

ছবি: রমিত
নিভিছে দেউটি – বঙ্কিম বাবুর বাকসো
আশার ছলনে ভুলি
রালফ ফোন করেছে, ‘একটা পরামর্শ চাই; হঠাৎ বোধহয় কপালটা খুলে গেছে। আমাকে কেউ অনেক টাকা দিতে ইচ্ছুক। একটা ই মেল পাঠিয়েছি, পড়ে আমাকে মতামত জানিও।’
সুইজারল্যান্ডের লেক তোমা থেকে রটারডামে উত্তর সাগর যাত্রার পথে লোরেলাই পাথরের নিচে যেখানে রাইন তার একমাত্র হেয়ার পিন বাঁকটি নিয়েছে, সেইখানে সাঙ্কট গোয়ারসহাউসেন গ্রামে রালফ লেওনহার্ডের বাস; পুরুষানুক্রমে আঙ্গুর চাষি। ওয়াইন বানিয়ে ও বেচে সংসার প্রতিপালন করে, অবসর সময়ে লোরেলাইয়ের নিচে আমাদের ছোট খেতেরও দেখভাল করে থাকে। এর বাইরের জগতের সঙ্গে তার চেনা শোনা জানা খুবই কম। বার্লিন, মিউনিক দূরের কথা, এমনকি ফ্রাঙ্কফুর্ট তার কাছে ধাঁধা লাগানো মহানগর! তার এই অযাচিত সৌভাগ্যে কিঞ্চিত সন্দিহান হয়ে সে তার লন্ডনের বন্ধুকে স্মরণ করেছে।
রালফকে হতাশ করতে হলো।
ই মেলটি এক নাইজেরিয়ান ওকালতি ফার্মের। তাঁরা জানাচ্ছেন কোন উত্তরাধিকারী খুঁজে পান নি বলে এক ধনী ব্যক্তি তাঁর উইলে সাঙ্কট গোয়ারসহাউসেনের রালফ লেওনহার্ডকে প্রভূত অর্থ দান করতে চান; তাঁরা সে অর্থ রালফের জার্মান ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পাঠাবেন, কিছু ডিটেলস প্রয়োজন। আজ থেকে বিশ বছর আগে এটি ছিল নাইজেরিয়ান বা চিনা প্রতারকদের প্রধান হাতিয়ার। এর পরে শুরু হলো আরেক ছলনা। ভিসা কার্ড অফিসের কমপ্লায়েন্স দফতরের ফোন; তাঁরা লক্ষ করেছেন আমার আকাউন্টে ৮৯৯ পাউন্ড ডেবিট হয়েছে; আমেরিকান ইনল্যানড রেভেনিউ দফতরে ৬৭১ ডলার এক্ষুনি জমা না দিলে গ্রেফতারি পরওয়ানা বেরুবে; অপশন এক টিপে কথা বলুন; এই ভাবে তাঁরা আমার কম্পিউটারে ঢুকে পড়বেন, বাকিটুকু সহজেই অনুমেয়।
খেলা বদলায় – আমি কোন লটারিতে পঞ্চাশ হাজার পাউন্ড জিতেছি, মাত্র দুশ ডলার ফি দিতে হবে, শুধু আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ও তৎসহ ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড (ও টি পি) জেনে নিয়ে তাঁরা আমার অ্যাকাউন্টের অর্থের বোঝা লাঘব করবেন। এই জুয়ো খেলা চলে কোন সবুজ ভেলভেট মোড়া টেবিলের ওপরে ১ থেকে ৩৬ লেখা ডায়ালের কাঁটা ঘুরিয়ে নয়, বেতার তরঙ্গের একদিকে জামতাড়া, কলকাতা সল্টলেক, সেবু সিটি বা অন্য কোন শহর বা গ্রামের কিছু ফেসলেস যুবক যুবতি মোবাইল ফোন এবং সুলভ ওয়াই ফাই দ্বারা অবাধে লুণ্ঠন করে আপনার আমার মতন কিছু অবোধ মানুষকে। এই টেকনোলজি আমাদের উল্লু বানিয়েছে বলে অভিযোগ করি, কখনো বা নিজের মূর্খতা জাহির না করে কিল ও ক্ষতি হজম ও নীরবতা অবলম্বন করি।
১৯২৯ সালের মার্চ মাসে ঝিমিয়ে পড়া ডাউ জোন্স শেয়ার বাজারকে চাঙ্গা করার জন্য নিউ ইয়র্ক সিটি ব্যাঙ্কের সি ই ও চার্লস মিচেল সস্তা সুদে মার্জিন মানি সরবরাহ করেছিলেন; পরে অভিযোগ উঠেছিল অনেক সাধারণ মানুষকে এই মরণের পাশা খেলায় তিনি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। জবাবে মিচেল বলেছিলেন আমি কাউকে জোর করে ফোর্ড মোটর বা রেডিও সিটির শেয়ার কেনাই নি।
স্ক্যাম শব্দের সঙ্গে পরিচিত হলাম। দুরন্ত গতিতে অগ্রসরমান টেক দুনিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে যারা অক্ষম তারাই কি কেবল এই যূপকাষ্ঠের বলি?
