এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা  শনিবারবেলা

  • সেই দিন সেই মন পর্ব ১২

    অমলেন্দু বিশ্বাস
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ১৪ জুন ২০২৫ | ৮৩ বার পঠিত
  • ছবি: রমিত 



    ইংল্যান্ডে এসে আমার অন্যতম লক্ষ্য ছিল এদেশে আমার সমযোগ্যতার কাজের অনুসন্ধান করা। এই উদ্দেশ্যে প্রথমেই আমি সব সরকারি ও বেসরকারি এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সিগুলোতে নাম রেজিস্ট্রি করেছিলাম। আর রাতে বসে বসে সব কম্পিউটার কোম্পানিতে দরখাস্ত করতাম। ১৯৬৯ সালের একসময়ে আমি একদিন হঠাৎ একটা চিঠি পেলাম। এক ফরাসি প্রতিষ্ঠান কোনো এক এমপ্লয়মেন্ট এজেন্সি থেকে আমার নাম পেয়েছে এবং তারা আমাকে ইন্টারভিউ করতে চায় তাদের লন্ডন সেন্টারে কম্পিউটার সিস্টেম রক্ষণাবেক্ষণের জন্য।

    লিখিত পরীক্ষা ও কয়েকটা ইন্টারভিউ-র বেড়া পেরিয়ে ওরা আমাকে মনোনীত করল। নিয়োগপত্র এল। প্যারিসে কিছুকাল কাটিয়ে লন্ডন অফিসে বহাল হতে হবে। কোম্পানিটি সারা পৃথিবীর সব এয়ারলাইনসের সমবায় সমিতি। নাম, SITA (Société Internationale de Télécommunications Aéronautiques)।

    ছয় মাসের ট্রেনিংয়ে থাকতে হবে– তিন মাস প্যারিসে আর তিন মাস লন্ডন থেকে প্যারিসে যাতায়াত করে।

    পৃথিবীর সব এয়ারলাইনস এই সংস্থার সভ্য। এদের নিজেদের মধ্যে এবং যাত্রী ও অন্য সকলের সঙ্গে যত লক্ষ হাজার খবরাখবর, তার আদান-প্রদান হয় এই সংস্থার মাধ্যমে। প্যারিসে এদের প্রধান কেন্দ্র, যেখানে ছিল এদের বিশেষ শক্তিশালী কম্পিউটার। তাছাড়া কম্পিউটার কেন্দ্র ছিল লন্ডন ও পৃথিবীর অন্যান্য শহরে। পৃথিবীজুড়ে এদের নিজস্ব একটা কমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক ছিল। এই সংস্থার যারা কর্মী তারা বিশেষ অল্প দামের বা বিনা টিকিটে পৃথিবীর সর্বত্র ভ্রমণ করতে পারত। এখানে কাজ পাওয়ার এটা ছিল একটা মস্ত আকর্ষণ।

    সনৎকে লিখলাম:

    "প্যারিসে এসেছি। টুরিস্টের মতো লাগাম এঁটে পৃথিবী ভ্রমণ নয় -- রীতিমতো অফিসের দাক্ষিণ্যে। বিশেষজ্ঞ শিক্ষানবিশ হিসেবে এসেছি আপাতত। শিক্ষানবিশি শেষে লন্ডন অফিসে স্থিতি। প্যারিস -- ছোটবেলায় স্বপ্ন দেখতাম আমি লন্ডন, প্যারিস, রোম, বার্লিন, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন ঘুরে বেড়াচ্ছি। স্বপ্নটা স্বপ্নই থাকবে ভেবেছিলাম, এখন দেখছি তা সত্যি হতে চলেছে। অথচ তেমন কিছু ভালো লাগছে না। আগের মতো আর উৎসাহ নেই নতুন কিছুতে।

    দিনে অফিস করি আর সন্ধ্যায় পথে পথে চোখ মেলি। মন দিলেই মন, মনে মনে অশেষ। আইফেল টাওয়ারের মাথায় উঠে “কলকাতা” দেখছিলাম।"

    কেশবকে লিখলাম:

    "ইউরোপের সব শহরই বোধহয় এক। লন্ডনের পর প্যারিস নতুন কিছু নয়। তবু প্যারিস প্যারিসই। আমার অন্তরায় ভাষা। চোখ খুলে দেখছি, মন দিয়ে প্রাণ ছুঁতে চাইছি। তবে ইউরোপকে বোধহয় কোনোদিন ভালোবাসা যাবে না।"

    প্যারিস, ১৯-৩-৬৯ Hotel Monceau Elysees, 180 Rue De Courcelles, Paris 17e

    দীপুকে লিখলাম:

    "আমি ভালো আছি। ভালো অর্থে মেটেরিয়ালি ভালো। অর্থাভাব নেই, রেশনের দোকানে লাইন দিতে হয় না, পশুর মতো গাদাগাদি করে বাসে উঠতে হয় না। আমার বাড়িতে কী হচ্ছে তা নিয়ে পাড়াতে কানাঘুষা হয় না। অতএব সখা, ভালো আছি। কিন্তু আমি কি এই চেয়েছিলাম? আমার সেই যন্ত্রণা কোথায়? হঠাৎ কেমন যেন উদাসীন হয়ে পড়েছি। এ আমার দেশ নয়, এখানে কোনোদিন আমি ভালো থাকব না, সুখী হব না। কোনোদিন সব ছেড়ে চলে যাব। চলে যাব তো নিশ্চয়ই।

