এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা  শনিবারবেলা

  • সেই দিন সেই মন - পর্ব ২০

    অমলেন্দু বিশ্বাস
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ১০ আগস্ট ২০২৫ | ৪২৭ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • ছবি: রমিত 




    সল্টলেকের বাড়ি - পর্ব ৩

    সল্টলেকের জমির চাহিদা অনেক। আগে সল্টলেকের জমি বিক্রি করা যেত না; শুধু হস্তান্তর করা যেত আপন রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয়কে। কিন্তু সম্প্রতি সরকার অনুমতি দিয়েছে, যে কোনও লোককেই বিক্রি করা যেতে পারে। খোলা বাজারে জমির দাম তাই গগনস্পর্শী হয়ে গিয়েছে। সল্টলেকে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী আছে যারা সল্টলেকের জমি বা বাড়ি কেনাবেচা করে। এরা ‘প্রোমোটার’ নামে পরিচিত। এদের মধ্যে অনেকেই অসৎ। কখনো অল্পকিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে অনির্দিষ্ট কালের জন্য সম্পত্তিটা ধরে রাখে, কখনো বা সত্তর বা আশিভাগ টাকা দিয়ে বাড়ির দখল নেয় কিন্তু বাকি টাকা আর দেয় না। কখনো বা একরকমের মৌখিক শর্ত করে অন্যরকম করে লিখিয়ে নেয়। এটা একটা জঙ্গল; এখানে সব লোভী ও ধুর্ত জন্তুরা শিকারের জন্য ওঁৎ পেতে আছে। সুতরাং খুব সতর্ক না হলে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

    আমার বাড়ি বিক্রি হবে শুনে অনেক প্রোমোটার ও ভদ্রলোক ক্রেতা আসতে লাগল। সবাই পুরো বাড়ি কিনতে চায়; যখন শোনে আমি মাত্র পঁচাত্তর শতাংশ বিক্রি করতে পারি তখন কেউ আর আগ্রহ দেখায় না। আমার আর সময় নেই। দু-দিন পরে আমাদের লন্ডনে ফিরে যাওয়ার টিকিট। ধরেই নিয়েছিলাম এ যাত্রায় কিছু হবে না, এমন সময় দিলীপ নামে এক বিহারী প্রোমোটার আগ্রহ দেখাল। কিন্তু এত অল্প সময়ের মধ্যে কী চুক্তি চূড়ান্ত করা যাবে! প্রোমোটারের উকিলের সঙ্গে সারাদিন বসে চুক্তির খসড়া তৈরি হল। ন্যায্য দামের থেকে অনেক কম দাম নির্ধারণ হল। আপাতত ওরা দশ লক্ষ টাকা অগ্রিম দেবে, বাকি টাকা দলিল চুড়ান্ত হলে দেবে। আমি প্লেনে ওঠার কয়েকঘন্টা আগে চুক্তিপত্রে সই করে দিয়ে প্লেনে উঠলাম।

    খোকনকে জানিয়ে দিলাম যে আমি আমার অংশ বিক্রির ক্রেতা পেয়েছি। দিন যায়, আমি নিয়মিত লন্ডন থেকে প্রোমোটার দিলীপকে ফোন করি। ও আমাকে আশ্বাস দেয়, কাজ এগোচ্ছে। কথা ছিল ছয় মাসের মধ্যে ও পুরো টাকা দিয়ে দলিল করার কাজ শেষ করবে। কিন্তু বছর পার হয়ে গেল, ও নিশ্চুপ। প্রতি ডিসেম্বরে যেমন অনু আর আমি দেশে যাই তেমনি সে বছরও টিকিট কেটে প্রস্তুত হয়ে বসে আছি। যাওয়ার ক’দিন আগে হঠাৎ অনু স্ট্রোকে আক্রান্ত হল। হৃদয়বিদারক ঘটনা। মস্তকে রক্ত জমেছে; বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম। শেষ পর্যন্ত ডাক্তাররা ওকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছিল কিন্তু ও বাকহীন হয়ে গেল; হাত-পা শক্তিহীন। বলা বাহুল্য দেশে যাওয়া আর হল না। সারা দিনরাত ওকে নিয়ে ব্যাস্ত, সল্টলেকের কথা ভাবার সময় নেই। অনেক চিকিৎসা ও থেরাপির পর অনু আস্তে আস্তে কথা বলতে ও হাঁটতে সক্ষম হল। কিন্তু সম্পূর্ণ স্বাভাবিক নয়। কথায় জড়তা আছে, স্মৃতিভ্রম হয়েছে, ভালো করে হাঁটাচলা করতে পারে না। খাওয়াতে অরুচি, প্রায় কিছুই খায় না। ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে, মাঝে মাঝে মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছে। ভাবলাম দেশে গেলে হয়তো একটু পরিবর্তন হবে। ওকে নিয়ে দেশে গেলাম পরের বছর।