একদিন ই মেল পেলাম অ্যাপল থেকে: আমার মেঘের সঞ্চয়ে কমতি পড়েছে, সত্বর সেই মেঘ মালিকায় আরও আবাসের দক্ষিণা দিতে হবে, আই ক্লাউড ভাণ্ডার বাড়ানো প্রয়োজন। নইলে আমার সমস্ত স্তূপীকৃত স্মৃতি ভ্রষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা। সেদিনেই আরেক ই মেল, মহারাজের কর দফতর থেকে; একটা নতুন অ্যাকাউন্টে অবিলম্বে বকেয়া ট্যাক্স জমা করতে হবে। অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে এইরূপ সাঁড়াশি আক্রমণে বিভ্রান্ত হয়ে প্রথমে আমার বহুকালের ট্যাক্স অ্যাকাউন্টেন্ট পল ব্রাউনকে ফোন করলাম। পল বললে, সেকি কথা? এইচ এম আর সি (হিজ ম্যাজেসটিজ রেভেনিউ অ্যান্ড কাস্টমস) তো কখনো ই মেল পাঠায় না! চিঠি লেখে।
ছেলে মেয়েরা আই ক্লাউডের স্থায়ী ভাড়াটে। সেখানকার জমিদারের নতুন দাবির কাহিনি জানাতে তারা হেসে অস্থির, “বাবা, আই ক্লাউড স্টোরেজে কতটা জায়গা আছে সেটা তোমার আই ফোন সেটিংসে দেখে নাও। তারপর মেলটা ঠিক কে পাঠিয়েছে জানবার চেষ্টা করো।
কীভাবে? কেন, সেন্ডার তো অ্যাপল?
শোনো, অ্যাপল কিনা ঠিক জানতে হলে সেন্ডারের নামে ক্লিক করো,দ্যাখো সে মেল কে পাঠিয়েছে। অ্যাপল ডট কম না অন্য কোন উদ্ভট আই ডি? আরেকটা জিনিস মনে রেখো – একটা দুটো অক্ষর এদিক ওদিক করে দিয়ে আসল নকল মিশিয়ে দেওয়া যায় যেমন হয়তো সেন্ডার Amajon কিন্তু তুমি পড়ছ Amazon! Aircel কে পড়ছ Airtel
পাঁচ মিনিট বাদে তাদের ফোন করে ধন্যবাদ দিলাম - অ্যাপল নয় একটা বিদঘুটে ঠিকানা থেকে অতিরিক্ত মেঘাশ্রয়ের দাবি এসেছে! কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের কর বিভাগের ইমেলটি অবশ্য এক অসাধারণ কীর্তি – দেখে বোঝার উপায় নেই এটি নকল ইমারত। প্রথমে ভেবেছিলাম সে সব আগ মার্কা জেনুইন মেল!
এই কৃত্রিম মেধার প্রতি চাহিয়া আমার অকৃত্রিম বিস্ময়ের সীমা নাই!
বঙ্কিম বাবুর বাকসো

বঙ্কিম ব্রহ্ম ভট্ট
গুজরাতের গান্ধীনগর সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুল এবং গুজরাত টেকনিকাল এডুকেশন বোর্ড থেকে পাস করে ১৯৮৯ সালে বঙ্কিম ব্রহ্মভট্ট নামক এক যুবক সে আমলের প্রাচীন বোতাম টেপা ফোন বানানো শুরু করেন আমেদাবাদে। ক্রমশ তিনি দূরভাষ যন্ত্রের আধুনিকতম কলা কৌশল আয়ত্ত করলেন, গেলেন নিউ ইয়র্ক। নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টের উত্তর পূর্বে গার্ডেন সিটিতে স্থাপিত হল ব্যাঙ্কআই গ্রুপ, তার একধাপ নিচে একটি টেলিকম ও ফিনটেক সলিউশন কোম্পানি, যার নাম ক্যারিওক্স ক্যাপিটাল। বঙ্কিমের সরকারি টাইটেল সি ই ও - বি বি গ্রুপ। সময়ের থেকে অনেকটা এগিয়ে ক্যারিওক্স একেবারে স্টেট অফ দি আর্ট সলিউশন সরবরাহ শুরু করে টেলিকম এবং ফাইনান্সিয়াল প্রোডাক্ট কোম্পানিকে, সে টেলিফোন লাইনের ব্যবহার হোক আর ক্ষণিকের মধ্যে যোজন মাইল দূরে টাকার আদান প্রদান হোক; হার্ডওয়ার নয় সবই রিমোট টেকনিকাল সমাধান। ইন্ডাস্ট্রি ক্রনিকল পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে বঙ্কিম বললেন, “ব্যাঙ্কআই এর টেলিকম ও ডিজিটাল অভিজ্ঞতা তিরিশ বছরের। আমরা যে কোন টেকনিকাল সমস্যা সমাধানের শক্তিকে এমন এক ফিউচারিসটিক জায়গায় নিয়ে এসেছি যেখানে কোন মানুষের হাত বা আঙ্গুল ব্যবহারের প্রয়োজন প্রায় শূন্য, অটোমেটেড, সম্পূর্ণ ভ্রমহীন এক পদ্ধতি। আমরা কেবলমাত্র প্রোগ্রাম প্যাকেজ বা হার্ডওয়ার বেচি না, রিমোট সলিউশন বেচা আমাদের কাজ। টেলিফোন বা ফিনটেক কোম্পানির সঙ্গে দৈনিক আলোচনা আমাদের রিসার্চ বিভাগকে বুঝতে সাহায্য করে কি তাঁদের প্রয়োজন। সেইমত আমাদের প্রোডাক্টকে নিরন্তর উন্নত স্তরে নিয়ে যাই। আরেকটা কথা, আমরা কোন ভৌগোলিক সীমানায় আবদ্ধ নই“। উদাহরণ দিলেন –তাঁর আরেক কোম্পানি মোবিফিন, এই পি টু পি (পারসন টু পারসন, গুগল পে ভাবুন) বা টেলিফোনি মারফত টাকা পাঠানোর ব্যাপারে নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে; টাকার প্রেরক, প্রাপক, এজেন্ট, ব্যবসাদার, দোকানি ব্যাঙ্কে না গিয়েই ওয়ালেট বা অ্যাকাউন্টের অধিকারী হয়েছে একাধিক পশ্চিম আফ্রিকান টেলিকম কোম্পানিতে। তাঁদের আস্তিনে আরও অনেক চমকপ্রদ আবিষ্কার লুকিয়ে আছে। ক্রমশ প্রকাশ্য!
ক্যারিওক্সের ছত্র ছায়ায় আরও দুটি ব্যবসা - ব্রডব্যান্ড টেলিকম, ব্রিজভয়েস। কর্মী সংখ্যা দুশোর কম, কাস্টমার কয়েক হাজার। ব্যবসা জগত জোড়া।
২০২৩ সালে ইন্ডাস্ট্রি ক্রনিকলের তালিকায় টেলিকম টেকনোলজির চিন্তাবীরদের টপ টেনের একজন বঙ্কিম ব্রহ্মভট্ট। সেই বছরেই ক্যাপাসিটি ম্যাগাজিনের টপ একশোর মধ্যে গুজরাতের বঙ্কিম ব্রহ্মভট্ট।

ক্যাপাসিটি টিভির টপ ম্যান
লাগে টাকা
ডজন দুয়েক দেশে হাজার কয়েক কাস্টমার – এই ব্যবসায় আজ নগদ কল উধার নয়, আজ উধার ছ মাস বাদে নগদ। তাহলে দিনের খরচা পাতি চলে কেমনে? বঙ্কিম ব্রহ্মভট্টের তিরিশ বছরের টেলিকম বিজনেসে খ্যাতি এবং তাঁর প্রবলেম সলভিং ডিজিটাল সলিউশনে ব্রডব্যান্ড এবং ভয়েসব্রিজের বাজার দেখে এগিয়ে এল ইউনিয়ন ব্যাঙ্ক অফ সুইজারল্যান্ড (ইউ বি এস), ফ্রান্সের বি এন পি পারিবা এবং দুনিয়ার বৃহত্তম অ্যাসেট ম্যানেজার কালো পাথর, ব্ল্যাকরক।
এঁরা কেউ সরাসরি ঋণ গ্রহীতার ঝুঁকি নিতে চান না; অর্থাৎ ব্যাঙ্ক আজ আমায় ধার দিল, সেই টাকা দিয়ে মাল মশলা কিনে বানানো হল কোন দ্রব্য সামগ্রী, সেটা বিক্রি হলে পাবো টাকা, সেই টাকা দিয়ে হবে আমার ধার শোধ। সেটায় সময় লাগে, তার মধ্যে অনেক কিছু বদলে যেতে পারে - যেমন আমার প্রোডাক্টের চাহিদা, বিক্রির পরিমাণ, কাঁচা মালের জোগান। তার সঙ্গে যোগ হতে পারে কারখানায় ধর্মঘট, আমার স্বাস্থ্যহানি। এ বড়ো ঝুঁকির ব্যাপার! তাই ইউ বি এস, ব্ল্যাকরক খোঁজেন অ্যাসেট ব্যাকড লোন- জিনিস বা পরিষেবা প্রস্তুত করার বালাই নেই, বিক্রি বাটা হয়ে গেছে এখন শুধু তার মূল্যটি জমা হবার অপেক্ষা। মাল কবে তৈরি হবে, বিক্রি হবে কি হবে না তার ভাবনা নেই; এর নাম অ্যাসেট ব্যাকড বা রিসিভেবল ফাইনাইন্সিং - ব্ল্যাকরক ধার দেবেন বিক্রির ইনভয়েস দেখে। ওমর খৈয়াম বলেছেন (কান্তি ঘোষের অনুবাদ) *
নগদ যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতায় শূন্য থাক
দূরের বাদ্যি লাভ কি শুনে? মধ্যিখানে বেজায় ফাঁক!
