

৩ শংকরের ‘মায়াবাদ’
মায়াবাদের মূল বিন্দুগুলোঃ পূর্বপক্ষ
৩.১ ব্রহ্ম কী?
শংকরের মায়াবাদ নামের দার্শনিক তত্ত্বকে এককথায় বলতে গেলে দাঁড়ায়ঃ “ব্রহ্ম সত্য জগন্মিথ্যা জীবোব্রহ্মৈচ নাপরঃ”।
অর্থাৎ, উপনিষদে বর্ণিত ব্রহ্ম হলেন একমাত্র সত্য, একমাত্র অস্তিত্ববান; অন্য কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই। আমরা চর্মচক্ষে যে বিশ্বব্রহ্মান্ড দেখি তা অবাস্তব, সাময়িক, ক্ষণস্থায়ী; আদৌ স্থায়ী শাশ্বত সত্যবস্তু নয়। জীব বা ব্যক্তি আত্মা সেই এক ও অদ্বিতীয় ব্রহ্মের থেকে অভিন্ন, তার কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই।
৩.২ তাঁর স্বরূপ কী?
ব্রহ্ম হলেন অনাদি অনন্ত। তাঁর জন্ম-মৃত্যু নেই। তিনি নিরাকার ও নির্গুণ। তিনি সচ্চিদানন্দ, অর্থাৎ একমাত্র সত্য ও বিশুদ্ধ চেতনস্বরূপ।
বিভিন্ন উপ্পনিষদ যেমন বলছেঃ
“ব্রহ্ম হলেন সত্য,জ্ঞান ও অনন্ত”,(তৈত্তিরীয় উপনিষদ,২.১.১)।
“ব্রহ্ম হলেন জ্ঞান ও আনন্দস্বরূপ”,(বৃহদারণ্যক উপনিষদ,৩.৯.২৮)।
“হে শ্বেতকেতু, তুমিই ব্রহ্ম -তত্ত্বমসি”(ছান্দোগ্য,৬.৮.৭)।
“আমিই ব্রহ্ম—অহম ব্রহ্মোস্মি”(বৃহদারণ্যক, ১.৪.১০)।
শেষ দুটো বর্ণনার অর্থঃ ব্যক্তি জীব ব্রহ্মের থেকে আলাদা স্বতন্ত্র কিছু নয়। সম্যক জ্ঞান হলে আমি-তুমি-পরব্রহ্ম সব এক এবং অভেদ।
৩.৩ সত্যি ও মিথ্যের মাপদন্ড কী হল? কেন শুধু ব্রহ্মই সত্য, আর সব মিথ্যে?
যা সময়ের সঙ্গে বদলে যায়, যার অস্তিত্ব ক্ষণিক, অর্থাৎ যা উৎপন্ন হয়ে আবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় তা’ অন্তিম বিচারে অসত্য বা মিথ্যে। তাই এই নামরূপের পরিবর্তনশীল জগত হল মিথ্যে। যেমন দড়িকে সাপ ভেবে ভয় পাওয়াটা ক্ষণস্থায়ী। একটু পরে ভুল ভেঙে যায়। দড়ি আগে যা ছিল, পরেও তাই থাকবে। এখানে দড়ি হল সত্য, সাপ হল মিথ্যা।
আর যার জন্ম-মৃত্যু নেই, যা উৎপন্ন ও ধ্বংস হয় না, যা শাশ্বত তাই হল সত্যি। তাই নির্গুণ ব্রহ্ম হল একমাত্র সত্য। তাই একে কোন গুণ বা উপাধি বা বৈশিষ্ট্যে বেঁধে ফেলা যায় না।কারণ সমস্ত বিশেষণ গুণদোষ- সব সীমাবদ্ধ, সব পরিবর্তনশীল ।
৩.৪ এই বিশ্বব্রহ্মান্ডের স্রষ্টা কে?
নির্গুণ পরব্রহ্ম হলেন এই বিশ্বসংসারের আদি (material cause) ও নিমিত্তকারণ(efficient cause)। এখানে আদি বা উপাদান কারণ মানে যা দিয়ে কোন জিনিস তৈরি হয়, যেমন মাটির ঘড়ার ক্ষেত্রে মাটির তাল। নিমিত্তকারণ হল যার সক্রিয় সংযোগ বা হস্তক্ষেপে ওই সৃষ্টি রূপ নেয়, উপরের উদাহরণে কুমোর।
কিন্তু পরব্রহ্ম ছাড়া সব কিছুই, নামরূপের জগত, তো মিথ্যে অস্তিত্বহীন, তাহলে কোন সৃষ্টি বা তার উপাদান ও নিমিত্ত কারণের প্রশ্ন কী করে ওঠে? আবার ব্রহ্ম যদি নির্গুণ তাহলে উনি সক্রিয় হয়ে বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টি করতে লেগে পরলেন কেন?
সত্যি কথা; প্রচলিত অর্থে সৃষ্টি বা ধ্বংস বলতে যা বুঝি তা বাস্তবে হয় না। যা হয় তাহল একটা ধোঁকা, একটা বিভ্রম। যেমন পড়ে থাকা দড়ি দেখে সাপ ভেবে আঁতকে ওঠা। কিন্তু কাছে গিয়ে ভাল করে দেখে যেই বুঝতে পারলাম যে ওটা আসলে দড়ি, অমনই ভয় কেটে গেল।
যেমন জাদুকরের জাদুতে মঞ্চে একটা হাতি দেখছি। আবার ম্যাজিকের মোহ বা আচ্ছন্নভাব কেটে যেতেই সেই হাতি মিলিয়ে গেল।
যেমন, কাদার তাল থেকে তৈরি হাঁড়িকুড়ি সব ক্ষণস্থায়ী ; ক’দিন পরে যে মাটি থেকে এসেছিল পরে তাই হবে। এভাবে হাঁড়িকুঁড়িকে কাদার তাল হিসেবে দেখাটাই সম্যক দর্শন। ঠিক এভাবেই নামরূপের দুনিয়া আসলে ব্রহ্মের থেকে উৎপন্ন হয়ে ব্রহ্মেই মিলিয়ে যায়। তাই ব্রহ্ম হল এই অস্থায়ী বাহ্যজগতের একই সঙ্গে উপাদান ও নিমিত্তকারণ। ব্রহ্মান্ডকে ব্রহ্মের থেকে আলাদা করে দেখাটাই ভুল বা বিভ্রম।
৩.৫ তাহলে মুক্তি কী? মুক্তির পথ কী? ঈশ্বরের আরাধনা?
না; কারণ ঈশ্বরেরও কোন স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই। পুজোপাঠ, ভজনকীর্তন, আরাধনার মাধ্যমে ব্যক্তি জীব নিরাকার পরব্রহ্মকে সগুণ এবং বিভুতিযুক্তরূপে যতদূর ভাবতে পারে ঈশ্বর হল তার অন্তিম রূপ। তবু সেটা সৎচিদানন্দ স্বরূপ সর্বব্যাপী ব্রহ্মের এক নিম্নকোটির(inferior)রূপ মাত্র। এতে দ্বৈতবুদ্ধি অর্থাৎ ঈশ্বর ও বাকিরা স্বতন্ত্র এই ভেদ থেকে যায়। সগুণ ব্রহ্ম উপাসকদের ভক্তিবাদ হল ঘুরপথ। ওসব অবান্তর।
মুক্তি হল পরব্রহ্মের সঙ্গে একাত্মবোধ হওয়া, তারজন্যে দরকার ভেদবুদ্ধি ছেড়ে জীবের ব্রহ্মের সঙ্গে অভেদ বোধ। উত্তম পন্থা হল সোজা জ্ঞানমার্গের পথে সম্যকদৃষ্টি অর্জন।
অজ্ঞানের তিমির থেকে জ্ঞানাঞ্জন লেগে চোখের দৃষ্টি স্পষ্ট হবে। এর জন্যে অর্থাৎ এই জ্ঞান অর্জনের জন্যে চাই শাস্ত্রের অধ্যয়ন। জ্ঞানের আলোকে যেই উপলব্ধি হবে ‘সর্বম খ্বলিদং ব্রহ্ম’, অর্থাৎ সমস্ত কিছু ব্রহ্মময়, তখনই ওই নামরূপের দুনিয়া মিলিয়ে যাবে। এই হল মুক্তি বা মোক্ষলাভ, আর কিছু নয়।
৩.৬ পুজোপাঠের বদলে শাস্ত্রের অধ্যয়ন? কোন কোন শাস্ত্র? ধরুন ন্যায়শাস্ত্র(logic) পাঠে, মানে প্রত্যক্ষ অনুভব(perception) , আর তার ভিত্তিতে যুক্তির প্রয়োগে অনুমানের(inference) মাধ্যমে কি পরব্রহ্মকে জানা যায় না?
না; প্রত্যক্ষ অনুভুতির সত্য আসলে ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বাহ্যজগত বা পরিবর্তনশীল দুনিয়ার সত্য। আর পরিবর্তনশীল দুনিয়া নিজেই ক্ষণস্থায়ী, কাজেই অসত্য। এই ন্যায়শাস্ত্রের যুক্তিপরম্পরা শুধু ব্যবহারিক সত্যের ক্ষেত্রে খাটে, পারমার্থিক সত্যের অনুসন্ধানে ব্যর্থ হয়। তাই ব্রহ্মকে বা পারমার্থিক সত্যকে জানতে হলে শ্রুতি এবং স্মৃতিশাস্ত্রই একমাত্র নির্ভরযোগ্য। অর্থাৎ, বেদাদি শ্রুতি এবং মনু-পরাশর-যাজ্ঞবল্ক্য আদি স্মৃতির অধ্যয়নেই অজ্ঞান দুর হয়ে জ্ঞানের আলো দেখতে পাওয়া যায়।
৩.৭ তাহলে কি দুটো সত্য আছে?
অবশ্যই। এক হল ব্যবহারিক সত্য যা রোজকার সাধারণ নশ্বর জীবনে কাজে লাগে। এই সত্য পরিবর্তনশীল এবং অবিদ্যার ফল, কাজেই মিথ্যার নামান্তর। এই সত্যের সাহায্যে ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয় না।আর পারমার্থিক সত্য হল আসল সত্য - ‘সর্বং খ্বলিদং ব্রহ্মঃ” বা সবকিছু ব্রহ্মময় হিসেবে দেখা, এবং এই নশ্বর ভঙ্গুর বাহ্যজগতকে এক ক্ষণস্থায়ী বিভ্রম রূপে অনুভব করা।
৩.৮ অবিদ্যা কী? অবিদ্যা ও মায়া কী আলাদা? দুটোর কাজ কী?
অবিদ্যা হচ্ছে সেই দোষ যার জন্যে চেতনা মলিন হয়ে একমাত্র সত্য বস্তু ব্রহ্মের জায়গায় বাহ্যজগৎ বা মানুষ,পশু, উদ্ভিদ, পাহাড়,নদী ইত্যাদি স্থাবর ও জঙ্গম বিশ্বের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সত্য বলে মনে হয়। যেমন চোখের দোষে আকাশে দুটো চাঁদ দেখা যেতে পারে বা আজকাল থ্রি-ডি ফিল্মে উপযুক্ত চশমা না পরলে দু’তিনটে মাথাওলা মানুষ দেখা যেতে পারে তেমনই অবিদ্যার প্রভাবে সত্যির বদলে মিথ্যাবস্তুর দর্শন হয়।
অবিদ্যার দুটো কাজ। এক, আসল রূপকে আবৃত করা। যেমন মেঘ এসে সুর্যকে ঢেকে দেয়। দুই, মায়াজালের মত কাল্পনিক কিছু সৃষ্টি করা।
যেমন সর্প-রজ্জু উদাহরণে বিভ্রান্তির ফলে দড়ির আসল চেহারা আবৃত হয়। তারপর সেখানে সর্প বলে এক ইমেজ সৃষ্টি হয় যা আসলে ওখানে নেই, যা পুরোপুরি কাল্পনিক।
অবিদ্যা ও মায়া একই প্রক্রিয়ার দুটো অংশ। অবিদ্যার ফলে ভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, সত্য আবৃত হয় আর তার জায়গায় যা দেখতে পাওয়া যায় তাই হল মায়া।
৩.৯ অবিদ্যার স্বরূপ কী? এ কি সৎ (বাস্তর), নাকি অসৎ (মিথ্যা)? এর নাশ কী করে হয়?
ব্রহ্মজ্ঞানের উদয়ে অবিদ্যার নাশ হয়। চেতনার মলিনতা ধুয়ে গিয়ে সমস্ত কিছু ব্রহ্মময় জ্ঞান হয়--অবিদ্যা সৎও নয়, অসৎও নয়।
কেমন করে?
অবিদ্যা ‘সত্য’ বা সৎ হলে ওর তৈরি বাহ্যজগতও সৎ বা অবিনশ্বর হত। ফলে ব্রহ্মবিষয়ে যথার্থ জ্ঞানের পরেও তা’ অবিকৃত বা অপরিবর্তিত থাকত, ওর নাশ হত না। কিন্তু শংকরের মতে একমেবাদ্বিতীয়ম ব্রহ্মই শুধু সত্য এবং অবিনাশী ও শাশ্বত। কাজেই ‘অবিদ্যা’কে সৎ বা সত্য বলা যায় না।
কিন্তু জগৎসৃষ্টিকারী অবিদ্যা অসৎ বা মিথ্যা হতেও পারে না। কারণ, আকাশকুসুম গোছের সম্পূর্ণ মিথ্যা বা কাল্পনিক তত্ত্বের মধ্যে কোন কিছু সৃষ্টি করার শক্তি নেই। অথচ অবিদ্যা এক কাল্পনিক মায়ার জগত বা ব্যবহারিক জগত সৃষ্টি করার ক্ষমতা ধরে। তাই অবিদ্যা হল না-সৎ এবং না-অসৎ, এককথায় ‘অনির্বচনীয়’—যাকে ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব।
(চলবে)