প্রথম পর্ব
- এখানে ভিসার দরখাস্ত নেওয়া হয় ?
- হয়। এই ফর্মটা ভর্তি করে আপনার পাসপোর্ট জমা দেবেন। হাতের লেখাটা যেন পড়া যায় । কলম চাইবেন না। নিয়ে কেউ ফেরত দেয় না বলে আর দেওয়া হয় না ।
- আমার কলম আছে। পাসপোর্ট ছাড়া আর কিছু লাগে? চাকরির বা বেতনের প্রমাণ পত্র?
- সেটা ফর্মে লেখা আছে । পড়ে নেবেন।
- ভিসা পেতে কতো দিন লাগে ?
- সপ্তাহে একবার আমাদের ব্যাগ যায় রোমে ; তাঁদের যখন ইচ্ছে ফেরত পাঠান। ছবি এনেছেন?
- হ্যাঁ। কটা দিতে হয় ?
- সুন্দরী মহিলা হলে দুটো । আপনি একটা দেবেন।
মাথায় চুল নেই , মুখে দাড়ি , পোকার ফেস । জার্মান গ্রাউয়ে মাউস ( ধূসর ইঁদুর – মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই ) কথাটা বোধহয় এঁকেই মানায় ।
শহরের কর্মব্যস্ততা থেকে খানিক দূরে ফ্রাঙ্কফুর্টের বোটানিকাল গার্ডেনের পাশের রাস্তায় একটি স্যান্ডস্টোন ভিলায় ইতালিয়ান কনসুলেটের ভিসা দপ্তর । ঢুকতেই বাঁ হাতে এক মহিলা ; ফোনে কারো সঙ্গে গল্প গুজব করছিলেন। রিসিভারে হাত রেখে জানতে চাইলেন আমি কি উদ্দেশ্যে এসেছি। তাঁর প্রভাতি অধিবেশনে বাড়তি বিঘ্ন না ঘটিয়ে দেয়ালে জার্মানে ‘ ভিসুম’ লেখা বোর্ডটি দেখালাম। । তিনি অঙ্গুলি নির্দেশে আমাকে ডান হাতের পয়লা দরজার দিকে এগিয়ে যেতে বলে আবার টেলিফোনে তাঁর গল্প গুজবে মনোনিবেশ করলেন ,’ আখ , ডাস ইস্ট নিখট ভার ( হতেই পারে না )!
বড় সড় ঘর , উঁচু সিলিং , টেবিলের ওপাশে বসে আছেন তিনি । চতুর্দিকে ইতালিয়ান খবরের কাগজ ছড়ানো - লা স্টামপা ( দি প্রেস ) , লা রেপুবলিকা , জিওরনালে এবং তার পাশে গাজেতে দেলো স্পোর্ট ( আমার দেখা গোলাপি কাগজে ছাপা একমাত্র দৈনিক পত্রিকা) । দেখলে মনে হবে লাইব্রেরীর রিডিং রুম। তাঁর মাথার ওপরে ইতালির শেষ রাজা ভিক্টর ইমানুয়েল ছবি হয়ে বিপজ্জনক ভাবে ঝুলে আছেন, একটু ঝড় ঝাপটা দিলে নেমে এসে ভিসা অফিসারের মস্তক চূর্ণ করতে পারেন। বহুদিন যাবত এলেবেলে মানুষের হাতে শাসনভার ছেড়ে দিয়ে মহান রোমান সিজার, সম্রাটবৃন্দ সপরিবারে চিত্রার্পিত হয়েছেন নানান মিউজিয়ামে, প্রস্তর বা ধাতব মূর্তিতে দাঁড়িয়ে আছেন বহু চত্বরে , উদ্যানে।
কিন্তু এই গণতান্ত্রিক দেশের ভিসা অফিসে ভিক্টর ইমানুয়েল দেখা দিয়েছেন কেন ? জিজ্ঞেস করার সাহস হল না।