অ্যাসেট ব্যাকড ফাইনান্সিংএ দুটো সমস্যা: ব্ল্যাকরক হেন অ্যাসেট ম্যানেজার ছ মাস, ন মাসের জন্য দু, দশ হাজার ডলার ধার দিয়ে ছুঁচো মারেন না, তাঁরা খোঁজেন গণ্ডার, যার ওজন অন্তত একশ মিলিয়ন এবং আয়ু পাঁচ বছরের। এই সমস্যাটির সমাধান- সহস্রটি ইনভয়েস জুড়ে আঁটা দিয়ে সেঁটে এক ভারি ওজনের কাগুজি গণ্ডার বানানো। কিন্তু তার পরেও আরেক সমস্যা থেকে যায় – যেমন যেমন একটা ইনভয়েসের দাম চুকিয়ে দেওয়া হবে তেমনই আরও নতুন ইনভয়েস জুড়ে গণ্ডারের ওজনের ভার সাম্য বজায় রাখতে হবে। আগে আমার হামবুর্গ সেমিনারের অভিজ্ঞতার গল্প লিখেছি - ক্রেদি সুইসের বন্ডগুরু বলেছিলেন আমরা পাঁচ বছরের জন্য একশো মিলিয়ন ডলারের বন্ড বানাতে রাজি, তার জন্য আমাদের চাই হাজার ইনভয়েসে ভরা এমন একটা বাকসো যার মোট মূল্য আজ একশো মিলিয়ন ডলার, কালও একশো মিলিয়ন। যোগ বিয়োগ লেগেই থাকবে, কিছুর পেমেন্ট হবে তার জায়গা নেবে আরও কিছু, কিন্তু যে কোন সময়ে বাকসোর মূল্য হতে হবে সেই একশো মিলিয়ন ডলার।
আমাদের মতন প্রাচীন ব্যাঙ্কাররা পাঠশালায় সাবধানবাণী শুনেছি; যে কোন ইনভয়েস মানেই একটি অ্যাসেট, সুরক্ষা কবচ; সেটি হতেই উদ্ধার হবে দেনা অতএব তার অস্তিত্ব নির্ধারণ করা এবং গুণবত্তা বিবেচনা করাটাই আমাদের প্রাথমিক কর্তব্য। বাড়ি কেনার সময়ে দলিলটি দেখে নেওয়ার মতন। এক্ষেত্রে এই সিকিউরিটি বা সেলস ইনভয়েস নিত্যি বদলাতে থাকে তাই কোন অ্যাসেট কেনা হচ্ছে সেটি দেখে নেওয়া জরুরি – কোথাও না কোথাও ঠকেই হয়তো বিজ্ঞ রোমান ব্যক্তি বলেছিলেন, ক্রেতা সাবধান (কাভেয়াত এমতর, caveat emptor)।
বঙ্কিম বাবু প্রথম দিনে (সেপ্টেম্বর ২০২০) যে বাকসোটি বাজারে দেখালেন তার দাম পাঁচশ মিলিয়ন ডলার। তিনি দায়িত্ব নিলেন সে বাকসোর ওজন কখনো হালকা হবে না। তাঁর ব্যবসায় রমরমা, খদ্দেরের তালিকায় চোখে পড়ার মত নাম- টেলিকম ইতালিয়া, বেলজিয়ামের বি আই সি এস, পশ্চিম আফ্রিকায় সেনেগালের সোনাটেল, নাইজেরিয়ান গ্লোবাকম, তাক লাগানো ডিজিটাল সলিউশনের ক্রেতা হাজার, দেনেওয়ালা এক বঙ্কিম। তাই নতুন বিক্রির রসিদ, ইনভয়েসের কমতি হবে না। সলিড অ্যাসেট।
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগে ব্যাঙ্কিং ব্যবসায়ে যখন এসেছিলাম, ইনভয়েস বা চালান শক্ত কাগজে লেখা হতো, তলায় বিক্রেতার দিন তারিখ সমেত সই এবং স্ট্যাম্প। জার্মান ইনভয়েসে আবার বিক্রেতার ব্যাঙ্ক ডিটেলস দেওয়া আবশ্যিক, যাতে ক্রেতা জানে কোন ব্যাঙ্কে টাকা জমা দিতে হবে। ব্রিটিশ ইনভয়েসে সেটা থাকতে পারে নাও পারে।
টিম বার্নার্স-লির আশ্চর্য ইন্টারনেট আবিষ্কারের ফলে সেই কাগজি কারবাই সমাপ্ত হলো, ইয়ে ডিজিটাল কা ইয়ুগ হ্যায় জনাব! ই মেলই যথেষ্ট, ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় লেখা -কি বস্তু বা সেবা, কতো দাম, কবে দেয়, কে দেবে। সার্ভিস ভাউচার অনেক দূরের কথা, আজকাল বাড়ি অবধি কেনা বেচা হচ্ছে, ভাড়াটের সঙ্গে চুক্তিপত্র সই করছি ডকু সাইন নামক এক পদ্ধতিতে, যেখানে একটা ফাঁকা চৌখুপিতে আঙ্গুলটা বুলিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট। সে সই কোনদিন কিছুরই সঙ্গে মিলবে না। সই বা স্ট্যাম্প তো সেই নাইনটিন অস্টিনের গুল্প।
বঙ্কিম বাবুর কাজ বাকসোটির সম্যক রক্ষনাবেক্ষন করা, এটি যেন দ্রৌপদীর হেঁসেল বা পি সি সরকারের ওয়াটার অফ ইন্ডিয়া- সর্বদা থাকে পূর্ণ, সদা বাহার।
একটা বাকসো কিনলেন এইচ পি এস নামক এক প্রাইভেট ক্রেডিট ফান্ড এঁরা সরাসরি ঋণ দিতে পারেন; ২০০৭/৮ সালের সাব প্রাইম ক্রাইসিসের পরে যে লোন মেলায় ব্যাঙ্কেরা নামতে কুণ্ঠিত, সেখানে এঁরা স্টল খোলেন ঘটা করে। কোন কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের বা সরকারের গাইড লাইন, নিয়ন্ত্রণ তাঁদের ওপরে প্রযোজ্য নয়। সাব প্রাইমের ঝটকার পরে ঋণদানে ব্যাঙ্কগুলির দ্বিধার পূর্ণ সুযোগ নিয়ে ১৯০ বিলিয়ন ডলারের এক বিশাল ক্রেডিট ফান্ড গড়ে তুলেছেন গোল্ডম্যান জাকসের তিন প্রাক্তন মহারথী স্কট কাপনিক, মাইকেল প্যাটারসন এবং স্কট ফ্রেঞ্চ, যাদের পেডিগ্রি কোন আলোচনার ঊর্ধ্বে। প্রাইভেট ক্রেডিটের দুর্বার গতি এবং লাভের হার দেখে ব্ল্যাকরক এইচ পি এসের অধিগ্রহণ করেছেন এ বছরের জুলাই মাসে। কাপনিক, প্যাটারসন, ফ্রেঞ্চ যে পোর্টফোলিও নিয়ে ব্ল্যাকরকে যোগ দিলেন তার এক উজ্জ্বল রত্ন বঙ্কিম বাবুর বাকসো।
আরেক বাকসো কিনলেন বৃহত্তম সুইস ব্যাঙ্ক ইউ বি এস। এঁরা হঠাৎ কেন একটি অচেনা অজানা টেকনোলজি কোম্পানির ইনভয়েস কেনায় টাকা লাগাচ্ছেন সে প্রশ্নের উত্তরে সি ই ও সারজিও এমোতি জানালেন – ইউ বি এস তাদের নিবেশকদের জন্য উঁচু সুদের (কেতাবি নাম হাই ইলড) ঋণপত্র খুঁজছে, এর অন্য নাম ডাইভারসিকেশন। ক্যারিওক্স এই পোর্টফলিওর নির্বাচিত প্যাকেজ।
বাকসো কিনলেন বৃহত্তম ফরাসি ব্যাঙ্ক বঁ নাসিওনাল দু পারি- পারিবা (Banque National du Paris – Paribas -Banque de Paris et des Pays-Bas) তাঁরা টেকনোলজি স্টক না কিনে এই বাণিজ্যে সরাসরি টাকা লাগাতে চান -তার টার্নওভার বিপুল এবং অ্যাসেট ব্যাকড ফাইনান্সিং একটি সুরক্ষিত নিবেশ।
বাকসো খোলার দিন/বঙ্কিমের অন্তর্ধান
জুলাই ২০২৫ – ব্ল্যাকরক সবে কিনেছে প্রাইভেট ক্রেডিট ফান্ড এইচ পি এস, তাদের পোর্টফোলিওর আকার বিশাল, আগের দিনের সঙ্গে তুলনা করলে সে লেজারের সাইজ দশটা এন্সাইক্লোপিডিয়ার চেয়েও বেশি বড়ো। নতুন মালিকরা হয়তো একটু কৌতূহলী হলেন- ঠিক কোনো অডিট বা ইন্সপেকশন নয়, একজনকে নিযুক্ত করলেন এইচ পি এসের অ্যাসেটগুলির তত্ত্ব তাবাশ করার জন্য।
সমস্ত ইনভয়েস এসেছে ই মেল মারফত। কি বিক্রি হয়েছে কতো ডলার/ইউরো প্রাপ্য সে সব ঠিকঠাক লেখা, ক্রস চেক করার প্রশ্ন নেই কিন্তু একটা জায়গায় সেই পরীক্ষকের চোখটা আটকে গেল- চতুর্থ বৃহৎ বেলজিয়ান টেলিকম সংস্থার নাম BICS; তাদের সব দফতরের আইডিতে সেটি দেখা যায় যেমন sales@bics.com কিন্তু এই ইমেল বান্ডিলে যে বেলজিয়ান কোম্পানি ইনভয়েস ইসু করেছেন তাঁর ইমেল আই ডি bicss.com - কৌতূহলী হয়ে তিনি বি আই সি এসের (Belgacom International Carrier Services SA/NV) সঙ্গে যোগাযোগ করলেন তাদের অফিশিয়াল আই ডি তে – purchases@bics.com
জবাব এলো তৎক্ষণাৎ - কোন কিছু কেনা দূরের কথা, তাঁরা কখনো ক্যারিওক্স বা ব্রিজভয়েসের নাম শোনেননি। টেলিকম ইতালিয়া সহ আরও অনেক ‘কাস্টমারের’ উত্তর তথৈবচ। পাগলা ঘণ্টি বেজে উঠলো। প্রথমে ব্ল্যাকরক অধিকৃত নতুন প্রাইভেট ক্রেডিট সংস্থায়, কিন্তু তার আওয়াজ গিয়ে পৌঁছুল বি এন পি পারিবায়, ইউ বি এসের জুরিখের সদর দফতরে। প্রথম দর্শনে অন্তত ১৫টি বড়ো ক্রেতা ও বিপুল সংখ্যক বিক্রির ফিরিস্তি সম্পূর্ণ ভুয়ো। ফেক ডোমেন থেকে, ইনভয়েস দেখিয়ে শ্রী বঙ্কিম ব্রহ্মভট্ট প্রায় এক বিলিয়ন ডলার উধার নিয়েছেন।
উদ্বিগ্ন পরীক্ষক ক্যারিওক্সের অফিসে ফোন করলে বঙ্কিম বাবু নিজেই ধরলেন, বললেন ওটা কোন চিন্তার বিষয় নয়। ডাটা প্রোটেকশনের কারণে অনেক টেলিকম কোম্পানি একাধিক ইমেল আই ডি ব্যবহার করে থাকেন; ক্যারিওক্সের পাঠানো সকল ইনভয়েস এবং অ্যাসেট একেবারে খাঁটি।
ততক্ষণে এই পরীক্ষক তাঁর বসের দফতরে হাজির হয়েছেন। এবার হাল ধরলেন মাস্টার অফ ইউনিভার্স, গোল্ডম্যান জাখস, জে পি মরগানে ট্রেইনড স্বয়ং স্কট ফ্রেঞ্চ। ফোন করলেন বঙ্কিম ব্রহ্মভট্টের পারসোনাল মোবাইলে। সে ফোন বঙ্কিম ধরেন না; স্কট লোক পাঠালেন ক্যারিওক্সের গার্ডেন সিটি নিউ ইয়র্ক অফিসে সেখানেও কেউ নেই, বঙ্কিম বাবুর তিনটি গাড়ি পার্ক করা আছে বাড়ির ড্রাইভে।

বঙ্কিম বাবুর তালাবন্ধ বাড়ি , সামনে তিনটে গাড়ি। বাবু বাড়ি নেই।
অভিযোগের ফিরিস্তি
• এইচ পি এসের সঙ্গে অ্যাসেট ব্যাকড ফাইনান্সিঙ্গের শুরু থেকে (২০২০) যেসব ইনভয়েসে দেখিয়ে ক্যারিওক্স সাড়ে চারশো মিলিয়ন ডলার ধার করেছে তার সত্তর শতাংশ জালি।
• একই ইনভয়েস তিন চার বার দেখিয়ে ঋণ নেওয়া হয়েছে যাকে আমরা বলি ডাবল ট্রিপল ফাইনান্সিং -কুমিরছানা দেখানোর খেলা
• ইউ বি এস বা বি এন পি পারিবাতে ক্যারিওক্সের কোন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ছিল না -তাঁরা বোরিং ট্রান্সাকশনাল ব্যাঙ্কিং করেন না, করলে জানতেন কোথাকার জল কোথায় গড়াচ্ছে। সব টাকার লেনদেন হয়েছে স্থানীয় আমেরিকান ব্যাঙ্কে, সেখানে কোন টাকা নেই, সব টাকা উড়ে গেছে মরিশাস এবং ভারতের বিভিন্ন ঠিকানায়।
• আগস্ট মাসের ১২ তারিখে আমেরিকান ব্যাঙ্করাপটসি আদালতে চ্যাপ্টার ইলেভেনের শর্ত মাফিক (পাওনাদারদের নিরন্তর হয়রানি থেকে সাময়িক অব্যাহতি, কোম্পানি পুনর্গঠন করে ঋণ উদ্ধারের সুযোগ) ক্যারিওক্স দেউলে ঘোষিত হলো। বঙ্কিম ব্রহ্মভট্টের উকিল সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
পুনশ্চ:
দোষ কারো নয় গো মা!