    দীপু, সেই বাবুই পাখি আর চড়ুই পাখির গল্প জানিস তো? আমি সেই চড়ুই পাখি, পরের অট্টালিকায় আছি। দেশ গরিব বলে দেশ ছেড়েছি, নিজের ভালোর জন্য পৃথিবী চষছি। কারো জন্য কিছু করতে পারলাম না, দেশের জন্য তো নয়ই। লক্ষ কোটি লোকের ভিড়ে হারিয়ে গেলাম। আমার সান্ত্বনা কোথায়? নতুন প্রযুক্তি, নতুন বিজ্ঞানের কাজ শিখছি। আমাদের দেশে এমন কাজ হতে বোধহয় আরও পঞ্চাশ বছর দেরি। অত দিন বাঁচব না। বাঁচলেও কর্মক্ষমতা থাকবে না। সুতরাং আমাকে দিয়ে দেশের কাজ হবে না। দেশে যদি ফিরি তবে কতকগুলো রেশন কার্ড বাড়বে। আমি সক্রিয় রাজনীতি করিনি। নেতা নই, সমাজ সংস্কারক নই, তবু বিদেশে বসে সব সময় দেশ দেশ করি। আমার দেশকে এদেশের সঙ্গে তুলনা করি। এ আমার বিলাস নয়, এই যন্ত্রণা নতুন। এবং এই যন্ত্রণা একমাত্র আমার, আমারই।

    বাংলা কবিতা পড়িনি অনেক দিন। বাংলা ছবি দেখিনি প্রায় এক যুগ। শেষ ছবি দেখেছি এখানে “ছুটি”। কেমন যেন পানসে লাগল। সম্প্রতি আমার ভাই পাঠিয়েছে শারদীয়া দেশ ও আনন্দবাজার। শারদীয়া পড়ার নেশাটা এখনো কাটেনি। আজন্মের চেতনা বাঁধা আছে যেখানে তার সবকিছু যেন ভালো লাগে এখন।

    ঋত্বিক ঘটকের খবর শুনে সত্যিই খারাপ লাগছে। অবশ্য আমরা গুণের কদর কখনো দিইনি -- যদি না সেটা ইউরোপ চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আর গুণীকে পয়সা দেব! নৈব নৈব চ। এখানে সাড়ম্বরে গান্ধী শতবার্ষিকী হল। আমরা টিভিতে রবিশঙ্কর-ইহুদি মেনুহিনের সেতার-বেহালার যুগলবন্দী শুনলাম। কেরালার কমিউনিস্ট গভর্মেন্ট ঘটি উল্টেছে খবর দেখলাম কাগজে। বাংলাদেশের সলতে নিভবে কবে? তোর কি দেশে নতুন কিছু চোখে পড়ছে না? আমাদের হতাশ করিস নে।"

    লন্ডন ২৮-১০-৬৯

    ইংল্যান্ডে সদ্য এসেছি। এ দেশের শীত, ঝিরঝির বৃষ্টি আর গুমোট আকাশ তখনও ধাতস্থ হয়নি। কাজ আর পড়াশোনা দুটোই পাশাপাশি চলছে। আমার মধ্যে একটা বোহেমিয়ান ভাব আছে। কোথাও এক কাজে বা এক জায়গায় বেশি দিন মন টেঁকে না। তাই সব দরজায় টোকা দিয়ে যাই। আমারে কে নেবে ভাই।

    চোখ-কান-মন খুলে নতুন দেশ দেখছি। স্পঞ্জের মতো পাশ্চাত্য সভ্যতার রস শুষে নিচ্ছি। শিল্প, কলা, সংগীত, সংস্কৃতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা, নগর পরিচালনা, সমাজবিধি ইত্যাদি– ক্ষুধার্ত প্রাণীর মতো গলাধঃকরণ করছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে এ দেশের ছাত্রদের দেখে হিংসা হয়। আহ্, কী স্বাধীনতা, কী অগাধ সুযোগ! দেশ ছেড়ে এসে এক নতুন উপসর্গ শুরু হলো। এ এক মনে মনে নতুন অসুখ, এদেশে যা দেখি তাই আমার দেশের সঙ্গে তুলনা করি। বুঝি বা এ ব্যাধি শুধু আমার একারই নয়।

    নতুন জীবন তখন প্রায় একটা নিয়মিত দিনপঞ্জি তৈরি করে নিয়েছে। এবং তাতেই আমি প্রায় মগ্ন হয়ে আছি। এমন সময় হঠাৎ একটা চিঠি আমাকে নিয়ে গেল জীবনের অন্য বৃত্তে। একটি ফরাসি কোম্পানি আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। ইতিমধ্যে আমার জীবনে অনেক ঘটনা ঘটেছে যা বাস্তবায়নের প্রেক্ষিতে আগে বা পরে কোনো ব্যাখ্যা বা যুক্তি নেই।

    সনৎকে ওর চিঠির উত্তরে লিখলাম:

