সুদীপ চ্যাটার্জী বড় সরকারী অফিসার। ওঁর স্ত্রী মধুরার স্বভাবটা তাঁর নামের সঙ্গে মিলিয়েই চলে যেন। বয়সে সুদীপের থেকে দু’বছরের ছোট। তিনি একটা স্কুলের শিক্ষকা। ওঁদের ছেলে অর্ণব আর মেয়ে অমৃতা। সুদীপের বয়স এখন প্রায় পঞ্চাশ। সকাল সাড়ে ন’টায় তিনি বাড়ি থেকে বেরোন সরকারি গাড়িতে অফিসের উদ্দেশে। মধুরাও স্কুলে বেরোন সকাল আটটায়। অর্ণব পড়ে বি টেক আইআইটি বম্বেতে আর অমৃতা পড়ে প্রেসিডেন্সি কলেজে পলিটিক্যাল সায়েন্স। সুদীপের বড় দোতলা বাড়ি সল্টলেকে প্রায় ছ’কাঠা জমির ওপর। বাড়ির চারদিক ঘিরে বড় বাগান। সামনে ফুলের আর পেছনে সব্জির। ছুটির দিনে অনেকটা সময় কাটে সুদীপের বাগান পরিচর্যায়। বাগান করাটা সুদীপের প্যাশন। বাগানের প্রত্যেকটা গাছকে সুদীপ ভালবাসে গভীরভাবে। দোতলার ব্যালকনিতে বসে বিকেলে সুদীপ ও মধুরা চা খান ছুটির দিনে। এই সময়টা মধুরা খুব ভালবাসেন। অফিসের দিনে সুদীপ এত ব্যস্ত থাকে যে মধুরা কথা বলার বিশেষ সময় পায় না। অফিসের দিনে সুদীপ বাড়ি ফেরেন রাত প্রায় আটটায়। তারপর সবাই মিলে রাতের খাওয়া হয় ন’টায়। খাবার টেবিলে বসে তখন সারাদিনের গল্প হয় সুদীপ, মধুরা ও অমৃতার। অর্ণব তো হস্টেলে থাকে। ছুটিতে মাঝে মাঝে বাড়ি আসে। রোজ রাত্রে খাওয়ার পরে ফোনে অবশ্য কথা হয় অর্ণবের সঙ্গে সবার।
মাঝে মাঝে রবিবারে সন্ধ্যায় ওদের বাড়িতে বন্ধু-বান্ধবরা আসেন। তখন জমাটি আড্ডা হয়। পানভোজনের ঢালাও আয়োজন করেন মধুরা ও সুদীপ। মধুরা আবার রান্না করতে খুব ভালবাসেন। সব সময় রান্নার জন্য অবশ্য একজন আছে – রূপা। সে ভালই রান্না করে। মধুরার নির্দেশ মত সবকিছু চটপট শিখেও নেয়। তাও বাড়িতে বন্ধুরা এলে মধুরা দু’একটা বিশেষ পদ রান্না করেন। যেমন – ফিশ চপ, চিকেন কাটলেট, বিরিয়ানি, রেজালা, মালপোয়া, পাটিসাপটা, স্পেশাল ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেন এই সব। অতিথিরা মধুরার রান্নার খুব প্রশংসা করেন। এইসব আড্ডায় সুদীপ ও মধুরার আপ্যায়নে বন্ধুরা খুব খুশি হয়। এভাবে দিনগুলো বেশ কাটছিল চ্যাটার্জী পরিবারের।
ওঁরা বছরে দু’তিন বার বেড়াতে যান নানা জায়গায়। বছরে একবার সপরিবারে বিদেশে যান। পৃথিবীর বহু জায়গায় ওঁদের ঘোরা হয়ে গেছে। যেমন -লন্ডন, প্যারিস, রোম, ভেনিস, ফ্লোরেন্স, লুসার্ন, জুরিখ, ভিয়েনা, স্যালসবার্গ, মেলবোর্ন, নিউইয়র্ক, ক্যালিফোর্নিয়া, ও আরও অনেক জায়গা। এছাড়া দেশের মধ্যেও ওঁরা বেড়াতে যান বছরে দু’বার। সব রাজ্যই প্রায় ওঁদের ঘোরা হয়ে গেছে। সুদীপের সবচেয়ে পছন্দের জায়গা পাহাড়। আর মধুরার পছন্দ সমুদ্র। ওরা একবার পাহাড়ে যান বেড়াতে, একবার সমুদ্রের ধারে যান কোথাও। সুদীপের বিশেষ আকর্ষণের জায়গা উত্তরাখণ্ড ও হিমাচলের পাহাড়গুলো। ওঁর বেশি পছন্দ ট্যুরিষ্ট আকর্ষণের বাইরের কিছু পাহাড়ি জায়গা। যেমন - মান্ডির কাছে জঞ্জেহলি, চিণ্ডি, ব্যারোট ভ্যালি, কিননৌরে সাংগ্লা, চিটকুল, সিমলার অদূরে কান্দাঘাট, কিংবা উত্তরাখণ্ডে মুন্সিয়ারি, লোহাঘাট, কানাতাল, খিরসু, চোপটা। এইসব জায়গায় গিয়ে সুদীপ মুগ্ধ হয়ে যান হিমালয়ের সৌন্দর্য দেখে। মৌন বিস্ময়ে দেখেন সেই দৃশ্য প্রাণভরে। কলকাতায় ফিরে এসেও তাঁর মন প্রাণ ঘিরে থাকে হিমালয়ের সেই অপূর্ব সৌন্দর্য। কদিন পরেই শুরু হয়ে যায় আবার অফিসের ব্যস্ততা। আবার সারা সপ্তাহ দৌড়াদৌড়ি, কাজ আর কাজ। মাঝে মাঝেই মনটা চঞ্চল হয়ে ওঠে ওই সব পাহাড়ে ফেলে আসা সময়ের জন্য। সুদীপ ভাবে আবার কবে যাব ওই হিমালয়ের কোলে। মনটা আবার কবে মুক্তি পাবে ওইখানে ওই বিরাটের সান্নিধ্যে; হিমালয়কে দেখতে দেখতে মনে হয় নিজের অস্তিত্বের ক্ষুদ্রতা। মনের মাঝে গুনগুনিয়ে ওঠে সেই গানটা, “তুমি মুক্ত মহীয়ান আমি ক্ষুদ্র দীন/ কী অপূর্ব মিলন তোমায় আমায়”।
দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে যায়। অর্ণব আমেরিকায় চলে যায় এমএস করতে। অমৃতাও মাস্টার্সের পরে পিএইচডি করতে চলে যায় আমেরিকায়। বাড়িতে শুধু সুদীপ আর মধুরা। বাড়িতে নিত্যপুজো হয় রাধা-মাধবের। ছেলে-মেয়েরা দূরে চলে যাওয়ার পরে সুদীপ ও মধুরার অনেকটা সময় কাটে পূজার্চনায়।
সুদীপের গানের গলা ভাল। মাঝে মাঝে গান ধরেন ঠাকুরঘরে বসে,
“অচ্যুতম কেশবম নামো নারায়ণম
কৃষ্ণ দামোদরম বাসুদেবম হরি।“
মধুরা ও পাশে বসে গলা মেলায়।
আবার কোনদিন সুদীপ গায়,
ভজে ব্রজৈইকা মণ্ডনম
সমস্ত পাপ খণ্ডনম।
স্বভক্ত চিত রঞ্জনম
সদৈব নন্দ নন্দনম।।
অনেকটা সময় জপ-ধ্যানে কাটে দুজনের। বাইরের জগতের সঙ্গে মেলামেশা কমে আসে ওঁদের। ছুটির দিনে অনেকটা সময় কাটে ওঁদের আধ্যাত্মিক বইপত্র পড়ে। ছেলে-মেয়েরা ফোন করে আমেরিকা থেকে। ওদের সঙ্গে কথা বলে মনটা খুশি হয়ে ওঠে সুদীপ–মধুরার। কিছুদিন পরে অর্ণব আর অমৃতার বিয়েও হয়ে যায়, ওদের পড়াশোনার পর্ব চুকলে। সুদীপ–মধুরা ভাবে, আমরা সব দায়িত্ব পালন করেছি ঠিকমত। এবার আমাদের ছুটি। এবার মনের গভীরে ডুব দিই।
সুদীপের বয়েস এখন ৬২ আর মধুরার ৬০। দুজনেই অবসর নিয়েছেন চাকরি থেকে। শান্তিতেই অবসর জীবন কাটছে ওঁদের। সাধন-ভজন আর পূজার্চনা নিয়ে বেশ কেটে যাচ্ছে দিনগুলো। অর্ণব–অমৃতা ঘুরে গেল গরমের ছুটিতে একমাস কলকাতায়। ওরা যখন এল তারপর আবার সুদীপরা সপরিবারে গেল আলমোড়ার চোদ্দ মাইল দূরে মির্তোলায় – হিমালয়ের কোলে। সেখানে অনেক আশ্রম আছে বিভিন্ন সাধু-সন্ন্যাসীদের। কয়েকদিন সেখানে থেকে সুদীপ-মধুরার জায়গাটা খুব ভাল লেগে গেল। পাহাড়ের নির্জনে বসে সুদীপ গাইতে থাকেন মাঝে মাঝে আপনমনে।
কোনোদিন তিনি গান ধরেন,
মা কুরু ধনজন যৌবন গর্বম
হরতি নিমেষাৎ কাল সর্বম।
মায়াময়মিদম অখিলম হিত্বা
ব্রম্ভপদম ত্বভম প্রভিশা বিদিত্বা।।
আবার কোনোদিন গাইতে থাকেন –
নমো রাধিকায়ো ত্বদীয় প্রিয়ায়ো
নমোনন্তলীলা দেবায়তুভ্যম।
কয়েকদিন ‘উত্তর বৃন্দাবন‘ নামের কাছের একটা আশ্রমে গিয়ে সুদীপ-মধুরার মনটা ভরে ওঠে পূজা ও আরতি দেখে ওখানকার বিগ্রহের। ওখানকার আশ্রমের পূজারী ও অধিবাসীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাও তৈরি হয়ে যায় ওঁদের। ঈশ্বর চিন্তায় মগ্ন হয়ে দিন কাটে তাঁদের। ওখান থেকে ফিরে আসতে যেন মন চায় না আর। তাও দেখতে দেখতে দশদিন থাকা হল এখানে। লোকালয় থেকে দূরে এই নিরিবিলি পরিবেশে ওঁদের মন আনন্দে ভরে ওঠে। কয়েকদিন পরে ওঁরা আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। চারদিন পরে অর্ণব-অমৃতা তাদের পরিবারের সঙ্গে আমেরিকা ফিরে যায়। সুদীপ–মধুরা আবার একা। কিন্তু এবারে মনটা একটা আনন্দে ভরে আছে ‘উত্তর বৃন্দাবনের‘ দিনগুলোর কথা ভেবে।
মির্তোলা থেকে ফেরার পরে দু’মাস কেটে গেছে। হঠাৎ মধুরার সেদিন বুকে ব্যথা শুরু হল। হসপিটালে নিয়ে গেলেন সুদীপ। একঘণ্টা বাদে ডাক্তারবাবু এসে বললেন, সব শেষ। কিছু করা গেল না। আত্মীয়–বন্ধুরা সবাই এসে পড়ল খবর পেয়ে। ঠিক হল বডিটা রাখা হবে পিস হ্যাভেনে। অর্ণব–অমৃতারা এলে দাহ হবে। দু’দিন পরে ওরা এল আমেরিকা থেকে। সব কাজ মিটতে কেটে গেল পনের দিন।
সুদীপ ডাকলেন কাছে অর্ণব-অমৃতাকে শ্রাদ্ধ শান্তি মিটে যাওয়ার পরে। বললেন, “আমি মনস্থির করে ফেলেছি মির্তোলার আশ্রমে স্থায়ী ভাবে থাকতে শুরু করব এবার থেকে। মধুরা যখন চলে গেল, এখানে আর পড়ে থাকার মানে নেই। এরপর থেকে কলকাতায় তোমরা এলে আমার সঙ্গে দেখা করতে মির্তোলায় যাবে”। ওরা জানত বাবা-মা অনেকদিন থেকেই আধ্যাত্মিক জগতে মনঃসংযোগ করেছে। হয়তো বাবার পক্ষে এটা ভালই হবে।
অর্ণব-অমৃতা ফিরে গেল আমেরিকায়। সুদীপ চিঠি লিখলেন ‘উত্তর বৃন্দাবন’ আশ্রমে, তিনি পূর্ণ সময়ের জন্য আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত হতে চান। আশ্রম থেকে সম্মতি জানিয়ে চিঠি এল কদিন পরেই। তার সাতদিনের মধ্যে সুদীপ চলে গেলেন মির্তোলার আশ্রমে অল্প কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস সঙ্গে নিয়ে। তাঁর সাধন জীবন শুরু হল নতুন উদ্যমে।
