গ্রামে থাকতে দেখেছি সত্তর ও আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত লোকে পাঁচ পলা সরষে তেল, পাঁচটা শুকনো লঙ্কা, গোটা চারেক হলুদ বা নুন ধার করতে আসতো। দেশলাই কাঠিও চেয়ে নিয়ে যেতো।
বাড়িতে হঠাৎ কুটুম এলে পাশের বা চেনা বাড়িতে ভালো তরকারি হয়েছে কিনা জানতে চেয়ে ছোট ছেলেমেয়েদের পাঠানো হতো। লুকিয়ে নিয়ে আসতো সেই তরকারি। আবার এমন ঘটনাও দেখেছি, কারও বাড়িতে জামাই বা কোনও আত্মীয় আসতে দেখে প্রতিবেশী নিজেই পাঠিয়ে দিয়েছেন তরকারি।
বর্ধমান শহরে বাস শুরু করার কয়েকমাস পর দাদা খালুইবিল মাঠে বাড়ি ভাড়া নেন। আমিও আমার বর্ধমানের ভাড়া ঘর ছেড়ে উঠে আসি। নতুন বাড়িটি ছিল সিপিএমের বিখ্যাত নেতা বিনয় চৌধুরীর পিসতুতো বোনের। মুসলিম নাম হলে বাড়ি ভাড়া পাওয়া কঠিন সেই প্রথম জানলাম। সেটা ১৯৮৩ সালের কথা। খালুইবিল মাঠ তখন মশার জন্য বিখ্যাত। হাজার হাজার মশা। সত্যি হাজার মশা। বাথরুমের জল পরিষ্কার হতো না। জমে থাকতো। নিকাশি একদম ভালো ছিল না। ওই বাড়ির পাশে বাড়ি ছিল নবস্থার এক ধনী পরিবারের। কংগ্রেস সমর্থক। দাদাকে খুব পছন্দ করতেন। তাঁরা তরকারি পাঠাতে শুরু করলেন। বৌদিও।
পরে আমি ওখান থেকে অন্য জায়গায় চলে আসি।
এবং বৌদির মুখে একটা কথা শুনেছিলাম, প্রথমে বাটি চালাচালি পরে লাঠি চালাচালি।
বলেছিলেন, ঘরে ডেকে এনে খাওয়াবে। কোথাও খাবে। কিন্তু বাটি আদানপ্রদান করবে না। সম্পর্ক নষ্ট হবে।
গ্রামের সঙ্গে শহরের তফাৎ বুঝলাম। আরেকজন প্রতিবেশী ছিলেন। সরকারি চাকরি করতেন। ভালো মানুষ। তিন মেয়ে।
বড় মেয়ের স্কুলের হোম টাস্ক আমাকে করে দিতে বলতেন মাঝে মাঝে কাকু।
আমার মাধ্যমিকে টিউশন পড়ানোর রাস্তা খুলে গেল।
আমি তখন একাদশ শ্রেণি।
অবশ্য এ-বিষয়ে আমি চিরকৃতজ্ঞ আমার শিক্ষক পরেশ চক্রবর্তীর কাছে।
স্কুলে প্রথম হলেও আমি ছিলাম চরম ফাঁকিবাজ। রাজনীতি ক্লাব খেলাধুলার দিকে ছিল মন।
পরেশবাবু পরেশ চক্রবর্তী আমাকে বাধ্য করেন, আমাদের ব্যাচে আমাকেই ইংরেজি ও অঙ্ক পড়াতে। টেস্ট পেপার সমাধান করাতে।
কালে বাংলা ব্যাকরণ পড়ানোর দায়িত্বও বর্তাল।
তখন কি জানতাম, একদিন বাংলা পড়িয়ে খেতে হবে।
আমার চোখে তো তখন বিপ্লবের স্বপ্ন।
যে স্বপ্ন পরে ফিকে হয়ে গেল। মনে হতে লাগল, একটা ঐতিহাসিক বিচ্যুতিকে সমর্থন করছি, ১৯৭২-৭৭ এর রক্তাক্ত দিনগুলোর আতঙ্কে।
নিজেরাই নিজেদের ব্ল্যাকমেল করেছি!
এঁরা গেলে কী হবে ভেবে!