    "হঠাৎ কি কোনোদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে তোর মনে হয়েছে দিনটা যেন অন্যরকম। নীল দিগন্তে যেন আলোর জলসা, কোনো একটা পুরনো ভালো লাগা সুর হঠাৎ কি গুনগুনিয়ে উঠছে মনের মধ্যে, অথবা ওঙ্কারনাথের কোনো হৃদয় নিংড়ানো আলাপ শোনার মতো আচ্ছন্ন আবেশ, অথবা প্রিয় কবির নতুন কোনো কবিতা পড়ার পর শব্দহীন উত্তাল আলোড়ন, অথবা অতীতে হারানো কোনো প্রিয় বস্তুর স্তিমিত শোকের মাঝে আবার সে জিনিস ফিরে পাওয়ার এক তৃপ্ত অনুভূতি– তোর চিঠি পাওয়ার পর ঠিক কোনটা বলতে পারব না। হয়তো সবগুলো একে একে অথবা সব একসঙ্গে আচ্ছন্ন করেছে আমায়।

    যা ফেলে এসেছি তা আর ফিরে পাওয়া যাবে না জানি, না সেই জীবন না সেই সব মুখ। তবু নস্টালজিয়ার বিছেটা যখন কামড়ায় তখন পরিচয়ের সুতোটা ধরে মাঝে মাঝে টান দিয়ে দেখি ও প্রান্তের গিঁটটা এখনো শক্ত আছে কিনা। হালকা হওয়ার সত্যটা আবিষ্কার করে নিদারুণ হতাশ হই। এবং হতাশা ও শোক ছাড়া আর কিছু করণীয় নেই জেনে মনকে সান্ত্বনা দিই। দেশ গরিব বলে দেশ ছেড়েছি, আমার চেয়ে পাষণ্ড আর কে আছে?

    তোর চিঠি একটা বিক্ষিপ্ত কবিতা– একথা আগের মতো এবারও মনে হল। অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই, তুই ভালো করেই জানিস যে তোর আমার লেখা যৌথ কবিতা ছাপাতে আমার আপত্তি থাকবে না। পুরানো পুঁথির পাতা উল্টে আবার পড়লাম,


    'পার্থেননে ইতিহাস নিতান্তই ইতিহাস তবু 


    রিরংসায় পরাজিত প্রেমে চিহ্নিত অতীত 


    সমাসের দ্বীজতায় সংক্ষিপ্ত প্রমাণ প্রতিভূ।'

    নিচে লেখা আছে অবি-সচ (অমলেন্দু বিশ্বাস – সনৎ চ্যাটার্জি) কফি হাউস ২৭শে মে ১৯৬৩, বিকেল-সন্ধ্যা।

    আশ্চর্য সাত বছর হয়ে গেল। এবং আরও আশ্চর্য তোর আগের চিঠিতে আমার কবিতা,


    'আমরা সবাই মৃত 


    মাঝে মাঝে বৈদ্যুৎ স্পর্শে চমকে উঠি 


    গ্যালভানির হাতে মরা ব্যাংটার মতো। 


    প্রেম হিংসা লোভ আর শোক 


    হঠাৎ ছুঁয়ে যায় আমাদের– 


    আর আমরা চমকে সচেতন হই 


    জীবনের অস্তিত্বেঃ


    নইলে আমরা সবাই মৃত।।'

    এবং এর আগের চিঠিতে,


    'এইসব নষ্ট সবের বন্ধনীতে 


    বৃথাই তুমি সৃষ্টির বীজ বুনবে। 


    বৃথাই তুমি ধুন্ধুমার তখতে 


    শাজাহানের বিকল্প কারু আনবে।'

    তোর স্মৃতিকে বাহবা না দিয়ে উপায় নেই। আমার কাছে এ এক অদ্ভুত অনুভূতি! আমি তাহলে একেবারেই বিফল নই। অন্তত একজন খুঁটে রেখেছে আমার যৌবনের ফসল। আমাকে লোভ দেখাচ্ছিস না তো?

    প্রায় তিন বছর আগে এদেশের মাটিতে পা দেওয়ার পর ঘটনা ঘটেছে প্রচুর। নিজের চেষ্টা ও ভাগ্যের কেরামতিতে আজ যে অবস্থায় এসে পৌঁছেছি তা এদেশের অনেক ভারতীয়ের ঈর্ষার খোরাক যোগায়।

    প্রাক-যৌবনে যেসব বস্তুর আকাঙ্ক্ষা করতাম তার প্রায় সবই আমার আয়ত্তে। এ দেশে যদি আরও কিছুদিন থাকি তবে যে বিলাস স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারতাম না তাও পাব। অথচ এর চতুর্থাংশও যদি আমি দেশে পেতাম তবে আমার চেয়ে সুখী বিশ্বের আর কেউ থাকত না। মানতেই হবে আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া যা তা আমি দেশেই পেয়েছি -- অনু। ও আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমার সব লোভের ও আমার অ্যান্টিডোট এবং ও আমার সব আকাঙ্ক্ষার, সব কর্মের চিরন্তনী এনার্জি, প্রেরণা।"