    অর্জুন বিশ্বস্ত, অনুগত ও করিৎকর্মা ছেলে। অনেক বছর ধরেই কলকাতায় ও-ই আমার সব কাজকর্ম করে দেয়। অর্জুনকে বলে দিয়েছিলাম ও যেন গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে। গাড়ি নিয়ে সল্টলেকের বাড়ির সামনে নেমে অবাক হয়ে গেলাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছি না। ঠিক দেখছি তো? অর্জুন আমাদের ভুল ঠিকানায় নিয়ে আসেনি তো? সল্টলেকের বাড়িটা চারিদিকে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, গ্যারেজের দিকে একটা বড় লোহার গেট, সেই গেট পেরিয়ে সদর দরজা খুলে বাড়িতে ঢুকতে হয়। দেখি সেই গেটে একটা ভারী তালা ঝুলছে। দিনক্ষণ জানিয়ে খোকনকে একটা মেল করে দিয়েছিলাম। সুতরাং খোকন জানত আমরা আসছি। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চীৎকার করে ওকে ডাকলাম, কোনও সাড়া নেই। দেশের টেলিফোন আমার নেই। অর্জুনের ফোন নিয়ে আমার বোন খুকু ও জামাই দিলীপকে ফোন করলাম, বললাম, “মেজদাকে বল দাদারা নিচে অপেক্ষা করছে। দরজা খুলে দিতে।” কিছুক্ষণ পরে দিলীপ ফোন করে বলল, ‘মেজদা বলছে, দরজা খুলবে না।‘ আমি হতভম্ব। খুকু বিচলিত। খুকু দিল্লিতে হাঁদিকে ফোন করল। হাঁদির কথাও শুনল না খোকন।

    ক্লান্তি, বিস্ময়, ক্রোধ সব মিলে আমার মস্তিষ্কে এক অদ্ভুত অনুভূতি। সারারাত প্লেনে কাটিয়ে অনু খুব ক্লান্ত। অবসাদ আর অপ্রত্যাশিত ঘটনা আমার সব শক্তি গ্রাস করেছে। ভাবলাম আমিও গেটে একটা তালা দিয়ে একটা হোটেলে গিয়ে বিশ্রাম নিই। কিন্তু সেটা ঠিক হবে না। ওরা তাহলে বাইরে আসতে পারবে না। বাজার-হাট করবে কি করে? আমার সেই আপ্ত বাক্য মনে পড়ল- “তুমি অধম বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’’ ও পথে গেলাম না। ভাবলাম থানায় গিয়ে বলে দেখি, ওরা যদি কিছু করতে পারে। আমি অনুকে গাড়িতে বসিয়ে থানায় গেলাম।

