

ছবি: রমিত
নরমানডির তটে - পর্ব তিন
শ্মশানের শান্তি
গত দু হাজার বছরে ছোট বড়ো, আঞ্চলিক আন্তর্জাতিক যুদ্ধ ও ধ্বংসের অজস্র তাণ্ডবলীলা দেখেছে ইউরোপ। ষোলশো এবং সতেরশো শতাব্দীতে একই প্রভুর নামে ভিন্ন অর্চনা পদ্ধতির বিবাদে ও ধর্মযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন এক কোটি মানুষ, গোটা মহাদেশের এক দশমাংশ। আঠাশে জুলাই, ১৯১৪ সালে সারায়েভোর ল্যাটিন ব্রিজে গাভ্রিলো প্রিঞ্চিপ নামের সতেরো বছরের এক সার্ব তরুণের নির্ভুল নিশানায় দুটি গুলিতে অস্ট্রিয়ান রাজকুমার ও তাঁর পত্নী প্রাণ দিলেন আর সেই মৃত্যুর কারণে খুন কা বদলা খুনের যে সিরিয়াল শুরু হলো সেটি চলবে ১৯৪৫ সাল অবধি, নিহত হবেন অন্তত আট কোটি সামরিক, বেসামরিক মানুষ। আহতের সংখ্যা অগুনতি, সামগ্রিক জন জীবনে ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ হিসেবের বাইরে।
সেই দক্ষযজ্ঞ, গৃহদাহের ছবি দেখেছি বইয়ে; লংগেস্ট ডে, প্যাটন, ফন রায়ান’স এক্সপ্রেস, এ ব্রিজ টু ফারের মতন সিনেমায়। যুদ্ধ শেষের মাত্র বত্রিশ বছর বাদে যে ইউরোপে এসে হাজির হলাম সেখানে পৃথিবীর সেই ভয়াবহ রণরঙ্গের কোন আপাত চিহ্ন আমার চোখে পড়েনি। ১৯৭৮ সালে ঝকঝকে পশ্চিম বার্লিনের কু ডামে বোমার আঘাতে অর্ধেক বিধ্বস্ত কাইজার ভিলহেলম গেদেখতনিস কিরখে দেখে জানতে চেয়েছিলাম এটির সংস্কার কি সম্ভব হয়নি? উত্তরে জানলাম, না, সেটা ইচ্ছাকৃত। মাত্র তিন দশক আগে এ দেশে ও ইউরোপে যে যুদ্ধ হয়ে গেছে তার বাস্তবতাটুকু মানুষকে মনে করিয়ে দেবার জন্যে এই দৃষ্টিকটু খণ্ডহরটি অবিকৃত অবস্থায় সংরক্ষিত হয়েছে।
ক্রমশ সারা ইউরোপ ঘুরে যুদ্ধের স্মৃতি অক্ষুণ্ণ রাখার জার্মান প্রয়াসের অর্থ হয়তো বুঝেছি; প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির অভ্যন্তরে ক্ষতি সামান্য, বেশির ভাগ দেখা গেছে ফ্রান্সে। প্রায় ছ বছর ব্যাপী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে ডাবলিন লিসবন মাদ্রিদ জুরিখ স্টকহলমে বোমা পড়েনি কারণ আয়ারল্যান্ড পর্তুগাল স্পেন সুইজারল্যান্ড সুইডেন ছিল নিরপেক্ষ; হিটলার চেম্বারলেনের চুক্তির করুণায় প্রাগ থেকেছে অক্ষত, ফন কোলদিতস নামের এক মহানুভব জার্মান সেনাপতির করুণায় প্যারিসে কোন অগ্নিকাণ্ড ঘটেনি। কিন্তু আজকের প্রজন্ম যখন ম্যাপ হাতে বা গুগল স্ক্রোল করে ইউরোপ ঘোরে, তাদের বোঝানো অসম্ভব যে মিউনিকের কার্লস প্লাতস, ওয়ারশ’র স্তারে মিয়াসতো, ড্রেসডেনের লিবফ্রাউয়েন, কলোনের জোড়া গিরজে, পুরো রটারডাম, ফ্রাঙ্কফুর্ট, ওয়েসেল এবং আরও অনেক শহর, প্রাসাদ, দুর্গ, ভজনা মন্দির মাটিতে মিশে গিয়েছিল। ১৯৪৫ সালের মে মাসে বার্লিনে কোন দেওয়াল খাড়া ছিল না; সে বছরের জুলাইতে তোলা একটি আমেরিকান ডকুমেনটারি ফিল্মে রিপোর্টারের অফ ভয়েসে (ইউ টিউবে লভ্য) শোনা যায়, ‘বার্লিন এক মহা শ্মশান; একটি ইটও দাঁড়িয়ে নেই। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর পরেও এখানে বাস করবে না কোন মানুষ। নিজের ইতিহাসের সঙ্গে সঙ্গে গোটা বার্লিন শহর ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হল চিরতরে। ‘সেই বার্লিন আজ উচ্চকিত, যেমনটি ছিল তিরিশের দশকে। অনেক পরে দেখেছি ইংল্যান্ডের অর্ধভগ্ন কভেন্ট্রি ক্যাথেড্রাল, এটিকেও সারানো হয়নি ঐ একই কারণে – রেখে দেওয়া হয়েছে জার্মান বম্বিং তথা যুদ্ধের স্মারক রূপে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করতে হয় ইউরোপ ঘুরলে দুশো বছর আগে নেপোলিয়নের বিজয়ী বাহিনীর অস্ত্রাঘাতের কিছু নমুনা এখনো দেখতে পাবেন - যেমন হাইডেলবের্গ দুর্গ অথবা হামেলিন (সেই হামলিনের বাঁশিওলা!) শহরের প্রাচীর; সেটি কি নেপোলিয়নের স্মৃতিরক্ষার্থে না অর্থাভাবে কিংবা পৌরপিতাদের আলস্যের কারণে তা অবশ্য সঠিক জানা যায় না।
তাহলে যুদ্ধের কথা কে মনে রাখে? কীভাবে? বছরে একবার ডি ডে সেলিব্রেশান, ‘আর যুদ্ধ নয়’ ব্যানার তুলে, প্রথম যুদ্ধ শেষের স্মৃতিতে নভেম্বর মাসে পপি ডে, স্কুলের ছেলে মেয়েদের ফ্ল্যানডারসের ভ্রমণ করানো, বেলজিয়ামের ইপ্র শহরের মেনিন গেটে প্রতিদিন সন্ধ্যেয় লাস্ট পোস্ট বাজিয়ে? ২০১৮, প্রথম যুদ্ধ অবসানের শতবর্ষে অন্তত ব্রিটেনের পথে ঘাটে দেখা গেলো এক বন্দুকধারী সৈনিকের কাট আউট তলায় লেখা ‘যেন ভুলে না যাই’। এইভাবেই কি পরবর্তী জেনারেশনকে সচেতন করা হবে?