    লন্ডন ২৮-০১-১৯৭০

    বিচিত্র জীবন। প্রথম যৌবনে লিখেছিলাম “একঘেয়ে জীবন, বৈচিত্র্যহীন অধুনা।” কিন্তু যৌবন শেষের আগেই জীবনটা প্রচণ্ড গতিতে বিভিন্ন ঘটনায় জড়িয়ে পড়ল। কিছু নিজের তৈরি, কিছু কাকতালীয়, জানিনা কেমন করে হলো, তাদের আগমন বা নির্গমন আমার আয়ত্তের বাইরে ছিল। কখনো কখনো মনে হয়েছে আমি বন্ধুর পথ দিয়ে দ্রুত পরিক্রমা করছি, যেতে যেতে কোনো পাথরে স্বেচ্ছায় নাড়া দিয়েছি, আর হুড়মুড় করে আলগা পাথরের ধ্বস নেমেছে। যখন উঠে দাঁড়িয়েছি তখন দেখি আমার সামনে নতুন পথ। আমি কখনো দ্বিধা করিনি। পথ যতই অজানা হোক, দুর্গম হোক, পথ চলতে আমার ভয় ছিল না। আর এই চলতে চলতে কত মানুষের সঙ্গ পেয়েছি, কত মানুষের স্নেহ, ভালোবাসা, বন্ধুত্ব পেয়েছি তার তুলনা হয় না। কত উদার, কত উচ্চমনা, কত বড় মাপের মানুষ আমাকে স্পর্শ করেছে।

    লন্ডনে এই ফরাসি সংস্থার জেনারেল ম্যানেজার মিস্টার জন ফ্রেন্ড। আমার মতো নবাগত অল্পবয়সী কম্পিউটারবিদের সঙ্গে জেনারেল ম্যানেজারের “হ্যালো” বা “কেমন আছো” ছাড়া অন্য কোনো কথোপকথনের সুযোগ থাকার কথা নয়। কিন্তু মিস্টার ফ্রেন্ড এক অসাধারণ পরিচালক। প্রায়ই আমার ডেস্কের সামনে আসতেন, আমার পরিবারের কথা জিজ্ঞেস করতেন, কাজ কেমন লাগছে জানতে চাইতেন, জানতে চাইতেন আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে কিনা। কোনো মানুষের নামের সঙ্গে তার ব্যবহারের মিল থাকে না বা না থাকাই স্বাভাবিক। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নামের সঙ্গে তার চরিত্রের এমন সাদৃশ্য আমি কোনো মানুষের মধ্যে দেখিনি। মিস্টার ফ্রেন্ড সত্যই বহুজনের বন্ধু।

    একদিন সন্ধ্যায় আমার শ্বশুর মহাশয়ের মৃত্যুর খবর এল। অনু কান্নাকাটি করছে, আমার মনটাও ভারাক্রান্ত। পর দিন সকালে অফিসে গেছি– মুখে একটা বিষাদের ছায়া আছে যা লুকানো যায় না। মিস্টার ফ্রেন্ড প্রতিদিন সকালে সকলকে “গুড মর্নিং” করেন, সেদিনও করলেন। আমার ডেস্কের কাছে এসে একটু দাঁড়িয়ে বললেন, “কী হয়েছে তোমার? মুখটা এত শুকনো কেন?” আমি বললাম কী হয়েছে। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, তারপরে দুঃখ প্রকাশ করে চলে গেলেন। লাঞ্চের পর তিনি আবার এলেন আমার কাছে। বললেন, তিনি আমার স্ত্রী ও দুই পুত্রের জন্য তিনটি টিকিটের ব্যবস্থা করেছেন, কলকাতা যাওয়ার জন্য। বলা বাহুল্য এর জন্য আমায় কোনো মূল্য দিতে হবে না। সে যুগে সদ্য-আসা আমার মতো কোনো বঙ্গসন্তানের তিনটি টিকিট কেনার মতো সামর্থ্য থাকত না। খবরটা শুনে আমার চোখে প্রায় জল আসে। কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাবো তা ভেবে পেলাম না। ভারি গলায় শুধু বললাম, “থ্যাঙ্ক ইউ, মিস্টার ফ্রেন্ড।” আশ্চর্য মানুষ! নতুন কাজে আমার তখনও ছ’মাস হয়নি সুতরাং আমার কোনো ছুটি নেই। অনুকে তাই দুটি ছেলেকে নিয়ে একাই যেতে হবে।

    দিন যায়। অনু ছেলেদের নিয়ে দেশে আছে। এবার শীতটা বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। ক্রিসমাস আসছে। মিস্টার ফ্রেন্ড আমাকে একদিন বললেন, “ক্রিসমাসে কী করছ?” আমি বললাম কিছু না। উনি বললেন, “ক্রিসমাসে কেউ একা থাকে না। তুমি আমাদের সঙ্গে ক্রিসমাস কাটাবে। তোমার নিমন্ত্রণ রইল।” সেদিন আমার যে কী অনুভূতি হয়েছিল তা আজ মনে নেই। ভিনদেশের স্বল্প পরিচিত এক মানুষ, যার সঙ্গে আমার সম্পর্ক শুধুমাত্র পেশাদারী জীবনে; বয়স, পদমর্যাদা, সামাজিক তুল্যমানে যার সঙ্গে আমার কোনো সমতা নেই, তার কাছ থেকে এমন ব্যবহার আমার কল্পনাকে হার মানালো।

