

৫.০ মায়াবাদের যুক্তিপরম্পরা(epistemology)
৫.১ যুক্তিকেই খারিজঃ শাস্ত্রপ্রমাণঃ দুই সত্যের তত্ত্ব
শংকরের দর্শনের যুক্তিপরপম্পরার বিচার করতে বসলে খেয়াল রাখা দরকার উনি প্রথমেই ন্যায়শাস্ত্রের যে কাঠামো, প্রত্যক্ষ(perception)-অনুমান (inference)-প্রমাণ(proof) তাকে খারিজ করে শাস্ত্রবচনকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
উনি জানেন যে প্রত্যক্ষ অনুভূতি বা বাইরের জগতের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ে সংযোগে প্রাপ্ত সংবেদন(perception) হল শ্রেষ্ঠ প্রমাণ, কারণ এটাই অনুমানের(inference)তথা সিদ্ধান্তের ভিত্তি। এবং শাস্ত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ অনুভবের বিরোধ হলে প্রত্যক্ষকেই গুরুত্ব দেয়া হবে।কিন্তু উনি মনে করেন বেদ আদি শ্রুতি এবং মনু আদি স্মৃতিশাস্ত্র হল এই নিয়মের ব্যতিক্রম।কারণ ওরা অপৌরুষেয় , স্বতঃপ্রকাশ, এবং নিজেরাই স্বতন্ত্র জ্ঞানের উৎস। যদিও ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের ব্যাখ্যায় ন্যায়শাস্ত্রের প্রত্যক্ষ অনুভব সবচেয়ে গুরুত্ব পাবে, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানের জন্যে শ্রুতি ও স্মৃতিকে বেশি মানতে হবে।
এর পরে উনি ব্রহ্মসূত্রের মূল ভাষ্যে বলছেন শাস্ত্রবচনকেই মেনে নেওয়া উচিত, তর্কবিচারকে নয়। কারণ তার্কিকরা নিজেরাই যে সহমত নন। এমনকি কপিল, কণাদের মত দার্শনিকরাও সত্যের স্বরূপ নিয়ে সহমত হননি। কাজেই যুক্তি যত ভালই হোক, তা’ যদি শাস্ত্রবচনকেই খন্ডন করে তব শাস্ত্রকেই মানতে হবে। কারণ ব্রহ্মকে বুঝতে হলে শাস্ত্রই সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য প্রমাণ।
কিন্তু এখানেই শংকরের মুশকিল শুরু। ওঁর যুক্তি ওঁরই বিরুদ্ধে যাচ্ছে।
দেখা যাচ্ছে বেদ ও স্মৃতির অনেক শ্লোক পরস্পরবিরোধাভাসী এবং তার ব্যাখ্যা নিয়ে মতভেদে অনেক দার্শনিক স্কুল গজিয়ে উঠেছে। এমনকি একই ব্রহ্মসূত্র এবং তৈত্তিরীয়, ছান্দোগ্য, শ্বেতাশ্বতর, বৃহদারণ্যক আদি উপনিষদে আস্থাশীল দার্শনিকেরাও নিরাকার ব্রহ্মের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করছেন না। মহাভারতের বনপর্বে বকরূপ ধর্মের কঃ পন্থা প্রশ্নের উত্তরে যুধিষ্ঠির বলেছিলেন-“বেদাঃ বিভিন্নাঃ, স্মৃতয়োর্বিভিন্না, নাসৌমুনির্যস্য মতংনভিন্নম”। এককথায় নানা মুনির নানা মত।
এছাড়া বিরুদ্ধবাদীরা এই প্রশ্নগুলো তুলেছিলেন—যদি কিছু যুক্তি তোমার ভিত্তিহীন বলে মনে হয়, তার থেকে কী করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো যায় যে ওই ধরণের সব যুক্তিই ভিত্তিহীন?
