নেনোর বাড়ি ছিল পাশের গ্রাম উদগড়ার দীঘিরপাড়ায়। দীঘিরপাড়াকে ডাকা হতো নানা নামে। দীগেরপাড়া, চাঁড়ালপাড়া, কামারপাড়া।
এক ঘর কামার ছিলেন দীগেরপাড়ায়। অনাথ কাকা। কেন জানি না, অনাথকাকাকে আমার 'গণদেবতা' উপন্যাসের অনিরুদ্ধ কামার মনে হতো। খুব তেজি লোক। চড়া সুর।
হাপড় টানতেন পেশীবহুল হাতে।
কাস্তে, কোদাল, টাঙনা, হেঁসো, টাঙ্গি-- সব তৈরি করতেন অনাথ কাকা। পৌষ মাসে বস্তাভরে লোকের বাড়ি থেকে ধান নিয়ে যেতেন। এরপর সারা বছর সংসারের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করতেন অনাথকাকা। পরে টাটা কোম্পানি কোদাল, বেলচা, কাস্তে তৈরি করতে শুরু করায় অনাথকাকাদের দিন ফুরিয়ে এলো।
নেনোরা ছিল বেশ কয়েকভাই। নেনোর ব্যবহার ছিল খুব মিষ্টি। সবসময় হেসে কথা বলতো। সেই নেনো অসুস্থ জেনে এবং কলকাতা নিয়ে গিয়ে ডায়ালিসিস না করালে ছেলেটা বাঁচবে না জেনে জোর ছোটাছুটি শুরু করে দিলাম। পার্টি অফিসের মালেকদা চিঠি লিখে দিলেন। বললেন, কলকাতায় কার্তিকদাকে দিতে।
কার্তিকদা চিঠি পড়ে ফোনে বলে দিলেন পিজির সুপারকে। তখনও পিজিতে গোপাল পল্টু বা মদন মিত্র জমানা শুরু হয়নি।
পিজিতে গিয়ে কথা বলে এলাম। তার পরদিন নেনোকে অ্যাম্বুলেন্সে করে পিজি হাসপাতালে নিয়ে আসা হল।
পড়াশোনা চৌপাট। ১৮-২০ দিন থাকতে হলো কলকাতায় পিজি হাসপাতালে।
মেন বিল্ডিংয়ে ভর্তি। চারবেলা দেখে আসছি। খাচ্ছি দাচ্ছি পিজির পুকুর পাড়ের ক্যান্টিনে। চার টাকায় মাছ ভাত। ডিম ভাত তিন টাকা। সব্জি ভাত দু টাকা।
আমার সঙ্গে ছিল নেনোদের মালিকের ছেলে। একদিন পরিচ্ছন্ন দেখে একটা ক্যান্টিনে খেতে গেলাম।
গাওয়া ঘিয়ের গন্ধ পেয়ে। মাসিমার ক্যান্টিন নামে পরিচিত।
মাছভাত দাম পাঁচ টাকা। পরিষ্কার সানমাইকা দেওয়া টেবিল।ক্যান্টিনে চটা ওঠা কাঠের বেঞ্চ এবং ময়লা টেবিল। এখানে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ব্যাপার।
বসেছি, দেখি কয়েকজন জুনিয়র ডাক্তার ঢুকলেন। গলায় স্টেথো ঝোলানো।
আমাদের দিকে তাকালেন, তারপর একজনকে ডেকে কী বললেন, সেটা শুনে সেই কর্মচারী এসে বললেন, এটা ডাক্তারদের ক্যান্টিন পেশেন্ট পার্টির খাওয়া বারণ।
এতকাল সিপিএম কংগ্রেস জনতা পার্টি শুনেছি, এই প্রথম শুনলাম পেশেন্ট পার্টি!
কেন খেতে পারবো না? তার্কিক লোক। ছোট হলেও ছোট থেকেই তার্কিক।
জিজ্ঞেস করলাম, মাসিমাকে।
মাসিমা আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দিলেন, অনলি ফর ডক্টর্স।
তা পরে ওখানে বন্ধুদের সঙ্গে খেয়েছি। আহা মরি, কিছু নয়।
তবে সান্ত্বনা মিলল, ওখানে জুনিয়র সিনিয়র ভাগও আছে।
শুধু পেশেন্ট পার্টি আর ডাক্তার ভাগ নয়।
ওই সময়েই আরেকটা কথা শিখলাম। ক্যাচ পেশেন্ট।
পার্টির মাধ্যমে যে-সব রোগী ভর্তি হন, তাঁদের সাংকেতিক নাম, ক্যাচ পেশেন্ট।
ক্যাচ পেশেন্ট বলে ভালো খাতির জুটেছে এমন নয়, প্রবল অবজ্ঞা।
কথায় কথায়, ও তোমরা তো ক্যাচ পেশেন্ট!
