এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বৈঠকি আড্ডায় আবার ৩৩ 

    হীরেন সিংহরায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০২ আগস্ট ২০২৫ | ৪৯ বার পঠিত
  • বার্লিনের  কৌতুক

    এক

    মিষ্টি  কথা সবাই বলতে পারে ,অভিযোগ করতে  এলেম লাগে

    বানকো দে চিলির  জন্য একটি আন্তর্জাতিক ঋণ  সংগ্রহের কাজে  বাজারে নেমেছিলাম ড্রেসনার ব্যাঙ্ক লুকসেমবুরগের সঙ্গে । ব্যাপারটা কিঞ্চিৎ জটিল , দক্ষিণ আমেরিকার ঋণ গ্রহীতা এই স্টেজে নতুন,   প্রথমবার এখানে  নেমেই চিলির ব্যাঙ্ক চায় সাত বছরের লোন। আমাদের দুই ব্যাঙ্কের যৌথ প্রয়াস সত্ত্বেও কাজটা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়েছে , খদ্দের অপ্রতুল । ড্রেসনার ব্যাঙ্কের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিং চিফ দিতমার আমাকে নিয়ে গেছে তার ক্লাবে । লন্ডনের ক্লাব কালচার লুকসেমবুরগে নেই তবে এদের স্টাইলও মন্দ নয়,  কেদারা  বেশ আরাম দায়ক , রেড ওয়াইন তারিফ-এ-কাবিল। দিতমারকে বললাম এই সবে তো মাঠে নেমেছি , চেষ্টা চলছে পুরো দমে , এখন দেখা যাক সামনে কি আছে ।  রেড ওয়াইনের পাত্রটি হাতে তুলে নিয়ে চিন্তিত মুখে  দিতমার বললে, হীরেন,  মুশকিল কি জানো ? ভবিষ্যৎটা আর আগের মতন তেমন  উজ্জ্বল নয় ( ডি তসুকুনফট ইস্ট নিখট মেহর জো শোন ভি ডি ফ্রুইয়ার মাল ওয়ার ) !

    দিতমার বার্লিনের মানুষ । নেহাত চাকরি সূত্রে তার প্রিয় শহর ছেড়ে এখানে ওখানে গড়াচ্ছে , তার বার্লিনিয়ানা কখনো বদলায় নি । ভবিষ্যতটা আর আগের মতন নয় এমন টার্ন অফ ফ্রেজ ছাড়তে  পারে একমাত্র বার্লিনের আসলি আদমি।  তার সঙ্গে যতো মিশেছি ততোই সেটা বুঝেছি । আমার জার্মান অভিজ্ঞতার  বাড়ফাট্টাই   সে এক ঝটকায় উড়িয়ে দিয়েছে । বলেছে,  কি  দেখেছো ? থেকেছ ফ্রাঙ্কফুর্টে , সেটা  একটা গণ্ডগ্রাম, ডুসেলডরফ হাতুড়ি পেটানো মিস্ত্রিদের  আখড়া , মিউনিক হলো চাষা গোয়ালাদের হাট, হামবুর্গ ফিরিওলার বাজার ।  কখনো কাজ করেছো বার্লিনে ? জানি দু সপ্তাহ ট্রেনিং নিয়েছ আমাদের ব্যাঙ্কে , বার্লিন চেনো  নি !

    বার্লিনার  নবাব কে জবাব দেয় কারণ সে হাজির জবাব , অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করার বদভ্যাস তার নেই।  তার ভাষা চোখা , নিশানায় নির্ভুল , উদ্ধত , হাই ডেসিবেল , স্মার্ট, কখনো তির্যক । দৈনন্দিন কথোপকথনের  স্টাইল তার নিজস্ব , এর মধ্যে  কৌতুক খুঁজে নেবার  দায়িত্ব আপনার আমার, তার নয় । মুজতবা আলী সাহেব পেশাওয়ারের আহম্মদ আলীকে বলেন, এই সামান্য রসিকতায় আপনি এত প্রচুর হাসতে পারেন কি করে ? জবাবে  তিনি বললেন, হাসি কি আর গল্পে ঠাসা থাকে?  হাসি থাকে খুশ দিলে । বার্লিনারের  বচন  শুনে আমরা  ঠা ঠা করে হাসতে পারি,সেটা আপনার আমার জিম্মেদারি। আমাদের মনোরঞ্জনের জন্যে বার্লিনার তার শব্দের মণি মুক্তো  ছড়ায়  না । সে তাই বলে যা তার  মুখে , মনে আসে ।

    বাকি দুনিয়া এর নাম দিয়েছে  বার্লিনের  কৌতুক , বেরলিনার ভিতস।


     
    বার্লিনের খণ্ডহর - কাইজার ভিলহেলম গিরজে 
     
    রোমের ভাঙ্গা চোরা কলোসিয়াম দেখে গাইডকে বার্লিনার বলে, এ আর কি   ? একবার বার্লিন এসে আমাদের খণ্ডহরগুলো দেখে যান । আমরা তার জন্যে পয়সা নিই  না , টিকিটও  লাগে না । ব্যাভেরিয়ার অপূর্ব হেরেন কিয়েম জের তীরে দাঁড়িয়ে নিজেই অভিভূত হয়ে গাইড  বলেন ,  আহা , দেখুন কি আশ্চর্য  সুন্দর এই নীল হ্রদ, দূরে সাদা বরফে মোড়া পাহাড়!  বার্লিনার তাঁকে বলে , পাহাড় আর জলটাকে বাদ দিলে , এমন কি আহামরি  ? পিসার হেলানো টাওয়ারের সামনে দাঁড়িয়ে সে  বলে, আপনি আমাদের টি ভি টাওয়ারটা দেখেন নি  বুঝি ? সেটা আরও হেলে গিয়েছে, চড়তে লিফট লাগে না।  সুইস মাটারহর্ন দেখে বার্লিনার বলেছে, এর চারপাশে অনেক উঁচু পাথর আছে তাই কতটা উঁচু বোঝা যায় না।  এই পাহাড়টাকে বার্লিনে বসিয়ে দিলে সেটা বোঝা যাবে । সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে নোংরা ধোঁয়া পড়া উ বান টানেলে ট্রেন ঢুকে পড়লে সে  বলে, আঃ কি আরাম, এতক্ষণে মনে হল  নিজের দেশে পৌঁছেছি ।

    শব্দের বিচিত্র উচ্চারণ ও তার ব্যবহার বার্লিনি কৌতুকের একমাত্র অস্ত্র  নয় ; অনেক শহরেই তেমনটা দেখা যায়।  ইস্ট লন্ডনের ককনিতে এইচ উচ্চারিত হয় না,  পিগম্যালিয়নের এলাইজা বলে রাইন ইন স্পাইন স্টেজ মাইনলি ইন দি প্লাইন, মেলবোর্নে কপিল দেবকে রিপোর্টার জিজ্ঞেস করেছিলেন , হ্যাভ ইউ কাম টু  ডাই – থতমত হয়ে কপিল দেব বলেন উই হ্যাভ কাম টু প্লে ,  ম্যানচেস্টারে আমরা বাস নয় বুসে চড়ি , লিভারপুলে খাদ্য ও পানীয় যথাক্রমে স্ক্র্যান এবং বেভি , মিউনিকে বহিরাগতকে বলা হয় জুগ্রোয়াস্তা , এডিনবরাতে চপ্পলকে বলে ব্যাফি , হামবুর্গ ব্রেমেনে গুটেন মরগেন নয় , শুধুই ময়েন । বার্লিনার  শব্দের যে ভাঙ্গাগড়া  করে  তা তার নিজের মাঠের খেলা। কিন্তু বার্লিনারের  এলেম আরও গভীরে, , আপাত অশিক্ষিত বাচনভঙ্গির মধ্যে জ্ঞানে অজ্ঞানে লুকিয়ে রাখে তার  লাগামবিহীন রঙ্গ  রসিকতা ।

    বার্লিনারের   মুখের ভাষা  জার্মান কিন্তু  সে যে ভাবে তা ‘উশ্চারন’ করে তার  বিধি নির্দেশ করার জন্য বার্লিন এখনো তার আপন সুনীতি চাটুজ্যের অপেক্ষায় আছে। এই ধরুন জি ( G) , সারা ইউরোপে এর বিবিধ উচ্চারণ শোনা যায় । স্পেনে যেটা শোনায় খ , হল্যান্ডে ঘ , সুইডেনে অবস্থান অনুযায়ী  সেটা গ, ঘ এমনকি  ওয়াই  হতে পারে । বার্লিনার   জি (G) অক্ষরের উচ্চারণে একান্ত অপারগ । এই বর্ণটি শব্দের  যেখানেই আসন নিক না কেন,লোকমুখে শোনায় ইউ । যেমন ভালোর জার্মান  গুট,  বার্লিনে সেটা শোনায় ইউট। কখনো ( R) হারিয়ে যায় ,মাইস্তার (মাস্টার ) হয় মেসতা ।

    গোয়েথে,  শিলারকে কলা বা সসেজ দেখিয়ে বার্লিন ব্যবহার করে তার আপন অলিখিত নিয়মাবলী  । একটা ছোটো উদাহরণ  :

    গোয়েথে ইনসটিউটে  শিখেছি , ইখ লিবে দিখ (আমি তোমায় ভালবাসি) , কিন্তু বার্লিনার   বলে  ইখ লিবে দিয়র ( আমি তোমাতে ভালবাসি )।

    জার্মানের মাতা সংস্কৃতের নিয়ম মতন , আমি  তোমাকে ভালবাসি -ইখ লিবে দিখ ।  দু মানে তুমি  তা  থেকে দিখ ,কর্ম কারক সঠিক। কিন্তু বারলিনার বলে দিয়র, সেটি  করণ কারক,  আমি তোমাকে নয়, তোমাতে ভালোবাসি!  

    নদে শান্তিপুরের পাটভাঙা ধুতি পরা পণ্ডিতের জার্মান অবতার , অর্থাৎ  হানোভার -গোয়েটিঙেনের সুট বো টাইধারী  প্রফেসর এ বাক্য শুনলে কানে আঙ্গুল দেবেন , আপনাকে ক্লাস থেকে বের করে দেবেন ।  বার্লিন আবিষ্কার করেছে নতুন নতুন শব্দ, অজস্র জার্মান শব্দকে দিয়েছে নতুন অর্থ । উচ্চারণ ও ব্যাকরণ নিয়ে বার্লিনের পথে ঘাটে যে খেলা প্রতিদিন চলে,  তার অনুবাদ কোন ভাষায় হতে পারে না । তা বার্লিনের একান্ত আপন, সিক্রেট ক্লাসিক।  টুলো পণ্ডিতের পাঠশালায় পড়া বহিরাগত জার্মান এখানে এসে প্রথমত ভাবে,  এ কোন ভাষা ? কান পেতে  শুনলে মনে হয়  অর্ধ শিক্ষিত চাষি বাসীর মুখের  আঞ্চলিক ডায়ালেকট।  ছাইয়ের ভেতরে  লুকিয়ে থাকে এক ঝকঝকে বুদ্ধির বিন্যাস।

    ফলের দোকানে
     
    • জার্মান আপেল আছে ?
    • কেন? আপনি কি আপেলের সঙ্গে কথা বলবেন না আপেলটা  খাবেন ?

    চুল কাটার সেলুনে
     
    • আজ আপনার অভিলাষ ( ডের হের উনশেন ?)?
    • আজ তিনটেই ছোটো করে।  
    • মানে?
    • আমার চুল, দাড়ি আর আপনার গল্প


    বন্দর শহরের মানুষের মুখের ভাষায় অজান্তে মিশে যায় সতত সঞ্চরমান বিদেশি নাবিকের, আগন্তুক ব্যবসায়ীর ভাষা , তার শব্দাবলী।  যেমন হামবুর্গের ডক এলাকায় প্লাত ডয়েচ  বা অলি গলির  জার্মানে লন্ডন ইস্ট এন্ডের সুর শোনা গেছে ( আমার জার্মানি পশ্য ) । আটশো বছর আগে বার্লিনের পত্তন –সেই   ছোটো জনপদে এসেছেন ফ্লেমিশ ব্যবসায়ী, বাক্স ভর্তি দ্রব্য সামগ্রীর সঙ্গে এনেছেন তাঁদের মুখের ভাষা।  বার্লিনকে সমৃদ্ধ করেছে  মূল  জার্মান থেকেই জন্ম নেওয়া ইহুদিদের মুখের ভাষা,  ইদিশ ; পোল্যান্ড বেলারুশ সাইলেশিয়া হতে এসেছেন  স্লাভিক জনতা ;  একদিন নেপোলিয়নের বিজয় বাহিনী এসে পৌঁছেছে,  তিনি ব্রানডেনবুরগের গেটের ওপরের রথটি প্যারিসে নিয়ে গেলেন  কিন্তু তাঁর সেপাইরা  রেখে গেল কিছু ফরাসি  শব্দাবলী , বাচন ভঙ্গি ।

    কলকাতার কোনো  মহলে  বড়ো ছুরির নাম  রামপুরিয়া , দিশী মদ চুল্লু, গলার হার ছল্লি,  পাঁচশোর নোট গান্ধী *।  বার্লিনের  নিচু মহলে সুপ্রচলিত স্ল্যাঙের সমষ্টির নাম রোটওয়েলশ - সেখান থেকে নির্দ্বিধায় শব্দ আহরণ করেছে বার্লিনের আম জনতা । যেমন  কফির গ্লাস বমবে ,ব্লেফেন মানে ভয় দেখানো , ফেখটেন ( সঠিক জার্মানে তলোয়ার খেলা, ফেন্সিং ) মানে ভিক্ষে করা ।

    গোড়ার  গলদটি সত্বর মেনে  নিই -  বার্লিনার বলে কেউ নেই।  এটি একটি সামগ্রিক নাম ( জার্মানে জামেলবেগ্রিফ ) মাত্র । খাস বার্লিনের বারোটি পাড়ার মানুষ এটি মানবেন না । তাঁর নিজস্ব অননুকরণীয় ভাষায় তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলবেন, আমাদের পরিচিতি পাড়ার নামে, বার্লিন শহরের নামে মোটেও নয়।  শারলটেনবুর্গার ,পানকোভার , স্টিগলিতসার, রাইনিকেনডরফার ইত্যাদি।  শ্যামবাজারের শশী বাবুর ভাই বেরাদর সব বড়ো শহরেই আছেন, রাসবেহারি এভিনিউ আর ফড়েপুকুর একই ভাষায় কথা বলে না। ফ্রাঙ্কফুর্টের যে পাড়ায় বাস করেছি তার সরকারি নাম বর্ণহাইম,  লোকমুখে বেরনেম । দুটো বিয়ারের পরে বয়স্ক মানুষেরা আমাদের মতন দুজন বিদেশিকে অত্যুৎসাহে বেরনেমের মুখের ভাষার  ( মুণ্ডআর্ট ) সঙ্গে কয়েক গজ দূরের লিনডেনবাউমের বিশাল পার্থক্যের সবিস্তার ব্যাখ্যা করেছেন। আমি যখন আমার ট্রিভিয়ার ভাঁড়ারে মণি  মাণিক্য সঞ্চয়ে ব্যস্ত, স্টেট ব্যাঙ্কে আমার সহযোগী শ্রীধর ( পরে এম ডি ) সেই সব জ্ঞানগর্ভ বাণী  শুনে গেছে নির্লিপ্ত ভাবে,  বিয়ারটা যখন পরস্মৈপদী !  
     
    বার্লিনের বাতাস রুক্ষ , তার কৌতুক শুষ্ক – ড্রাই হিউমর,  যা  সবিশেষ মেলে ব্রিটিশ হিউমরের সঙ্গে ।  বার্লিনের উদ্ধত দুর্বিনীত রসিকতা কোনো  হুলিদাসকে মাথায় তুলে রাখতে একান্ত অনিচ্ছুক , কাউকে খাতির করা তার ধাতে সয় না  ,  কখনো কোনো  ডেকোরাম সে  মানে না ।  তাই বার্লিনের বার,  কফি হাউসের বক্র মন্তব্য কোনোখানে মিলে মিশে যায় আমাদের উত্তর কলকাতার চায়ের দোকানের , কুঠি ঘাটের আড্ডার  সঙ্গে।

    ১৯৭৮ সালে প্রথমবার বার্লিন গিয়ে জেনেছিলাম অনেক সরকারি মূর্তি বা ভবনকে বার্লিন চেনে অন্য নামে।  



    শারলটেনবুর্গে স্টইবেন প্লাতসের নির্বস্ত্র অশ্বারোহী স্ট্যাচুর নাম শেষ করদাতা ( ডের লেতসতে স্টইয়ারতসালার / লাস্ট ট্যাক্সপেয়ার )।  অন্তিম পুঁজিটুকু সরকারি তিজোরিতে জমা করে সে ঘোড়ায় চড়ে পালাচ্ছে ।



    যুদ্ধের পরে নির্মিত কংগ্রেস ভবনের নাম  গর্ভবতী ডিম্ব  ( শোয়াঙ্গারে আই )।  



    জিগেসআলে বা বিজয় সরণিতে দু হাত অন্তর প্রস্তরীভূত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন অনেক জার্মান মনিষী , রাজপুরুষ ।বার্লিন তার নাম দিয়েছে পুতুলের গলি ।  

    একশো বছর আগে বার্লিন ছিল ইউরোপের পারমিসিভ সোসাইটির শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াঙ্গন। ফ্রিতস লাঙ্গ ( মেট্রোপোলিস,ডক্টর মাবুসে ),  ইওসেফ ফন স্টারনবেরগ (মারলেনে দিতরিখের ব্লাউয়ে এঙ্গেল / ব্লু এঞ্জেল ), রাইনহোলড শুঞ্জেল ( ভিক্টর /ভিক্টোরিয়া , পরে ১৯৮২ সালের রিমেক ,  জুলি অ্যানদ্রুজের  একই নামের ছবি ) বার্লিনের সিনেমা জগতকে তোলপাড় করেছেন, সেই সঙ্গে বার্লিন ক্যাবারে ! ক্রিস্টোফার ঈশারউড ( গুডবাই বার্লিন) এবং স্যালি বোলসের  কথা বারবার উল্লেখ করেছি, বিশেষ করে ঈশারউডের  লেখার ওপরে আধারিত  লিজা মিনেলি অভিনীত ক্যাবারে  ছবিটির কথা মনে করুন।  সেই গান , টুমরো বিলংস টু মি , যখন সবার ডান হাত অতি ধীরে নাৎসি স্যালুটের ভঙ্গিতে ওপরে উঠে যায়। বিশের দশকে  বার্লিনের একটি ক্যাবারের নামই  ছিল এলফ শারফরিখটার ( এগারো জন হত্যাকারী ) ; তাদের ব্যঙ্গের পাত্র সকল রাজনৈতিক নেতা ও তাঁদের রাজনীতি ।  প্রাশিয়ান বার্লিন একদিন হারিয়ে গেল, ১৯৩৫ সালে গোয়েবলস ক্যাবারে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেন, তার দুর্বিনীত অট্টহাসি স্তব্ধ রইল  বারো বছরের নাৎসি শাসনে । তারপর একদিন ফরাসি ব্রিটিশ আমেরিকান রাশিয়ান চার সেক্টরে বার্লিন ভাগ হলো কিন্তু কারো মুখের ভাষা কি বদলাল ? রাশিয়ান সেক্টরের লিখটেনবের্গে কফি পাওয়া যায় না , পাবে মেলে কেবল  রাদেবের্গার পিলস বিয়ার, পাড়ার মোড়ে স্তাসি গোয়েন্দা অলস ভঙ্গিতে গাড়ির আসা যাওয়া দেখছে ।  অতএব  লিখটেনবের্গার চতুর ভঙ্গিতে শুরু করে আরেক বক্তিমে –

    গেনজে মার্কেটে ছবি সহ একটি প্রকাণ্ড ব্যানার
     
    • ওটা কার ছবি ?
    • স্টালিন । উনি আমাদের মুক্তিদাতা ।
    • ভালো কথা। উনি কি রাশিয়ানদের হাত থেকে আমাদের মুক্তি দিতে পারেন?
     
    অথবা

    সাইবেরিয়াগামী  ট্রেনে তিনজন জার্মান ।

    প্রথম জন     তোমার কতদিনের সাজা ?
    দ্বিতীয়          পাঁচ বছরের।  
    প্রথম           অপরাধ ?
    দ্বিতীয়          পোপোভের পক্ষে কথা বলেছিলাম।তা তোমার সাজা কতদিনের? অপরাধ?
    প্রথম           পাঁচ বছর , পোপোভের বিরুদ্ধে ছিলাম বলে।

    তৃতীয় ব্যক্তি  এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন ।  এবার তাঁকে প্রশ্ন

    প্রথম           আপনার কতদিনের সাজা?
    তৃতীয়          পাঁচ  বছরের ।
    প্রথম           অপরাধ?
    তৃতীয়          আমার নাম পোপোভ।  

    স্বভাব যাবে কোথায় ?

    কয়েকশ বছরে অনেক পালা বদল হলেও  শেলির ক্লাউড কবিতার লাইন  ধার করে বলা যায়, আই চেঞ্জ বাট আই ক্যান নট ডাই ! নানা কালে নানা রূপ ধরে বেঁচে বর্তে থাকে বার্লিনের কৌতুক ।  



    পুরনো বার্লিনের পটসডামার প্লাতস বা  স্কোয়ার ছিল শহরের প্রধান ট্রাফিক হাব , যুদ্ধের পরে সেটা পুব বার্লিনের ভাগে পড়ে । ১৯৭৮  সালে পশ্চিম বার্লিন থেকে  একটা সাময়িকভাবে  বাঁধা ভারার ওপরে চড়ে  দেখেছি মানব বর্জিত  বিশাল রুক্ষ সেই পটসডামার প্লাতস , যার একদিকে হিটলারের বাঙ্কার , অন্য দিকে গোয়েরিঙের হাওয়া অফিস। এখন পটসডামার প্লাতস গমগম করে , তার সুদিন ফিরে এসেছে । বার্লিন কি আর এই মউকা ছাড়ে?


     
    হালের বার্লিন পুনরায় সোচ্চার , লাউড ।
    ল্যাম্প পোস্টের গায়ে ঝুলছে  ছোট ছোট ডাস্টবিন তার ওপরে লেখা  –



    পুতসডামার প্লাতস

    পুতসেন মানে পরিষ্কার করা , প্লাতস অর্থ স্কোয়ার, চত্বর।  কিন্তু প্লাতস একটি স্থানও  নির্দেশ করতে পারে অর্থাৎ পটসডামার প্লাতস হয়ে গেলো ‘ পরিষ্কার করে এখানে ময়লা জমা দিন !’  বার্লিনকে স্বচ্ছ রাখুন!  

    জার্মানির  আইন কানুন সব্বনেশে।  সেখানে প্রচলিত  নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সরকারি সম্পত্তি,  ডাস্টবিনের নাম বদলে দেওয়ার ঔদ্ধত্য  রাখে একমাত্র বার্লিন।  

    পু:

    বার্লিন নয়, সঠিক উচ্চারণ অবশ্যই বের্লিন । কিন্তু যিনি আমাকে জার্মানি তথা ইউরোপ চিনিয়েছেন, সেই মুজতবা আলী সাহেব, সর্বদা বার্লিন লিখেছেন , কখনো বেরলিন লেখেন নি । দেশে বিদেশেতে সর্দারজি  আলী সাহেবকে জিজ্ঞেস করেন  , আপনি কাবুলীওয়ালা বলেন কেন ? কাবুলের লোক হয় হবে কাবুলী নয় কাবুলওয়ালা . কাবুলীওয়ালা হয় কি করে?  শুনুন তার উত্তরে আলী সাহেব কি বললেন –

    হকচকিয়ে গেলুম স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন ‘কাবুলীওয়ালা” গুরুকে  বাঁচাই কি করে ?

    যদ্যপি আমার গুরু শুঁড়ি বাড়ি যায়
    তথাপি আমার গুরু নিত্যানন্দ রায়

    আমি বললুম, এই আপনি যেমন । জওহর এক বচন , জওয়াহির বহু বচন তাহলে জওয়াহিরাত বলেন কেন?   

    গুরুর ওপরে খোদকারি করার দুর্মতি আমার যেন কোন দিন না হয় ।

    *কলকাতা শহরের নিচতলা , একতলা,  দোতলার শব্দাবলী  আমাকে চিনিয়েছেন সুপ্রিয় পাঠক ; তাঁর ‘আরেকটা কলকাতা’  সকলের অবশ্যপাঠ্য তালিকায় থাকা  উচিত।  

    ক্রমশ

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০২ আগস্ট ২০২৫ | ৪৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে প্রতিক্রিয়া দিন