পাঠক
আগের পর্বগুলিতে ফার্স্ট ব্র্যান্ডস, ট্রিকলর, গ্রিনসিল কিসসা পড়েছেন হয়তো ধৈর্য সহকারে; আপনাদের কাছে বঙ্কিম বাবুর বাকসো এক ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তি মাত্র।
বছর বিশেক আগে ঋণের মহাজন ছিল ব্যাঙ্ক, প্রাইভেট ক্রেডিট প্রায় অজানা। পাঁচ বছর আগেও প্রাইভেট ক্রেডিটের ফান্ড অর্ধেক বিলিয়নের সীমানায় পৌঁছয়নি; আজ সেটি তিন ট্রিলিয়ন ডলার (হল্যান্ড, পোল্যান্ড, বেলজিয়াম, সুইজারল্যান্ডের মোট জি ডি পির বেশি অথবা ফ্রান্স এবং স্পেনের সমান); আগামী পাঁচ বছরে সেটি পাঁচ ট্রিলিয়নে পৌঁছুবে বলে অনুমান করা হচ্ছে।
আজ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের ২৭টি প্লাস নরওয়ে সুইজারল্যান্ড আইসল্যান্ড জুড়লে মোট ব্যাঙ্ক ঋণের পরিমাণ পনেরো ট্রিলিয়ন ডলার।
ব্যাঙ্কিং সিস্টেমের বাইরে অর্থের এক বিশাল ভাঁড়ার খুঁজছে টাকা লাগানোর ঠিকানা, ব্যাঙ্কের মতো সার্বিক ব্যাঙ্কার -কাস্টমার রিলেশনশিপের ঝক্কি নেই। তাদের হাত পা বেঁধে রাখেনি কোন নিয়ন্ত্রক; তাদের আভ্যন্তরীণ আইন কানুন আলাদা এবং তারা খোঁজে বেশি সুদ, হাই রিটার্ন। তাই কি চলতি হাওয়ার পন্থী প্রাইভেট ক্রেডিট হামলে পড়েছে অ্যাসেট ব্যাকড সিকিউরিটির পিছনে? ব্যবসায় লাভ ক্ষতি আছেই, আজ ট্রিকলর কাল ফার্স্ট ব্র্যান্ডস ক্যারিওক্স। বঙ্কিম বাবুর আত্মগোপনের পরে ইউ বি এসের চেয়ারম্যান এমোতি বললেন অকুপেশনাল হ্যাজার্ড, জেমি ডাইমন বললেন, আরেকটা আরশোলা।
শেষ কথা?
কাভিয়াত এমতর।
সাধু সাবধান
* Some for the glories of this world, and some
Sigh for the Prophet’s Paradise to come;
Ah, take the cash and let the credit go.
Nor heed the rumble of a distant drum
Edward FitzGerald
The Rubaiyat of Omar Khayyam
দেবাঞ্জন | 2409:4060:ebf:31b2:53ee:c50b:1e12:***:*** | ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৬:১৫737279
হীরেন সিংহরায় | ২৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ২৩:৪৩737353