লক্ষণীয়, এখানে শঙ্করাচার্য্য নিজেও inductive generalization এর logic ব্যবহার করছেন, যে logic তিনি আগে খারিজ করেছেন।
এভাবে যদি সমস্ত যুক্তিতর্ক ব্যাপারটাকেই(প্রত্যক্ষ থেকে অনুমান হয়ে সিদ্ধান্তে যাওয়া) খারিজ করে দেয়া হয় তাহলে বাস্তব মানবজীবন থমকে দাঁড়াবে। কারণ মানুষ পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতেই জীবনে কোন পদক্ষেপ নেয়। তার উদ্দেশ্য হল ভবিষ্যত জীবনে দুঃখের থেকে মুক্তি এবং আনন্দ পাওয়া।
আর এটা কোন যুক্তি হল না যে বড়ভাই যদি হাবা বা মূর্খ হয় তবে ছোটজনও তাই হবে।
এখানে লজিকের বিরুদ্ধে শংকরের যুক্তিটি এরকমঃ
কিছু যুক্তিভিত্তিক সিদ্ধান্ত ভুল এবং নির্ভরযোগ্য নয়।
মায়াবাদ খন্ডনও একটি যুক্তিভিত্তিক সিদ্ধান্ত।
অতএব, মায়াবাদ খন্ডনের যুক্তিটি নির্ভরযোগ্য নয়।
এভাবে যুক্তিতর্কের জায়গায় শ্রুতি ও স্মৃতিকে অন্তিম প্রমাণ বললেও শংকরকে রামানুজের সগুণ ব্রহ্ম এবং সাংখ্য, ন্যায়-বৈশেষিক, বৌদ্ধ ও জৈনমত খন্ডনের জন্যে তর্কযুদ্ধে নামতে হয়েছে। কারণ, উনি বিশেষ একটি দার্শনিক মত প্রতিষ্ঠা করতে চান। ব্রহ্মসূত্রের শাংকরভাষ্যের দ্বিতীয়ভাগের পুরোটাই অন্যমত খন্ডনে নিযোজিত।
সেখানেও শংকর প্রতিপক্ষের যুক্তিতে কোণঠাসা হলেই শাস্ত্রবিরোধী তর্ক স্বীকৃত নয় বলে বেরিয়ে আসতে চেয়েছেন। এ যেন আদালতে প্রমাণ করতে না পারলে কাউকে দেশদ্রোহী বলে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা আইনে জেলে পুরে দেয়া। অনেকেরই মনে পড়বে জনকসভায় গার্গীর প্রশ্নের উত্তর দিতে অসমর্থ হয়ে যাজ্ঞবল্ক্যের ধমক- অধিক প্রশ্ন করলে মাথা খসে পড়বে!
স্থানাভাবে মাত্র একটি উদাহরণ দিচ্ছিঃ
বিরোধীপক্ষ বলছেন- ব্রহ্মকে সৃষ্টির আদি বা উপাদান কারণ বললে মানতে হয়ঃ
ক) সমগ্র ব্রহ্ম সৃষ্টিতে রূপান্তরিত হয়েছে। তাহলে আর ব্রহ্ম রইল কোথায়? কেবল সৃষ্টিই রইল। কিন্তু শ্রুতি অনুযায়ী ব্রহ্ম তো অবিনশ্বর, তাহলে?
খ) যদি বলা হয় গোটা ব্রহ্ম নয়, তার অংশমাত্র সৃষ্টিতে রূপান্তরিত, কাজেই বাকি অংশ তো বেঁচে রইল,(ছান্দোগ্য,৩.১২.৬)।
তাহলে মানতে হয় ব্রহ্ম অনেকগুলো টুকরো বা খন্ড দিয়ে তৈরি। কিন্তু শ্রুতি তো ব্রহ্মকে অখন্ডমন্ডলাকার বলে, তাহলে শাস্ত্রও পরস্পরবিরোধী কথা বলে? এ তো অযৌক্তিক।
তখন শংকর যুক্তি ছেড়ে সোজাসুজি বলেন, মানছি কিন্তু এ’ব্যাপারে শাস্ত্রে বলা আছে ব্রহ্মই সৃষ্টির আদিকারণ, ব্যস।
শেষে শংকর পেশ করেন দুই সত্যের তত্ত্ব- ব্যবহারিক সত্য ও পারমার্থিক সত্য। একটা আপেক্ষিক(relative),অন্যটি পরম(absolute)। উনি আরও বলেন যে প্রচলিত ন্যায়পদ্ধতি শুধু দৈনন্দিন জীবনের ব্যবহারিক সত্যের বেলায় খাটে। পারমার্থিক সত্য বা ব্রহ্মজ্ঞানের জন্যে কেবল শ্রুতি এবং স্মৃতিশাস্ত্রই প্রমাণ।
রামানুজ দুই সত্যের তত্ত্ব মানেন না। ওঁর বক্তব্য হল দুটো পরস্পরবিরোধী জিনিস একসাথে সত্য হতে পারে না এবং সে’ক্ষেত্রে শাস্ত্রবাক্যের চেয়ে প্রত্যক্ষ অনুভব উত্তম প্রমাণ।
৫.২ রজ্জুতে সর্প দর্শনের ভ্রান্তি
উত্তরপক্ষঃ বলা হচ্ছে যে দড়ি হল সত্যি, কিন্তু আলোআঁধারিতে যে সাপ দেখছি সেটা অবিদ্যা বা মায়ার নির্মাণ।
কেন? আসলে দড়ি কিন্তু দেখলাম সাপ। ওখানে দড়িই আছে, সাপ নেই। এটাই মায়ার খেলা। তেমনই আসলে রয়েছে ব্রহ্ম, আমরা অবিদ্যার ফলে দেখছি মায়াজাল, দেখছি নানারঙের এই দিনদুনিয়া।
এখন আরিস্ততলীয় ত্রিপদী লজিকের সঙ্গে তুলনা করলে দেখব ভারতীয় ন্যায় হল পঞ্চপদী। মানে তাতে পাঁচটি বাক্য, তিননম্বরটি উদাহরণ। দেখুনঃ
পাহাড়ে আগুন জ্বলছে। (যা প্রমাণ করতে হবে)
যেখানে ধোঁয়া সেখানে আগুন। (হেতু বা কারণ)
যেমন, রান্নাঘরে। (হেতুর বাস্তব উদাহরণ)
পাহাড়ে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে। (হেতু ও সাধ্যের সমাবেশের উল্লেখ)
তাহলে পাহাড়ে আগুন জ্বলছে। (সিদ্ধান্ত)
এই সিস্টেমে তিননম্বর মানে উদাহরণ হল বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আপনি যদি এই উদাহরণের একটিমাত্র ব্যতিক্রম দেখাতে পারেন,অর্থাৎ এমন একটা বাস্তব উদাহরণ যাতে ধোঁয়া থাকলেও আগুন নেই, তাহলেই যুক্তিটি বাতিল মনে করা হবে।
অর্থাৎ দড়িকে সাপ ভেবে ভয় পাওয়ার উদাহরণে যদি দেখা যায় যে উদ্ভট কল্পনা ছাড়া কোথাও সাপ বলে কিছু নেই বা থাকলেও সাপকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই তবেই মায়ার সাপ যুক্তিটি দাঁড়ায়, নইলে নয়।
তাই উদাহরণটি খুঁটিয়ে দেখা যাক।
এক, যদি এই ভ্রান্তি ম্যাজিশিয়ানের মত মায়ার খেলা হত, তাহলে সবাই একসঙ্গে ওখানে সাপ দেখত, দড়ি নয়। কিন্তু একই সময়ে কেউ কেউ সাপ দেখবে, অন্যেরা দড়ি। এটা নির্ভর করবে স্থান-কাল, আলো-আঁধারি, যে দেখছে তার চোখের অবস্থা সব মিলিয়ে।
দুই, যে কখনও সাপ দেখেনি সে কি বাঁকা হয়ে পড়ে থাকা দড়িতে সাপ দেখবে? আদৌ নয়।
তিন, দড়িতে সাপই কেন দেখে? হাতি কেন নয়? তার মানে কোথাও সাপ ও দড়ির মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে।
চার, এই দেখার ভ্রান্তি যদি অবিদ্যা বা মায়ার খেলা হত তাহলে এমন সব অদ্ভুত জিনিস দেখা যেত যার সঙ্গে দড়ির কোন সম্পর্ক নেই।
পাঁচ, সাপকে পুরোপুরি মিথ্যে বলছি কী করে? আমাদের অভিজ্ঞতায় সাপ রয়েছে, তার ছোবলমারার স্বভাব এবং বিষের প্রভাব জানার ফলে ভয় রয়েছে।খালি সাপটা সেই সময় সেই জায়গায় নেই, ওইটুকুই।
ছয়, কেবল রজ্জুতে সর্পভ্রম কেন? সর্পে রজ্জু ভ্রমও তো হয়।বাস্তব জীবনে দড়ি ভেবে সাপের ছোবল খেয়েছে এমন অভিজ্ঞতা বিরল নয়। এর দার্শনিক তাৎপর্য হল দড়ি ও সাপ উভয়েই বাস্তব, কোনটাই মায়া নয়। দুটোরই দার্শনিক স্ট্যাটাস সমান—অভিজ্ঞতালব্ধ বাহ্যবস্তু। ভুলটা সাপের বা দড়ির নয়, তৃতীয় ব্যক্তির দেখার। তাই ও দুটোর সঙ্গে তৃতীয় ব্যক্তির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব মানতে হবে। অর্থাৎ, সর্প -রজ্জু-ন্যায় অনুসরণ করলে ব্রহ্ম(রজ্জু),বাহ্যজগত(সর্প) এবং ব্যক্তিজীবটির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করতে হবে।
৫.৩ স্বপ্নো নু , মায়া নু, মতিভ্রমো নুঃ দুই দুনিয়ার তত্ত্ব
অদ্বৈত বেদান্ত বাহ্যদুনিয়ার অস্তিত্ব খারিজ করতে গিয়ে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ নিয়ে আসে। তাহল স্বপ্ন।
মোদ্দা কথা, আমরা কীভাবে নিশ্চিত হতে পারি যে আমাদের চেতনার বা অনুভূতির বাইরে কোন বাহ্যজগত আছে?
কেন পারি না? আমরা প্রতিনিয়ত ইন্দ্রিয়ের সংযোগে ছুঁয়ে দেখে শুনে চেখে যে অনুভুতি পাচ্ছি তা কি মিথ্যে হতে পারে?
হ্যাঁ, পারে। তুমি খালি অনুভূতিই পাচ্ছ, কিন্তু কী করে নিশ্চিত হচ্ছ যে অনুভূতির পেছনে বা বাইরে কোন বস্তু রয়েছে?
এটা কী কথা হল? এখন ঘরে এই টিভিসেটটা দেখতে পাচ্ছি।আমি যদি ঘর থেকে বেরিয়ে যাই তাহলে কি সেটটা ওখানে থাকবে না? কীকরে নিশ্চিন্ত হচ্ছ? যদি কেউ তুলে নিয়ে গিয়ে থাকে? আরে তাহলেও তো আবার যখন ঘরে গিয়ে দেখব তখন টের পাব যে ওটা নেই, তখন থানায় গিয়ে ডায়েরি করব।
কিন্তু টিভিসেটের অস্তিত্ব যদি আমার চেতনার উপরই নির্ভর করত তাহলে আমি ঘরেই থাকি বা বাইরে, টিভিটা সবসময় দেখতে পেতাম। কারণ টিভি আমার ঘরে নেই, চেতনায় রয়েছে।
এই ব্যাপারে, অর্থাৎ বাহ্যবস্তুর অস্তিত্ব কি কেবল ব্যক্তিমানুষের চেতনায়, আইন্সটাইন ও রবীন্দ্রনাথের চিত্তাকর্ষক কথোপকথন রয়েছে। তাতে অবশ্য আইনস্টাইন বাহ্যিক জগতের অস্তিত্ব ব্যক্তিনিরপেক্ষ বলে জানিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতে, মানুষের অনুপস্থিতিতে বস্তুর অস্তিত্ব প্রশ্নাতীত হতে পারে না।
মনে করুন, “আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে”।
পূর্বপক্ষে অদ্বৈতবেদান্তী বলবেন—সমস্যাটা বুঝতে পারছ না। দেখ, স্বপ্নেও অমন অনুভূতি হয়, যেন আমি কোন বস্তু ছুঁতে দেখতে শুনতে বা চাখতে পারছি, তার মানে কি ওটা আছে? জেগে টের পাচ্ছ সব ভোঁ-ভাঁ,—নিশার স্বপন্অসুখে সুখী যে কী সুখ তার, জাগে সে কাঁদিতে। তেমনই এই যে নামরূপের বাহ্যজগত, হতে পারে আসলে তুমি স্বপন দেখিছ, জাগিয়া দেখিবে ওটা মিথ্যা। কাজেই ইন্দ্রিয়য়ানুভূতি থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় না যে বাহ্যজগত আছে, ওটা কোন পাক্কা প্রমাণ নয়। শাস্ত্রবাক্য শোনঃ’ইন্দ্রজালমিব মায়াময়ম, স্বপ্নমিব মিথাদর্শনম’।
এই মিথ্যাদুনিয়া হল ইন্দ্রজালের মত মায়াময়, যেমন স্বপ্নে টের পাওয়া যায়। অর্থাৎ, ইন্দ্রিয়ানুভুতি বা প্রত্যক্ষানুভুতি সত্যের কোন গ্যারান্টি নয়, অমন অনুভূতি স্বপ্নেও হয়। আর জেগে উঠলে ভুলটা টের পাওয়া যায়। মানে, ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান হল স্বপ্নলব্ধ জ্ঞান অথবা হ্যালুসিনেশনের মত প্রমাণ- নির্ভরযোগ্য নয়; কেবল শাস্ত্রের জ্ঞানই ভরসা করার মত।
এই যুক্তিটির দুটো স্টেপ।
এক, স্বপ্নে বা হ্যালুসিনেশনে কোন বস্তুর অস্তিত্ব নিয়ে যে অনুভুতি হয় সেটা মিথ্যে বা ধোঁকা । দুই, কাজেই বস্তুজগতের অস্তিত্বের ব্যাপারে যত প্রত্যক্ষানুভুতি সব ওই স্বপ্নের মত মিথ্যে বা ধোঁকা।‘এ সংসারটা ধোঁকার টাটি’(কথামৃত)।
উত্তরপক্ষে আমাদের দুটো আপত্তি।
এক, কয়েকজন মিথ্যে সাক্ষী দিয়েছে। তার মানে কি আদালতে সবার সাক্ষ্য মিথ্যে? কোন কোন পুলিশ ঘুষ খেয়েছে। তারমানে কি সব পুলিশ ঘুষ খায়?