অফিসের সাইজ , পরিষ্কার ডেস্ক এবং মোট কর্মী সংখ্যা দেখে বোঝা গেলো তাঁর বিশেষ কাজকর্ম নেই । তৎকালীন কমন মার্কেটের নটি দেশের অধিবাসীদের ইতালি যেতে ভিসা লাগে না, কোনো জার্মান এঁর আরামে অযথা উপদ্রব ঘটাবে না । ইনি বসে আছেন কেবল আমাদের মতন থার্ড কান্ট্রি ন্যাশনাল , উটকো লোকেদের সেবায় নিবেদিত প্রাণ হয়ে, নীল বা সবুজ রঙের পাসপোর্ট হাতে নিয়ে পথ ভুলে কেউ কখনো যদি এসে হাজির হয়, আবদার ধরে ইতালি যাবো ! সেটা অবশ্য নিতান্ত বেগার খাটা নয়, প্রবেশের অনুমতি প্রদান কর্মে মহামান্য ইতালিয়ান সরকার অন্তত তিন হাজার লিরা ( ছ মার্ক – সেকালের ২৫ টাকা ) ও আপনার ধৈর্য দাবি করেন।
প্রসঙ্গত , আমাদের সকলের বিদেশ ভ্রমণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে আছে দুটি ইতালীয় অবদান।
জীবনের হাল না ভেঙ্গে যে নাবিক সঠিক দিশায় উপনীত হয়ে নৌকো বা জাহাজ থেকে নেমে কোন বন্দর অতিক্রম করেন, সেই অভিযানকে ইতালিয়ানে বলা হয়েছিল – পেরিয়ে বন্দর বা ‘ পাসে পোরত’ যা থেকে পাসপোর্ট কথাটা এসেছে। ফরাসিরাও অবশ্য এ শব্দের পিতৃত্ব দাবি করে থাকেন বলে শোনা যায় । জার্মান সহ বহু ইউরোপীয় ভাষায় তার নাম শুধু ‘পাস’- অতিক্রম ।
ভিসা শব্দের ওপরেও ইতালিয়ান কপিরাইট অনস্বীকার্য । দেখার ল্যাটিন ক্রিয়াপদ ভিদেরে থেকে ( জুলিয়াস সিজার বলেছিলেন ভেনি ভিদি ভিচি – এলাম দেখলাম জয় করলাম ; ভিদি অর্থ দেখেছি বা দেখেছিলাম )। যাকে নিরীক্ষণ করা হয়েছে সেটা ভিসা।
বন্দরে নাবিক যে পরিচয়পত্র পেশ করেন তা পাসপোর্ট , সেটির নিরীক্ষণ পূর্বক বন্দর অতিক্রমের অনুমোদনের নাম ভিসা।
অশোক স্তম্ভ শোভিত এবং সত্যমেব জয়তে খচিত ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে ইউরোপ এসেছি। তার প্রথম পাতায় আমাদের রাষ্ট্রপতির নামে পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রকে অনুরোধ জানানো হয়েছে তাঁরা যেন এর ধারককে বিনা বাধায় ভ্রমণের সুবিধা ও সকল প্রকারের সহায়তা প্রদান করেন – একবার খুলে দেখে নিন । ব্রিটিশ পাসপোর্টের প্রথম পাতায় হুবহু একই অনুরোধ - তবে সে আবেদনটি জানান দেশের রাজা রানি নয় - আম জনতার ভ্রমন নিয়ে তাঁদের কোন মাথা ব্যথা নেই : অগত্যা সেটি নিবেদন করেন সেকরেটারি অফ ষ্টেট । কোনো দেশে প্রবেশের অনুমতি চাইতে গিয়ে বুঝেছি আমাদের রাষ্ট্রপতির বা ব্রিটিশ সেক্রেটারি অফ ষ্টেটের এই আবেদনে কেউ কর্ণপাত করেন না – এমনকি আফ্রিকায় ইংরেজের পুরনো রাজত্বেও নয়। সবাই ফর্ম ধরিয়ে দেন। অর্থ দাবি করেন।
ইউরোপে প্রথম পনেরো বছর একটি বেঢপ সাইজের নীল পাসপোর্ট নিয়ে ঘুরেছি- ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানাতে পারি সেদিনের সেই কালচে নীল রঙের ভারতীয় পাসপোর্টের ইজ্জত ছিলো ।
আজ শুনলে গুল গপ্পো মনে হবে, সাতের দশকে জার্মানি যেতে ভিসা লাগতো না, ভারতীয় পাসপোর্ট দেখামাত্র তিন মাসের বসবাসের অটোমেটিক অনুমোদন। শুধু তাই নয় , সেই কাল পূর্ণ হলে পাশের কোন দেশে দু দিন কাটিয়ে আবার জার্মানি ঢুকলে পুনরায় তিন মাসের ভিসা প্রাপ্য ! আমার মা জার্মানি আসেন ভারতীয় পাসপোর্ট হাতে নিয়ে -ফ্রাঙ্কফুর্টে নামতেই নব্বুই দিনের বসবাসের ছাপ ! তিন মাসের মাথায় ইংল্যান্ড গেলাম প্লেনে । ট্রেনে ফিরছি। ডোভার পেরিয়ে জেব্রুঘেতে আমাদের ফ্রাঙ্কফুর্টের ট্রেন টিকেট আছে দেখে বেলজিয়ান পুলিশ আমার ও মায়ের পাসপোর্টে নিখরচায় ট্রানজিট ভিসার ছাপ মেরে দিলো । এবার বেলজিয়ামের লিয়েজ ছাড়িয়ে ট্রেন ঢুকল জার্মানি – আখেনে ইউনিফরম পরা জার্মান সীমান্ত রক্ষী দেখা দিলেন। আমার কেসটা সহজ :জার্মানিতে আইনসম্মত ভাবে থাকি, কাজ করি। এবার মায়ের পাসপোর্ট হাতে নিলেন। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে একটা ডিকশনারি টাইপের মোটা বই বের করে পাতা ওলটাচ্ছেন – এক সময় থেমে নিজের মনেই বিড়বিড় করলেন, ‘ ইন্ডিয়েন, নয়েনতসিগ টাগে’ ( ইন্ডিয়া নব্বুই দিন )।
সীমান্ত পুলিশ বিনা বাক্য ব্যয়ে ব্যাগ থেকে সিল বের করে ছাপ মেরে মায়ের হাতে ফেরত দিলেন। পাসপোর্ট খুলে দেখলাম প্রথম এন্ট্রি স্ট্যাম্প যেখানে পড়েছিল ঠিক তার পরের পাতায় নতুন অনুমোদন- পাসপোর্টের ধারক পরবর্তী নব্বুই দিন জার্মানিতে বাস করতে পারেন , চাকুরী মানা । ব্যাপারটা শুনে আমার দাদা বিশেষ শঙ্কিত হয়েছিলেন ; যদি সেদিন ঢুকতে না দিতো, কি করতিস ?’ আমি বলেছিলাম, এ বড়ো নিয়মনিষ্ঠ দেশ দাদা , আইন অনুযায়ী চলে – চিন্তা বা ডিসক্রিশানের কোন স্থান নেই। আইন হলো আইন- গেজেতস ইস্ট গেজেতস! তার অন্যথা হবে না।
নুরেমবেরগে আমার বন্ধু রবিন ভটচাজ পাঠাভ্যাস করতো । তাদের হস্টেলে একটি বাঙালি ছেলে আখেনে আমার মায়ের পাসপোর্ট চেকিঙ্গের গল্পটা শুনে হেসে বলল , এই ভাবেই তো আমি তিন বছর আছি এদেশে ! তিন মাস অন্তর অস্ট্রিয়া চলে যাই- ট্রেনে ঘণ্টা চারেক । তাদের ভিসা পাওয়া খুবই সহজ , রাতের খরচা বাঁচাতে অস্ট্রিয়ার পয়লা স্টেশন কুফস্টাইনের ওয়েটিং রুমে এক রাত কাটিয়ে পরের দিন জার্মানি ফিরি, আবার তিন মাসের ছাপ! শীতকালে অবশ্য হোটেলে এক রাত কাটাতে হয়- বেজায় ঠাণ্ডা। জার্মান বর্ডার পুলিশ আমার মুখ চিনে নিয়েছে। তারাও হাসাহাসি করে, বলে – গেজেতস ইস্ট গেজেতস!
