বার্লিনের রসিকতায় টীকার ভূমিকা শূন্য ; বার্লিন থাকে বার্লিনে , বার্লিনার কোথাও যায় না। এ পাড়া থেকে ও পাড়ায় বাসা বদল করাটাই গর্হিত কর্ম বিবেচিত হয় । বার্লিনের বাচনভঙ্গিতে মিশে আছে ফ্লেমিশ, ফরাসি, স্লাভ, ইহুদি তাদের মুখের ভাষা ও হাসির ঝলক নিয়ে ! কে কোথা হতে কবে এসেছে সে তর্ক নিরর্থক ; তার আধার কার্ড নেই, বাপ ঠাকুরদার জাতি ধর্মের কোন প্রমাণ পত্র নেই। তারা সবাই বার্লিনার । আমার পাঠকের সামনে বার্লিনের রসিকতা তুলে ধরতে গিয়ে তাই কুশীলবের পরিচয়, স্থান, সময়টা সকাল না সন্ধ্যে এমত ধারাভাষ্যকে সম্পূর্ণ বর্জন করেছি ; একটি সমস্যা অবশ্য থেকেই যায় -বার্লিনের কৌতুক অনেকটা ভাষা নির্ভর , শব্দ উচ্চারণ ও ব্যাকরণের এই মজার খেলার মূল আবেদন জার্মান ও ইদিশ ভাষাভাষীর কাছে । অন্য ভাষায় ‘ বার্লিন কৌতুক সঞ্চয়িতা’ নামক কোন গ্রন্থ চোখে পড়ে নি। সাধ্যমত চেষ্টা করেছি বার্লিনের মুখের ভাষার মজাকে বরানগর , শ্যামবাজারের রক অবধি পৌঁছে দিতে , যদিও মনে রাখতে হবে আপনার আমার চিত্ত বিনোদনের জন্য বার্লিনার কোন গল্প ফাঁদে না। সেই চিত্রনাট্যে ফোরগ্রাউনড , আবহসঙ্গীত, মেকআপ বা সেটের ভূমিকা নগণ্য , সকল রসের মূল তার সংলাপ। ... ...
বার্লিনার নবাব কে জবাব দেয় কারণ সে হাজির জবাব , অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করার বদভ্যাস তার নেই। তার ভাষা চোখা , নিশানায় নির্ভুল , উদ্ধত , হাই ডেসিবেল , স্মার্ট, কখনো তির্যক । দৈনন্দিন কথোপকথনের স্টাইল তার নিজস্ব , এর মধ্যে কৌতুক খুঁজে নেবার দায়িত্ব আপনার আমার, তার নয় । মুজতবা আলী সাহেব পেশাওয়ারের আহম্মদ আলীকে বলেন, এই সামান্য রসিকতায় আপনি এত প্রচুর হাসতে পারেন কি করে ? জবাবে তিনি বললেন, হাসি কি আর গল্পে ঠাসা থাকে? হাসি থাকে খুশ দিলে । বার্লিনারের বচন শুনে আমরা ঠা ঠা করে হাসতে পারি,সেটা আপনার আমার জিম্মেদারি। আমাদের মনোরঞ্জনের জন্যে বার্লিনার তার শব্দের মণি মুক্তো ছড়ায় না । সে তাই বলে যা তার মুখে , মনে আসে । বার্লিনের বাতাস রুক্ষ , তার কৌতুক শুষ্ক – ড্রাই হিউমর, যা সবিশেষ মেলে ব্রিটিশ হিউমরের সঙ্গে । বার্লিনের উদ্ধত দুর্বিনীত রসিকতা কোনো হুলিদাসকে মাথায় তুলে রাখতে একান্ত অনিচ্ছুক , কাউকে খাতির করা তার ধাতে সয় না , কখনো কোনো ডেকোরাম সে মানে না । তাই বার্লিনের বার, কফি হাউসের বক্র মন্তব্য কোনোখানে মিলে মিশে যায় আমাদের উত্তর কলকাতার চায়ের দোকানের , কুঠি ঘাটের আড্ডার সঙ্গে। বাকি দুনিয়া এর নাম দিয়েছে বার্লিনের কৌতুক , বেরলিনার ভিতস। রোমের ভাঙ্গা চোরা কলোসিয়াম দেখে গাইডকে বার্লিনার বলে, এ আর কি ? একবার বার্লিন এসে আমাদের খণ্ডহরগুলো দেখে যান । আমরা তার জন্যে পয়সা নিই না , টিকিটও লাগে না । ব্যাভেরিয়ার অপূর্ব হেরেন কিয়েম জের তীরে দাঁড়িয়ে নিজেই অভিভূত হয়ে গাইড বলেন , আহা , দেখুন কি আশ্চর্য সুন্দর এই নীল হ্রদ, দূরে সাদা বরফে মোড়া পাহাড়! বার্লিনার তাঁকে বলে , পাহাড় আর জলটাকে বাদ দিলে , এমন কি আহামরি ? পিসার হেলানো টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে সে বলে, আপনি আমাদের টি ভি টাওয়ারটা দেখেন নি বুঝি ? সেটা আরও হেলে গিয়েছে, চড়তে লিফট লাগে না। সুইস মাটারহর্ন দেখে বার্লিনার বলেছে, এর চারপাশে অনেক উঁচু পাথর আছে তাই কতটা উঁচু বোঝা যায় না। এই পাহাড়টাকে বার্লিনে বসিয়ে দিলে সেটা বোঝা যাবে । সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে নোংরা ধোঁয়া পড়া উ বান টানেলে ট্রেন ঢুকে পড়লে সে বলে, আঃ কি আরাম, এতক্ষণে মনে হল নিজের দেশে পৌঁছেছি । ... ...
মেলায় একটা গোটা দেশ বিক্রি হলো , টুকরো টুকরো করে । চার হাজার লোকের অফিসে নির্ধারিত হলো দশ হাজার প্রতিষ্ঠান, পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের কাজ , বহু লক্ষ একর জমি জায়গার ভবিষ্যৎ মালিকানা । ছিল না কোন আপিল আদালত , ট্রাইবুনাল, কোন জবাবদিহির দায়িত্ব। বেসরকারিকরনের নামে পশ্চিমের পুঁজিপতিরা কিনলেন কিছু, মেরামত করলেন কিছু, বন্ধ হলো বাকি দোকান,কল কারখানা । পশ্চিম জার্মান সরকার যেদিন ঘোষণা করলেন পাশাপাশি দুই অর্থনীতির সহাবস্থান নয় ( পরবর্তী কালে চিনে যেমন ওয়ান কান্ট্রি টু সিস্টেমস দেখা গেছে ) দু দেশকে এক হতে হবে একই শর্তে, যা স্থির হবে রাজধানী বন শহরে । দুয়োরের আগল খুলে যাওয়ার পরে পূর্ব জার্মানি চেয়েছিল গণতান্ত্রিক এবং অর্থনৈতিক রিফরম , তাঁদের মতন করে। তাদের কণ্ঠ রুদ্ধ হলোঃ সত্তর শতাংশের বেশি নাগরিক যারা এই পশ্চিমি স্টাইলের দেশ তৈরির হুকুমে সম্মতি ভোট দিয়েছিলেন তাঁরা দিগন্তে কোন দুঃস্বপ্নের ইঙ্গিত দেখেন নি। ত্রয়হানড নামক ট্রাস্ট দফতর তখন সেলস লিস্টের জাবদা খাতা বানিয়ে ফেলেছে। আমাদের ছোট বেলায় দেখেছি সারা বছর হরলালকার সেল লেগে থাকতো - প্রি পূজা সেল , পূজা সেল, পোস্ট পূজা সেল ! ত্রয়হানডের প্রাত্যহিক সেল চলল বছরের পর বছর। তাদের সঙ্কলিত ফাইলগুলিকে পাশাপাশি রাখলে তার দৈর্ঘ্য হবে দুশ কিলোমিটার,যার প্রায় অর্ধেক আজও প্রকাশিত হয় নি। তুলনামূলক ভাবে , চল্লিশ বছরে এক কোটি ষাট লক্ষ মানুষের ওপরে খবরদারি করে তৈরি পূর্ব জার্মান গোয়েন্দা এজেন্সি স্তাসির ফাইলের দৈর্ঘ্য পৌঁছেছিল ১৮০ কিলোমিটারে; নতুন জার্মান সরকার যার সামগ্রিক প্রকাশ আজও নিষিদ্ধ রেখেছেন । কিভাবে এই মহতী সেল যজ্ঞ আয়োজিত এবং পালিত হয়েছিল তার গল্প অনেক । যেমন থুরিঙ্গিয়ার পটাশ ( জার্মানে কালি ) মাইন , বিশফেরোডে। গ্রামে কোন পুরোহিত নেই, পুজো আচ্চার সঙ্কট দেখে আমার ঠাকুরদা তৎকালীন প্রথা মাফিক পদুমা গ্রামে একঘর বামুন প্রতিষ্ঠা করেন। এমনটা গ্রাম বাংলায় চালু ছিল। জার্মান সরকারের সংবাদ সংস্থা ডয়েচে ভেলের ( জার্মান তরঙ্গ) খবর পড়ে মনে হল বেশ কিছুদিন ধরেই পূর্ব জার্মানির শহর ও গ্রামে মানুষ প্রতিষ্ঠার ধুম পড়েছে । সেই আগের দিনের মতো ? সরকার রোটি কাপড়ার সন্ধান দেবেন , মকান মিলবে সস্তায়? ... ...
আরেক শঙ্কিত দেশ ফিনল্যান্ড। তাঁদের অবশ্য বাঙ্কার আছে। খবর পাই সেখানে, বিশেষ করে পূর্ব অঞ্চলে, মানুষজন অস্ত্র সংগ্রহ করছেন। ১৯৩৯ সালের শীতকালীন যুদ্ধে ( উইন্টার ওয়ার) ফিনরা সোভিয়েত ইউনিয়নের আক্রমণ কেবল ঠেকান নি, কষে কয়েক ঘা দিয়েছিলেন। এবার স্থিতি বেশ জটিল। রাশিয়ান মতিগতির সম্বন্ধে সন্দিহান ফিনল্যান্ড ন্যাটোর দ্বারস্থ হবে – এটি সেই লাল শালু যা দেখলে শ্রী পুতিন উচ্চকিত হয়ে ফিনল্যান্ডে হানা দিতে পারেন। শোনা যাচ্ছে সুইডেনও নিজেকে বিপন্ন বোধ করছে। শিগগির ন্যাটোর দুয়োরে করা নাড়তে পারে। ... ...
কাগজে কলমে রোমানিয়ার ইউক্রেন সীমান্ত প্রায় ছশো কিলোমিটার লম্বা কিন্তু তার মাত্র অর্ধেকটা স্থলপথ। বাকিটা জলপথ- পার হতে হয় দানিউব নদী অথবা কৃষ্ণ সাগরের ব দ্বীপ দিয়ে। ক্যালে থেকে প্রধান রোমানিয়ান চেক পয়েন্ট সিরেত প্রায় বাইশ শো কিলোমিটার, আবশ্যিক বিরতি সহ চব্বিশ ঘণ্টার ড্রাইভ। সেখান থেকে ইউক্রেনের ট্রেন বা রাস্তার যোগাযোগ তেমন ভালো নয়। আরেকটা সমস্যা রোমানিয়ার নিজের আভ্যন্তরীণ পরিবহন কাঠামো। দু দশক আগে হাঙ্গেরিতে বাণিজ্যের সূত্রে গিয়ে দেখেছি ভিয়েনা থেকে বুদাপেস্ত (এম ওয়ান) এবং বুদাপেস্ত থেকে রোমানিয়ান বর্ডার যাওয়ার চমৎকার অটোবান (এম সেভেন) তৈরি হয়ে গেছে। ... ...
আমাদের গ্রামে যে সব ইউক্রেনিয়ান পরিবারকে আশ্রয় দেওয়া হবে তাঁদের আজ এক লম্বা প্রশ্নোত্তরের ফর্ম ভর্তি করতে হচ্ছে – এই সব শিশু এবং তাঁদের মাতারা যে সন্ত্রাসবাদী বা অলিগারকের সন্ততি নন সেটি প্রথমে প্রমাণ করতে হবে। এই পদ্ধতির কেতাবি নাম ভেটিং। বিশ বছর আগে চেলসি ক্লাব এবং লন্ডন শহরে একাধিক অট্টালিকা কেনার সময়ে রোমান আব্রামোভিচকে ব্রিটেন কোন প্রশ্ন করে নি। আজ অন্তত মুখরক্ষার্থে ব্রিটিশ সরকার এইসব অপ্রিয় প্রশ্ন করছেন। মিখাইল ফ্রিডমান গত সপ্তাহে লন্ডনে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন। তিনি নাকি সেই ডাক্তারের ২০০ পাউনডের ফি দিতে পারেন নি – সব টাকা আটকে আছে। ... ...
১৯৪৫ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ চার্টারের অন্যতম ফাউনডার মেম্বার ইউক্রেন।সমীর সার আরও বলেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগ দেবার সময়ে ইউক্রেনকে স্বতন্ত্র হয়ে যাবার (রাইট টু সিসিড) অধিকার দেওয়া হয়, সংবিধানের ৬৯ নম্বর ধারা অনুযায়ী। মহান অক্টোবর বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গে ইউক্রেন সোভিয়েত ইউনিয়নে যোগ দেয় নি। দেশের মধ্যে বিবদমান নানা দলের লড়াই চলছে সেই সুযোগে সোভিয়েত ইউনিয়ন বন্ধুর হাত বাড়িয়ে বলল – আহা, আপোষে ঝগড়া ঝাঁটি করো না। এসো আমার ঘরে এসো। আমি তোমার বড়ো ভাই। গলে মিলো। সেটা ১৯২২। সেই আলিঙ্গন থেকে মুক্তি চাইছে ইউক্রেন। ... ...
পাশের গ্রাম বিসলি থেকে সাইমন এলেন কাল সন্ধ্যেয়। মা ইউক্রেনিয়ান, তাঁর বাবা জন্মেছেন মুসুরিতে, ইংরেজ , কলকাতার ডন বসকো স্কুলে পড়েছেন! সাইমনড় স্ত্রী ইরিনা ইউক্রেনিয়ান দিদিমা নাৎসিদের অগ্নি চুল্লী থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে ইংল্যান্ডে আসেন। সাইমন একদা বার্লিনে কাজ করেছেন ভালো জার্মান বলেন। আমাদের সংগ্রহশালা থেকে টিনের খাবার, জামা কাপড় নিয়ে গেলেন। জানা গেলো এতো সামগ্রী জড়ো হচ্ছে যে এবার যাত্রা হবে ট্রাকে। সারি সারি ট্রাক চলেছে পোল্যান্ডের দিকে। ওষুধ পত্র পাঠানোর ব্যবস্থা হয়েছে ছোট প্লেনে। বালিগঞ্জের বিভিন্ন ফারমাসি থেকে আমার যোগাড় করা দুশো আমক্সিসিলিন উঠবে সেই প্লেনে। ঘড়ির কাঁটার মতো চলছে কাজ। ... ...
এই যুদ্ধ প্রতি মুহূর্তে ছুঁয়ে যাচ্ছে আমাদের পরিবারকে এবং পূর্ব ইউরোপের অনেক বন্ধুজনকে। আমার রোমানিয়ান স্ত্রীর কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনকালটা গল্পে পড়া কাহিনি নয়। মাখনের জন্য দীর্ঘ লাইন। কাঠের টুল পেতে হোম ওয়ার্ক করেছে সেখানে। যে কোনো বিরোধী মতামতের মানুষকে পাড়া থেকে অদৃশ্য হয়ে যেতে দেখেছে নিয়মিত। অত্যন্ত গোপনে রেডিও ফ্রি ইউরোপ শুনেছে বাবার পাশে বসে। চাউসেস্কু শহর ভ্রমণে বেরুলে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে পতাকা নেড়েছে। সেটাই নিয়ম ছিলো। ... ...
- আমাদের বাড়িটা খুলে দিতে পারি? - মানে ঢুকতে ভিসা পাসপোর্ট লাগবে না? - স্টপ ইট। বলছি আমি একা মানুষ। নানান বাড়িতে ঘোরাঘুরি করে দান সংগ্রহ আর প্যাক করার চেয়ে ভালো হয় যদি সেই সব দান আমাদের বাড়িতে পৌঁছে যায়। তাহলে বাড়িতে বসে আমি আর কয়েকজন সেগুলো বেঁধে দিতে পারি। শুক্র থেকে রবিবার মায়াও সাহায্য করবে। - তাহলে চালাঘর আর সুইমিং পুলটাও খুলে রাখো। এখন কেউ কি আর জলে নামবে? ... ...