সে-সময় জুনিয়র ডাক্তার ধর্মঘট চলছে। বামফ্রন্টের ওপর প্রচণ্ড রাগ জুনিয়র ডাক্তারদের একটা বড় অংশের।
সেই রাগ আমাদের ওপর বর্ষাতেন।
আমিও তখন বামফ্রন্ট সরকারের প্রবল সমালোচনা করছি।
'বিপ্লবের পথ থেকে সরে যাচ্ছে। সংশোধনবাদী হয়ে যাচ্ছে, ক্ষমতার জন্য লড়াই, শুধু ভোট আর ভোট, এবং গ্রুপবাজি চলছে, পয়সা করার ঝোঁক বাড়ছে নেতাদের, বড়লোকদের সঙ্গে গা ঘেঁষাঘেঁষি করার প্রবণতা বাড়ছে, নেতারা ইয়েসম্যান চায়, পছন্দ অপছন্দের রাজনীতি চলছে'।
এইসব কদিন আগেই ছাত্র লোকাল কমিটির সম্মেলনে তেড়ে বলেছি।
আমার বয়স তখন ১৬+
আমার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ১৯৮২ থেকেই বলা শুরু করেছেন, তুই পার্টির যা সমালোচনা করছিস, বরুণ সেনগুপ্তও এতটা করে না।
আর আমি ক্লাসের পড়াশোনা যত না করছি, তার চেয়ে বেশি করছি, মার্কসবাদ লেনিনবাদের পড়াশোনা। বিনোদ মিশ্রের লেখা ভালো লাগছে। 'লিবারেশন' পড়ি।
তবে আর্কাদি গাইদারের 'ইশকুল', নিকোলাই অস্ত্রভস্কির 'ইস্পাত' পড়া মন রোমান্টিক অ্যাডভেঞ্চারিজমে ভরপুর। আমি তখনও বিপ্লবের স্বপ্ন দেখি। এখনও। তবে তখন ছিল যুদ্ধে যাওয়ার সময়। আমার মন চাইল, সব ছেড়েছুড়ে নকশালদের সশস্ত্র সংগ্রামে যোগ দিতে।
কোথায় পাবো তারে?
সে-সময় কাগজে নদীয়ার কৃষ্ণনগর শান্তিপুর বীরনগর এলাকায় আজিজুল হক এবং রমেন-এর নেতৃত্বে বিপ্লবী কার্যকলাপের কথা নিয়মিত পড়ছি।
আমি ঠিক করলাম, এতে যোগ দিতে হবে।
কী করে খোঁজ পাবো?
উপায় ঠিক বের হবে।
এই ভেবে ব্যাগ গুছিয়ে ফেলা প্রায়, সে-সময় ঘটল নেনোর সাপের কামড়ের ঘটনা।
সেই গোছানো ব্যাগ নিয়ে চলে আসতে হলো পিজি হাসপাতালে।
মেন বিল্ডিংয়ের সামনে খবরের কাগজ বিছিয়ে শুই।
আমাদের সঙ্গে থাকেন অন্য রোগীর আত্মীয়রাও। পালা করে খবর নিই।
কেউ বাড়ি গেলে আরেকজন তার হয়ে খেয়াল রাখেন রোগীর।
এই খেয়াল রাখতে গিয়েই বেধে গেল ঝামেলা।
বর্ধমানে ভাতার বলে একটা এলাকা আছে। ভাতার নিয়ে নানা গল্প আছে। আছে কথা চালু । তার মধ্যে একটা, ভাতারের পাশে শুসনে।
শুসনে বা শুষনে একটা গ্রামের নাম। ভাতার সত্তর দশকে কংগ্রেসের নেতা, মন্ত্রী এবং বিশিষ্ট আইনজীবী ভোলানাথ সেনের কল্যাণে সেজেগুজে ওঠে। দমকল পর্যন্ত চালু হয়।
সেই ভাতারের এক গ্রামের ছেলেকে সাপে কামড়ায়। মাত্র ২৬ বছর বয়স।জোয়ান ছেলে। পেটানো চেহারা। মাঠে লাঙ্গল দেওয়ার সময় বিষধর সাপে কামড়ায়।
নেনোর দুয়েকটি বেড পরেই ছিল তাঁর বেড।
তাঁর বাড়ির লোক গ্রামে গেছেন টাকা আনতে।
আমরা দেখভাল করছি।
দুপুরে খাওয়ার পর দেখতে গেছি।দেখছি প্রচণ্ড ছটফট করছেন। স্যালাইনের বোতল বন্ধ। মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন।
আমরা ছুটে গেলাম নার্সদের ঘরে। সেখানে দুজন জুনিয়র ডাক্তার বসে হাসি ঠাট্টা করছেন।
আমরা গিয়ে বললাম, একবার চলুন। রোগীর অবস্থা ভালো নয়। কিছু করুন।
জুনিয়র দুজন বললেন, আপনারা ক্যাচ পেশেন্ট পার্টি না। পার্টি ধরে ডায়ালিসিসের জন্য ভর্তি করেছেন। যান, স্বাস্থ্যমন্ত্রী রামনারায়ণ গোস্বামীকে গিয়ে ডেকে আনুন। তিনি চিকিৎসা করবেন। হাত পা ধরতে শুধু বাকি রাখলাম। এলেন না। বাধ্য হয়ে রোগীর কাছে ফিরে এলাম।
আমাদের সামনে কয়েকটি হেঁচকি তুলে জোয়ান মানুষটি স্থির হয়ে গেলেন।
জুনিয়র ডাক্তার দুজনের নাম জেনেছিলাম।
এখন আর লিখতে ইচ্ছে করছে না।
মানুষ কেন, প্রতিবাদ করতে পারে না, বুঝেছিলাম সেদিন।
আমি চিৎকার করতে যাচ্ছিলাম আপনারা কি মানুষ?
আমার সঙ্গী আমার হাত চেপে বলল, শোন, নেনো আছে।
ওকে যদি ভুল ইঞ্জেকশন দিয়ে মেরে দেয়।
বা চিকিৎসা না করে?
বোবা বনে গেলাম।
এবং আমার নকশালপন্থীদের প্রতি মোহ খানিকটা ঘুচে গেল।
তখন আমরা জানতাম, জুনিয়র ডাক্তারদের ধর্মঘটের পিছনে কংগ্রেস থাকলেও সামনে আছে নকশালরা।
আদৌ কি ওই দুজন ডাক্তার নকশাল ছিলেন, এখন সন্দেহ জাগে।