আসলে আমরা তো ইতিবাচক কারণে ভোট দিই কম। নেতিবাচক কারণে বেশি।
এর চেয়ে যেন খারাপ না হয়--- এই বোধ থেকে।
এর চেয়ে ভালো আশা করা কেমন দুরাশা মনে হয়।
বাড়িতে নানা ধরনের অতিথি আসতেন। বলে আসার প্র থা তো ছিল না।
খুব কম সময়েই জানা যেত, কেউ আসছেন।
বাড়িতে দু তিনজনের চাল তরকারি সবসময় বেশি নেওয়া হতো।
কেউ না কেউ খাবেন।
আমাদের বাড়ির অতিথি অভ্যাগতের তালিকা বড়ই বিচিত্র।
বাবার বন্ধু, দাদার বন্ধু, আমাদের বন্ধু, পার্টির লোক। এঁদের কাছে অনেক শিখেছি। এঁদের আড্ডা ও কথা শুনে। বই পড়ার নানা ধরনের ঝোঁক থেকে।
বাড়িতে নানা ধরনের মানুষ আসা খুব জরুরি।
এই সব বন্ধু আত্মীয় কমরেড ছাড়াও আসতেন
হঠাৎ অজানা উটকো লোক।
এই উটকো লোকরা বেশ কয়েকবার কয়েকদিন থেকে কিছু না কিছু চুরি করে পালিয়েছেন, কিন্তু তাতে আশ্রয় দেওয়া বন্ধ হয়নি।
এক ভদ্রলোকের কথা মনে আছে। এলেন। বছর ত্রিশেক বয়স। দিন কুড়ি থাকলেন। সন্ধ্যা বেলায় বিচিত্র গল্প শোনালেন। তারপর একদিন একটা চাদর নিয়ে চলে গেলেন।
আর একজনের কথা খুব মনে আছে। অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় মার্কা চেহারা। দক্ষিণ ২৪ পরগণার মানুষ।
কামারশালা বসাতেন আমাদের বৈঠকখানার পাশে। রাতে থাকতেন বৈঠকখানায়।
হাঁড়িকুঁড়ি ঝালাই করতেন। তামার হাঁড়ি পাতিল নিকেল করতেন। রিপিট মারতেন কড়াই বা বালতিতে। কাজ ছিল চমৎকার। বেশ কয়েকবছর এসেছিলেন। তাঁরা বেগুন দিয়ে একটা তরকারি করতেন। বেড়ালের পায়খানার মতো রঙ হতো। গোলমরিচের হাল্কা ঝাল থাকতো। আহা অমৃত।
আমি তো সারা সন্ধ্যা কোনও মতে একটু পড়ে কামারশালেই বসে থাকতাম।
ওই আগুনে রঙ, হাপরটানার কায়দা, নিপুণভাবে ঝাল করা, আমাকে মুগ্ধ করে দিত।
ইচ্ছে হতো, হাপর টানি। দুয়েক বার চেষ্টা করেছি। সুবিধা হয় নি।
গণদেবতা তখন পড়ে ফেলেছি।
আমার তাঁকে অনিরুদ্ধ কামার মনে হতো।
রাত নটা নাগাদ কাজ শেষ হতো। কার্তিক মাসের শেষে এসে অগ্রহায়ণ মাস কাটিয়ে যেতেন।
অগ্রহায়ণেই শীত আসতো। চাদর লাগতো না যতক্ষণ কামারশালে কাটতো। তারপর নটা বাজলে হাতমুখ ধুয়ে খেতে বসতেন। আর আমার পাওনা ছিল, বেগুনের ব্যঞ্জন। কচু পাতায় মুড়ে দিতেন।
ইনিও এক রাতে গ্রামের বহু লোকের হাঁড়ি পাতিল কড়াই নিয়ে উধাও হয়ে গেলেন।
শীত পড়লে গ্রামে সাতটার মধ্যে খেয়ে শুয়ে পড়ার প্রথা ছিল। শুধু যাঁরা বড় ক্লাসে পড়তেন, তাঁরা হেডমাস্টারের টিউশন থেকে ফিরতেন দেরিতে। টিউশন পড়তে যেতে হতো নিজের নিজের লন্ঠন বা হ্যারিকেন নিয়ে। লোকে বলতেন, হেরিকেন বা হেরিকেল।
তখন স্বপ্ন ছিল অনেক। বিপ্লব হবে। কিন্তু লোকের চাহিদা ছিল বড় কম।
কেউ ভাবতেন, এবার তালপাতা বা পেলাসটিকের পেকে নয় , এবার একটা ছাতা হবে। কেউ ভাবতেন চাদর নয় সোয়েটার কিনে দেবো ছেলেমেয়েদের।
মেয়েরা ভাবতেন, একটা নয়, গোটা দুয়েক তোলা শাড়ি থাকবে। শীতে তুহিনা বা আফগান স্নো কিনবেন আন্ডাওয়ালার কাছ থাকে। আর হিমানি তেল। লাল ফিতের ছিল বড় কদর নতুন বৌ ও কিশোরী মহলে।
বাড়ির গিন্নিরা ভাবতেন, ছছল বছল থাকবে সংসার। ছেলেমেয়েদের বিয়ে দেবেন অনেক আত্মীয় কুটুম এনে। বছর ঘুরতেই নাতির মুখ দেখবেন।
নাতনি কি চাইতেন? কে জানে?
আমাদের ছোটদের স্বপ্ন ছিল, নিজের একটা সুন্দর টেবিল ল্যাম্প হবে। সরু গলার টেবিল ল্যাম্প ছিল পছন্দের। কুড়ি টাকা দাম সত্তর দশকে।
আমি মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় এটি কিনি।
নিজেই পরিষ্কার করে সলতে লাগাতাম। কেউ যদি কাচ ভেঙে দেয় মুছতে গিয়ে। পাঁচ টাকা দাম।
লন্ঠন ছিল প্রধান আলোক দাতা।
কুপির আলো ছিল গরিব ঘরের ভরসা। তাঁদের স্বপ্ন ছিল লন্ঠন কেনার। কেরাচিনি বা মিট্টি কা তেল দিয়ে জ্বালাবেন। রেড়ির তেলের কুপিও দেদার দেখেছি।
শেষ দেখলাম, ২০০৯ এ সুন্দরবনে আয়লা ত্রাণ করে ফেরার পথে। এল-৫ এলাকায়।
ঘরে ঘরে শুধু কুপি আর কুপি।
লন্ঠন দেখিনি প্রায়।
গ্রামে যে মেলা বসতো, সেখানে কুপি লন্ঠন হ্যারিকেন সব মিলতো। মিলতো সংসারের সব জিনিস। রুটি বেলবার কাঠের সরঞ্জাম ( কী যেন নাম! মনে পড়ছে না), থেকে হাঁড়ি কুড়ি কড়াই হাতা খুন্তি। তখন লোহার কড়াই বেশি চলতো। আস্তে আস্তে আনি বা অ্যালুমিনিয়াম এলো। তারপর এলো স্টিলের কড়াই। এখন তো ননস্টিক।
আমাদের গ্রামে আন্ডাহারিদের কাছেই মিলতো সারা বছরের সাংসারিক জিনিস।
পয়সা নয় বিনিময় প্রথা চালু ছিল। সত্তর আশির দশকে। হাঁস বা মুরগির ডিম দাও। জিনিস নাও। ধারেও মিলতো।
আবু তাহের ছিলেন প্রধান ও জনপ্রিয় আন্ডাহারি। মানে আন্ডা বা ডিম ক্রেতা। বড় মিষ্ট ভাষী। তাঁকে রাগতে কেউ দেখেননি। সবাই ভাই তিনি। তাঁর বউ ছিলেন দাপুটে। তিনটে ছেলেকেই ভালো মানুষ করেছেন। তিনজনেই কলকাতায় সরকারি বাসে চাকরি করে ভালো আয় করেছেন।
সবার ভালো ব্যবহার।
আবু তাহের ভাই প্রথমে মাথায় করে ঝাঁকা বইতেন। একদিকে আন্ডা আরেকদিকে নানা সরঞ্জাম। সেফটিপিন, সিঁদুর, টিপ, আলতা, স্নো পাউডার, ইঁদুর মারা বিষ, নানা রঙের ফিতে, মাথার ক্লিপ, লন্ঠন হ্যারিকেনের সলতেসহ মেয়েদের প্রয়োজনীয় নানা জিনিস।
পরে সাইকেল কেনেন। সাইকেলের পিছনে ডিমের ঝুড়ি। সামনে একটা বড় লাঠি দুদিকে বাড়ানো। তাতে আগুরগুলো ছাড়াও সায়া ব্লাউজ। আমরা মজা করে, আবু তাহের ভাইকে বললে বাঘের দুধও এনে দেবে।
আর ছিল লুডো।
লুডো এক অবিশ্বাস্য খেলা।
এই খেলা খেলেননি এমন কাউকেই পাওয়া যাবে না আমাদের প্রজন্মে।