    ইতিমধ্যে খুকু দাদা বৌদির অবস্থা চিন্তা করে রত্নাকে ফোন করে বলেছে, “তুমি শীঘ্র এসে দাদাবৌদিকে তোমার ফ্লাটে নিয়ে যাও।” আমি থানায় গিয়ে থানার ও-সিকে আমার অবস্থার কথা বললাম। সব শুনে উনি দু-জন পুলিশ অফিসার পাঠিয়ে দিলেন। পুলিশ এসে খোকনকে ডাকতে খোকন নিচে নেমে এল। পুলিশ জিগ্যেস করল, “আপনি এদের ঢুকতে দিচ্ছেন না কেন?“ খোকন বলল, “এ বাড়ি আমার, আমি অন্য লোককে ঢুকতে দেব না।” পুলিশ বলল, “কিন্তু আপনার দাদা বলছেন এ বাড়ি ওঁর, আপনাকে মাত্র পঁচিশ পারসেন্ট দান করেছেন।” খোকন বলল, “আগে এ বাড়ি দাদার ছিল কিন্তু এখন এ বাড়ি আমার।”

    যে ইন্দ্রিয় মানুষকে বিস্মিত করে সে ইন্দ্রিয় মনে হয় আমার লোপ পেয়েছে। আমি আর কিছুতে অবাক হই না, বিস্মিত হই না। এত বড় মিথ্যা ও উচ্চারণ করল কী করে? অনু গাড়ি থেকে নেমে এসে খোকনকে কাকুতি মিনতি করল, “খোকন, আমি আর দাঁড়াতে পারছি না। দরজা খুলে দাও।” খোকন গ্রাহ্য করল না। খোকনকে অনু নিজের ভাইয়ের থেকেও বেশি ভালোবাসে। গাড়িতে যে স্যুটকেসগুলো আছে তার মধ্যে ওদের জন্য উপহার ভর্তি– সারা বছর ধরে একটু একটু করে কিনেছে। সেই খোকন অনুর কথার জবাব দেওয়ার প্রয়োজন পর্যন্ত বোধ করল না। কত বড় পাষণ্ড হলে মানুষ এমন কাজ করে! আর কত নীচে নামতে পারে মানুষ!

    আমার ভয় করতে লাগল, অনু খুবই অসুস্থ, হয়তো এখুনি পড়ে যাবে বা হার্ট ফেল করবে। ইলা উপর থেকে নিচে নেমে এসে মজা দেখে চলে গেল। পুলিশ খোকনকে অনেক বোঝাবার চেষ্টা করে অসফল হয়ে হাল ছেড়ে দিল। আমাকে বলল, “আপনি থানায় গিয়ে একটা ডায়েরি করুন। আর কোর্ট অর্ডারের ব্যবস্থা করুন। কোর্ট অর্ডার না পেলে আমরা কিছু করতে পারব না।” ততক্ষণে রত্না এসে গেছে। অনুকে নিয়ে রত্না চলে গেল ওর বাসায়। আমি গেলাম থানায়। তখন আমার মনের যে কী অবস্থা তা বর্ণনা করার ভাষা আমার নেই। মানুষ কি এত নীচে নামতে পারে? ওর কোমল সুন্দর মুখটা আমার কুৎসিত মনে হল। আমি তো ওকে ভালোবেসে আশ্রয় দিয়েছিলাম।

    আমার এই অষ্টআশি বছরের দীর্ঘ জীবনে আমি একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছি। আমি যখনই কোনও বিপদ বা সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছি তখনই কোনও চেনা অল্পচেনা অচেনা মানুষ আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, আমার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, বিপদ থেকে রক্ষা করেছে। কে যেন আমাকে সর্বদা দু-হাতে আগলে রেখেছে। এ বারেও সহানুভূতিশীল, শুভাকাক্ষী, পরোপকারী মানুষের অভাব হয়নি। রত্না ওর ফ্লাটটা ভাড়া দিয়ে কেষ্টপুরে দুটি ঘরের একটা ফ্লাট ভাড়া করে থাকে। অয়ন পড়াশোনা করতে উড়িষ্যায় আছে। রত্না আমাদের ওর বাসায় নিয়ে গেল। অনু আর আমি রত্নার বাসায় গিয়ে উঠলাম। কি করে কী ভাবে কোর্ট অর্ডার বার করব বুঝতে পারছি না। চিমু আর তপতীর দিল্লি থেকে কলকাতায় আসার কথা ছিল। আমরা যাওয়ার কয়েকদিন পরেই চিমু আর তপতী কলকাতায় এল এবং রত্নার বাসাতেই উঠল। চিমু শান্তশিষ্ট নরম মনের মানুষ।

    আমার মেজভাই খোকনের সঙ্গে আমার অন্যান্য ভাইবোনদের সঙ্গে চরিত্রগতভাবে কোনো সাদৃশ্য নেই। আমার ওপর খোকনের এই ব্যবহার আমার অন্য কোনো ভাইবোনেরা মেনে নিতে পারেনি। দরকারের সময়ে সকলেই আমাকে সাহায্য করেছে, আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। আমি সকলের কাছে কৃতজ্ঞ।

    আমার অবস্থা দেখে চিমু আমায় সহানুভূতি জানাল। বলল, ওর এক শ্বশুরালয়-সম্পর্কিত আত্মীয় আছেন, তিনি হয়তো সাহায্য করতে পারেন। তিনি অবনীবাবু, আই পি এস (IPS), কর্মজীবনে উচ্চপদের জাঁদরেল পুলিশ অফিসার ছিলেন। অবসর নেওয়ার পর তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন। অধুনা এম এল এ (MLA, Member of Legislative Assembly)। চিমু আর আমি অবনীবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। অবনীবাবুর সঙ্গে আমার পূর্বপরিচয় ছিল। বুবাইয়ের বিবাহ উৎসবে আমাদের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন– ক্ষণকালের আলাপ। চিমু ও আমাকে সাদর অভ্যর্থনা করলেন। আমার কথা শুনে দুঃখ প্রকাশ করলেন ও সমবেদনা জানালেন। বললেন উনি সার্ভিসে থাকলে কোনো সমস্যাই হত না। কিন্তু এখন খুব বেশি খবর রাখেন না। তাছাড়া উনি কৃষ্ণনগরের এম এল এ, সল্টলেকের নন। বললেন, “দু-একদিন সময় দিন, দেখি কী করা যায়। আপনি পরশুদিন আসুন।”

    তখন প্রায় সাত-আট দিন হয়ে গিয়েছে; আমরা গৃহহারা, রত্নার আশ্রয়ে আছি। একজন উকিলের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলাম, কিন্তু তার কথাবার্তা আমাকে ভালো লাগেনি। সে আমাকে আর কিছু মিথ্যা জুড়ে দিয়ে ফৌজদারি মামলা করতে বলল। আমি মিথ্যা কেস সাজাতে রাজি হইনি। যা হয়েছে সেটাই যথেষ্ট ন্যক্কারজনক অন্যায়। তার জোরেই আমার কোর্ট অর্ডার পাওয়া উচিত। আমি তাই কোনও কেস করিনি। আর কিছু হবে না এমন এক ভাবনা নিয়ে অবনীবাবুর বাড়ি থেকে ফিরে এলাম। দু-দিন পরে আবার গেলাম ওঁর সঙ্গে দেখা করতে। অবনীবাবু বললেন ভালো খবর আছে। ওঁর এক পূর্বতন সহকর্মী এখন সল্টলেকের পুলিশ কমিশনার, জ্ঞানবন্ত সিং। উনি তাঁর সঙ্গে কথা বলেছেন। বললেন, “কাল সকাল ঠিক এগারোটার সময় পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করুন। উনি কিছু একটা করতে পারেন।” অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষে যেন আলোর ঝলকানি। রাত্রে ভালো করে ঘুম হল না।

    পরদিন নির্ধারিত সময়ে চিমু আর আমি সল্টলেকের পুলিশ হেডকোয়ার্টারে গিয়ে হাজির। বিরাট চত্বর ও করিডোর পেরিয়ে পুলিশ কমিশনারের অফিস। রক্ষী এসে আমাদের জ্ঞানবন্ত সিং-এর অফিসে নেয়ে গেল। বেশ বড় একটা ঘর, মাঝখানে এক বিশাল টেবিল। টেবিলের ওপর নানারঙের তিন-চারটে ফোন। জ্ঞানবন্ত সিং-এর ব্যাক্তিত্ব আছে, কথা বলেন কম। কমিশনার আমাকে সমস্ত ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ দিতে বললেন। আমি আমার জমি কেনা থেকে আরম্ভ করে গেটে তালা দেওয়ার ঘটনা পর্যন্ত সব বললাম। উনি খুব মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। বললেন, সল্টলেকে এরকম জবরদখল বেড়ে যাচ্ছে। একটা ব্যবস্থা করতে হবে। বলে তিনি লাল ফোনটা তুলে আমাদের থানার ও সি-র সঙ্গে কথা বললেন, “আপনি কি সি-এফ ২৩১-এর ঘটনা জানেন?” অল্প যা শুনতে পেলাম তাতে বুঝলাম ও-সি বলছেন যে উনি জানেন এবং চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু কিছু করতে পারেননি। কমিশনার বললেন, “আপনি বিমলেন্দু বিশ্বাসকে অ্যারেস্ট করে থানায় অনেকক্ষণ আটক করে রাখুন। তারপর অমলেন্দু বিশ্বাসকে ওঁর বাড়িতে ঢুকিয়ে দিয়ে আসুন।” আর আমাদের বললেন, “আপনারা এখুনি আপনাদের থানায় চলে গিয়ে ও-সির সঙ্গে দেখা করুন।” আমি কমিশনারকে অজস্র ধন্যবাদ দিয়ে চিমুকে নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

    থানার সামনে এসে চিমু বলল, “তুমি একা যাও। আমি আর যাব না। মেজদাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে সেটা আমি দেখতে পারব না।“

    চিমু চলে গেল, আমি একা গেলাম ও-সি সোমদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কথা বলতে। এ যেন অন্য ও-সি, গলার স্বর ও ব্যবহার পালটে গিয়েছে। প্রাথমিক কথাবার্তা সারা হলে উনি দু-জন পুলিশ অফিসারকে বললেন বিমলেন্দু বিশ্বাসকে থানায় ধরে নিয়ে আসতে। আমাকে সঙ্গে যেতে বললেন। আমি গাড়িতে বসে, পুলিশের ডাকে খোকন নিচে নেমে এল। তখন ভরা দুপুর, খাবার সময়। কিন্তু পুলিশ ওকে খাবার সময় দেয়নি, ওই অবস্থাতেই ওকে থানায় নিয়ে এল এবং বড় হল ঘরটাতে বসিয়ে রাখল। আমাকে একটা ঘর দেখিয়ে বলল আমি সেখানে বিশ্রাম নিতে পারি বা ঘুরে আসতে পারি, দু-তিন ঘণ্টা পরে আসবেন।

    ঘণ্টা-দুয়েক পরে গিয়ে দেখি পুলিশ স্টেশনে পিউ, ছোটন, ওর উকিল ও দু-চার জন বন্ধু খোকনের সঙ্গে পরামর্শ করছে। এমন কিছু ঘটবে ওরা কল্পনা করতে পারেনি। ঘটনার আকস্মিকতায় ওরা অবাক। সোমদেববাবু এক বিশেষজ্ঞ অফিসারকে বললেন এই কেসটা দেখতে। তিনি আমাদের একটা বড় ঘরে বসিয়ে খোকন ও আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন এ জমিটা আমার কিনা। আমি জমি কেনা থেকে আরম্ভ করে খোকনকে পঁচিশ শতাংশ দান করা পর্যন্ত সব বললাম। খোকনকে জিজ্ঞেস করলেন এ জমি কার? খোকনের গলার সুর এখন অন্যরকম- সেই উদ্ধত উচ্চকণ্ঠ, হিংস্রভাব নেই আর। নিচু গলায় বলল, “দাদা, আমাকে পঁচিশ পারসেন্ট গিফট করেছে।” অফিসার বললেন, “তবে আপনি ওঁর বাড়িতে ওঁকে ঢুকতে দিচ্ছেন না কেন?”

    উত্তরে খোকন ঠিক কি বলেছিল মনে নেই। অফিসার আমাদের নিয়ে বাড়িতে আসলেন এবং খোকনকে আদেশ দিলেন তালা খুলে দিতে। খোকন বশংবদ ভৃত্যের মতো মাথা নিচু করে গেট, সদর দরজা, ও নিচের কলাপ্সিবল দরজা খুলে দিল। আমি স্যুটকেস নিয়ে বসার ঘরে গিয়ে বসলাম। অফিসার আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চলে গেলেন। তখনও জানিনা আমার জন্য আরো কত দুর্ভোগ ও যন্ত্রণা অপেক্ষা করে আছে।

    অফিসার চলে যাওয়ার পর আমি ওপরে আমাদের শোবার ঘরে স্যুটকেস রাখতে গেলাম। আশর্য হয়ে দেখি আমাদের ঘরে তালা লাগানো। আমাদের ঘরের দরজায় তালা লাগানোর কোনও উপায় নেই। চাবি দিয়ে দরজা খুলতে হয়। আমি তাই উপরের ঘরে না গিয়েই পুলিশকে চলে যেতে দিয়েছিলাম। কিন্তু খোকন ধূর্ত, শয়তানী মতলবের সীমা নেই। মিস্ত্রি এনে দরজায় ছিদ্র করে আংটা লাগিয়ে তবে তালা দিয়েছে। বহুদিনের সুচিন্তিত পরিকল্পনা। এ ট্রুলি ক্রিমিনাল মাইন্ড। A truly criminal mind। আমার চিন্তাশক্তি সব লোপ পেয়েছে। শরীর মন কোনটাই আর সাড়া দিচ্ছে না। সেই ভোরে উঠে চিমুকে নিয়ে বেরিয়েছিলাম আর এখন প্রায় সন্ধ্যা হয় হয়। খাওয়াদাওয়া বিশ্রাম কিছুই হয়নি। সারাদিন দ্রুতগতি নাটকের মত মুহুর্তে মুহুর্তে পট পরিবর্তন হয়েছে। আর সব দৃশ্যেই আমি প্রধান চরিত্র। আমার আর শক্তি নেই। মনে হল, আমি তো কখনও খোকনের ভালো ছাড়া মন্দ করিনি, কখনো অমঙ্গল কামনা করিনি। যখন যা চেয়েছে সাধ্যমত দিয়েছি। তবে ও আমাকে কেন এত যন্ত্রণা দিচ্ছে? আমার ওপর ওর কেন এত আক্রোশ তার কোনও যুক্তি খুঁজে পেলাম না। এ কি আমার সাফল্যে ওর ঈর্ষা অথবা আমার অনুপস্থিতিতে এ বাড়ির অধিপতি হওয়ার লোভ? বা উভয়ই?

    কোনোরকমে ক্লান্ত শরীরটাকে বয়ে নিয়ে গেলাম আবার থানায়। সেই অভিজ্ঞ অফিসার সব শুনে বিরক্তি প্রকাশ করলেন। বললেন, চলুন। বাড়িতে এসে খোকনকে যথেষ্ট তিরস্কার করলেন ও তালাগুলো খুলে দিতে বললেন। খোকন সারমেয়সুলভ লেজ গুটিয়ে মাথা নিচু করে তালাগুলো খুলে দিল। সে দৃশ্য মনে রাখার মত। সেই উদ্ধত আচরণ নেই আর; সেই উচ্চ কন্ঠে “এ বাড়ি আমার” ঘোষণা নেই আর। ওর ব্যক্তিত্ব, মর্যাদা, সম্ভ্রম সব ধুলিস্যাৎ হয়ে গিয়েছে। এরপর ও ছেলে-মেয়ে-স্ত্রীর সঙ্গে মাথা উঁচু কথা বলবে কী করে? পুলিশ অফিসার ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ না করার বহু উপদেশ দিলেন, ধর্মের কথা বললেন; মহাভারতের উদাহরণ দিলেন। আমি তাঁকে অনেক ধন্যবাদ দিয়ে গাড়ি পর্যন্ত গেলাম। হঠাৎ মনে হল সদর দরজাটা একবার দেখি। পকেট থেকে চাবি বার করে দরজা খোলবার চেষ্টা করলাম। দরজা খুলল না। অফিসার তখনো গাড়িতে ওঠেননি। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে ওঁকে বললাম সদর দরজা খুলতে পারছি না। উনি এগিয়ে এসে খোকনকে বললেন। খোকন সদর দরজার চাবিও পাল্টেছে। আমাকে ঢুকতে না দেওয়ার যত পথ আছে সেগুলো সব বন্ধ করেছে। অফিসার ধমক দিতে ও নতুন চাবিটা আমার হাতে দিল।

