এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  গপ্পো  শনিবারবেলা

  • মুড়কিদিদির রামায়ণ

    শেখরনাথ মুখোপাধ্যায়
    ধারাবাহিক | গপ্পো | ০১ নভেম্বর ২০২৫ | ২৯ বার পঠিত


  • চল্‌ উচ্ছে, মুড়কি দিদি বলে, এবার আবার ফিরি দনু রাক্ষসের কাছে, যেখানে গর্তে ফেলে তার গায়ে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।

    শেষ যখন তোকে দনুর গল্প বলেছি, বলতে থাকে মুড়কি দিদি, সে মরে যাবার পর তার গায়ে যখন আগুন দেওয়া হল, শুধু ধোঁয়াই ছিল বেশ খনিকক্ষণ, তারপর ধোঁয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা রথও উঠে এল। প্রায় লাফিয়েই সেই রথে চড়ে বসে দনু, তার অত তাড়াহুড়ো দেখে লক্ষ্মণের কাছ থেকে সেই বিখ্যাত ধমকটা খায় সে: একবার যদি ব্রহ্মার কাছে নালিশ করি, স্বর্গে যাওয়া পণ্ড হয়ে যাবে তোমার, সে কথা কি জান? তখন স্বর্গের দিকে উঠতে উঠতে রাম-লক্ষ্মণকে হাত জোড় করে বলে সে, আমি তো এখন স্বর্গে প্রায় পৌঁছিয়েই গেছি, তোমাদের সঙ্গে আপাতত আর দেখা হবে না আমার, তোমরা কতদিন আগে বেরিয়েছ তোমাদের দণ্ডকারণ্যের কুটির থেকে? কতদিন ঘুমোওনি, খাওনি কতদিন? তোমাদের দেখেই তো মনে হচ্ছে ক্লান্ত খুবই তোমরা, খিদেও নিশ্চয়ই পেয়েছে খুব। আমার মনে হয় ঋষ্যমূকে পৌঁছিয়ে সুগ্রীবের সঙ্গে অনেক কথাবার্তা অনেক পরামর্শ তোমাদের দরকার। তখন খিদে আর ক্লান্তি মেটানোর সময় বা সুযোগ তোমরা পাবেই না। তাই ঋষ্যমূক যাবার যে রাস্তাটা আমি তোমাদের বলে দেব সেটা এমন চমৎকার যে পথেই প্রচুর পছন্দসই খাবার তোমরা পাবে, আর শরীর-জুড়োনো মিষ্টি হাওয়া আর চোখ-জুড়োনো দৃশ্য তোমাদের খিদে আর ক্লান্তি – দুটোই কমিয়ে দেবে।

    এখান থেকে পশ্চিমে যে রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে, দনু বলে, সেটা দিয়ে খানিকটা এগোলেই দেখতে পাবে নানা ফলের গাছ। খুব মিষ্টি আর সুন্দর গন্ধের নানা ফল পেকে তাদের ভারে গাছগুলোকে যেন নুইয়ে দিয়েছে। খাওয়ার জন্যে কোন কষ্টই করতে হবে না তোমাদের, গাছ বেয়ে ওঠারও প্রয়োজনই নেই, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাত তুলেই পাড়া যায় সেই সব ফল। সেই ফল তোমরা যথেচ্ছ খেও, কেউ বারণ করবে না। পুরাকালে যখন একদল মুনি এখানে বাস করতে আসেন তখন গাছগুলোতে এত ফল ছিল না। তাঁদের তপস্যার ফলেই এই সব গাছে এখন সারা বছর ফল পেকে ঝুলতে থাকে। প্রথম প্রথম গাছে উঠে এইসব ফল সংগ্রহ করতে মুনি আর তাঁদের শিষ্যদের খুব পরিশ্রম হত। তাঁদের ঘাম পড়ে এখানকার মাটি ভিজে যেত। কিছুদিন পর সেই ভেজা-মাটিতে জন্মাল শ'য়ে শ'য়ে ফুলের গাছ। সেই ফুল গাছগুলো এখন সারা বছর ফুলে ভরা। জোরে বৃষ্টি পড়লে যেমন বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা আমাদের গায়ে-মাথায় পড়ে সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে দেয়, এখানকার শরীর-ঠাণ্ডা-করা হাওয়ায় ঠিক তেমনই অনবরত এই ফুল ঝরতে থাকে, স্নিগ্ধ সুগন্ধী ঝরা-ফুলের বৃষ্টি তোমাদের শরীর আর মনকে শীতল করবে, সব ক্লান্তি দূর করে দেবে। একটু এগোলেই দেখতে পাবে পম্পা নদী। একই নদী কোথাও সরোবর নামে পরিচিত, কোথাও-বা সরসী কিংবা পুষ্করিণী বা পুকুর। নাম যাই হোক এর জল সব সময়ই নীল, নীচে কাদা পাঁক বা শ্যাওলা নেই। শুধুই সোনার বরণ বালি। সেই জলে অজস্র মাছ আর পদ্মফুল একই সঙ্গে দেখা যায়। নদীর পাশে গাছের সারি, তাতে গান গাইছে আর উড়ে বেড়াচ্ছে প্রচুর ফল-খেয়ে-খেয়ে-মোটা-হয়ে-যাওয়া পাখির দল। অভ্যাসের চেয়ে অনেক বেশি ফল খেয়ে যদি তোমাদের অরুচি হয় তাহলে শূলপক্ক সেই পাখি বা মাছ খেয়ে তোমরা তৃপ্তিলাভ কোরো।

    এতক্ষণ রামায়ণের এইসব গল্প একটানা বলে যাচ্ছিল মুড়কি দিদি। আর, একটাও কথা না বলে মুড়কি দিদির মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল উচ্ছে, এবার সে বলে ওঠে, আমি শূলপক্ক জানি।

    জানিস? কীভাবে জানলি?– বলে মুড়কি।

    ডাক্তার কাকা, বলে উচ্ছে।

    হঠাৎ ডাক্তার কাকা বলছিস কেন, ডাক্তার কাকা এসেছে নাকি?

    না, খুব জোরে হেসে ওঠে উচ্ছে, বলে, আজ আসেনি, কিন্তু অন্যদিন এসেছিল না? আর এসেই যে বলল, এন্টালীর বাজার থেকে মাংসর টুকরোগুলো একেবারে কাটিয়ে নিয়ে এসেছি, এখন শুধু রেঁধে নিলেই হয়। মনে নেই তোমার? শুনে, জেঠামা বলল, তাহলে আমাকে দিন, আমিই রেঁধে দিচ্ছি। ডাক্তার কাকা তো রাজি হল না, বলল, নাঃ, রান্না আমিই করব, কিন্তু রান্নাঘরে নয়, উঠোনে। আর আমার অ্যাসিস্ট্যান্ট হবে উচ্ছে। এবারটা আমি শিখিয়ে দেব, পরের বার থেকে উচ্ছেই রাঁধবে। মনে নেই তোমার?

    মনে যে ছিল না মুড়কির তা তো নয়, কিন্তু পরম উৎসাহে উচ্ছে বলছে সেদিন কী কী হয়েছিল, শুনতে বেশ মজাই লাগছে ওর। ও তাই বলল, আমার অতো মনে নেই, বল্‌ না তুই, বেশ তো বলছিলি।

    ডাক্তার কাকা কাঠকয়লার আগুন জ্বালালো উঠোনে, বলতে থাকে উচ্ছে। মাংসর টুকরোগুলো তারপর কীসব মশলা দিয়ে মেখে নিল। তারপর কাঁধের ব্যাগটা থেকে কতকগুলো লোহার শিক বের করে শিকগুলো গেঁথে দিল মাংসর টুকরোয়। লাল হয়ে কাঠকয়লাগুলো জ্বলছে যখন ডাক্তার কাকা মাংস-গাঁথা শিকটা ধরে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাংসর টুকরোগুলোকে আগুনে আগুনে – আগুনে কী যেন করল, কী যেন বলে!

    কী করল?– প্রশ্ন করে মুড়কি, আগুনে পুড়িয়ে দিল?

    না না, পোড়াল না, পোড়াল না, পোড়ালে তো সবই খারাপ হয়ে যাবে, টুকরোগুলোতে আগুন একটু একটু লাগতে দিল ডাক্তার কাকা, কিন্তু – কাঁদো কাঁদো মুখে বলে উচ্ছে, বলে দাও না মুড়কি দিদি, আমার মনে পড়ছে না কথাটা, কী যেন ––

    ঝলসে নিল?– তাই বলতে চাইছিস তুই?– বলে মুড়কি দিদি।

    হ্যাঁ, ঝলসে নিল। তারপর একটু ঠাণ্ডা করে আমাকে একটা টুকরো দিয়ে বলল, খেয়ে দেখ তো, কেমন লাগে।

    তোর কেমন লাগল?

    দারুণ। আমি তো তাই বললুম ডাক্তার কাকাকে। ডাক্তার কাকা বলল, শিখে নিয়েছিস তো আজ রান্নাটা? এবার থেকে কিন্তু তুই-ই রাঁধবি। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করল, যা খেলি সেটার নাম কী বল তো? এটাকে বলে শূলপক্ক। এখনকার লোকরা অবিশ্যি বলে শিক-কাবাব, আমি কিন্তু শূলপক্কই বলি।

    এতটা কথা বলে এবার একটা লম্বা শ্বাস টানে উচ্ছে, তারপর বলে, কিন্তু মুড়কি দিদি, তুমি যে বললে রাম-লক্ষ্মণকে দনু বলছে শূলপক্ক পাখি বা মাছ খাবার কথা। মাছের তো আমরা ঝাল খাই। ঝোলও খাই। অথবা ভাজা। শূলপক্ক কি মাছের হয় নাকি?

    হবে না কেন?– মাছের আঁশ ছাড়িয়ে ছাল ছাড়িয়ে নিলেই হবে, বলে মুড়কি।

    মাছেরও হবে? উচ্ছে অবাক। কিন্তু রাম-লক্ষ্মণ শিক পাবে কোথায়?

    হ্যাঁ, এটা একটা প্রশ্ন বটে, শিক পাবে কোথায়? তারপর হাসতে হাসতে উচ্ছের গালে একটা আদরের চিমটি কাটতে কাটতে বলে, রাজার ছেলে, বনে-জঙ্গলে চোদ্দ বছরের জন্যে থাকতে এসেছে। ওদের সঙ্গে তলোয়ার নেই নাকি? একটা তলোয়ার দিয়ে তো অনেক কিছুই করা যায়। আঁশ ছাড়াবে তলোয়ার দিয়ে, ছালও। ছাল ছাড়ালেই তো মাংস, ভেতরে মাছের কাঁটা। এবার টুকরো কর, আর শিকের বদলে তলোয়ারে গেঁথে ঝলসে নাও আগুনে। ব্যস, শূলপক্ক মাছ।

    দনুর উপদেশ মতো পেট-ভরা পাকা ফল খেয়ে, আবার বলতে থাকে মুড়কি দিদি, নদীর পারের ফুলগাছগুলোর ঝরা ফুলের বৃষ্টির মিষ্টি গন্ধের আরামের মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মাছ আর দলে দলে পাখি – কিন্তু শুধুই পাখি বললে অপমানই করা হয় তাদের, আসলে তারা উড়ন্ত ঘৃতপিণ্ড (ঘৃতপিণ্ড বুঝলি উচ্ছে? ঘৃত মানে ঘী। দিনের পর দিন যত ইচ্ছে মিষ্টি পাকা ফল খেতে খেতে এমন মোটা হয়েছে পাখিগুলো, সর্বাঙ্গে চর্বি জমে তারা চর্বির এক-একটা গোলা! সেই চর্বিকেই ঘী বলছে দনু!) – তলোয়ারের সাহায্যে তাদের শূলপক্ক করে খাওয়ার লোভ সামলাতে পারল-না রাম-লক্ষ্মণ। তারপর হাঁটতে হাঁটতে বেশ গোটাকয়েক পাহাড় পেরিয়ে চলা। চলতে চলতে দিব্যি যখন নিজেদের চনমনে লাগছে তখনই নজরে পড়ল একটা পাহাড়ের মাথায় পাঁচজন বাঁদর। মাঝখানে একজন, আর তাকে ঘিরে বাকি চারজন। রাম-লক্ষ্মণের বুঝতে কোনই অসুবিধে হল না যে অবশেষে তারা সুগ্রীব আর তার অনুচরদের দেখতে পেয়েছে।

    আর তাদেরও দেখেছে সুগ্রীব। সে তো ঠিক মাঝখানটায় বসেছে, যাতে কোন কিছুই তার নজর না এড়ায়! সে হনুমানকে বলে, ওই দেখ দুজন বীরপুরুষ। কতটা লম্বা দেখেছ? আর কী স্বাস্থ্য! দুজনেরই কোমরে খাপখোলা তলোয়ার ঝকমক করছে, কাঁধ থেকে প্রায় মাটি-ছুঁই-ছুঁই বিশাল ধনুক আর পিঠ থেকে ঝুলছে কেমন মোটাসোটা তীর-দিয়ে-ঠাসা তূণীর। আমার মনে হয় আমার দাদা বালীই পাঠিয়েছে এদের, আজ মনে হয় আর আমার রক্ষে নেই।

    মাথাটা একবার ঘুরিয়ে হনুমান দেখে নেয় রাম-লক্ষ্মণকে। হতেই পারে না, বলে হনুমান, স্বর্গের দেবতার মতো চেহারার এই দুজনের পক্ষে অন্য কোন রাজার আজ্ঞাবাহক খুনী হওয়া অসম্ভব। আপনি মাথা ঠাণ্ডা করে এখানে বসে থাকুন, আমি বৃদ্ধ ভিক্ষুকের ছদ্মরূপে এঁদের সঙ্গে চট করে কথা বলে ফিরে আসি।

    হনুমান এসে প্রথমেই হাত জোড় করে জিজ্ঞেস করে রাম-লক্ষ্মণকে, এই মনুষ্যহীন জায়গায় আপনারা কী করছেন প্রভু?

    মনুষ্যহীন তো বয়েই গেল, রাম বললেন, আমরা মানুষের সন্ধানে এখানে আসিনি। সুগ্রীব নামে বাঁদরদের যে রাজা আছেন একজন, তাঁকেই খুঁজছি আমরা।

    সুগ্রীব তো বাঁদরদের রাজা নেই আর, হনুমান বলে, আগে কিছুদিনের জন্যে কিষ্কিন্ধ্যার রাজা হয়েছিলেন। এখন তাঁর দাদা বালী – তিনিই তো রাজা ছিলেন আগে – একটা ভুল বোঝাবুঝির ফলে সুগ্রীব রাজার সিংহাসন পেয়েছিলেন সামান্য কয়েকটা দিনের জন্যে, এখন রাজত্ব আবার ফিরিয়ে নিয়েছেন বালী – সুগ্রীবকে এখন তিনি দারুণ শাস্তি দিতে চান। তাঁরই ভয়ে সুগ্রীব পালিয়ে এই পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন।

    এই সুগ্রীবকেই আমার দরকার, তাঁর সঙ্গে দেখা করবার জন্যেই আমি এই ঋষ্যমূকে এসেছি। আমার নাম রাম আর আমার সঙ্গে এ আমার ছোটভাই লক্ষ্মণ, আমরা অযোধ্যাপতি মহারাজ দশরথের পুত্র। আমার মনে হয়, সুগ্রীব আর আমি, আমরা দুজনেই দুজনকে সাহায্য করতে পারব।

    হনুমান বলল, আমি সুগ্রীবের একজন মন্ত্রী, আমার নাম হনুমান। দূর থেকে আপনাদের বীরের মতো চেহারা দেখে সুগ্রীব ভয় পেয়েছেন, আমি তাই ছদ্মরূপে আপনাদের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। আপনারা এখানেই বসুন, বিশ্রাম নিন একটু, বলতে বলতে হনুমান নিজের রূপ আবার ধরে কাছাকাছি দুটো চন্দন গাছে উঠে বেশ পাতা-দিয়ে-ঢাকা দুটো মোটা মোটা ডাল ভেঙে রাম আর লক্ষ্মণের আরাম করে বসার ব্যবস্থা করে দিল। বলল, আপনারা বসুন, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সুগ্রীব আর তাঁর অন্য তিনজন মন্ত্রীকেও আমি নিয়ে আসছি।

    রামের মুখে রাবণের সীতা-চুরি করার কাহিনী শুনে সুগ্রীব বলল, তাহলে তো আমরা সীতা মা আর রাবণকেই দেখেছি। এই পাহাড়ের ওপরে আমরা পাঁচজন একদিন বসে আছি, এমন সময় আকাশ দিয়ে একটা রাক্ষস এক সুন্দরী মেয়েকে উড়িয়ে নিয়ে হু হু করে বেরিয়ে গেল। কোন কথা বলার সুযোগ না-পেয়ে সেই মেয়ে তখন তার সমস্ত গয়না একটা চাদরে মুড়ে আকাশ থেকে এই পাহাড়ে ফেলে দিল। আমরা চিনতে পারিনি, কিন্তু সেই চাদর আর গয়নাগাঁটি আমরা যত্ন করে তুলে রেখেছি। তারপর জাম্ববানের দিকে ফিরে সুগ্রীব বলল, ভাই জাম্ববান, তুমি তো জান কোথায় রাখা আছে ওগুলো, একবার নিয়ে এসে ওঁদের দেখাও না। জাম্ববান যখন ফিরলো বাণ্ডিলটা নিয়ে, তখন সেই চেনা চাদর আর গয়নাগাঁটি দেখে রাম তাঁর চোখের জল আটকাতে পারলেন না। গয়নাগুলোর মধ্যে এক জোড়া নূপুর ছিল, সেটা মাথায় রেখে কাঁদতে কাঁদতে লক্ষ্মণ বলল, আমি প্রতিদিন সকালে বৌদিকে প্রণাম করতুম, প্রণাম না-করে কিছু খেতুম না। এই নূপুর আমার ভারী চেনা। এটাকে আমি সঙ্গে রাখছি।

    সুগ্রীব এবং তাঁর মন্ত্রীরা রামকে বোঝালেন কেন বালী না মরলে সুগ্রীবের চলবে না। খুবই আশ্চর্য ভুল-বোঝাবুঝি, কিন্তু কিছু করার নেই। সুগ্রীব এ-ও বলল যে, বালীকে রাজত্ব ছেড়ে দিতে তার কোনই আপত্তি নেই – বালী রাজা হলেই সে বরঞ্চ খুশি হবে কিন্তু বালী সে কথা বুঝবেই না। আগে সুগ্রীবকে মরতে হবে, তারপর অন্য কথা! কাজেই শেষ অবধি রাম রাজি হলেন সুগ্রীবের হয়ে বালীকে শাস্তি দিতে।

    সেইদিনই সুগ্রীব আর তাঁর তিন সঙ্গী ফিরে গেল কিষ্কিন্ধ্যায়, রাম আর লক্ষ্মণকে পিঠে বসিয়ে ফিরল হনুমানও। রাম আর লক্ষ্মণকে কিষ্কিন্ধ্যার রাজসভায় নিয়ে যাওয়া হল না প্রথমেই। খানিকটা দূরে বেশ কয়েকটা বড় বড় গাছ-ঘেরা একটা জায়গায় রাম-লক্ষ্মণ আশ্রয় নিলেন। অভিজাত সমস্ত বাঁদর-প্রজাদের উপস্থিতিতে স্থির হল, হয় বালী নয় সুগ্রীব – দুজনের একজন রাজা হবেন। সেইদিনই দ্বন্দ্বযুদ্ধ হবে বালী-সুগ্রীবের, যিনি জিতবেন তিনি হবেন রাজা, পরাজিতজন হয় নির্বাসিত হবেন অথবা মৃত্যু বরণ করবেন। হনুমান রাম-লক্ষ্মণকে এমন জায়গায় রেখে এসেছিল যেখান থেকে লড়াইয়ের নির্দিষ্ট জায়গাটা স্পষ্ট দেখা যায়, প্রয়োজন হলে সেখানে সকলের অলক্ষ্যে গাছের আড়াল থেকে রাম তাঁর তীরও তাক করতে পারেন।

    বীরত্বে সুগ্রীব আর বালীর মধ্যে কেউই কম যায় না, কিন্তু বালী-সুগ্রীবের লড়াই হলেই ঘাবড়িয়ে যায় সুগ্রীব, আর প্রথম ঘন্টার লড়াইয়ের মধ্যেই তার শক্তি কমতে কমতে অর্ধেক হয়ে যায়। রামকে সুগ্রীব আগেই সে-কথা বলে রেখেছিল, সে-রকমটা হলে রাম গাছের আড়াল থেকে ছুঁড়বেন তীর। কিন্তু, লড়াই যখন চলছে আর সুগ্রীব একেবারেই পেরে উঠছে না, হতাশ হয়ে সুগ্রীব দেখল, কোন তীরই ছুটে আসছে না রামের দিক থেকে। অবস্থা বুঝে হনুমান দৌড়িয়ে যায় রামের কাছে, কী ব্যাপার?

    রাম বললেন, বালী আর সুগ্রীব, দুজনের চেহারাতে এত মিল যে দূর থেকে রাম তাদের আলাদা করতে পারছেন না, অতএব তীর তো দিব্যি পড়ে আছে তাঁর পিঠের তূণেই!

    হনুমান আর অন্য সব জাঁদরেল বাঁদররা তো প্রথম থেকেই দৌড়োদৌড়ি করছিল; নিজের নিজের পছন্দ অনুযায়ী হাততালি দেওয়া, উৎসাহ যোগানো, এসবও চলছিলই। এরই মধ্যে হনুমান একটা মোটাসোটা গাঁদা ফুলের মালা দূর থেকে ছুঁড়ে পরিয়ে দিল সুগ্রীবের গলায়। হলুদ রঙের মোটা মালা! রামের আর চিনতে অসুবিধে রইল না কে সুগ্রীব, কে বালী! ব্যস, কিছুক্ষণের মধ্যেই সুগ্রীবের জয়, বালী খতম!

    বুঝলি উচ্ছে, মুড়কি দিদি বলে, মনে করিস না সুগ্রীব খুবই খুশি এতে। কিন্তু উপায় তো নেই, দুজনের মধ্যে একজনকে তো মরতে হতই। সুগ্রীব যখন রাজা হল এবার, সে যুবরাজ করে দিল বালীর ছেলে অঙ্গদকে!

    রাজা হয়ে, যেমন কথা ছিল, উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিমে বিরাট বড় বড় চারটে দল পাঠিয়ে দিল সুগ্রীব। যেমন করে হোক সীতার খবর চাই-ই চাই!



    চলবে...
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ০১ নভেম্বর ২০২৫ | ২৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন