লেখকদের সঙ্গে লেখকদের জীবন, জীবনচর্যা ও বেদনাদায়ক জীবন আমাদের প্রভাবিত করত। হয়তো এখনও করে। এবং করবে।
'ইস্পাত' উপন্যাসের লেখক নিকোলাই অস্ত্রোভস্কি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। খাঁজকাটা এক পিচবোর্ডে লিখতেন। পরে তাতেও অসুবিধা। তাঁর শুশ্রূষায় থাকা নার্স তাঁর মুখে শুনে লিখতেন। পরে এই নার্স হয়ে ওঠেন তাঁর জীবনসঙ্গিনী।
আরেকটি বই, খুব প্রভাবিত করেছিল, আনা ফ্রাঙ্কের ডায়েরি।
হিটলার ও তার এস এস বাহিনীর অত্যাচারে অন্ধকার কুঠরিতে আশ্রয় নেওয়া এক কিশোরীর জীবন কথা এই ডায়েরি।
হিটলারের আমলে জার্মানির ইহুদিরা তীব্র অত্যাচারিত হন। এখন ইহুদি ধর্মের নাম করে ইহুদিবাদী তথা জায়নবাদীরা চরম অত্যাচার চালাচ্ছে প্যালেস্টাইনে। ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ৫৫ হাজার মানুষ খুন দুবছরে। ১৭ হাজার শিশু খুন। ৩৮ হাজার নিখোঁজ অথবা আহত।
মোট আহত এক লাখ ৩৭ হাজার। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, তিন লাখ সাতাত্তর হাজার প্যালেস্টাইনিয় মানুষের কোনও খোঁজ নেই।
আমাদের কৈশোর শৈশব ছিল ইহুদিদের প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ।
এখন খারাপ লাগে, এ কোন ইহুদিবাদ, যার জন্য মস্কো বিমানবন্দরে একজন দুয়বছরের ইরানিয় শিশুকে দেখে আছড়ে ফেলেন এক অচেনা ইহুদি।
ঘৃণার চেয়ে ভালোবাসা বড়-- এইসব লেখা হতো উপন্যাস, ছোটগল্পে।
এরিখ মারিয়া রেমার্কের উপন্যাস পড়ে যুদ্ধ কত খারাপ শিখেছি। 'থ্রি কমরেডস' পড়ে কত কত বন্ধু প্রেম করার সময় নিজেদের হের লোকাম্প আর প্যাট্রিসিয়া বলে চিঠি লিখেছে।
এই নিয়ে একটা উপন্যাস ছিল, সমীর মুখোপাধ্যায়ের লেখা।
এসো ছিন্ন করো। ১৯৭৪ সালে আট বছর বয়সে পড়ি। কী সুতীব্র লেখা।
উপন্যাসের পটভূমি সত্তর দশক। নায়ক কমিউনিস্ট। ভালো সাংস্কৃতিক সংগঠক। নাটক গান করে। বক্তৃতা দেয় আগুন ঝরানো। তাঁর ভয়ে কাঁপে গুন্ডা আর মজুতদাররা। তারপর একদিন তাঁকে আত্মগোপনে যেতে হয়। ফেরে। পার্টির সঙ্গে আর যোগাযোগ রাখে না। প্রেমিকাও তাঁকে ছেড়ে গেছে। 'মঞ্জরী আমের মঞ্জরী' নাটক করেছিল একসঙ্গে। সে আবার কিছু কাজকর্ম করার চেষ্টা করে, দাঁড়ায় না। মা নিত্যদিন গঞ্জনা দেন। শিক্ষিত ছেলে বেকার বসে বাপের অন্ন ধ্বংস করছে।
একদিন সে এলাকার কংগ্রেস নেতা আড়তদারের ঘরে চলে যায়।
সবাই ভয়ে চমকে ওঠে তাঁকে দেখে।
তোতলাতে থাকে, ক্কী দরকার?
সে বলে, না এমনি এসেছিলাম।
শুনে একটু আগেই তাঁকে ভয় পাওয়া মানুষগুলো হাসতে থাকে।
সে আরও হতাশায় ভোগে। তাঁর মনে পড়ে শহিদদের কথা। পার্টির জন্য সর্বস্ব ত্যাগ করা কর্মীদের কথা। যারা কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পার্টিতে এসেছিল, তাঁদের কথা।
কিছু করতে পারল না কেন?
পার্টি তাঁর জন্য কিছু করলো না কেন? চূড়ান্ত হতাশ নায়ক।
শেষে একদিন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এলেন একজন মানুষ। পার্টির জন্য বোমা বাঁধতে গিয়ে তাঁর হাত উড়ে গেছে।
ভদ্রলোককে পার্টি নেতারা তাঁর কাছে পাঠিয়েছেন।
শুনে নায়ক বলেন, কী পার্টি কিছু করেনি তো?
ভদ্রলোক বলেন, না করেছে, হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে।
এখন এলাকা ছাড়া হয়ে এই এলাকায় এসেছেন, নিজে কিছু করতে চান, পার্টির পয়সায় খেতে চান না। এটা জেনে তাঁকে পার্টি নেতারা তাঁর কাছে পাঠিয়েছেন?
কেন আমার কাছে কেন?
নেতারা বলেছেন, ও খুব ভালো কমরেড। এখন হতাশায় ভুগছে। কিন্তু অমিত সম্ভাবনা।
কিছু করতে পারলে আপনার জন্য ওই কিছু করতে পারবে। শুনে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া ছেলেটি,
চরম হতাশায় ভোগা ছেলেটি, হঠাৎ দেখে সূর্যের আলো কেমন রঙিন ও সতেজ হয়ে উঠে, সে হাতকাটা মানুষটিকে বলে, দেখুন দেখুন প্রজাপতির ডানাগুলো কত সুন্দর।
এই উপন্যাসের লেখককে আমি খুঁজেছি। তাঁর মৃত্যুর পর জেনেছি, তিনি চুঁচুড়ার মানুষ।
কেন যে দেখা হয়নি।
কোনও দিন চলচ্চিত্র বানালে, এই বিষয় নিয়ে আমি ছবি বানাবো।
কলেজে পড়ার সময় চুঁচুড়ার আরেক মানুষ অধ্যাপক প্রদীপ মুখোপাধ্যায়ের একটা গল্প আমাকে ভাবিয়েছিল, অ্যাকোয়ারিয়াম।
প্রদীপদাও শুনছি নেই। বড় দেখা করতে ইচ্ছা করে এই লেখকদের সঙ্গে।
'গণতন্ত্র ও গোপাল কাহার' একটা নাটক খুব বিখ্যাত হয় আশির দশকে।
কার লেখা? মনে হয়, মণি মুখোপাধ্যায়।
দুর্গাপুরের একটা নাটকের দল অভিনয় করতো।
সত্তর আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় যাত্রা প্রতিযোগিতা হতো। বাবার কাছে নানা যাত্রার বই আসতো। 'বেগম আসমান তারা'য় দেড় পাতা ব্যাপী একটা সংলাপ ছিল। কী অসম্ভব গভীর অথচ কাব্যিক উচ্চারণ। আমার মতো কিছু তরুণ তখন এইসব মুখস্থ করার চেষ্টা করতো।
যাত্রা প্রতিযোগিতা শুনে মনে পড়ল, শ্যামসুন্দর আর নাড়ুগ্রামের মাঝখানে দেবীবরপুর গ্রামে দিনের বেলায় যাত্রা হতো। কেন? সেটা জানতে হবে।
আমাদের স্কুলের এক সহপাঠী সেলিম সেদিন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে লিখল, রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হওয়ায় দিনে যাত্রা হয়েছে বাদুলিয়ায়।
বৃষ্টির কথা উঠলে রথের কথাও বলতে হয়। রথযাত্রা মানে বৃষ্টি হবেই। গ্রামে কাউকে ছোট বা বড় রথ টানতে দেখিনি।
এখনও বড় রথ হয় না। টিভি দেখে ছোট রথ, বাচ্চাদের, চালু হয়েছে।
রথ চলতো, আহার বেলমা গ্রামে। এখন যার নাম হয়ে গেছে, শ্যামসুন্দর। শ্যামসুন্দর দেবতার নামে। ২৯ জুন ২০২৫ হাওড়া বাঁকুড়া ভায়া মশাগ্রাম, রায়না, সেহারাবাজার ট্রেন চালু হল। শ্যামসুন্দর থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে একটি স্টেশন, শ্যামসুন্দর।
শুনেছি, হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেছেন এই ঐতিহাসিক দৃশ্য দেখতে। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছিলাম এরকম নাকি একদম হবে। ষাট বছর পর সার্থক হলো। বাঁকুড়ার প্রাক্তন সাংসদ বাসুদেব আচারিয়া খুব চেষ্টা করেছিলেন।
তাঁর দাবি এতদিনে প্রাণ পেল।
রথ বললেই মনে পড়ে, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'রাধারাণী'র কথা। রাধারাণী'র শ্রীরামপুরের মাহেশে রথে মায়ের সেবার জন্য ফুল বেচতে যাওয়ার কথা শুনে খুব কেঁদেছিলাম।
এই কারণে না পাঁপড় জিলিপি বাঁশির আকর্ষণে রথ খুব আগ্রহের জিনিস হয়ে দাঁড়ায়।
তার চেয়েও বড় কথা ছিল, খবরের কাগজ জুড়ে যাত্রার বিজ্ঞাপন। ষাট সত্তর আশির দশকে যাত্রা আর ফুটবল যে কতখানি প্রিয় ছিল গ্রামীণ জীবনে, কল্পনাও করতে পারবেন না, গ্রামে না জন্মালে। আশির দশক থেকে গ্রাম সমাজ রাজনৈতিক সমাজে রূপান্তরিত হলো। যাত্রা ফুটবলের দাপট কমল। টিভি এল। খবরের কাগজ জুড়ে রথের দিনে যাত্রার বিজ্ঞাপন। তখন কাগজ সাধারণত ছয় পাতা বা আট পাতা হতো।
রথের দিন ষোল চব্বিশ বা বত্রিশ পাতা ছাপত। আনন্দবাজার, যুগান্তর, সত্যযুগ, দৈনিক বসুমতী ১৯৮০ পর্যন্ত প্রধান কাগজ। এরপর একে একে এল 'আজকাল', 'বর্তমান', ভারত কথা, ওভারল্যান্ড।
আশি পর্যন্ত এক টাকায় চারটি কাগজ কেনা যেত।
আমি এক টাকা জমিয়ে রাখতাম, রথের দিনে যাত্রার বিজ্ঞাপন দেখবো বলে।
আরও অনেকেই এটা করতেন। রথের দিনে সর্বোচ্চ কাগজ বিক্রি হতো। বাড়তি কাগজ আনতেন কাগজের ডিলার।
রথের দিন চর্চা হতো দোকান বাজার চায়ের দোকানে, কোন যাত্রা তারকা কোন দলে গেলেন। কোন দল এবার হিট পালা নামাবে।