দুই, স্বপ্নের অনুভুতিকে মিথ্যা বলছ কিসের ভিত্তিতে? তার মানে জাগ্রত অনুভূতিকে সত্যি বলে মানছ। একটাকে সত্যি্ না বললে আরেকটাকে মিথ্যে বলছ কী করে?তোমরা তো স্বপ্নের উদাহরণ দিয়ে সব অনুভূতিকেই খারিজ করে দিচ্ছ।
মহা-পূর্বপক্ষঃ মূল পয়েন্ট মিস করছ। তুমি জেগে আছ নাকি ঘুমিয়ে রয়েছ তাই বা বুঝছ কেমন করে? হতে পারে যে এই বিতর্কটি স্বপ্নের ঘোরে করছ? স্বপ্ন এবং জাগ্রত দুটো অবস্থার অনুভূতিতে এত মিল যে ফারাক করা মুশকিল। হতে পারে যে বিশ্বে তুমি রয়েছ সেটা স্বপ্নের দুনিয়ায় অবস্থিত। আসল বিশ্ব ব্রহ্মজ্ঞান হলে চিনতে পারবে।
‘গোরী চুনরিয়া আত্মা মোরী মৈল হ্যায় মায়াজাল।
ও দুনিয়া মোর বাবুলকে ঘর, এ দুনিয়া শ্বশুরাল’।।
মহা-উত্তরপক্ষঃ
এক, স্বপ্নে অনুভূতির সময় অপেক্ষিত ইচ্ছেপূরণ(সুখপ্রাপ্তি বা বেদনার উপশম)হয় না। জাগ্রত অনুভূতিতে সেটা হয়।এটা দিয়ে তফাৎ বোঝা যায়।যেমন স্বপ্নে গেলাস গেলাস জল খেলেও তেষ্টা মেটে না। জেগে উঠে জল খেলে মেটে।
দুই, ন্যায়শাস্ত্র অনুযায়ী একটি প্রমাণ পরবর্তী কোন ওজনদার বিপরীততথ্য বা প্রমাণের জোরে খারিজ না হলে তাকে সত্য বলে মানতে হবে। যেমন স্বপ্নের অনুভূতিকে জাগ্রত অনুভূতি খারিজ করে দেয়। তারপর যদি কোন অনুভূতি জাগ্রত অনুভূতিকে খারিজ না করে তাহলে বুঝতে হবে দ্বিতীয় অনুভূতিটি সত্যি, মানে জেগে আছি। একে বৌদ্ধ দার্শনিক শুভগুপ্ত বলছেন ‘অবিসম্বাদদৃষ্টি’।
পূর্বমীমাংসার কুমারিল ভট্টের মতে ‘স্বাভাবিক জাগ্রত অবস্থায় আমরা বাহ্যজগতের ব্যাপারে যা অনুভব করি তা’ সত্যি। কারণ এটা এমন জ্ঞান যাকে অন্য কোন পরবর্তী জ্ঞান এসে খারিজ করেনি। যেমন জাগ্রত অবস্থার অনুভূতি স্বপ্নের অনুভূতিকে খারিজ করে।
(চলবে)