নজরুলের খাওয়ার গল্পটা বলেই নিই । নাহলে ভুলে যাব। খাওয়ার গল্প সবসময় মূল্যবান।
আমি তখন কলকাতায় চলে এসেছি পাকাপাকিভাবে। ফরডাইস লেনের মেসে থাকি। ১৩ নম্বর ফরডাইস লেন।
ঐতিহাসিক এই মেস। অনুশীলন সমিতির লোকেরা থাকতেন। তারপর এটা সিপিএম সমর্থকদের দখলে যায়। আমার মতো বিক্ষুব্ধ দু একজন ছিলেন। মেসের নিয়ম ছিল, একজন যাওয়ার সময় আরেকজনকে দিয়ে যেতে পারতো। অতীশ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সাংবাদিক। পরে কৃতী অধ্যাপক। তিনি সুপারিশ করেন পুরুলিয়ার অরিন্দম চক্রবর্তীর নাম। অরিন্দমদা আমার পূর্ব পরিচিত। অরিন্দমদা আসতেন পুরুলিয়া থেকে রাজ্যস্তরের প্রতিযোগিতায়। আমি কুইজ বিতর্ক তাৎক্ষণিক বক্তৃতা বা প্রবন্ধ কিংবা পোস্টার বা শ্লোগান লেখায়।
আমরা জেলার লোক। জিতলে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরতাম। হাততালি দিতাম।কলকাতার প্রতিযোগীরা অনেকেই ছিলেন উন্নাসিক । জেলার ছেলে সেরা হয়ে যাচ্ছে, এটা ছিল নাপসন্দ। অরিন্দমদার গলার আওয়াজ ছিল বেতারের কন্ঠস্বরের মতো। আমরা পাঁচটাকা দিয়ে মৌলালি যুবকেন্দ্রে থাকতাম। আর রাজ্য যুব সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, হেলথ হোমের প্রতিযোগিতা, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় -- এইসব প্রতিযোগিতায় লড়ে যেতাম। অরিন্দম চক্রবর্তীদা দিল্লি বেতারে চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ায় আসন ফাঁকা হল। অতীশদা আমাকে নিয়ে গেলেন ফরডাইস লেনে। ভবানীপুরে একটা মেসে কিছুদিন ছিলাম। সেখানকার অভিজ্ঞতা অন্যরকম। মেসবাসীরা খুব ভালো।
খাবার চমৎকার।
কিন্তু একজন 'মুসলিম' মেসে থাকবে এটা কেউ কেউ আপত্তি তোলেন! ফলে ভোটাভুটি হয়। ১৮-৪ এ হেরে যান, আমাকে রাখতে চাওয়া মানুষরা। মেসের সর্বময় কর্তা ছিলেন খুব ভালো মানুষ। আমাকে খুবই ভালো মানুষ। কিন্তু তিনিও এই বিষয়ে ভোটে হারলেন। কারা বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল, তিনি বলেন নি। আমিও জানতে চাইনি। কারণ, সবাই আমার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন।
আমার ঠাঁই ফরডাইস লেনে।
প্রথম ঘরেই। মজার বিষয়, তিনজন বাসিন্দা। একজন প্রায়ই থাকেন না। খুব ভালো মানুষ। কাটোয়া থেকে যাতায়াত করেন।তাঁর জায়গা ফাঁকা থাকায় আমার বইপত্র রাখার সুবিধা হল।
আমার সহবাসী মেধাবী ছাত্র। পরে বড় সরকারি অফিসার হন। ওই
মেসে কম পয়সায় খুব ভালো খাওয়া যেত। আমি জীবনের দৈনিক হিসেবে ভালো খাবার একটানা যদি কোথাও খেয়ে থাকি, তবে এই মেস।
নিয়ম অনুযায়ী ষাট জন বাসিন্দার একজন মেস ম্যানেজার হবেন। ষাটজন বাসিন্দার একজনকে দু মাসে একবার বাজার করতে হবে। দুবেলার বাজার। বাজারকারীকে মাছ/মাংস/ ডিম বা সব্জি, তেল নুন, হলুদ মশলা ইত্যাদি কেনার জন্য একটা নির্দিষ্ট টাকা দেওয়া হতো। যতদূর মনে আছে ১৩০ টাকার মতো। চাল খালি নির্দিষ্ট। ওই টাকায় পছন্দ মতো বাজার করে পছন্দ মতো মেনু খাওয়ানো।
অসাধারণ সব খাবার খেয়েছি।
মিল চার্জ সব মিলিয়ে চার থেকে সাড়ে চার টাকা পড়তো। এর মধ্যে কর্মীদের বেতন কাঠকয়লা ঘুঁটে কেরোসিন জ্বালানি সব হিসেব থাকতো
মাসে ২৩০-২৫০ টাকার বেশি কোনওদিন লাগেনি।
ওখানে মেদিনীপুরের দুজন ছেলে কাজ করতেন।
ত্রিপুরা, উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকজন থাকতেন।
রসিক আমুদে সব ছেলে। ভাস্কর , গৌরব, সৌরভ। ভাস্কর তো জমিয়ে রাখতেন। ওঁরা একজনের নাম দেন, ডাঙ্কেল।
তখন ১৯৯৪। ডাঙ্কেল, গ্যাট চুক্তি নিয়ে দেশ তোলপাড়।
ডাঙ্কেল আমাকে খুব ভালো বাসতেন। বছর ১৮-১৯ বয়স। ওড়িশা থেকে মেদিনীপুর। সেখান থেকে ফরডাইস লেন।
রান্না করতেন একজন। ডাঙ্কেল তাঁর সহকারী।
আজকের প্রজন্ম গ্যাট ডাঙ্কেল না জানলেও তখন কম বেশি সবাই জানতেন।
বিদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক চুক্তি, বিশ্বব্যাঙ্কের শর্ত, বিদেশে মস্তিষ্ক পাচার তথা ব্রেন ড্রেন, এক চব্বিশ হাজার রকম ব্রান্ডের ওষুধের বদলে শুধু একশো চব্বিশ রকমের জেনেরিক নামের ওষুধ চাই, শিক্ষা স্বাস্থ্য কৃষি বীমা ব্যাঙ্কে বেসরকারিকরণ চাই না--এইসব ধ্বনিতে তখন আকাশ বাতাস মুখর।
দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা লেখা থাকতো পেট্রল ডিজেল কেরোসিন কয়লা গ্যাসের এক টাকা দুই টাকা দাম বৃদ্ধির খবর।
খবরের কাগজ তোলপাড় করে ফেলতো দুধ পাঁউরুটির দাম ১০-২০ পয়সা ( টাকা নয় পয়সা) বাড়লে।
এখন ১৪ টাকার দুধ ৩৪ টাকা হলেও হেলদোল নেই।
৪৮ টাকার সর্ষে তেল ২২৫ হলেও মিছিল বের হয় না।
১৯৯৪ এ ভালো চালের দাম ছিল ১৪-১৫ টাকা।
গোবিন্দভোগ ১৮ টাকা।
বাসমতি সহজে পাওয়া যেত না।
২২-২৫ টাকা কেজি।
এখন ১২২-১২৫ টাকা কেজি।
মাছ ছিল চারাপোনা ২৫ টাকা কিলো।
রুই মাছ ৩২ টাকা।
ভালো কাতলা ৩৮-৪০ টাকা।
মুরগির মাংস ২৫-৩০ টাকার মধ্যে। খাসি ৬০ টাকা।
মেসে দু বছরের বেশি থেকেছি খাসির মাংস কোনওদিন হয়নি।
ভাবতেই পারতো না লোকে, ৬০ টাকা কেজি খাসির মাংস খাওয়া যায়!
এখন ৮৬০ টাকা থেকে ৯০০ টাকা।
মাংসের দোকানে লাইন।
দুটাকায় চারটে রুটি। আলু ভাজা ফ্রি।
চা আট আনা।
চপ আট আনা।
বেগুনি আট আনা।
এগুলো ১৯৯৪-এর দাম।
যাক, নজরুলের খাওয়ার গল্পে ফিরি। নজরুলের ভাইয়েরা কলকাতায় থাকতো। সে এল আমার সঙ্গে মেসে দেখা করতে খেতে বললাম।
ডাঙ্কেল তাঁর কাছে আমার নামে নালিশ করল, বড্ড কম খায়। ছাত্রদের খাইয়ে দেয়। খায় না। রোগা প্যাঁকাটি চেহারা। একটু বলো ভালো করে খেতে।
ডাঙ্কেলের আমার প্রতি কেমন একটা মমতা ছিল।
রাত দুটোয় ফিরবো। ভাত চাপা দিয়ে রাখতো। ঠান্ডা জলে স্নান করতে পারি না বলে গরম জল দিত।
আমার গায়ে যাতে একটু গত্তি লাগে, তার জন্য ডাঙ্কেলের চেষ্টার সীমা ছিল না।
নজরুলও কম খেল।
ডাঙ্কেল বলল, তুমি না গাঁয়ের ছেলে এত কম খাও কেনে। ভাত এমন খাবে, বিড়াল ডিঙোতে পারবেনি।
নজরুল রাতের বেলায় খেয়ে দেখাল। সাত আটজনের ভাত খেলে একাই।
ডাঙ্কেলকে আবার ভাত বসাতে হল।
তাতে ডাঙ্কেলের দু:খ নাই।
এতদিনে একটা খাইয়ে লোক পেয়েছে। খাইয়ে সুখ। এখানে বেশিরভাগ তরকারি বেশি চায়, ভাত কম। ভাত বেশি না খেলে, সেটা আবার খাওয়া!
এর মধ্যে আমিও একদিন বেশি খেলাম। ত্রিপুরা থেকে ভাস্কর ভট্টাচার্য শুঁটকির আচার এনেছে। একটু গুঁড়ো গুঁড়ো। শিলে বাটা। কী অপূর্ব তার স্বাদ!
দক্ষিণ দিনাজপুরের সিপিএম জেলা সম্পাদকের দুই ছেলে আমাদের মেসে থাকতো। গৌরব আর সৌরভ। সুদর্শন। সৌরভ ছিল আমার অতি প্রিয়। যত রাতেই ফিরি খবরের কাগজের দপ্তর থেকে দেখা করতেই হবে। সৌরভ তার ভাগেরটাও আমাকে দিলে। অত পছন্দ নয় তার শুঁটকি।
ডাঙ্কেল আমার খাওয়া দেখে বলল, এইরকম খাবে, তবে গালে মাংস লাগবে।
ত্রিপুরার আগরতলায় তেসরা মার্চ বই উদ্বোধন ছিল। অক্ষর পাবলিকেশানস থেকে। 'বাঙালির চিন্তানায়ক: চৈতন্য থেকে অশোক-শঙ্খ'। আগরতলা বিমানবন্দরে গাড়ি পাঠিয়েছিলেন শুভব্রত দেব, রতুদা। বিকেলে ওড়িশা হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি শুভাশিস তলাপাত্রর উদ্বোধন করার কথা। কথায় জানলাম, গাড়ি চালক নিজেই গাড়ির মালিক এবং তিনি যন্ত্রশিল্পী। অক্টোপ্যাড বাজান। সকালে বের হয়েছি। সকাল নয়টার সময় ভাত খাওয়ার অভ্যাস। খিদে পেয়েছে। চালক শেখরদাকে বললাম, আগরতলার ভালো খাবার কী? একটু খেতাম। কোন হোটেলে সেটা পাওয়া যায়?
উনি বললেন, সবই তো কলকাতার মতন। শুধু সিঁদল শুঁটকি আলাদা।
কোন হোটেলে পাবো?
সব হোটেলেই পাবেন বললে।
আচ্ছা।
এরপর আমাকে অবাক করে শেখরদা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি দুপুরে কখন খাবেন? আমি বললাম, দুটো, আড়াইটা।
আমি খাওয়ার নিয়ে আসবো।
না না সেকী!
আমি আনবো, কী পছন্দ বলেন।
পছন্দ তো সবচেয়ে আলুভাতে আর ডাল।
দুপুরে দেখি, শেখরদা ধনে পাতা দিয়ে পাতলা মুসুর ডাল, আর আলু ভর্তা শুকনো লঙ্কা পোড়া দিয়ে। আশ্চর্য ঠিক যেন আমার মায়ের হাতের রান্না।
সঙ্গে সিঁদল শুঁটকি আর লটে মাছের চাটনি।
আমি আজকাল 'বাঙাল' ধরনে খাই। একটা পদ দিয়ে ভাত।সেটা শেষ হলে আরেক পদ।
সিঁদল থাকলে খাসি বা বড় খাসির মাংসও ছুঁই না।
কিন্তু এদিন ব্যতিক্রম হল, ডাল আর আলুভাতে এত ভালো লেগে গেল, আমি শুঁটকিতে পৌঁছাতেই পারলাম না।
রাতের জন্য তা তুলে রাখা গেল। রাতেও আরেক অভিজ্ঞতা।