আমি দূর দেশের এক কৌতূহলী বিদেশি - লক্ষ করেছি ব্রিটেন বা ফ্রান্সের এমন কোন গ্রাম শহর নেই যেখানে ছোট বড়ো মাঝারি অন্তত একটি স্মারক দেখা যাবে না যাতে দুটি যুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন এমন বরেণ্য সন্তানদের নাম লেখা নেই। লন্ডন ওয়াটারলু স্টেশন থেকে গিলড হল, ফ্রান্স বেলজিয়াম ইংল্যান্ড স্কটল্যান্ডের প্রত্যন্ত গ্রাম, নরওয়ে, কেমব্রিজ অক্সফোর্ডের কলেজ (বিশেষ করে লক্ষণীয় নিউ কলেজের চ্যাপেল) সর্বত্র। ফ্রান্সে আমাদের ছোট্ট গ্রাম উবি সাঁ লো ঢুকতেই চোখে পড়ে প্রথম যুদ্ধের ব্রিটিশ সৈন্য সমাধি। ১৯১৮ সালে ইউরোপ জানত না এই মহামারি আবার ঘটবে তাই ভার্সাই শান্তির পরে একে বলা হয়েছিল ‘দি গ্রেট ওয়ার’। এর চেয়েও গ্রেটার ওয়ার যখন এলো, ১৯৪৫ সালের পরে সেই সব মনুমেন্টে যোগ হলো তাঁদের নাম যারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে প্রাণ দিলেন। কোন কোন দেশে নাৎসি শাসন মোচনের জন্য অন্য বিদেশি সৈন্যদের সম্মান জানাতে দেখেছি - যেমন নরওয়ের কিরকেনেসে সোভিয়েত মুক্তিদাতা স্মারক। পূর্ব ইউরোপে এহেন উদ্যোগ চোখে পড়ে কম। সেন্ট পিটারসবুর্গের নেভস্কি প্রসপেক্টে হিরো সিটির ফলক দেখে মায়া প্রশ্ন করেছিল, ‘এখানে লেখা রয়েছে ২১ জুন ১৯৪১- ৮ মে ১৯৪৫। কিন্তু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তো শুরু হয়েছিল ১ সেপ্টেম্বর?’ তাকে বোঝাতে হলো পয়লা সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ থেকে একুশে জুন ১৯৪১ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মানি কাঁধে কাঁধ দিয়ে ইউরোপ দখলের লড়াই চালিয়েছে। জার্মান বন্দুকের নল পুব দিকে ঘুরে গেলে তবেই না সোভিয়েত ইউনিয়নের জনযুদ্ধ শুরু হয়।
পোল্যান্ডে আছে ওয়ারশ ঘেটো, প্রাগের কাছে লিডিতসে গ্রামে নাৎসি হত্যাকাণ্ডের স্মারক, বিভিন্ন দেশে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের মেমোরিয়াল – মাউটহাউসেন (অস্ট্রিয়া) আউশউইতস (পোল্যান্ড), বেরগেন -বেলসেন (লোয়ার সাক্সনি) থেরেসিয়েনস্টাড(চেক রিপাবলিক) দাখাউ (ব্যাভেরিয়া) – তাদের থিম শুধু যুদ্ধ বিরোধী নয়, মানবিক অধিকার অপহরণের বিরুদ্ধেও; এমন যেন আর না ঘটে, নি উইডার, নেভার এগেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পোলিশ এয়ারফোর্স এবং স্থল সৈন্য লড়েছেন সম্মানের সঙ্গে কিন্তু ইংল্যান্ডের তুলনায় পোল্যান্ডের হাটে বাজারে তাঁদের নাম লেখা হয়েছে সামান্য। অন্যদিকে স্তালিনগ্রাদে জার্মান বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামের পর ঘরে ফেরেননি দু লক্ষ রোমানিয়ান সৈন্য, তাঁদের কথা রোমানিয়াতে কেউ মনে রাখেন না। বরং জার্মানির সঙ্গে সহযোগিতার পর্বটি তাঁরা ভুলে যেতে চান। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলিতে ব্যাপকভাবে আমাদের ময়দানের মতন গ্লোরিয়াস ডেড মেমোরিয়াল দেখা যায় না। জার্মানির প্রায় সকল গ্রাম শহরে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মৃত সৈনিকদের সাম্মানিক স্তম্ভ চোখে পড়ে, কিন্তু সামগ্রিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শহীদ স্মৃতি রক্ষার প্রচেষ্টা খানিকটা নিচু সুরে, লো কী; কারণটি সহজেই অনুমেয়।
উটা, ওমাহা, গোল্ড, সোরড, জুনো এই পাঁচটি বিচ কেবল সাম্প্রতিক ইতিহাসের, যুদ্ধ বিবরণীর পাতায়, সিনেমায় থেকে গেছে, থেকে যাবে। সাঁ মের ইগলিস, সাঁলরাঁ -সুর-মের, কোলভিল-সুর-মের, সাঁওবাঁ -সুর -মের, লুক-সুর-মের নামের সমুদ্র তীরবর্তী ছোট ছোট গ্রামের দিন কাটে একই ভাবে। কেবল শনি রবিবার, ছুটির দিনে, গ্রীষ্মকালে হাজির হন নানা দেশের মানুষ, কোথাও কোন সমাধির ওপরে, কোন ফলকে খোঁজেন প্রিয়জনের নাম।
আমাদের উওকিং, ফ্রান্সের উবি সাঁ লো বা জার্মানির কাউবের গ্রামের মতন ইউরোপের অগুনতি সমাধিক্ষেত্রে শায়িত আছেন লক্ষ কোটি সাধারণ মানুষ। তাঁরা চলে গেছেন বিভিন্ন দিনে, বিভিন্ন শতাব্দীতে, দরিদ্র মানুষের কবরে একটি পাথরের ফলক, কোথাও পারিবারিক মসোলিউম, কোনোটি একক, কোথাও মৃতের স্মৃতিতে লেখা কয়েকটি ছত্র, কোথাও বা একটিমাত্র লাইন – তুমি আমাদের প্রিয় ছিলে। বাদ হোমবুর্গে আমার বন্ধু অরটউইনের পরিবারের সমাধি ভল্টটি দেখা শোনা করে থাকি, দশ বছরের কড়ারে সেটি বজায় রাখা হয়। সময়মত অর্থ না দিলে সেটি বাজেয়াপ্ত হবে, সেখানে সমাহিত হবেন অন্য কেউ।
প্রায় পাঁচ দশক আগে জার্মানিতে যখন এলাম, রবিবারে চার্চে নিয়মিত না গেলেও কবরখানায় যাবার একটি প্রথা জার্মানিতে রীতিমত সচল ছিল। রবিবারে বাজারে কুলুপ। কেবলমাত্র ফুলের দোকান ও পেস্ট্রি কফি হাউস খোলা – কারণ রবিবারে সমাধিক্ষেত্রে গিয়ে পূর্ব পুরুষদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার, ফুল চড়ানোর দিন, ফেরার সময় এক কাপ কফি পান!
নরমানডি দুনিয়ার যে কোন সমাধিস্থল থেকে আলাদা।

সাতাশটি সামরিক সমাধি ক্ষেত্রে সমাহিত আছেন এক লক্ষের বেশি মানুষ যারা এক মাসের নরমানডি যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন, একে অপরের মাত্র তিরিশ দিন আগে পিছে। আমেরিকান সৈন্যদের গড়পড়তা বয়েস ছাব্বিশ। প্রত্যেক সমাধি ফলক এক, সাদা ক্রস, ইহুদিদের ক্ষেত্রে স্টার অফ ডেভিড। ক্বচিৎ কোথাও দুটো শব্দ লেখা, অজানা সৈনিকের ফলকে যে ক্রস, তাতে লেখা ‘যার নাম কেবল ঈশ্বর জানেন’।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেনানী রূপার্ট ব্রুকস লিখেছিলেন,
ইফ আই শুড ডাই, থিংক ওনলি দিস অফ মি
দ্যাট দেয়ার ইস সাম কর্নার অফ এ ফরেন ফিল্ড
দ্যাট ইজ ফরেভার ইংল্যান্ড
তিনি ফেরেননি। শায়িত আছেন ফরেন ফিল্ডে।
দুটি মহাযুদ্ধে ফ্রান্সের পক্ষে লড়াই করে এই মাটিতে প্রাণ দিয়েছেন পাঁচ লক্ষের বেশি বিদেশি সৈন্য। চির কৃতজ্ঞ ফ্রান্স প্রতিটি সমাধিক্ষেত্র চিরতরে দান করেছে সেই সব দেশকে। রূপার্ট ব্রুকের কথা ধার করে তাই বলা যায়
দেয়ার ইজ সাম কর্নার অফ এ ফরেন ফিল্ড
দ্যাট ইজ ফরেভার ইংল্যান্ড/ আমেরিকা/ কানাডা/ অস্ট্রেলিয়া/ ইন্ডিয়া /পোল্যান্ড /বেলজিয়াম


কোলভিল- সুর- মেরে প্রায় দুশো একর জমি জুড়ে আমেরিকান সেমেটারি- সেখানে শায়িত আছেন ৯,৩৮৯ জন, দেওয়ালে লেখা আছে ১৫৫৭ জন মিসিং সোলজারের নাম (প্রথম মহাযুদ্ধে নিহত টেডি রুজেভেলটের সন্তানকে পঁচিশ বছর বাদে এখানে গোর দেওয়া হয়)। বছরে দশ লক্ষ পর্যটক আসেন। আমার দেখা বৃহত্তম সমাধি অঙ্গন। স্টিভেন স্পিলবের্গের ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’ ছবিটির শেষ দৃশ্যে দেখা যায় হাজার হাজার ক্রসের সারি, দূরে আটলান্টিক, জেমস ফ্রান্সিস রায়ান (ম্যাট ডেমন) হাঁটু গেড়ে বসেন জন মিলারের ক্রসের সামনে। প্রিয়জনের চির বিদায়ের এই ভূমিতে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে যায়।

একটি নীল বোর্ডে লেখা
দেখুন তাঁরা কতজন ছিলেন
দেখুন তাঁরা কতো তরুণ ছিলেন
তাঁরা আপনার স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিয়েছেন
চোখের জলকে রাশ দিন, থাকুন স্তব্ধ
আরেকটু দূরে, ভের-সুর-মেরের সবুজ প্রান্তরে সাদা পাথরের মেমোরিয়াল, সেখানে সাদা ক্রসের নিচে এগারো হাজার ব্রিটিশ সৈন্য সমাহিত। রয়্যাল নেভির শেষ জীবিত সদস্য ট্যাঙ্ক ড্রাইভার হেকটর ডাফ লিখেছেন ছয়ই জুন সকালের জোয়ারে ল্যান্ডিং বোট তীর অবধি পৌঁছুতে পারেনি, হাঁটু জলে নেমে ডাইনে বাঁয়ে মৃতদেহ ঠেলে ডাঙ্গার দিকে হেঁটেছেন। আরোমানশের বিচে বসে এমনি কজন ভেটারেনের সঙ্গে গল্প জুড়ে দিয়েছিল আমাদের মায়া।

শত্রু মিত্র?
বিচ দখলের পরে নরমানডির লড়াই চলেছিল কোন উন্মুক্ত ময়দানে নয়, নদীর তীরে, অজস্র ঝোপে ঝাড়ে ঢাকা গ্রামাঞ্চলে যেখানে স্নাইপার অনায়াসে আত্মগোপন করে বন্দুক চালিয়েছে . জার্মান বাহিনী তাদের পশ্চাদপসরণের সময়ে ফেলে গেছে অনেক কমরেডকে; শত্রু মিত্র নির্বিশেষে লা কাম গ্রামে তাঁদের পাশাপাশি সমাধিস্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আমেরিকান কর্তৃপক্ষ। ১৯৪৫ সালে কোলভিল-সুর-মেরে আমেরিকানদের জন্য জমি নির্দিষ্ট হলে তাঁদের সেখানে পুনরায় গোর দেওয়া হয়। নতুন জার্মান সরকারকে জানানো হলো তাঁরা লা কামে আপন স্মারক বানাতে পারেন। দেড়, দুশো মাইল ব্যাপ্ত রণাঙ্গনের অজস্র গ্রাম জঙ্গল থেকে তাঁদের মরদেহের অবশিষ্ট সনাক্ত করে লা কামে ঠাই দিতে আরও কয়েক বছর কেটে যায়। ১৯৬১ সালে ফ্রাংকো জারমান চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে লা কাম সমাধিক্ষেত্রের পরিচালনার ভার বর্তায় জার্মান যুদ্ধ সমাধি রক্ষণাবেক্ষণ সমিতির ওপর (ফোলকসবুনড ডয়েচে ক্রিগসগ্রেবারফুয়েরসরগে)।




লা কামের সদর দুয়োরে লেখা আছে
জার্মান সমাধিক্ষেত্র লা কাম, একই ফরাসি ভূখণ্ডে
বিষণ্ণ এই সমাধিক্ষেত্রে শায়িত আছেন একুশ হাজার সৈন্য যাদের সকলে এই যুদ্ধের কারণ অথবা এই যুদ্ধকে অন্তর থেকে সমর্থন করেননি। তাঁরাও আশ্রয় পেয়েছেন আমাদের এই ফ্রান্সের মাটিতে।
লা কাম ঘন বনানীর মাঝে, আটলান্টিক খানিকটা দূরে। আয়তক্ষেত্রের আকারে এই সমাধিস্থলের প্রতি সারিতে চারশ দেহ সমাহিত, তার ওপরে মাটিতে সমান করে গাঁথা ধূসর ক্রস। সমাধিক্ষেত্রের ঠিক মাঝখানে একটি স্তূপ, তার মাথায় জমানো লাভা থেকে তৈরি উঁচু একটি ক্রস।

সারি সারি মৃতের নামের ফলক দেখে থমকে গেছি বারবার
রাইনহোলড ভলফ জন্ম ৪.২.২৬- মৃত্যু ১৮.৭.৪৪
জিগফ্রিড লিল জন্ম ১০.৬.২৬ মৃত্যু ১৯.৭.৪৪
ওয়াল্টার তসিমারমান জন্ম ১৮.৫.২৬ মৃত্যু ১২.৬.৪৪
ইয়াকব গ্রুবার জন্ম ২৫.১০.২৫ মৃত্যু ২১.৬.৪৪
আলয়েস অস্ত্রাভস্কি জন্ম ৫.১১.২৬ মৃত্যু ১৬.৭.৪৪


ব্রিটিশ, আমেরিকান জার্মান ছেলেরা সবাই কোন মায়ের সন্তান, ঈশ্বরের সন্তান। কোথায় তাঁরা জন্মেছিলেন, প্রাণ দিলেন নরমানডির এই নির্জন প্রান্তরে। রাজা, পতাকা, নীতির নামে?
সবাই একই অশ্বমেধের বলি।
রণ রক্ত সফলতা?
আজ আবার দিকে দিকে যুদ্ধের দামামা বাজে, টিনের ড্রাম বাজায় কিশোর, বিশেষ দিবসে দেশে দেশে বোমারু বিমান, ট্যাঙ্ক সাঁজোয়া বাহিনীর মার্চ পাস্ট, বারুদের গন্ধ আকাশে বাতাসে, নেতারা কাগজে কলমে সৈন্য বাহিনী, ক্ষেপণাস্ত্রের নিশানা সাজান, টেলিভিশনে যুদ্ধ বিজয় বার্তা শোনানো হয়।
কিসের রণ, কেন রক্তপাত? কোন সফলতার অভিলাষে?
নরমানডির তটে এক আশ্চর্য নিঃশব্দতা আমাদের গ্রাস করে। অজস্র শিশু কিশোর কিশোরী বয়স্ক মানুষ নীরবে হেঁটে যান; নীল আটলান্টিক সমুদ্রের হাওয়া আমাদের, সমস্ত মৃত মানুষকে বারবার ছুঁয়ে যায়।
মায়ের কাছে শোনা একটা কথা আজ একটু অন্যভাবে বলতে ইচ্ছে করে
সব তীর্থ বারবার, নরমানডি একবার।