

নামাঙ্কণ: রমিত
সাগাদা (ফিলিপিন্স) স্ট্রীটফুড
আজকে তথাকথিত স্ট্রীট ফুডের জন্য ততটা বিখ্যাত নয় এমন একটা জায়গার গল্প করা যাক। ফিলিপিন্সের উত্তরে পাহাড়ে ঘেরা সাগাদা অঞ্চলটি, সেখানে পর্যটকেরা মূলত যায় প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং সেই বিখ্যাত ‘ঝুলন্ত কফিন’ দেখতে। যাঁরা ফিলিপিনো খাবার খেয়েছেন তাঁরা জানেন যে এদের খাবার বাকি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার খাবারের থেকে অনেকটাই বা পুরোপুরি আলাদা। ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কাম্বোডিয়া – এদের খাবারে কিছু মিল পেলেও স্বাদে এবং গন্ধে, বা মশালার ব্যবহারে ফিলিপিনো খাবার এদের থেকে বেশ দূরে।
সত্যি কথা বলতে কি ফিলিপিন্সের খাবার আমার নিজের খুব একটা প্রিয় এমন নয়। খাবার দিলে খাব না বা আয়েশ করে চাখবো না এমন নয় – কিন্তু কোথাও খুঁজে পেতে ফিলিপিনো রেষ্টুরান্ট-এ খেতে যাচ্ছি, তেমন সম্ভাবনা বেশ কম। আমার বাড়িতে দীর্ঘ সময় ফিলিপিনো কাজের লোক ছিল – একজন বেশ ভালো রাঁধত, কিন্তু তার রাঁধা ফিলিপিনো খাবারও তেমন একটা মুখরোচক লাগত না। উলটে সেই মেয়ে আমার বউয়ের কাছ থেকে ভারতীয় রান্না, বিশেষ করে মাংসের ঝোল রান্না করা শিখে নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করে খেত!
সাগাদা ফিলিপিন্সের এমন জায়গা গুলির মধ্যে পড়ে যেখানে খুব বেশি ঔপনিবেশিক প্রভাব নেই – অন্তত ছিল না বহুদিন। কারণ তখনকার দিনে এই এলাকায় আসাই চাপের ছিল – মানে দুর্গম যাকে বলে আর কি। সেই কারণে এই এলাকায় ক্যানকানা উপজাতির স্থানীয় সংস্কৃতি অনেকাংশেই অপরিবর্তিত থেকে গেছে – এবং সেই ছাপ এখনও এখানকার প্রচলিত খাবারগুলির মধ্যে দেখা যায়। সংরক্ষিত থেকেছে, যা তাদের খাদ্য ও খাদ্যাভ্যাসে স্পষ্ট। এখানে বলে রাখা ভালো যে এই ক্যানকানা উপজাতি ফিলিপিন্সের বৃহত্তর ইগোয়োট গোষ্ঠীর অংশ যারা এখনো উত্তরের পাহাড়ী অঞ্চলে ছড়িয়ে আছে।
বাইরে থেকে প্রথম বিদেশী এই এলাকায় মনে হয় আসে স্প্যানীশরা। ১৭০০ সালের শেষ দিকে স্প্যানিশ ধর্মপ্রচারকরা এখানে আসার চেষ্টা করলেও, ১৮৮২ সালের আগে তারা কোনো স্থায়ী মিশন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। "সাগাদা" নামটিও নাকি খুব সম্ভবত স্প্যানিশ সৈন্যদের দেওয়া। একসময় তারা স্থানীয় ব্যক্তির কাছে পাশের গ্রামের নাম জানতে চাইলে, সে নাকি তার হাতে থাকা মাছ ধরার বাঁশের ঝুড়ি দেখিয়ে দিয়েছিল – আর স্থানীয় ভাষায় সেই বাঁশের ঝুড়ির নাম ছিল সাগাদা।
এর পরে ১৯০০ সালের কাছাকাছি সময়ে আমেরিকান মিশনারিরা এখানে আসে। তারা অ্যাংলিকান চার্চ এবং সেন্ট মেরি'স স্কুলে ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা করে – যার মাধ্যমে পাশ্চাত্য প্রভাব আসে। তবে এই প্রভাব প্রধানত অ্যাংলিকান খ্রিস্টধর্ম এবং শিক্ষার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল। বাকি উপজাতিদের খুব একটা প্রভাবিত করতে পারে নি।

এই অঞ্চলের আদিবাসীরা মূলত মাংসপ্রেমী। স্বভাবিক ভাবেই তাদের রান্নাবান্নাতে মাংস সংরক্ষণ এবং রান্নার নিজস্ব কৌশল দেখা যায় – যা হল গিয়ে সাগাদার এলাকার নিজস্ব আদি খাবারের ভিত্তি। তবে দিন এগুনোর সাথে সাথে সাগাদার ঝুলন্ত কফিন পেয়েছে বাইরের পৃথিবীতে পরিচিতি – পর্যটক আসতে শুরু করেছে আগের থেকে অনেক বেশি। ফলে আজকের সাগাদা অঞ্চলের স্ট্রীট ফুডে আপনি পেয়ে যাবেন বাইরের অনেক ছাপ – ফিউশন ডিস টাইপের আর কি।
তবে একটা কথা বলে নিই – আমি যখন গিয়েছিলাম তখন অন্তত স্ট্রীট ফুড মার্কেট বলে সাগাদাতে কিছু পাই নি, যেমনটা পেয়ে থাকি আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অনেক জায়গায়। তাছাড়া সাগাদা বেশ পাহাড়ি এলাকা – সন্ধ্যের পর বেশ জমিয়ে রাত নামে – যোগাযোগ ব্যবস্থা তেমন বড় শহরের মতন নয়। ফলে রাতের বেলা স্ট্রীট ফুড খেতে কেউ আহ্লাদ করে বেড়িয়েছে, আমি অন্তত তেমন খুব একটা দেখি নি। স্ট্রীট ফুড এখানে যা খেয়েছি বেশির ভাগটাই দিনের বেলা ঘুরতে বেরিয়ে – বেশির ভাগ সময় তেমন কোন প্ল্যান ছাড়াই। খিদে পেয়ে গেছে, ঘুরতে ঘুরতে রাস্তার ধারে যা পেয়েছি খেয়েছি – স্ট্রীট ফুড খেয়ে নিজেকে সম্পৃক্ত করছি এমন ভাবনা ছাড়াই। আর তাই এখানে স্ট্রিট ফুডের তেমন ছবি নিজে প্রায় তুলি নি – মানে মনে আসে নি তখন যে ছবি তোলা জরুরি! আর আগে যেমন বললাম, ট্রেকিং করতে এখানে এখন অনেক জনতা আসে বলে ওয়েষ্টার্ণ স্টাইলে সাথে বয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে, তেমন খাবার আজকাল পাওয়া যাচ্ছে।

এখানকার স্ট্রীট ফুডের মধ্যে স্থানীয়দের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় মনে হয় ইটাগ, যা কিনা নুন দিয়ে সংরক্ষিত এবং ধোঁয়ায় শুকানো শূকরের মাংস। বিদেশী ভাষায় কাছাকাছি হল গিয়ে স্মোকড হ্যাম। এটা মনে হয় এখানকার ক্যানকানা উপজাতির হার্ট-বিট টাইপের। একে আবার অনেক সময় সাগাদার বেকন কিউব-ও বলা হয়। শূকরের মাংসের পেটের দিকে বড় ও চর্বিযুক্ত টুকরোগুলি প্রচুর পরিমাণে নুন দিয়ে মাখিয়ে একটি ঢাকা দেওয়া পাত্রে বা মাটির জারে রেখে দেওয়া হয় ভিতরের জল শুকিয়ে নেবার জন্য। সাথে সাথে নুনও মাংসের গভীরে প্রবেশ করে। এটি জিনিস চলে এক সপ্তাহ বা তার বেশি সময় ধরে। তারপর সেই জার থেকে মাংস বের করে জলে ধুয়ে নিয়ে সূর্যের আলোতে শুকোতে দেওয়া হয়। এর পর আসে মাংসে ধোঁয়া খাওয়ানো রান্না ঘরের উনুনের উপরে ঝুলিয়ে – বেশ কয়েক সপ্তাহ। এই সব কাজ কারবারের ফলে মাংসের বাইরের দিক গাঢ় লালচে-বাদামী হয়ে যায়।

প্রথাগত ভাবে, ক্ল্যাসিক্যাল বিচারে এই ইটাগ ব্যবহৃত হয় এখানকার এক বিশেষ স্যুপে (পিনিকপিকান)। তবে আজকাল এটা পাবলিক গ্রিল করে স্ট্রীট ফুডের পর্যায়ে নিয়ে চলে এসেছে। পিনিকপিকান দেখতে গেলে এক ধরণের চিকেন স্ট্যু - এতে স্থানীয় আদা, বাঁধাকপি, এবং ইটাগের নোনতা ও ধোঁয়াটে ফ্লেভার যোগ করা হয়। আগের দিনে নাকি সেই মুরগির মাংস-কে হালকা ভাবে পিটিয়ে নেওয়া হত – তাতে নাকি টেক্সচার ভালো আসত স্যুপে। কিন্তু আজকাল আর কে সে সব মেনে চলে!

আর বিদেশীদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় মনে হয় লেমন-পাই। সত্যি বলতে কি এই জিনিসটা আমাকে অবাক করেছিল লেমন-পাইয়ের মতন পাশ্চাত্য খাবার এখানে এমন জনপ্রিয় হল কিভাবে! এতে মিষ্টি মেরিং এর হালকা টেক্সচার থাকে। এই লেমন পাই সাগাদার স্থানীয় উৎপাদিত লেবু ব্যবহার করে তৈরি করা হয় – পাবলিকের দাবী সেই লেবু নাকি এক স্বতন্ত্র টক স্বাদ আনে এই লেমন পাই-য়ে।
এর কাছাকাছি থাকবে সাগাদার অন্য বিখ্যাত খাবার বাড়িতে বানানো টক-মিষ্টি দই যা বেশির ভাগ সময় কিছু কাটা ফলের সাথে বা গ্রাণোলা মিশিয়ে পরিবেশন করা হয়।

এটা তো সবাই জানেন যে ফিলিপিন্সের মূল খাবার হল ভাত – মানে এরা ভাত অনেক বেশি খায় ভেতো বাঙালীর থেকেও! ব্রেকফাষ্ট থেকে শুরু করে রাতের ডিনার, মাঝের যা কিছু খাবার তাতে বেশির ভাগটাতেই ভাতের প্রাধান্য থাকে। তাই স্ট্রীট ফুডের কথা উঠলে রাইস বেসড কিছু খাবার থাকবে না, তা হয় নাকি! পুটো বুম্বন এবং অন্যান্য রাইস কেক (চালের গুঁড়ো বা আঠালো চাল দিয়ে তৈরি) আকছাড় পেয়ে যাবেন। যদিও এটা সাগাদার স্পেশালিটি তেমন কিছু নয় – পুরো ফিলিপিন্স জড়েই আপনি এই জিনিস পেয়ে যাবেন। এই চালে দিয়ে বানানো খাবারের গোত্রে আসে সুমান যা হল চাল ও নারকেল-দুধে তৈরি একধরণের মিষ্টি।
কলা ও কাঁঠাল-ভর্তি ভাজা রোল পেয়ে যাবেন যাকে এখানে বলে টুরন। কলা ও কাঁঠাল কেটে স্প্রিং রোল শিটে ভরে রোল করে চিনি ছিটিয়ে ভেজে নেয় এরা। এই খাবারটা প্রায় মোরে মোড়ে পাওয়া যায়, স্থানীয়দের কাছে খুব জনপ্রিয়।
অন্যান্য ফিলিপিনো শহরের মতো সাগাদার বাজার এলাকায় বা ছোট স্টলগুলিতে গ্রিল করা মাংসের স্কিউয়ার দেখতে পাওয়া যায় যাকে স্থানীয়রা 'ইহাউ-ইহাউ' বলে। আর পাবেন গ্রিলড কর্ন, ভাজা মাংসের বল, এবং স্থানীয় ফলমূল।
সাগাদার স্ট্রিট ফুডে খুব বেশি দেশের প্রভাব নেই আগেই লিখেছি। তবু কিছু থেকে গেছে স্প্যানিশ প্রভাব, সেই স্প্যানিশ ঔপনিবেশিক যুগে অনেক খাবার যেমন এম্পানাডা ইত্যাদি বেশ জনপ্রিয় হয়। নুডুল জাতীয় খাবার এসেছে চীনা সংস্কৃতি থেকে, আমেরিকানরা দিয়েছে হটডগ এবং নানা ধরণের ক্যান জাত খাবার জিনিসের অভ্যাস।
তাহলে কি দাঁড়ালো? আপনি যদি সাগাদার দিকে যান, তাহলে খেয়ে দেখবেন নিদেন পক্ষে ইটাগ, পিনিকপিকান, লেমন পাই এবং স্থানীয় দই।
kk | 2607:fb91:4c21:664d:a9bc:c63c:7c5b:***:*** | ২৩ নভেম্বর ২০২৫ ০০:১৮736038
অরিন | 119.224.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০২৫ ০১:৩৬736039
অরিন | 119.224.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০২৫ ০১:৩৭736040