    ক্রিসমাসের আগের দিন থেকেই অল্প অল্প তুষার ঝরছে আকাশ থেকে। ক্রিসমাসের দিন সেটা আরও প্রবল হল। “আয় বৃষ্টি ঝেঁপে”র মতো অঝোরে ধূসর আকাশ থেকে অজস্র তুষার কণা শুভ্র শিমুল তুলোর মতো এলোমেলো হাওয়ায় চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। ক্রমশ রাস্তা, মাঠ, পার্ক, গাছ, লাল টালির বাড়ি, নানা রঙের গাড়ি, নির্ভেজাল দুধ-সাদা চাদরে ছেয়ে গেল। যারা উষ্ণ সমতল মাটিতে জন্ম নিয়েছে ও জীবন কাটিয়েছে তাদের প্রথম দর্শনে আদিগন্ত শ্বেত-শুভ্র তুষারাচ্ছন্ন ধরণীতল দেখলে শিহরণ জাগবে। কোথাও কোনো রঙের ছোঁয়া নেই। যেদিকে চোখ যায় সেদিকে শুধু কোমল শীতল ধবল শয্যা।

    সেকালে এদেশে ক্রিসমাসে প্রায় সমস্ত সাধারণ যানবাহন বন্ধ থাকত। আমার তখন গাড়ি ছিল না। ট্যাক্সি ভাড়ার সাধ্যও নেই। আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে মিস্টার ফ্রেন্ডের বাড়ি প্রায় পনেরো মাইল। আমি মনে মনে ভাবছি ক্রিসমাস ডিনার আমার কপালে নেই। এমন সময় টেলিফোন এল। অন্য প্রান্তে মিস্টার ফ্রেন্ডের কণ্ঠস্বর। “তোমার ঠিকানাটা বল। আমার ছেলে গিয়ে তোমাকে নিয়ে আসবে।”

    ক্রিসমাস এদেশে পারিবারিক উৎসব। যত হইচই তা ক্রিসমাসের আগের দিন পর্যন্ত। দোকানগুলোতে উপহার কেনার ধুম পড়ে যায়। এদিন বাবা-মা, ছেলে-মেয়ে, আত্মীয়-স্বজন, কাছের মানুষ, প্রিয়জন, প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী, ভাই-বোন, বন্ধু-বান্ধব, সবাই সবাইকে ক্রিসমাস কার্ড পাঠিয়ে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানানো এই উৎসবের এক বিশেষ অঙ্গ। পোস্ট অফিসের কাজ বাড়ে বহুগুণ। বাণিজ্যিক মাপকাঠিতে এ সময় দোকানগুলোর লেনদেন হয় অনেক বেশি। তারা সারা বছর ক্রিসমাসের মুখ চেয়ে বসে থাকে। রাস্তায় রাস্তায় আলো ঝলমল করে। সারা দেশে যেন একটা আনন্দ উৎসবের ধ্বনি ওঠে। বলা বাহুল্য সব কর্মস্থানই এদিন বন্ধ, জরুরি প্রতিষ্ঠান ছাড়া। সবারই আজ ছুটি। পথ, বাজার, হাট প্রায় জনমানব শূন্য। শান্ত নিঃশব্দ পরিবেশ। "ওরে তোরা আজ যাসনে ঘরের বাহিরে।" সবাই আত্মীয়-পরিজনসহ স্ফূর্তি ও ভূরি ভোজে মেতেছে।

    ফ্রেন্ড-পুত্র গাড়িতে চাপিয়ে আমাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেল।

    লন্ডনের শহরতলিতে এক বর্ধিষ্ণু বিত্তবান পাড়ায় ফ্রেন্ড পরিবারের বাস। গাড়ি গিয়ে থামল একেবারে সদর দরজার সামনে। আমাকে বরফের ওপর দিয়ে হাঁটতে হলো না বেশিক্ষণ। লাউঞ্জ বা বসার ঘর প্রশস্ত, পরিসরের অভাব নেই, বেশ কিছু সোফা সেটিতে ভরা। জন কুড়ি অতিথি অনায়াসে বসতে পারে। দেয়ালে কয়েকটা ছবি ঝুলানো, ধ্রুপদী ও আধুনিক। ঘরের অন্য প্রান্তে দীর্ঘ এক ডিম্বাকৃতি টেবিল। তাতে নানা ধরনের খাবার সাজানো, এগুলো যাকে বলে স্ন্যাক্স। এর পরে তো আসল ডিনার আছে।

    টেবিলের ওপর আট-দশ রকমের চিজ। ইউরোপে আসার আগে চিজের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল না। ইংল্যান্ড যাত্রাপথে জাহাজে চিজের স্বাদ পেয়েছিলাম। তবে সেগুলো অল্প মূল্যের নরম চিজ। জাহাজে তো এমনিতেই পাকস্থলীতে কিছুরই স্থিতি হচ্ছিল না– চিজও নয়। প্রথম পরিচয়ে তাই চিজের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়নি। পরে অবশ্য ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সে কিছুদিন থাকার সময় আমি প্রকৃতই চিজের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। চিজের স্বাদ ঠিকমতো উপভোগ করে চরম তৃপ্তির শরিক হতে হলে কিছুদিন সময় দিতে হয়। অনেকটা মার্গ সঙ্গীতের অমৃত রসে ডুবে যাওয়ার মতো। প্রথমে বারবার ঠেলে সরিয়ে দেবে, তারপর অন্তরঙ্গতা যতই গভীর হবে ততই ধীরে ধীরে ইন্দ্রলোকের আনন্দদ্বার খুলে যাবে। চিজের সাথী বিস্কিট– বিভিন্ন স্বাদের– নোনতা, মিষ্টি, নিরপেক্ষ। আর আছে নানা ধরনের ব্রেড – নরম, শক্ত– রাই, গম। এবং আর্কে ডোবানো শশা আর অলিভ। ক্রিসমাস টেবিল সম্পূর্ণ হবে না যদি না সেখানে নাট বা বাদামের ঝুড়ি আর নাট ক্র্যাকার বা বাদাম ভাঙার জাঁতা থাকে– আমন্ড, ব্রাজিল নাট, হেজেল নাট, পেকান, ওয়াল নাট ইত্যাদি আরও কতরকম। নাম-না-জানা আরও দু-চারটি ফল। একটু দূরে ছোট একটা টেবিলে নানা জাতীয় পানীয়। সব মিলে সে কী আয়োজন!

    বাইরে ধূসর মেঘলা আকাশ। ভরা দুপুরেও ঘরে আলো আসে না। জানলার পাশে একটা ক্রিসমাস ট্রি, লাল-নীল-সবুজ-হলুদ আলোর মালা জড়ানো। খুব মৃদুস্বরে ক্রিসমাস ক্যারল ও পিয়ানোর টুং-টাং শব্দে ঘরে একটা মনোরম আবহাওয়ার সৃষ্টি করেছে।

    ক্রিসমাস যেহেতু পারিবারিক মিলন দিন সেহেতু ঘরে সবাই মিস্টার ফ্রেন্ডের ঘনিষ্ঠ পরিবার। ব্যতিক্রম শুধু তিনজন অতিথি। আমি ছাড়া আরও যে দুজন আছেন; তাদের মধ্যে একজন ফ্রেন্ড-পুত্রের প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। একা থাকেন তাই আমন্ত্রিত। ফ্রেন্ড-পুত্র এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, কিন্তু বাল্যকালের শিক্ষিকাকে ভুলে যায়নি। অন্যজন ফ্রেন্ড-কন্যার পিয়ানো শিক্ষক। অনুমান করলাম তিনিও একাকী। খুব অপ্রস্তুত লাগছিল যে সকলেই যেন আমার দিকে একটু বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন। আকারে, ইঙ্গিতে, কথায় বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন যে আমি যেন ওদের আপন ভেবে সহজ ভাবে থাকি -- নিজেকে যেন সংকুচিত করে না রাখি। সবাই আমার সঙ্গে হেসে কথা বলে আমাকে খুশি রাখতে চাইছিলেন, চাইছিলেন আমি স্বচ্ছন্দে থাকি। আমি মনে মনে বেশ বুঝতে পারছিলাম ওরা সকলে ভাবছেন, আমি এ দেশে নতুন, এমন পরিবেশে আমি অনভ্যস্ত। কিন্তু এদের সৌজন্য ও আতিথেয়তায় কিছুক্ষণের মধ্যেই এঁরা আমাকে আপন করে নিলেন।


    ইংল্যান্ডে এসে পর্যন্ত নীল খাতায় কলম ছুঁইনি। একদিন সময় করে এক বছরের ইতিহাস লেখা যাবে। এখন একটা তারিখ বেঁধে রেখে দেওয়া যাক। আজ রবিবার ১২ই মে ১৯৬৮ সাল, সন্ধ্যা সাতটা পাঁচ মিনিটে কিংসবেরি মেটার্নিটি হসপিটালে, হানিপট লেন, লন্ডন, এন ডব্লিউ নাইন-এ অনু দ্বিতীয় পুত্রের জন্ম দিল। নবজাতকের ওজন ছিল ৭ পাউন্ড ৪ আউন্স। মা ও পুত্র উভয়েই সুস্থ।

    গৌতম বা কিংশুক সুস্বাগতম। বুদ্ধপূর্ণিমার দিন জন্ম বলে আমার মা ওর নাম দিল “গৌতম”।

    নবজাতক সদান্তঃকরণ, সুস্থ ও দীর্ঘায়ু হোক এই কামনা করি। তুলা রাশি, বুদ্ধ পূর্ণিমা।

    লন্ডন ১২-৫-৬৮

    সনৎকে লিখলাম:

    "এই চাকরিটা ছাড়ছি। এয়ারলাইনসের চাকরি ছেড়ে একটা কনসালটেন্সি ফার্মে কাজ নিচ্ছি। এখানে কাজ শেখার আরও বেশি সুযোগ পাব, অভিজ্ঞতা বাড়বে। পয়সাও ভালো, তাই বিনা পয়সায় পৃথিবী ভ্রমণের লোভ ত্যাগ করে এ কাজ নিলাম। মনকে যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েছি বেশি কাজ শিখব এবং বাড়তি পয়সায় ভ্রমণের সাধ মেটাবো। তবে দ্রুত উন্নতির একটা বিপদ আছে। একবার পিছলে পড়লে অনেক উঁচু থেকে মাটিতে পড়ব, আর উঠে দাঁড়াবার সামর্থ্য থাকবে না হয়তো। অথচ বিপদ হয়েছে আমার ইগো। চ্যালেঞ্জ এলে তাকে না নিলে নিজেকে কেমন যেন কাপুরুষ মনে হয়। যা হয় হবে। মা ভৈঃ।