    আমি অনুকে নিয়ে লন্ডন ছাড়ার দশ দিন পরে নিজের বাড়িতে ঢুকলাম। এই দশ দিন আমরা গৃহহীন, অন্যের আশ্রয়ে রাত কাটিয়েছি। ভাবলাম এবার বাকি ক’টা দিন শান্তিতে কাটানো যাবে। খোকনের দুর্বুদ্ধির সীমা পরিসীমা নেই। সাতদিন পর কোর্ট থেকে নোটিস পেলাম --- খোকন আমার নামে কেস করেছে। আমি যাতে আমার অংশ বিক্রি না করতে পারি তার জন্য ইঞ্জাংশন (injunction) আবেদন করেছে। আর লিখেছে আমার ওপরের শোবার ঘরটা আমি জবর দখল করে আছি; সেটা ওর দখলে দেওয়ার দাবী জানিয়েছে। আমি আর কিছুতে অবাক হই না। বুঝলাম আমার কপালে শান্তি নেই। আবার অবনীবাবুর শরণাপন্ন হলাম। অবনীবাবু পরামর্শ দিলেন ওঁর জানাশোনা হাইকোর্টের এক নামকরা ব্যারিস্টার আছে যার কাছে অবনীবাবুর নাতনি শিক্ষানবিশ, তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। আমি কেসের কাগজপত্র নিয়ে ব্যারিস্টার সাহেবের উপদেশ নিতে গেলাম। উনি বললেন, এটা ক্রিমিনাল অফেন্স। উনি খোকনের নামে হাইকোর্টে একটা ক্রিমিনাল কেস করতে পারেন। আপনি কেসে জিতলে খোকনকে জেলে যেতে হবে। আমাকে বললেন, “ভেবে দেখুন, আপনি কি চান আপনার ভাই জেলে যাক?”
    আমি একটু ভেবে বললাম, “না, আমি তা চাই না।”

    উনি বললেন তাহলে ওঁর কিছু করার নেই। উনি হাইকোর্টে ক্রিমিনাল ল’ইয়ার।
    এটা বারাসাত কোর্টের সিভিল কেস। অবনীবাবুর আত্মীয় বলে উনি আমার কাছ থেকে কোনো কন্সালটেশন ফি নিলেন না। বারাসাত কোর্টে ওঁর জানাশোনা উকিল আছে, মুকুল মুখার্জী; তার সঙ্গে দেখা করতে বললেন। উনি আমাকে এক টুকরো কাগজে তাঁর নাম ঠিকানা লিখে দিলেন।



    ক্রমশ
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১০ আগস্ট ২০২৫ | ৪২৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • তপতী বিশ্বাস, সিংগাপুর। | 27.125.***.*** | ১০ আগস্ট ২০২৫ ২১:২৫733182
  • ভয়ঙ্কৰ অভিজ্ঞতা !
  • Sanjoy Das | 2409:4060:e85:ac78::8b48:***:*** | ১১ আগস্ট ২০২৫ ১৭:৩০733215
  • The same ishappening in Panskura.
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন