্গাকে দেয়নি, ছোট ভাইটাকে দিচ্ছে না।
ছোট ভাইটাও শান্ত প্রকৃতির। সে আবার খুব পিসির ন্যাওটা, ইস্কুলে যেতে তার নিজেরও খুব একটা আগ্রহ নেই। খেপী পিসির সঙ্গে সঙ্গে থাকে, রান্নাঘরের কাজে, যখন দিদি বাড়ি থাকেনা। নাহলে পিসি যে কী অঘটন করে ফেলবে তার ঠিক নেই। সকালে দুর্গা যায় দু চারটে টিউশন করতে, এছাড়া কোনো কোনো দিন ইস্কুলে রান্নার কাজে সাহায্য করতেও যায়, যাতে সেখানকার লোকজনদের নজরে পড়ে পিসির কাজটা তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এইসময় ভাইটা বাড়িতে থাকে বলে সে নিশ্চিন্তে বাইরে যেতে পারে, নাহলে পাগল পিসি আর মেজাজি বাবা দুইয়ে মিলে কী যে করবে সেই ভাবনায় তার আর বেরনোই হত না। অথচ রোজগারের চেষ্টা করতেই হয়, মায়ের ওই কটা টাকায় দুবেলা ভাত হয়, কিন্তু সংসারে খরচের কী শেষ আছে। বাবার পান বিড়ির নেশা আছে, তেল সাবান আছে, তাছাড়া দিন দিন যা জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। আজকাল তো মেয়েরা ইস্কুলে পড়লে কী সব টাকা দিচ্ছে কিন্ত সে তো তার আগেই পাস করে পড়া ছেড়ে বসে আছে!
রোদ চড়তে থাকলে ছোট ছেলেটা ভেতর থেকে মাঝে মাঝে বাইরে এসে এক এক পরত পোশাক খুলে দিয়ে যায়। ধারিতে দু একটা কাঁথা রোদে মেলা থাকে। কোনো দিন পিসি রেশনের নোংরা গম বা ক্ষুদের চাল ধুয়ে দিলে তা শুকুতে দিয়ে যায়। একটা সুবিধে, হারু বসে থাকলে, তার কাশির শব্দে কাক পক্ষীও সে দিকপানে আসবে না।
অবশ্য এ পাড়ার মানুষজন একেবারে দয়ামায়াহীন এমনটা ভাবার কোনো কারণ নেই। গিন্নিরা প্রায়ই নিজেদের বাড়ির উদ্বৃত্ত এটা ওটা হাতে নিয়ে রাস্তা থেকে ছেলেমেয়েদের ডাক দেয়, অথবা খবর পাঠায় বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে। তারাও ছেলেপুলে নিয়ে বাস করে, জ্ঞাতিবাড়ির ছেলেপিলেদের ম্লানমুখ দেখলে অনেকেরই খারাপ লাগে। দায়ে অদায়ে লোকে সাহায্য করে বৈকি, বিশেষ করে দুর্গা যবে থেকে বড় হয়েছে, তার নম্র স্বভাবের জন্য অনেক গিন্নিরাই তাকে পছন্দ করে। সে শান্ত চুপচাপ হলেও মায়ের মত অমিশুকে নয়, ডাকলে কাজকম্ম করে দেয়, কারুকে কোনো কাজে না বলে না।
হারুর কথা অবশ্য আলাদা, তাকে কোনোকালেই কেউ পছন্দ করে না, ওই ভবেশ ডাক্তারের মত গোনাগুনতি দু চারজন ছাড়া। তবে অপছন্দটা ঠিক কী কারণে সে জিজ্ঞেস করলে কেউ সেরকম গুছিয়ে বলে উঠতে পারেনা। হারুর তরফেও তেমন পাড়ার কারুর সঙ্গে সম্পর্ক রাখার চাড় কখনো দেখা যায়নি।
শীতে রোদের ওমের সাথে দখিনের ঠান্ডা হাওয়ার কাঁপুনির যেন চোর পুলিশ খেলা হারু পালের মাটির ধারিতে, কখনো রোদ হারে, কখনো হাওয়া। ভগবান আর সব কিছুতে কৃপণতা করলেও আঁচলভরে রোদ দিয়েছে, সারাদিন ধরে তা থাকে এ বাড়ির উঠোন আর ধারি জুড়ে, পড়শিদের ঈর্ষার কারণ ঘটিয়ে। ভেবেচিন্তে দেখতে গেলে মনে হয় কারুর সাথে বার্তালাপ না থাকলেও, আসলে মানুষজনের সান্নিধ্যে আসার তাগিদেই বুঝি হারুর বাইরে ধারিতে এসে বসা সারাবেলা। নাহলে বাড়ির ভেতর উঠোনেও তো রোদ আসে। এই নিয়মটি গত কয়েক বছর ধরে চলছে, বাইরে এসে বসা, পাড়া জানিয়ে কাশি, থুতু ফেলা। শীতের প্রথম রোদে ঘরের বাইরে এসে এখানে ওখানে, মাঠ, খামারে জটলা বাঁধে লোকজন, চানের আগে গা গরম করতে। এদিক ওদিক কথা ভাসে, ঘটনা রটনা, নানা খুচরো খবর চালাচালি হয়। সব বোঝা না গেলেও কানে আসে জীবনের শব্দ, রোগাভোগা মানুষের কাছে তাই হয়ত সঞ্জীবনীর কাজ করে, কে জানে!
পাড়ার শেষপ্রান্তে বিমলার দুকামরার বাড়িজোড়া বিশাল উঠোনেও রোদ আসে ঢালাও, পুবের রোদ নয়, দখনে রোদ, দেরীতে এসে থাকে বিকেল অবধি। তবে এ বাড়ির রোদ ধারিতে বা উঠোনে একলা নিভৃতে থাকে না, তাতে শামিল হতে আসে পাড়ার মেলা লোকজন। বিমলার ফাঁকা বাড়ি, কত্তা শহরে চাকরি করে, মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়ে ঝাড়া হাত পা সে, হাতে তার অঢেল সময়। এ বাড়ির দুয়ার সবার জন্যে খোলা থাকে সারাদিন, কেউ না কেউ সবসময়ই আসতে থাকে, কাজে অকাজে। রোদ না পাওয়া বাড়ির লোকেরা আসে আচার বড়ি রোদে দিতে, কাচাকাচি বেশি হলে দড়িতে কাপড় শুকোতে দিয়ে যায়। এছাড়া দুপুরে অবসরে মেয়ে বউয়ের দল আড্ডা জমায় রোদে গা ডুবিয়ে। হারু পালের বাড়ির মত বিমলার বাড়িও যাতায়াতের পথে পড়ে, তবে সদর নয় খিড়কি রাস্তায়, কিন্তু এ বাড়িকে কেউ এড়িয়ে যায় না সচরাচর, যাওয়ার উপায়ও নেই, বিমলার চোখ সর্বদা সবদিকে নজর রাখছে।
দুর্গাও রোজের মতই টিউশনের ফিরতি পথে বিমলা জেঠির কাছে ধরা পড়ল। লোকচক্ষুর আড়াল খুঁজে সে এবাড়ির পিছনের পুকুর পাড় দিয়ে যাতায়াত করে, তাতেও জেঠির চোখ এড়িয়ে যেতে খুব একটা পারে না। আজ যেন বিমলা দুর্গার জন্যেই অপেক্ষা করছিল, উঠোন থেকে খিড়কির খোলা দরজা দিয়ে হাঁক দিল।
এক একজন থাকে সংসারে যারা সামনে দিয়ে চলে গেলে বা কাছে দাঁড়িয়ে থাকলেও মনে হয় যেন কেউ নেই। তাদের উপস্থিতি সেই সময়ের চিত্রকল্পে কোনো দাগ কাটেনা। হারু পালের এই মেয়েটাও সেই গোত্রের মানুষ। এ পাড়াতেই ছোট থেকে বড় হয়েছে, সংসারের দায়ভার অনেকটাই সামলায়, ঘরে বাইরে, লোকের কাজও করে দেয়, দরকারে পাড়ায় বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে কথা সেই বলে, তবু যেন কারোর ওর দিকে চোখ পড়ে না, বা ওর অস্তিত্ব মনেই থাকে না। ওদের বাড়ির প্রসঙ্গ উঠলে সবাই ওর ভাই কাজলের নাম করে, “কাজলদের বাড়ি, কাজলকে ডেকে বলে দে”। কাজল যে বেশ কিছুকাল বাড়ি ছাড়া, শহরবাসী, তাও যেন কারো খেয়ালই থাকে না।
বিমলা অবশ্য এদের দলে পড়ে না। তার দুর্গার দিকে ভালোই নজর থাকে, আসা যাওয়ার পথ ও সময় দুইই খেয়ালে রাখে। চোখ পড়লেই দু দন্ড ডেকে কথা বলে, কারণে অকারণে বকাঝকা করে, প্রায়ই সকালে মুড়ি শশা ঢেলে দেয় আঁচলে, দুপুরে ডেকে দেয় বাড়তি মাছের টক। মা নেই, পিসিটা মাথাপাগল, পাষণ্ড বাপটা শুধু মেয়েটাকে খাটিয়ে মারে, উঠতি বয়সের মেয়ে, কেউ একটু মুখে খাবার তুলে দেবারও নেই।
মাথার চুলের দড়ির গিঁটটা খুলতে খুলতে দুর্গা বিমলার উঠোনে এসে দাঁড়ালো। বাড়ি ফিরে মাথায় একটু তেল দিয়ে মিত্তিরঘাটে চানে যাবে। শীতকালে খুব সকালে চান করতে পারে না, টিউশন থেকে ফিরে করে। পিসি রান্না চাপিয়েছে কিনা কে জানে, তার খুব খিদে পেয়েছে। সকালে এক ছাত্রীর বাড়ি এক কাপ চা ছাড়া পেটে কিছু পড়েনি এত বেলা পর্যন্ত। ভাইটা ইস্কুলে গেল কিনা কে জানে। কাজল দিন কয়েক আগে এসে খুব কথা শুনিয়ে গেল, ভাইকে বাবার হাত থেকে উদ্ধার করে ইস্কুলে পাঠাতে পারে না বলে। মা তার কাছে ভাইকে রেখে গেছে, কত কষ্ট করে টাকা উপায় করছে সংসারের জন্যে, যাতে তারা মানুষ হয়, আর দুর্গা এইটুকু করতে পারে না!
জেঠি এখন ধরলে সাত সতেরো কথা বলবে, মায়ের কথা জানতে চাইবে, সময় নষ্ট। সবচেয়ে যা তার অপছন্দের তা হল বাবাকে নিয়ে আজেবাজে কথা বলবে। বলবে বাবার কারণেই তাদের সংসারের এই হাল, তারা এত গরীব, নাহলে ঠাকুরদার আমলে জমিজমা যা ছিল তা আজ থাকলে ভাতের অভাব হয় না। বাবাকে নিয়ে কেউ কিছু বললে দুর্গার খুব রাগ আর কষ্ট হয়। তার কেমন যেন মনে হয় সবাই বাবাকে হিংসে করে করে বাবার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে বাবাকে সফল হতে দেয়নি। তার বাবা এখনো কী সুপুরুষ, দুধে আলতা রঙ, রোগে ভুগেও চোখমুখের কী গড়ন। কম বয়সের ছবিতে বাবাকে সিনেমার হিরোর মত লাগে। ওরকম রূপ এ পাড়ায় কেন, এ গ্রামেও আর একজনেরও নেই, তাই বুঝি সবার এত রাগ বাবার ওপরে।
তবু জেঠির মুখের ওপর কথা বলতে পারে না, ডাকলে না এসেও পারে না। এই একটা মানুষ আছে যে তাকে ডেকে কথা বলে, কোনো কাজ না থাকলেও, খেতে দেয়। কোনো কিছুর দরকারে একমাত্র এই জেঠির কাছেই এসে চাওয়া যায়। মা থাকতে কত দিন বিমলার কাছ থেকে চাল নিয়ে গিয়ে তাদের হাঁড়ি চড়েছে। এমন উপকারী লোকের দু কথা শুনতেই হয়। এছাড়া জেঠির ডাক মানে জলখাবারের মুড়ি পাওয়া যাবে খিদের মুখে।
উঠোনের এক কোণে জেঠির কাজের মেয়ে কাপড় সেদ্ধ করছে। সেই দিকে তাকিয়ে বিমলা দুর্গাকে ঘরের ভেতরে যেতে বলে, মুখটা কেমন থমথমে, অন্যদিনের মত চিৎকার চেঁচামেচি নেই, চাপা স্বরে কথা বলছে। দুর্গা প্রথমটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে থমকে গিয়ে, তাড়াতাড়ি করে সামনের আবছা অন্ধকারমত ঘরটায় ঢুকতে গিয়ে দরজার পাশে রাখা চৌকির কোণায় ঠোকর খায়, হাঁটুটা ব্যাথায় টনটন করে ওঠে। বিমলা পেছন পেছন এসে গম্ভীরমুখে চৌকিতে বসে।
“কিছু খবর রাখিস? তোর বাপের জেলে যাওয়ার ব্যবস্থা পাকা হচ্ছে যে।”
দুর্গা হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। কী বলছে জেঠি, মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?
“আমার দিকে অমন করে তাকিয়ে কিছু হবে না। সকালে বোসপাড়ায় গেসলুম। শেফালীর ছেলে দিল্লি যাবে, নাতিটার জন্যে পাটালি গুড় আর মীনুর জন্যে গয়নাবড়ি দিতে গেছিলাম, ও নিয়ে যাবে। সেখানে শুনলুম সুধীর বোসের যে ভাগ্নির এই কদিন আগে বিয়ে হল, সে এসেছে মামার বাড়ি। ভাগ্নিজামাই পুলিশের হোমরাচোমরা। সে তোদের কে হয় জানিস?”
দুর্গার মনে হল জেঠির মাথায় সত্যিই কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। বোসেদের বাড়ির কে না কে আত্মীয়, তাদের সাথে ওদের কী সম্পর্ক?
বিমলা দুর্গার হতবাক দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমিও জানতাম না, কেউই জানত না। এই শুনে এলাম। সে তোর বাবার প্রথম পক্ষের ছোট শালা। খুব চুপিসারে সব পরিকল্পনা চলছে, এখানের থানার পুলিশের বড়কর্তা এসেছি্ল, তার সাথে দেখা করে গেছে। মামাশ্বশুরের বাড়ি আসার তার উদ্দেশ্যই হচ্ছে তোর বাবাকে ধরে জেলে দেওয়া।”
দুর্গা এবার স্থির নিশ্চিত হল যে একা একা থেকে জেঠির মাথা খারাপ হয়ে গেছে। একটেরে বাড়িতে থাকে, কিছু ভর টর করল কিনা তা বা কে জানে।
“কী সব যাতা বলছ জেঠি, তোমার শরীর ঠিক আছে তো?”
চাপা গলাতে অল্প রাগ আর কিছুটা উদ্বেগ ঝরে পড়ল। বাবার ওপর জেঠির এত কিসের রাগ সে ভেবে পায়না, বানিয়ে বানিয়ে যা খুশি বলতে আরম্ভ করেছে।
“আবার মুখে মুখে কথা, এইটুকু পুচকে মেয়ে তার রকম দ্যাখো। মর তুই, আমার শরীর নিয়ে তোকে ভাবতে হবে না, নিজের বাপকে কী করে বাঁচাবি তাই ভাব।”
এবার দুর্গার একটু কেমন লাগতে লাগল। মনে পড়ে গেল মায়ের কাছে যেন অনেককাল আগে শুনেছিল যে বাবার আগে একজনের সাথে বিয়ে হয়েছিল, আর সে বউ বিয়ের অল্পদিন পরেই মরে গেছিল। তবে তাদের বাড়ির কথা কোনোদিন কাউকে বলতে শোনেনি, মা বা পিসি কাউকে না।
পিসি তো আর আসলে পাগল নয়। অল্পবয়সে একজন বুড়ো দোজবরের সাথে বাবা বিয়ে দিয়েছিল। পাড়ার লোকে বলে বাবা তার কাছে টাকা ধার নিয়ে শোধ দেয়নি, তাই শেষে পিসির সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল। বিয়ের একবছর পরেই সে বর মরে যায়। সৎ ছেলেরা তখন পিসির সব গয়নাগাটি কেড়ে নিয়ে তাকে ঘর থেকে বার করে দেয়। সেই থেকেই কেমন ভুলো মনের বেখেয়ালে হয়ে গেছে, কারোর সাথে কথাবার্তা তেমন বলে না, কাজে ভুল করে। শুধু নিজের মনে কথা বলে, মাঠেঘাটে একলা ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু আবার কখনো একদম ভালোমানুষের মত তাদের গল্প বলে, তখন রান্নাও ঠিক করে করে, ভাইটাকে আদর যত্ন করে, তার চুলে তেল দিয়ে দেয়। তবে বাবার সাথে পিসি কখনো কথা বলেনা।
পিসি মাকে খুব ভালোবাসে, অনেক বার তাকে মায়ের বিয়ের গল্প শুনিয়েছে, কিন্তু বাবার আগের পক্ষের বউয়ের কথা পিসির মুখে কোনোদিনও শোনেনি।
বিমলা দেখছিল দুর্গাকে, মেয়েটা চুপচাপ থাকলেও বাপকে কিছু বললে যে ওর পছন্দ হয় না, সেটা সে অনেকদিন লক্ষ্য করেছে। ওই তো ছিরি বাপের, ছেলেমেয়ের জন্যে একচুলও কিছু করেনি কোনোদিন, একটু ভালো করে কথাও বোধহয় বলেনা ওদের সাথে, সেই মানুষকে নিয়ে আবার মেয়ের সোহাগ কত! সে গলার স্বরকে আরো তীব্র করে বলে,
“বলি তোর বাপ যে মিথ্যে বলে ফুসলিয়ে এক ভালোমানুষের মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে এসে কালীঘাটে সিঁদুর পরিয়ে বিয়ে করেছিল, সে কথা জানা আছে তোর? মেয়েটা ভদ্র সভ্য লেখাপড়া জানা মেয়ে, তাদের বাড়ির অবস্থাও ভালো ছিল। তোর বাবার চেহারা দেখে তারা সবাই ধোঁকা খেয়েছিল, তার ওপরে মিথ্যে করে বলেছিল গ্রামের বড়লোক জোতদার বাড়ির ছেলে, সরকারী চাকুরে। বাড়িতে বিয়ের কথা তুললে খোঁজখবর হত, সব ফাঁস হয়ে যেত, তাই মেয়েটাকে কথায় ভুলিয়ে বার করে নিয়ে যায়। পরে সেই মেয়েই সব দেখেশুনে তোর বাপের স্বরূপ দেখে, একমাসের মধ্যেই সিঁদুর মুছে বাড়ি ফিরে যায়।
তারপর নাকি সে অনেক লেখাপড়া করে, ভালো চাকরি নিয়ে বাইরে চলে যায়। অনেক পরে বিয়েও করে এক ভালোমানুষকে, তাদের একটা মেয়ে আছে, সুখের সংসার। কিছুদিন আগে তারা দেশে ফিরেছে, কলকাতায় বসবাস করছে। তোর বাবা কোথা থেকে সে খবর পেয়ে তার ফোন নাম্বার যোগাড় করে তাকে ফোন করে ভয় দেখিয়ে টাকা চাইতে থাকে। বলে তোর বাবার সঙ্গে বিয়ের নাকি আইনত ছাড়াছাড়ি হয়নি, এই কথা তার স্বামীকে প্রমাণ দিয়ে জানিয়ে দেবে, যদি না তোর বাবাকে সে নিয়মিত টাকা পাঠায়। সে কিছু টাকা পাঠিয়েছে এক দু বার, কিন্তু তোর বাপের খাঁই বেড়েই চলেছে। এই ভাই সেই মেয়ের থেকে অনেক ছোট, পুলিশের লোক। নিরুপায় হয়ে দিদি সব জানাতে ভাই তখুনি খোঁজখবর নিয়ে সব আটঘাট বেঁধে এসেছে। সাক্ষী প্রমাণ সব ঠিক হলে আজকালের মধ্যেই তোদের বাড়ি পুলিশ নিয়ে এল বলে!”
দুর্গার বিশ্বাস হয় না, এসব কী টিভির নাটকের গল্পকথা শোনাচ্ছে জেঠি। বাবা কাউকে ফোন করে ভয় দেখাচ্ছে? বাড়িতে মোবাইল ফোন একটা আছে তাদের, মা দিয়ে রেখেছে, বাবুর বাড়ির পুরনো ফোন। ভাইয়ের কাছে থাকে, মা সপ্তাহে দু দিন ফোন করে, খুব দরকার পড়লে সেখান থেকে মাকে ফোন করতে বলেছে। কিন্তু বাবা তো কখনো সেই ফোনে হাত দেয় না, মায়ের সাথে কথাও বলে না, শুধু কাজল মাসের টাকা নিয়ে এলে টাকা গুনে নেয়। পুরো টাকা অবশ্য বাবার হাতে দেয় না কাজল, লুকিয়ে কিছু টাকা দুর্গার হাতেও দেয়। বাবা মনে হয় তা আন্দাজ করে কারণ কিছুদিন যেতে না যেতেই আর সংসারের টাকা দেয়না, বলে ফুরিয়ে গেছে।
বাবাকে সেই বউ টাকা পাঠিয়েছে? কিভাবে? বাবা তো কোথাও বেরোয় না, কেউ আসেও না বাবার কাছে। ব্যাঙ্কের একাউন্ট একটা ছিল বটে কিন্তু সে বোধহয় আর চালু নেই। নাঃ, কোথাও একটা গণ্ডগোল হচ্ছে, আবার গ্রামের লোকজন বাবার বিরুদ্ধে কিছু একটা পরিকল্পনা করছে না তো? ওদের বাড়ির জমিটা একদম রাস্তার ধারে, সেদিকে অনেকের নজর আছে। বাবাকে জেলে পাঠিয়ে ওদের তাড়িয়ে দিয়ে বাড়ি দখল করবে, বা মাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে জলের দরে কিনে নেবে। জেঠিকে তারাই হয়ত এসব বলেছে, জানে জেঠি ওদের বলবে আর ওরা ভয় পাবে।
সে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে এল, বিমলার ডাকেও আর দাঁড়ালো না। মাথাটা কীরকম জট পাকিয়ে আছে, বাড়ির দিকে না গিয়ে সোজা মিত্তিরদের ঘাটের দিকে গেল। মিত্তিরদের বাড়ির পিছন দিকে এই ঘাটটা ঝোপঝাড়ে ঘেরা, কেউ এদিকে আসেনা, এই ঘাট সরে না, তাই সে এখানে আসে, নিরিবিলি, সকলের চোখের আড়ালে। বাড়িটাও বন্ধই পড়ে থাকে। তবে মাসখানেক আগে হবে, একদিন দুর্গা চান করতে এসে দেখে খিড়কি দরজাটা একটু ফাঁক করা, আর ভেতর থেকে সুন্দর চন্দন আর ধুপের গন্ধ। একজন বুড়ো দাদু ধুতি পরে খালি গায়ে ভিজে গামছা জড়িয়ে উঠোনের মাঝখানে তুলসীতলায় দাঁড়িয়ে খুব চাপা গলায় মন্ত্রের মত কী বলছে। সেই থেকে দাদুকে সবসময় না চোখে পড়লেও, দরজাটা আধখোলা থাকে, আর ধূপধুনোর গন্ধ একটা ওই চত্বরের বাতাসে ভাসে।
দুর্গা চাপা মেয়ে, দরকারী কথা ছাড়া গল্পগুজবে সে থাকেনা, তাই জানা হয়নি যে মিত্তিরদের বাড়িতে কে থাকতে এসেছে। হবে ওদের কোনো গরীব আত্মীয়, বাড়ি খালি পড়ে আছে, থাকতে দিয়েছে। মাঝে মাঝে ওর মনে হয়েছে যে একবার একটু খোঁজ নেবে, একা বুড়ো মানুষ, রান্নাবান্নার বা অন্য কাজে সাহায্য লাগলে। কিন্তু সাহস হয় নি শেষ পর্যন্ত, পাড়ার লোকেদের ব্যাপারে আগ বাড়িয়ে কিছু করতে না যাওয়াই ভালো, কে কী মনে করবে!
স্নান সেরে উঠে আজও দরজাটা আধখোলা দেখল, কিন্তু ভেতরে কাউকে চোখে পড়ল না, তবু মনে হল কে যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। জলে ডুবে বুকের মধ্যেকার চাপা কান্নাটা যেন আরো ফুলেফেঁপে ওঠে, সে ভেজা শাড়িটা ভালো করে জড়িয়ে ছুটে যায় বাড়ির দিকে। ধারির রোদে বাবাকে রোজকার মত একইভাবে হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে দেখে, আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না, দরজার কাছে দাঁড়িয়েই হাউহাউ করে কেঁদে ফেলে। বাবার কানে তার কান্নার শব্দ পৌঁছয় কিনা কে জানে, হারু পাল মেয়ের দিকে তাকিয়েও দেখেনা।
পিসি আজকে একটু ভালো আছে, রান্না ঠিকমত করেছে। বাবাকে খাইয়ে আঁচিয়ে দুর্গা নিজেও ভাত নিয়ে বসল। চাপা অস্বস্তিটা কান্না হয়ে বেরিয়ে যাবার পরে মাথাটা এখন কিছুটা ঠান্ডা হয়েছে। খেয়ে উঠে উঠোনের রোদে ভাবতে বসল, কী করবে। ভাইকে ডেকে মাকে ফোন লাগিয়ে জেঠির কথাগুলো বলবে? মাকে বলে লাভ হবে? সে অনেকদিনই বোঝে মা আর কাজল দুজনেই আসলে এ সংসার থেকে আলাদা হয়ে গেছে, বিশেষ করে বাবাকে ওরা একেবারেই সইতে পারে না। তাছাড়া পুলিশ যদি সত্যিই আসে, মা কী করবে?
অন্ধকার বাবার ঘরের দিকে চোখ গেল। বাড়িতে দুখানা ঘর, আর রান্নাঘরের পাশে এক চিলতে একটা ফালি ভাঁড়ার ঘর, সেখানে পিসি থাকে। এমনিতে এককালে এ বাড়ি মজবুতই ছিল, অনেককাল মেরামতি কিছু না হওয়াতে জীর্ণ দশা এমন। দুটোর একটা ঘর নিয়ে বাবা থাকে, আর অন্য ঘরে তারা সবাই। বাবার ঘরে কারুর ঢোকার বা কোনো কিছুতে হাত দেওয়ার অনুমতি নেই। পিসি অন্য ঘর ঝাঁট দিয়ে পরিস্কার করলেও বাবার ঘরে কোনোদিন ঢোকেনা। দিনে একবার দুর্গা ঢুকে যত্ন করে পরিস্কার করে, অনেকটা ঠাকুর মন্দিরের মত, কোনো কিছু না ছুঁয়ে, বা না ঘেঁটে। তাও মাঝে মাঝেই হারু পাল চিৎকার করে তার জিনিসে হাত দেওয়া হয়েছে বলে।
আজ দুর্গা নিজে থেকে এমনিই ঢুকল।খুব আস্তে করে টিনের বড় ট্রাঙ্কটা খুলল। ন্যাপথলিন আর চন্দনের গন্ধ মিলে মিশে একটা অদ্ভুত গন্ধ বেরোচ্ছে। হারুর তোলা জামাকাপড়, প্যান্ট শার্ট সব পরিস্কার ইস্ত্রি করে গুছিয়ে রাখা। ঘরের জামা ছিঁড়ে গেলেও বাবা এগুলো কখনো পরবে না, এগুলো কাজের পোশাক, উৎসবের পোশাক, যত্নে রাখা অতীত। এক দিকে একেবারে কোণায়, একটা ফুটো হয়ে যাওয়া শাল মুড়ে ছোট চামড়ার বাক্সটা রাখা আছে। দুর্গা এত সাবধানে এগুলো গুছিয়ে রাখে হারু তার হাত টেরও পায় না কখনো, নাহলে সে অনর্থ করত। হয়ত এ বাড়ির অন্য আর কেউ জানেওনা এই বাক্সটার কথা। থাকলে কিছু এটার মধ্যেই থাকবে দুর্গা নিশ্চিত। এই একমাত্র জিনিস বাবার যাতে তালাচাবি দিয়ে রাখা আছে। তবে সে চাবির খবরও দুর্গার অজানা নয়, যদিও এর আগে কোনোদিনও তার বাক্সতে কী আছে জানার কৌতূহল হয় নি।
দেওয়াল আলমারির পাল্লাটা খুব আস্তে খুলল। হারু পাল বাইরে ধারিতে এবং এসময় ভাত খাওয়ার পর বসে বসেই ঘুমোয়, ঘরের ভেতরের আলমারির পাল্লার শব্দ তার কানে যাওয়ার কথা নয়। নিচের তাকের কোণে যে ঠাকুরদার আমলের নীল রঙের ভাঙ্গা চিনেমাটির টি সেটের দুধের পট টা রয়েছে, তার মধ্যে থেকে চাবিটা বার করে আনল।
সাদাকালো ফটোতে বাবাকে পরিস্কার চেনা গেলেও, তার পাশের মহিলাকে দেখে দুর্গার একেবারেই ভালো লাগল না। তার বাবা তো অসুন্দর লোকেদের পছন্দই করে না, মাকে সারাজীবন কেলেকিষ্টি বলে গঞ্জনা দিয়ে এসেছে, আর এই ছবিটার মেয়েটা তো মায়ের থেকেও দেখতে খারাপ। বাবা একে বিয়ে করেছিল? কেন?
অস্বস্তি হলেও সে চিঠির গোছা থেকে এক দুই করে পড়তে শুরু করল। বাবাকে লেখা পুরনো চিঠি বিয়ের আগের, এক দুই লাইন পড়ে আর ইচ্ছে করল না। কেউ বাবাকে ভালোবাসলে তাতে বাবার দোষ কোথায়! কয়েকটা চিঠির পরেই হাতে এল তার বাবার লেখা চিঠি, ঠিকানা ভুল হয়ে ফেরত আসা চিঠি। আর সবথেকে নিচে, দুটো টাকার বান্ডিল। দুর্গার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছিল, এমনিই অন্ধকার ঘর তায় চোখে আরো যেন আঁধার দেখে।তবে কি জেঠি যা বলছে সব সত্যি, এই প্রমাণ গুলোর জন্যেই পুলিশ আসবে বাবাকে ধরতে?
কিন্তু বাবার হাতে টাকা এল কিভাবে সে বুঝতে পারে না। ভাই একদিন বলছিল বটে যে বাবার পুরনো কাজের জায়গার থেকে একজন লোক এসে তাদের বাড়ির খোঁজ করছিল। তবে কী?
দুর্গা খুব বুদ্ধিমতী না হলেও, চুপচাপ থাকলেও, একেবারে বোকাহাবা নয়। সংসার চালাতে হয় তাকে, নানা লোকের সঙ্গে বুঝে চলতে হয়। ছবি, চিঠিগুলো আর টাকার বান্ডিল দুটো আঁচলে নিয়ে, বাক্সটাকে বন্ধ করে পাশের ঘরে চলে এল দ্রুত। ছোট টেবিলটার ওপর ফোনটা রাখা আছে। ফোনটার কল লিস্ট খুঁটিয়ে দেখল, মুছে দিল। দেওয়ালের পেরেক থেকে ঝোলানো কাপড়ের ঝোলার মধ্যে থেকে একটা প্লাসটিকের প্যাকেট বের করে নিয়ে তাতে আঁচলের জিনিসগুলো ভরে মুড়ে একটা রাবার ব্যান্ড দিয়ে ভালো করে আঁটল।
এটা বাড়িতে রাখা চলবে না, কোথাও লুকিয়ে ফেলতে হবে, অন্তত কিছু দিনের জন্যে। জেঠির কথা যদি ঠিক নাও হয়, তাহলেও। পরে আবার নিয়ে এসে জায়গায় রেখে দিলেই হবে। অবশ্য সেরকম হলে বাবা যদি এরমধ্যে বাক্স খোলে তাহলে কেলেংকারি হবে। তবু সেই ঝুঁকি নিতেই হবে দুর্গাকে। এই চিঠিগুলো ওই পুলিশের লোকের হাতে গেলেই তো প্রমাণ হয়ে যাবে বাবা টাকার জন্যে ভয় দেখিয়েছে।
কিন্তু লুকিয়ে রাখবে কোথায়? জেঠির বাড়ির কথা মনে হল। নাঃ, জেঠি টের পেলে নিজে গিয়ে তাদের প্রমাণ দিয়ে আসবে, বাবাকে জেল খাটাবার এমন সুযোগ ছাড়বে না।
আঁচলের আড়ালে প্যাকেটটা নিয়ে সে বাড়ি থেকে বেরোলো ধীর পায়ে। আড়চোখে ধারিতে বসা মানুষটার দিকে তাকালো একবার, রোদের আরামে বুঁদ হয়ে চোখ বুজে আছে, হয়ত ঘুমিয়েই পড়েছে। উত্তেজনায় এই শীতেও তার শরীর ঘামছে, গাল কপাল একবার হাতের চেটোর উল্টোদিক দিয়ে মুছে নিল। রোদ পড়ে এলে এই ঝোপঝাড় জল ঘেরা জায়গাটা কেমন আবছায়া হয়ে ওঠে। আধখোলা দরজাটা ঠেলে ঢুকে পড়ল সে, ভেতরটায় নানা আবর্জনা ডাঁই করা আছে, শুধু উঠোনের মাঝখানটা পরিস্কার, তুলসীমঞ্চের আশপাশটা ঝকঝক করছে। দুয়ারের ঠিক পাশেই একটা ভাঙ্গা টেবিল পড়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে দুর্গা ঠিক করে ফেলল তার করণীয়। টেবিলটার দেরাজদুটো ভালোই মজবুত, দ্রুত তার একটার মধ্যে প্লাস্টিকের প্যাকেটটা রেখে, বন্ধ করে, একপাশ রাখা কিছু পুরনো ছেঁড়া কাপড় আর কাগজ নিয়ে এসে টেবিলের ওপরে চাপা দিয়ে দিল, যাতে চট করে কারুর চোখে না পড়ে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল বুড়ো দাদু নজরে পড়ে কিনা। বুড়ো মানুষ, হয়ত কোনো ঘরে ঘুমিয়ে আছে।
কাজ সারা হলে দুর্গা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চারদিকে তাকিয়ে দেখল। ইস, কী ধুলো, পাতার জঞ্জাল ভরে আছে। পরদিন এসে দাদুর সঙ্গে কথা বলে একটু পরিস্কার করে দেবে, ঝামেলাটা মিটে যাক সব। তাদের বাড়িতে কিছু না পেয়ে যদি পাড়ার অন্য বাড়িতে খোঁজ করতে যায় কেউ তাহলেও মিত্তির বাড়ির কথা মনে হবেনা। সদর দরজায় তালা, কতকাল ধরে সবাই জানে এবাড়ি খালি বাড়ি।
আজকে ওকে ইস্কুলে রান্না করতে হবে, আগেই শিউলি মাসি বলে রেখেছিল। পিসির বদলি হিসেবে সবচেয়ে বেশিদিন শিউলি মাসিই কাজ করে, আর আজকাল তাকে প্রায়ই ডাকে একটু হাতে হাতে সাহায্য করতে। অবিশ্যি পুরো রান্না এই প্রথম করতে বলল। রান্না কিছু না, ভাত ডাল আর ডিম সেদ্ধ। ডাল, ডিমসেদ্ধ করতে সে পারবে, ভাতটা মাসি বলেছে বসিয়ে দিতে, নিরাপদদা এসে নামিয়ে দেবে।
ভাতটা সবে বসিয়েছে, দেখল ভাই আসছে ছুটতে ছুটতে।
“দিদি, বাবা কেমন করছে, শীগগির ঘর চল।”
দুর্গার হাত পা ঠান্ডা হয়ে এল। কোনরকমে নিরাপদদাকে ডেকে ভাতটা দেখে নামাতে বলে ছুট দিল ভাইয়ের সাথে।
“আমি বাড়ি যাচ্ছি, তুই যা ভবেশকাকাকে নিয়ে আয়, বল এক্ষুনি আসতে।”
বাড়ির সামনে একগাদা লোকের জটলা, পিসি উঠোনে বসে আছে। বাবার ঘরে ঢুকে দেখল লন্ডভন্ড অবস্থা, সমস্ত জিনিসপত্র মাটিতে ছড়ানো, আলমারির পাল্লা হাট করে খোলা, বাক্সর ডালা খোলা, বাবার ভাঁজ করা সাধের তোলা জামাকাপড় সব দলা পাকানো। বাবার শরীরের ওপর ভাগটা তক্তপোষের ওপর, আর কোমর থেকে পা নীচে ঝুলছে, মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ আওয়াজ বেরোচ্ছে। দৃশ্য দেখে দুর্গা ডুকরে কেঁদে উঠল “পিসি” বলে, আর সেই ডাকে পিসিও যেন কিরকম সম্বিত ফিরে পেয়ে এত বছরে এই প্রথম এ ঘরে এসে ঢুকল। দুজনে মিলে প্রথমে বাবার শরীরটা খাটের ওপর তুলে শুইয়েছে, ভবেশ ডাক্তার এসে পড়ল।
তারপরে একটা পুরো দিন রাত কেমন দুঃস্বপ্নের মত কাটল দুর্গার। কারা এল, কে গেল, বাড়ির আর কে কী করল কোনো দিকেই তার খেয়াল ছিল না। দ্বিতীয় দিনের ভোরে বাবার ঘরের মেঝেতে বসে কিছুক্ষণের জন্যে তার চোখ লেগে গিয়েছিল, মা এসে ওঠালো। ভবেশকাকাই বলল, তিন ভাইবোন একটু একটু করে মুখে জল দাও এবার।
বিমলা একবার ভেবেছিল দুর্গাকে তার বাড়িতে ডেকে দুটো খাইয়ে দেবে। এ কদিনে মেয়েটার চোখমুখের কী অবস্থা হয়েছে, তাকানো যায়না। হারু পাল কে সে মোটেই দেখতে পারত না, সারাজীবন বউটাকে কী হেনস্থা করেছে লোকটা, সংসারটাকে পথে বসিয়ে দিয়েছে, তবু একটা লোকের নেই হয়ে যাওয়া অনেক বড় ব্যাপার। মেয়েটাই যেন সবচেয়ে বেশি শোক পেয়েছে, ওদের বাড়ির আর কারোকে দেখে তো তেমন শোকাতুর বলে মনে হচ্ছেনা। সবচেয়ে বড় বদল দেখা যাচ্ছে দুর্গার মায়ের। ইদানীং তেমন দেখাসাক্ষাৎ হত না, আসত কম। এলেও দুদিন যা থাকত বাড়ি থেকে বেরোতে দেখা যেত না। দেখা যাচ্ছে সে সেই মুখচোরা বউমানুষ আর নেই। শহরের জল হাওয়ায় বেশ বদল হয়েছে। সবকিছুর হাল বেশ দক্ষতার সাথে ধরেছে, সবার সঙ্গে কথা বলছে, বড় ছেলেকে নির্দেশ দিয়ে সব কাজ করাচ্ছে। হারুর ঘরের সমস্ত জামাকাপড় বিছানামাদুর বার করে জ্বালিয়ে দিতে পাঠালো মড়া বেরিয়ে যাবার সাথে সাথেই। সেই ঘরেই কম্বল পেতে এখন দুই ভাই শুচ্ছে। ফিনাইল ডেটল দিয়ে সারা বাড়ি নাকি ধুয়েছে, পাড়ার লোকে এই নিয়ে আলোচনা করছে, রোগটা তাহলে ছোঁয়াচে ছিল, বউটা জানত।
শ্রাদ্ধশান্তির ব্যাপারেও সব কথাবার্তা বউই বলছে। এই সমস্ত কিছুর মধ্যে মেয়েটাকে যেন কেউ দেখতেই পাচ্ছে না। বিমলার একটু রাগই হচ্ছিল, বাপটাকে অত ভালোবাসত, সেও ফিরে দেখত না, আর এখন এই মাও সব কিছুতে শুধু বড় ছেলেটাকে ডাকে। এইসব ব্যবস্থাপনার মধ্যে মেয়েটাকে জোর করে ডেকে জড়ালে হয়ত কিছুটা স্বাভাবিক হত, ভুলে থাকত। খুব ইচ্ছে করছে বিমলার তবু ডাকতে পারছেনা, কোথায় যেন একটু সংকোচ হচ্ছে। সুধীর বোসের ভাগ্নিজামাই ওইদিন পুলিশ নিয়ে এসে বাড়ি সার্চ করিয়ে হুমকি না দিলে হয়ত এই অঘটন ঘটত না। সব জানতে পেরেও সে যদি দুর্গাকে না বলে, পাড়ার মাতব্বরদের জানাতো, তাহলে হয়ত কথাবার্তার মাধ্যমে একটা রাস্তা বেরিয়ে আসত। যতই হোক পাড়ার লোক, জ্ঞাতিজন, পাড়ায় পুলিশ ঢুকবে শুনলে কর্তারা নিশ্চয়ই মাথা ঘামাতো।
“ও জেঠি, মিত্তিরদের বাড়িটা বন্ধ। খিড়কি দরজায় তালা ঝুলছে। জেঠি, তুমি জানো বুড়ো দাদু কোথায় গেছে? ওদের বাড়ির তালার চাবি কার কাছে থাকে, ও জেঠি?”
দুর্গার কথা বিমলা কিছু বুঝতে পারে না। মেয়েটার চুলগুলো তেল আর চিরুনীর অভাবে রুক্ষ ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া হয়ে আছে, চোখদুটো কেমন যেন, চোখের দৃষ্টি অস্বাভাবিক লাগছে, কথায় কেমন একটা ঘোরের ভাব।
বিমলা হাতের কাজ ফেলে উঠে দাঁড়িয়ে দু হাতে মেয়েটাকে ধরে।
“কী হয়েছে, ও দুগগি, কী হল তোর? কী সব বলছিস? মিত্তিরবাড়ি তো বন্ধই থাকে, ও তো পোড়োবাড়ি হয়ে গেছে। সেখানে তোর কী কাজ?”
দুর্গাকে খুব উত্তেজিত দেখায়, বিমলার হাতটা ছাড়িয়ে একটু সরে গিয়ে দুয়ারের খুঁটিটা ধরে নিজেকে সামলায়। একটু যেন জেদী ঘোড়ার মত ঘাড় বাঁকিয়ে বলে,
“আমার দরকার। তুমি বল না চাবি কার কাছে আছে। পোড়োবাড়ি হতে যাবে কেন। দুদিন আগেও তো আমি খিড়কি দরজা খোলা দেখেছি।”
বিমলা কিছু বলার আগেই উঠোনে গম রোদে মেলছিল বিমলার কাজের মেয়ে, সে বলে উঠল,
“কী বলছ গো দুগগা দিদি, আমি তো দুদিন ছাড়াই বাড়ি ফেরার পথে মিত্তিরদের ঘাটে ল করতে যাই, গরুর জন্যে। জন্মে তালা খোলা দেখলাম নি, ও তালায় জং ধরে গেছে এমন যে চাবি আনলেও তালা খুলবেনি বোধহয়।”
দুর্গা আস্তে আস্তে খুঁটি ধরে বসে পড়ল, বিড়বিড় করে কী যেন বলতে থাকে,
“না না, আমি ঠিক দেখেছি...............”
মেয়েটা কেমন নেতিয়ে গেছে, ভিরমি খাবে নাকি! বিমলা ইশারায় কাজের মেয়েটাকে চুপ করতে বলে, এগিয়ে এসে দুর্গার মাথাটা টেনে বুকে নিয়ে বড় মায়ামাখা গলায় বলে,
“স্বপ্ন দেখেছিস মা? এ সময় এরকম হয়, দেখার ভুল। একটু শক্ত হয়ে যা এবার, শক্ত হয়ে যা, নিজেকে সামলা। মুখে হাতে একটু জল দে দেকি, আমার উপোষের পরোটা ভাজা আছে, খেয়ে এই দুয়ারে একটু শুয়ে থাক।”
দুর্গা আবছা হয়ে যায়, প্রতিবাদ করতে চেয়েও পেরে ওঠে না। বিমলাকে খাবার জোগাড় করতে উঠতে দেখেও বারণ করতে পারে না। স্বপ্ন দেখেছে সে? কোনটা স্বপ্ন? বুড়ো দাদু, ধূপের গন্ধ, বাবার চিঠি, টাকার বান্ডিল, নাকি বাবার না থাকা?