অবাধে জার্মানি প্রবেশের স্বর্ণযুগ সমাপ্ত হলো আটের দশকে। সঠিক কারণ আমার অজ্ঞাত । তবে যতদূর জানা যায় এক ধুরন্ধর আইনজ্ঞ তার জন্য দায়ী। অনেক পড়াশোনা করে তিনি প্রজাতান্ত্রিক জার্মান রাষ্ট্রের সংবিধানের ( গ্রুনডগেজেতস, ১৯৪৯) এমন একটি ধারা খুঁজে পান যার মোতাবেক রাজনৈতিক কারণে অত্যাচারিত যে কোন দেশের মানুষ জার্মান ভূমিতে পদার্পণ করে আশ্রয় (অ্যাসাইলাম) চাইলে তা দিতে এ দেশ অঙ্গীকারবদ্ধ। । অনুমান করতে অসুবিধে হয় না এর মূল উদ্দেশ্য ছিল কমিউনিস্ট দেশগুলি থেকে পলাতক জার্মান মূলের মানুষকে পশ্চিম জার্মানিতে পুনর্বাসনের সুযোগ দেওয়া কিন্তু অচিরে দেখা গেলো ভারতীয় উপ মহাদেশ থেকে কিছু মানুষ বিনা ভিসায় জার্মানিতে পা দিয়েই আপন দেশের পাসপোর্ট মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে পলিটিকাল অ্যাসাইলামের জন্য আবেদন জানানো শুরু করলেন। সংবিধান অনুযায়ী তাঁদের পত্রপাঠ ফিরতি হাওয়াই জাহাজে চড়িয়ে দেওয়া যায় না । প্রাথমিক ভাবে সরকারি খরচায় কোন ক্যাম্পে রেখে খুঁটিয়ে দেখা হয় সেই আবেদন যুক্তিযুক্ত কিনা। তাতে সময় লাগে, ক্যাম্প ভরে ওঠে । এই প্রোসেসিং শেষ হলে কিছু মানুষ স্থায়ী আশ্রয়ের অধিকার পেয়েছেন; বাকিদের আপন দেশে ফেরত পাঠানো হয় জার্মান সরকারের খরচায় । অনেকের ধারণা এই বিড়ম্বনা এড়ানোর জন্য আমাদের অবাধ আগমনের ওপরে জার্মানি কুলুপ লাগায়।
ডাচ কনসুলার অফিস ছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের উত্তর প্রান্তের নিতান্ত ঘরোয়া পাড়ায় একটা ফ্ল্যাট বাড়ির দোতলায়। উটরেখট হয়ে রটারডাম যাবো ; ভিসা অফিসার জানালেন আপনি এই একই ভিসায় বেলজিয়াম লুকসেমবুরগও যেতে পারেন মানে এক ভিসার খরচে আরও দুটো দেশ মেলে ফাউ। সেই ত্রিভাষিক বেনেলুক্স( বেলজিয়াম নেদারল্যান্ড লুকসেমবুরগ )ভিসা অ্যাপ্লিকেশন ফর্ম এখনও চোখের ওপরে ভাসে- পাঁচটা প্রশ্নের উত্তর সহ ছবি , পাসপোর্ট এবং পনেরো মার্ক (আমাদের ষাট টাকা ) জমা দিলে পর ভিসা অফিসার বললেন, কাল পাসপোর্ট নিয়ে যাবেন ।
তিনটে দেশে এটি সমান চালু কিন্তু একটি ছোটো শর্ত ছিল – যে দেশ ভিসা দিচ্ছে, সে দেশে যেন প্রথম প্রবেশ করি , তারপর অন্য দুটো দেশে চলাফেরার কোন বাধা নেই! কার্যক্ষেত্রে ডাচ সরকারের ভিসা নিয়ে বেলজিয়ামে প্রথম পদক্ষেপ করার কোন বাধা ছিল না।
যদিও যাই নি কিন্তু জানা ছিল নীল পাসপোর্টের বলে ইউগোস্লাভিয়া, বুলগারিয়াতে আমাদের অবাধ প্রবেশ অধিকার। পূর্ব জার্মানি যাবার সময়ে দেখলাম পঁচিশ ডয়েচ মার্ক বদলে প্রায় মূল্যহীন পঁচিশ পূর্ব জার্মান মার্ক কেনার বাধ্যবাধকতা (তসোয়াংউমতাউশ ) পশ্চিম জার্মান নাগরিকদের জন্য আবশ্যিক হলেও নীল পাসপোর্টধারির ওপরে প্রযোজ্য নয়।
আটের দশকের শেষ অবধি ডেনমার্ক , সুইডেন, নরওয়ে, ফিনল্যান্ডে তিরিশ দিনের জন্যে আমাদের প্রবেশের পথে কোনো বাধা বন্ধ ছিল না। নরডিক ট্রাভেল পাস কিনে তিন সপ্তাহ ভ্রমণের প্রথম পর্বে হামবুর্গ থেকে কোপেনহাগেন হয়ে অসলো যাচ্ছি। ডেনমার্কের হেলসিঙ্গরে (HELSINGOR , এইচ এবং জি কেটে বাদ দিলেই পাবেন হ্যামলেটের এলসিনোর প্রাসাদ -
সামথিং ইজ রটন ইন দি স্টেট অফ ডেনমার্ক! ) সমুদ্র পেরিয়ে ট্রেন সুইডেন পৌঁছুলে কাঁচা ঘুম থেকে তুলে এক সুইডিশ পুলিশ আমার পাসপোর্ট দেখে নিয়ে বললেন , ‘ ছাপ দিয়ে দিলাম। এটা এবার আপনার ব্যাগে ভরে রাখতে পারেন । একটা দেশে যখন এসে পড়েছেন অন্য তিনটে দেশ ধরে নেবে আপনি একেবারে লিগাল !’ যথার্থ ! একুশ দিন বাদে ডেনমার্ক থেকে ফেরার সময় পুটগার্ডেন মিটে জে স্টেশনে জার্মান সীমান্ত পুলিশকে সেটি দেখিয়েছি।
ঠিক কোন কারণে যে ইউরোপের উত্তরে চারটি বন্ধু দেশ আইন বদলিয়ে আমাদের প্রতি বিমাতৃসুলভ আচরণ শুরু করলেন জানি না। বছরটা খুব মনে আছে - ১৯৯১। স্টেট ব্যাঙ্কে কাজ করার সময় কপর্দকশূন্য টুরিস্ট হিসেবে ঘুরতাম এবার সিটি ব্যাঙ্কের কাজে ওই দেশগুলিতে বাণিজ্যের সন্ধানে নিয়মিত আসা যাওয়া শুরু করেছি , ভিসার ঝঞ্ঝট নেই । হঠাৎ কি যে হলো। । সুইডেন যাবো ; আমাদের ট্রাভেল এজেন্ট ভাগঁ লি ( Wagon-Lit – আক্ষরিক অর্থে ট্রেনের বিছানা ) জানালে , দুঃসংবাদ ! আগে ভিসা তবেই টিকেট । সে দরখাস্ত লন্ডনের সুইডিশ এমবাসিতে পাঠালেই হবে না , সিটি ব্যাঙ্ক স্টকহলমের সি ই ও ডেভিড ওয়ারনারকে একটা আমন্ত্রণ বার্তা লিখে সরাসরি ফ্যাক্স মারফত সেখানে পৌঁছে দিতে হবে । আমার কর্ম জীবনে নরওয়ে সুইডেন ফিনল্যান্ডের তখন বিশেষ ভূমিকা ( উত্তরের আলোয় অচেনা ইউরোপ পশ্য) । রাজকীয় সুইডিশ দূতাবাস থেকে ইসু করা প্রথম নরডিক ভিসার চেহারা মনে পড়ে - অন্ন সংস্থানের উপবীত !
ইতিমধ্যে জার্মানিতে ভিসা লাগে , বেনেলুকসের ভিসার দরখাস্তে অধিক প্রমাণ পরিচয় দিতে হয়, ফ্রান্স অস্ট্রিয়া সুইজারল্যান্ডের প্রশ্নাবলী লম্বা হতে থাকে।
স্থলপথে কোন দেশের গণ্ডি পার হবার সময় দুটো স্থায়ী চৌকি পার হতে হতো । জার্মান সীমান্তে পুলিশ একবার দেখে নেবে আইন অনুযায়ী সে দেশে বাস করছিলাম কিনা; সে পর্ব চুকলে পাঁচশ মিটারের নো ম্যানস ল্যান্ড । তার পরের গেটে ধরুন ডাচ প্রহরী – তারা দেখবে আমার পাসপোর্টে নেদারল্যান্ডে ঢোকার অনুমতি সূচক ছাপ আছে কিনা।
আমার একান্ত আপন অভিজ্ঞতায় বিমান বন্দরে বা স্থল পুলিশ চৌকিতে কেউ বিশেষ বাড়তি প্রশ্ন করে নি, বড় জোর কদিন থাকবেন ,এই প্রথম এলেন কিনা এই রকম কিছু। তারা ধরে নিয়েছে তাদের দেশের কনসুলেট বা এমবাসি সকল তত্ত্ব তালাশ করেই আমাকে প্রবেশ অধিকার দিয়েছে । এ ক্ষেত্রে সীমান্ত পুলিশের কাজ সেই ছাপটি দেখা , কেন কি ভাবে সেটি পেয়েছি সে প্রশ্ন করা নয়।
এই সাধারণ ও সহজবোধ্য সীমান্ত পারাপার প্রক্রিয়ার ব্যতিক্রম ছিল ব্রিটিশ ইমিগ্রেশন।
তিনিই মধ্যম যিনি চলেন তফাতে!
যে দেশ থেকে আসছি সেখানকার ব্রিটিশ কনসুলেটের ভিসার ছাপ থাকা সত্ত্বেও কেন , কি কারণে আসা, কে আসতে বলেছে, খরচার টাকা সঙ্গে আছে কিনা ইত্যাকার শতেক প্রশ্ন না করে তাঁরা ছাড়বেন না। বলতে ইচ্ছে করেছে ফ্রাঙ্কফুর্টে বোকেনহাইমার লান্ডস্ত্রাসেতে আপনাদের অফিস এই সব জিজ্ঞাসার সন্তোষজনক উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট হয়েছেন বলেই তো আমাকে এই ক্ষুদ্র দ্বীপে আসার অনুমতি দিয়েছেন । এন্ট্রান্স পরিক্ষেয় পাস করেছি -এবার চাক্ষুষ দেখতে এলাম। এবার কি রি টেস্ট নেবেন, সঙ্গে সাপ্লিমেনটাল কোয়েসচেনেয়ার ? না কি পুরনো প্রশ্নমালার পুনরাবৃত্তি করে আপনার ও আমার সময় নষ্ট করবেন? ? কিন্তু সে কথা বলা যায় না। সরকারি অফিসারের অসম্মান দণ্ডনীয় অপরাধ। বরং সুবোধ বালকের মতো জুৎসই জবাব দিতে হয় । এটাও জানি হিথরো গ্যাটউইকে দেওয়া আমার উত্তরের সঙ্গে তাঁদের ফ্রাঙ্কফুর্ট কনসুলেটে শোনানো গল্প মেলে কিনা তা ক্রস চেক করার কোনো উপায় নেই।
একবার তৈরি হয়ে গিয়েছিলাম । সে আমলে এক পাউনডের নোট চলত। স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার তিজউরি থেকে একশোটা নোট ট্যাঁকে বেঁধে নিয়ে গেছি। যেই ইমিগ্রশান অফিসার জানতে চাইলেন আপনার দিন যাপনের খরচার টাকা আছে কি , আমি সেই নোটের বান্ডিল তাঁর সামনে রেখে অতি ধীরে গুণতে শুরু করি। দৃশ্যটি বহু জনের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বিব্রত হয়ে বলেন, ওকে ওকে , টাকা গুলো তুলে নিন।
যখন রীতিমত আইনসম্মত ভাবে ব্রিটেনে বাস ও কর্ম করি তখনও সীমান্ত পেরোতে এই ধরণের প্রশ্ন ও কিছু বক্রোক্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে - আপনার আস্তানার পুরো পোস্ট কোড বলুন দেখি, কোন আন্ডারগ্রাউনড লাইন ধরে কাজে যান । ব্যাঙ্কে কাজ করি শুনে জিজ্ঞেস করলেন, কোন ব্যাঙ্ক, বি সি সি আই ?* নিজেকে ঠেকানো শক্ত হয়েছিল – বললাম, না, তার চেয়ে একটু বড়ো , দুনিয়ার র্যাঙ্কিঙ্গে প্রথম , তিনশো নিরানব্বুই পার্ক এভিনিউ নিউ ইয়র্কে যাদের হেড অফিস, সেখানে। এমন বেয়াদপিতে তিনি একটু থতমত খেলেন। কথা না বাড়িয়ে ছাপ দিলেন।
মন্দ যদি তিন চল্লিশ ভালোর সংখ্যা সাতান্ন ! তার পরিচয় পেয়েছি ইউরোপে , অনেকবার ।
বাসেল থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট ফিরছি ।
আমার পাসপোর্ট নীল, বিয়ের পরে স্ত্রী পদবি পরিবর্তন করেন নি; তাঁর ও কন্যা ঐন্দ্রিলার পাসপোর্ট ব্রিটিশ, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন প্লেট জার্মান। পেছনের সিটে তারা দুজনেই ঘুমন্ত । সুইজারল্যান্ড বর্ডারে থেমেছি। গাড়ির জানলায় সুইস পুলিশ। পাসপোর্ট দেখালাম । বলতে হলো বাকি দুটো পাসপোর্ট আমার স্ত্রীর ব্যাগে ।
তিনি একবার তাদের দেখে নিয়ে বললেন, ঠিক আছে, যেতে পারেন। ওদের আর জাগাতে হবে না।পাঁচশ মিটার নো ম্যানস ল্যান্ড পেরিয়ে জার্মান চৌকি; সবুজ পোশাকে সজ্জিত গ্রেন্তসপোলিতসাই একবার উঁকি দিয়ে আমার পাসপোর্ট দেখেই ছেড়ে দিলেন ,’ গুটে ফারট (শুভ যাত্রা )’।
ইউরোপীয় সাধারণ বাজারের শিলান্যাস হয়েছিল রোম চুক্তির(১৯৫৭) বলে। তার প্রায় তিরিশ বছর বাদে কেউ চিন্তা ভাবনা করলেন; যে চারটি থামের ওপরে এই সাধারণ বাজার দাঁড়িয়ে আছে তার পয়লা নম্বর ক্লজ মানুষের অবাধ যাতায়াত। তাহলে বর্ডার ফোর্স, পাকাপাকি চৌকি, নো ম্যানস ল্যান্ড , গাড়ি ট্রাক মানুষ থামিয়ে দিয়ে পাসপোর্ট পরীক্ষার কি প্রয়োজন? বেনেলুক্স তো চল্লিশ বছর আগেই এক ভিসায় তিনটে দেশের দরোজা খোলার মডেল চালু করেছে! হয়তো তাদের সম্মানে ইউরোপীয় সাধারণ বাজারের সীমান্ত অতিক্রমণের নতুন পর্বের সূচনা হলো ১৯৮৫ সালে, লুকসেমবুরগে। মোজেল নদীর ওপরে একটি গ্রামীণ বন্দরে নোঙর পাতা ‘মারি আস্ত্রিদ’ নামক এক বিলাস বহুল নৌ যানের লাউঞ্জে বসে পাঁচটি দেশ এক চুক্তিতে সই করলেন।
সেই নদী বন্দরের নাম শেঙ্গেন ।
*–প্রখ্যাত পাকিস্তানি ব্যাঙ্কার আগা হাসান আবেদি প্রতিষ্ঠিত ব্যাঙ্ক অফ ক্রেডিট অ্যান্ড কমার্স ইন্টারন্যাশনাল (বি সি সি আই ) যেটি এক দশকের মধ্যে সত্তরের বেশি দেশে শাখা খুলেছিল , এক সময়ে দুনিয়ার সাত নম্বর প্রাইভেট ব্যাঙ্ক হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ব্যবসা বিশ্বময়, ইউ কেতে ব্যাপক শাখা প্রশাখা কিন্তু ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ড তার জিম্মেদার নয় , হেড অফিস লুকসেমবুরগে- কে কাকে দেখে । নিয়ামক সংস্থার অভাবে , সুপারভিশনের গাফিলতিতে ও বিভিন্ন প্রকারের দুর্নীতির ফলে মানি লনডারিং , ড্রাগ ও গান রানিংসহ বহুবিধ উপসর্গে ভুগে ব্যাঙ্ক অফ ইংল্যান্ডের আদেশে ১৯৯১ সালে সে ব্যাঙ্ক দরোজা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। পশ্চিমি ব্যাংকিং জগতে সে ছিল এক চ্যালেঞ্জার ব্যাঙ্ক , ভুঁইফোড় , বিরল ব্যতিক্রম । তার পতন ও মূর্ছার গ্লানি সেখানে কর্মরত আমাদের উপ মহাদেশের অনেক ব্যাংকারকে দীর্ঘদিন বয়ে বেড়াতে হয়েছে।