আশ্রমের কিছু কাজের দায়িত্ব পড়ল সুদীপের ওপর। যেমন বাগানের ফুল তোলা সকালে, মালা গাঁথা, বিগ্রহকে ফুল-মালা দিয়ে সাজানো, ঠাকুরের বাসন ধোয়া, সন্ধ্যাবেলা আরতির জোগাড় করা এইসব। বাকি সময় সুদীপ ধ্যান, জপে সময় কাটান। মাঝে মাঝে ভাবাবিষ্ট হয়ে সুদীপ গান ধরেন –
ইতনি বিনতি শুনো হরিজি
বিনতি শুনো প্রভুজি।
অন্তঃগময়মমুখ নাম হো তেরা
হৃদয় ছবি হো তেরী।।
আশ্রমের বাকি অধিবাসীরা মুগ্ধ হয়ে শোনেন সেই ভজন। তাঁরাও আখর দেন সঙ্গে সঙ্গে। মন ভরে ওঠে সকলের।
কোনোদিন আবার সুদীপ গাইতে থাকেন তন্ময় হয়ে–
তুম মেরী রাখো লাজ হরি
তুম জানত সব অন্তর্যামী।
করণী কছু না করি
তুম মেরী রাখো লাজ হরি।
দুপুর বেলায় খাওয়া হয় ঠাকুরকে নিবেদন করা ভোগ এই আশ্রমে। খাওয়ার পরে এক ঘণ্টা বিশ্রাম নেন সব অধিবাসীরা নিজের নিজের ঘরে। তারপর তিনটে থেকে শুরু হয় পাঠের আসর। নানান ভক্তিমুলক ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করেন একজন আর বাকিরা শোনেন। কোনোদিন পড়া হয় শ্রীমদভাগবত, কোনোদিন গীতা, আবার কোনোদিন চৈতন্যচরিতামৃত বা চৈতন্যভাগবত। এরকম পাঠ চলে প্রতিদিন দু’ঘণ্টা। তারপর শুরু হয় সন্ধ্যা আরতির প্রস্তুতি। সন্ধ্যা ছটায় আরতি শুরু হয় আশ্রমে। পূজারী নিবিষ্ট চিত্তে আরতি করেন বিগ্রহের। সেই সময় ভজন-কীর্তনও হয় মাঝে মাঝে। প্রধান গায়ক সুদীপ, বাকিরা কোরাসে যোগ দেন। আশ্রমের দেবতা ভক্তের নৈবেদ্য গ্রহণে তুষ্ট হয়ে ওঠেন যেন।
প্রায় এক বছর থাকার পরে সুদীপের দীক্ষা হল ঐ আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা সাধিকা যশোদামায়ীর কাছে। সেই সঙ্গে তাঁর সন্ন্যাস জীবনও শুরু হল। আরও গভীরভাবে সুদীপ সাধন-ভজনে ডুবে গেলেন। আশ্রমের নিত্যকাজের বাইরে জপ–ধ্যানে সময় কাটতে থাকল আরও বেশি করে। প্রতিদিন ভোর চারটেয় ব্রাহ্ম মুহূর্তে উঠে ধ্যান শুরু করেন সুদীপ। ছটায় শুরু করেন আশ্রমের কাজ। দুপুরে একঘণ্টা বিশ্রামের পর ধর্মগ্রন্থ পাঠ শোনা, আরতি, ভজন এসব চলতে থাকে। রাতের প্রসাদ গ্রহণ করে আবার নটায় তিনি নিজের ঘরে প্রবেশ করেন। তারপর ধ্যান, জপ করতে বসেন আবার, চলে প্রায় তিনঘণ্টা। রাত বারোটায় শুতে যান।
এই রুটিনে সুদীপ ক্রমশ অভ্যস্ত হতে থাকেন। মনটা প্রশান্তিতে ভরে উঠতে থাকে দিনে দিনে। জুলাই মাসে শুরু করেন চাতুর্মাস্য। চারমাস ঘরে দরজা বন্ধ করে সাধন-ভজন নিঃশব্দে করে যেতে হয় এই সময় সাধকদের। কারোর সঙ্গে এই সময়ে কথা বলেন না তাঁরা। একবেলা আহার করেন স্বল্প পরিমাণে। কথিত আছে, এই সময় ভগবান বিষ্ণু যোগনিদ্রায় শায়িত থাকেন। এই কঠোর নিয়মে সাধনা করতে থাকেন সুদীপ চারমাস প্রতিবছর।
সুদীপের বয়স এখন নব্বই। অর্ণব-অমৃতারা বছরে একবার আসে আমেরিকা থেকে কলকাতায়। তখন ওরা দিন পনেরো থেকে যায় মির্তোলার এই আশ্রমে। ওদের চোখে ধরা পড়ে সুদীপের পরিবর্তনগুলো। ওরা দেখে ওদের বাবা আর সাংসারিক কথাবার্তা পছন্দ করেন না। সারাক্ষণ মগ্ন থাকেন আধ্যাত্মিক চিন্তায়। ছেলে-মেয়েদের সঙ্গেও আলোচনা করেন এই বিষয়ে শুধু। ওরা বোঝে, সুদীপের অন্তর্জগতে পরিবর্তন হয়ে চলেছে ক্রমশ। সুদীপ ওদের বলেন অনেক দিব্য অনুভূতির কথা যা তিনি উপলব্ধি করেছেন এই কয়েক বছরে এই আশ্রমে এসে থেকে। অর্ণব–অমৃতারা বুঝতে থাকে যে তাদের বাবার গভীর অন্তর্দর্শন হয়েছে। তিনি পার্থিব বিষয় থেকে এখন অনেক দূরে। তিনি এখন এক অনন্ত পথের পথিক। তাঁর মন পেয়ে গেছে অমৃতের সন্ধান। তিনি অন্তরের আলোয় আলোকিত এক সত্তা। তাঁর প্রশান্ত মুখ দিব্য প্রভায় উজ্জ্বল। অর্ণব–অমৃতারা ফিরে যায় আবার আমেরিকায়। সারা বছর অর্ণব–অমৃতাদের কোনও যোগাযোগ থাকে না সুদীপের সঙ্গে। বছরে একবার মির্তোলায় এলে ওদের দেখা হয় সুদীপের সঙ্গে।
এরপর আরও পাঁচ বছর কেটে গেছে। সুদীপের বয়স এখন পঁচানব্বই। শরীরে জরার প্রভাব বিশেষ পড়ে নি। দৈনন্দিন রুটিন এখনও যথা নিয়মে পালন করেন। এ বছরে ডিসেম্বরে অর্ণব–অমৃতারা এলো দেখা করতে সুদীপের সঙ্গে। সুদীপ ওদের বললেন, “হয়তো এটাই তোমাদের সঙ্গে আমার শেষ দেখা। আমার সময় শেষ হয়ে আসছে”। অর্ণব–অমৃতারা লক্ষ্য করে দেখেছে বেশ কিছুদিন ধরে যে, তাদের বাবা যা বলেন তা ঘটে। ওরা বুঝতে পারে যে বাবার এই কথাটাও হয়তো সত্যি হবে। ওরা ফিরে যায় পনের দিন পরে। তারপর একমাস হয়তো কেটেছে। সুদীপ রাত্রে খাওয়ার পরে নিজের ঘরে ধ্যানস্থ হয়েছিলেন। ধ্যানের মধ্যেই তাঁর প্রাণবায়ু নির্গত হয়ে গেল। পরের দিন সকালে আশ্রমের অন্যান্য অধিবাসীরা দেখলেন সুদীপ ধ্যানের মধ্যেই অমৃতলোকে যাত্রা করেছেন।
নিয়ম মেনে তাঁকে দাহ করলেন আশ্রমবাসীরা। যখন কাঠের চিতায় সুদীপকে সমাহিত করা হল, সকলে মিলে গেয়ে উঠলেন,
যো ভজে হরিকো সদা
সো হি পরমপদ পায়েগা।
সন্ন্যাসীর শ্রাদ্ধ হয় না। তাঁরা সন্ন্যাস গ্রহণের সময়ই নিজের শ্রাদ্ধ করে থাকেন। আশ্রমে বড় করে ভাণ্ডারা হল ক’দিন পরে। অনেক ভজন–কীর্তন হল সারাদিন ধরে আর সাধু-সন্ন্যাসীদের ভোজন করানো হল শ্রদ্ধার সঙ্গে। আর সুদীপের আত্মা ঊর্ধ্বলোকে পরমপুরুষের সত্তায় বিলীন হয়ে গেল। সমাপ্তি হল গৃহী থেকে সন্ন্যাসীতে উত্তরণের এক উজ্জ্বল যাত্রার।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।