    ভালো কথা, একটা ফ্ল্যাট কিনেছি সুতরাং আবার চিঠি দেওয়ার ইচ্ছা হলে নিচের ঠিকানায় লিখিস। 30 Eagle Road, Wembley, Middlesex, UK

    আমার কাছে জীবনের অর্থ আর আগের মতো স্বচ্ছ নেই, অনেক সমস্যার নাকানিচোবানিতে উদ্দেশ্য বেপথু এবং আবছা। কেমন যেন একটা নেশার মতো এগিয়ে চলেছি। আমার সব চাই, অল্পে আর সন্তুষ্ট হই না।"

    লন্ডন ২৮-০১-৭০

    আমি ক্রমশ অবাক হয়ে দেখছিলাম আমার অভিজ্ঞতা ও যোগ্যতার চাহিদা বাড়ছে কম্পিউটার কর্মজগতে। যেখানেই উন্নততর কাজের জন্য আবেদন করি সেখান থেকেই ইতিবাচক উত্তর আসে। ভালো ভালো নামকরা সফটওয়্যার কোম্পানি থেকেও কাজের প্রস্তাব আসছে। আমি এয়ারলাইনসের কাজ ছেড়ে এক বিখ্যাত সফটওয়্যার কোম্পানিতে কাজ নিলাম, মূলতঃ অভিজ্ঞতার ব্যাপ্তি ও গভীরতা বৃদ্ধি করতে, যদিও অর্থের অঙ্কটাও মন্দ নয়। কোম্পানির নাম সায়েন্টিফিক কন্ট্রোল সিস্টেম।

    তবু এখানেও আমি বেশি দিন কাজ করিনি। আমার অভিষ্ট লক্ষ্য ছিল কম্পিউটারের অন্দরমহলে কী হয় তা পুঙ্খানুপুঙ্খ জানার। কম্পিউটার বিভিন্ন ধাতু ও ইলেকট্রনিক্স দিয়ে তৈরি এক জড় বস্তু কিন্তু অসীম শক্তিমান। আমার ইচ্ছা এই শক্তিকে যারা প্রাণ দান করে তাদের সঙ্গে কাজ করার, সেই সব বিজ্ঞানী ও ঋদ্ধ মস্তিস্কের দলভুক্ত হওয়া। কম্পিউটারের প্রাণকেন্দ্রে আছে অপারেটিং সিস্টেম– এর সব বুদ্ধিমত্তার উৎস, এর মস্তিস্ক। আমি কম্পিউটারের অন্তর্মহলে ঢুকতে চাই। সে যুগে মাইক্রোসফট ছিল না। অপারেটিং সিস্টেম লিখত কম্পিউটার যারা তৈরি করত (কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারার), তারাই শুধু নিজেদের জন্য। এবং সেগুলো সব ছিল আমেরিকাতেই – আই বি এম, ইউনিভ্যাক, বারোজ, ডেক-এর মতো গুটিকয়েক কোম্পানি। বৃটেনে একমাত্র আই সি এল (International Computer Ltd) ছিল যারা নিজেদের অপারেটিং সিস্টেম ও ওই জাতীয় সফটওয়্যার লিখত। এদের কাছে কয়েকবার এই বিভাগে কাজের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলাম। মুখ্যতঃ এই ধরণের কাজের পদ খালি থাকত না, আর তা থাকলেও তার জন্য এদেশের ইউনিভার্সিটির মেধাবী ছাত্রদের এই রকম গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য নির্বাচিত করা হত। এদেরই মস্তিস্ক কম্পিউটারের মস্তিস্ক।

    আগেই বলেছি সে কালে কোনো ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার বিজ্ঞানের বা কম্পিউটার প্রযুক্তির কোনো কোর্স ছিল না। সুতরাং এই রকমের কতিপয় কম্পিউটার কোম্পানি ভালো ছাত্রদের নির্বাচিত করে তাদের বিশেষ ট্রেনিং দিয়ে কুশলী ও যোগ্য করে নিত।

    এই অদম্য ইচ্ছা আমাকে নিরন্তর অন্বেষণে উদ্বুদ্ধ করে রেখেছিল। আমেরিকার অন্যতম বিখ্যাত কম্পিউটার ম্যানুফ্যাকচারার ইউনিভ্যাক আর এন্ড ডি কেন্দ্র (Research and Development Centre) লন্ডনে আরম্ভ করেছিল। এই রকম অভিজ্ঞতার জন্য আমি উদ্গ্রীব হয়েছিলাম। আমি সুযোগ পেয়ে আবেদন করলাম এবং ওরা ওদের নির্বাচন পরীক্ষায় বসার জন্য আমন্ত্রণ পাঠাল। পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখলাম পরীক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ জন। এত ছেলেমেয়ে আমি আশা করিনি। আমি একটু হতাশ হলাম। কয়েকদিন পর ইউনিভ্যাকের কাছ থেকে চিঠি পেলাম পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হয়েছি, ওরা আমাকে ইন্টারভিউ করতে চায়। দুটো ইন্টারভিউ-র পর আমি আমার আকাঙ্ক্ষিত কাজের নিয়োগপত্র পেলাম।

    এতদিনে আমার উদ্দেশ্য সফল হতে চলেছে। এখানে কাজ ভালোই লাগছিল। নিত্য নতুন কিছু শিখছি। সহকর্মীরা প্রায় সবাই এদেশের ইউনিভার্সিটির কৃতি ছাত্র– উজ্জ্বল, বুদ্ধিদীপ্ত ছেলেমেয়ে। তাছাড়া আমেরিকা থেকে কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও দক্ষ কুশলীরা আসত আমাদের সঙ্গে কাজ করতে ও ট্রেনিং দিতে। মনে মনে স্থির করলাম এখানেই স্থিতি হব, আর কোথাও যাব না। এখানে বিভিন্ন বিভাগে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ তো ছিলই, সেই সঙ্গে ছিল আমেরিকায় ওদের অন্য রিসার্চ কেন্দ্রে গিয়ে কাজ করার। এতকাল দীর্ঘদিন একটানা লন্ডনে থাকার সুযোগ হয়নি, কর্মসূত্রে লন্ডনের বাইরে থাকতে হয়েছে দিনের পর দিন। এখন আর ছোটাছুটি নয়। অনেক দিনের ইচ্ছা একটা ম্যানেজমেন্ট কোর্স করার। সন্ধ্যা ছাড়া আমার সময় নেই আর সন্ধ্যায় করলে প্রায় তিন-চার বছর সময় লাগবে। অতদিনের পরিকল্পনা করা আমার মতো অস্থিরমতি মানুষের পক্ষে কঠিন। তবু যাতায়াতের সুবিধা বুঝে কাছাকাছি ওয়েস্টমিন্সটার পলিটেকনিকে, অধুনা ওয়েস্টমিন্সটার ইউনিভার্সিটিতে, তিন বছরের ম্যানেজমেন্ট কোর্সে ভর্তি হলাম এবং সৌভাগ্যবশতঃ শেষও করলাম। মনে আছে ইউনিভ্যাকের জেনারেল ম্যানেজার লিখেছিল, “Congratulations, a good job well done”।

    কিন্তু এখানেও বেশিদিন থাকা হল না। বছর চারেক পরেই ইউনিভ্যাক সিদ্ধান্ত নিল লন্ডনের আর এন্ড ডি কেন্দ্র বন্ধ করে দেবে। সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে। কম্পিউটার আর এন্ড ডি-তে অভিজ্ঞ ছেলেমেয়েদের চাহিদা ছিল কম্পিউটার জগতে। বড় বড় সফটওয়্যার হাউস ও ম্যানুফ্যাকচাররা এদের কাজে নিতে আগ্রহী ছিল। ইউনিভ্যাক উঠে যাচ্ছে শুনে তারা নিকটবর্তী বড় হোটেলে চিজ ও ওয়াইন পার্টির আয়োজন করত। এগুলো ছিল ওপেন হাউস অর্থাৎ সবারে করি আহ্বান, যার ইচ্ছা সে এসো, আমাদের আতিথেয়তা গ্রহণ করো, আলোচনা করো, দেখো আমরা তোমাদের কী সুযোগ দিতে পারি। ইউনিভ্যাক আমাদের সকলকে দুঃসংবাদটা দিয়েছিল। কিন্তু ওরা অল্প কিছু সংখ্যককে ওদের আমেরিকার অন্য আর এন্ড ডি কেন্দ্রে কাজ করার আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। আমাকে ওদের ফিলাডেলফিয়া অঞ্চলে ব্লু বেল-এ যোগ দেওয়ার জন্য মনোনীত করেছিল।

    আমরা তখন লন্ডনে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেছি। লন্ডনের বাঙালি সমাজের সঙ্গে মিশে গেছি। অনুর অনেক বন্ধু-বান্ধব হয়েছে। আমারও এ সব ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না। ততদিনে আমি বার দুয়েক আমেরিকায় গিয়েছি, ওদের সঙ্গে কাজ করেছি। আমেরিকার জলবায়ু, সমাজ ব্যবস্থা, ওয়ার্ক কালচার বা কর্ম পদ্ধতি আমার ভালো লাগেনি। যাব কী যাব না এই দ্বন্দ্বের মধ্যে যখন আছি তখন এক হোটেলে আই সি এল (International Computer Limited) আয়োজিত ওই রকম চিজ ও ওয়াইন পার্টিতে আমি গেলাম। আই সি এল-এ আমি কয়েকবার কাজের চেষ্টা করেছি কিন্তু কখনো সফল হইনি। তবু আবার একবার চেষ্টা করে দেখা যাক মনে করে গেলাম। কোনো আশা না করেই শুধু আয়োজন দেখার জন্যই গেলাম। সারা ইংল্যান্ড জুড়ে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে আই সি এল-এর কর্মস্থান। চার-পাঁচটা বিভাগ থেকে প্রতিনিধি এসেছিল এই সব সম্ভাব্য কর্মীদের যাচাই করতে। আমি সকলের সঙ্গেই দেখা করলাম। আমি অবাক হলাম, আশ্চর্য হয়ে দেখলাম সকলেই আমাকে তাদের বিভাগে কাজের জন্য নির্বাচিত করল। এই চার বছরের বিশেষ অভিজ্ঞতা ও একটা ম্যানেজমেন্ট শংসাপত্র আমাকে অন্য স্তরে পৌঁছে দিয়েছিল। আমি আই সি এল-এ যোগ দিলাম।


    ক্রমশঃ

     



     


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৪ জুন ২০২৫ | ৮৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন