

৬.০ উপসংহার
এতক্ষণের আলোচনার ভিত্তিতে এটা দেখতে পাচ্ছি যে শংকরের মায়াবাদের মেটাফিজিক্যাল স্ট্রাকচার বা অন্টোলজি বেশ গোলমেলে। সোজাসুজি মায়াকে ব্রহ্মের শক্তি এবং বিশ্বব্রহ্মান্ডকে তাঁর সচেতন ইচ্ছার ফল বললে মডেলটা বেশ আঁটোসাটো হত। কিন্তু উনি আনলেন এক অতিরিক্ত ধারণা ‘অবিদ্যা’ যে ব্রহ্মের মতই অনাদি কিন্তু ব্রহ্মের অংশ বা মহিমা নয়। অথচ সে এমন শক্তিশালী যে চেতনাকে আবিল করে গোলাপি হাতি দেখাতে পারে। সে বাস্তব(সৎ) বা অবাস্তব কোনটাই নয়। সে যে কী তাও পরিভাষায় ধরা গেলনা।
এই অবিদ্যা একদিকে শংকরের মায়াবাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, আরেকদিকে এটাই তাঁর দর্শনের,আমার মতে, অ্যাকিলিস হীল’।
জ্ঞানতত্ত্বের কথা বললে উনি যুক্তির ব্যাপারে মুশকিলে পড়লে শাস্ত্রবাক্যের দোহাই দিয়ে এড়িয়ে গেছেন। কিন্তু অন্যান্য স্কুলের আস্তিকেরা দেখিয়েছেন যে তাঁর ব্যাখ্যাই উপনিষদের শ্লোকগুলোর সর্বমান্য ব্যখ্যা নয়।‘অবিদ্যা’ শব্দটি উপনিষদে নেই।
তাহলে কি এটি শংকরের নিজস্ব ইন্টেলেকচুয়াল সংযোজন? তা’নয়, এই নামপদ এবং দৃষ্টিবিভ্রম, দুই সত্য ও স্বপ্নের উদাহরণ আগেই ভারতীয় দর্শনের আঙিনায় এসে গেছল, যদিও বৈদিক সাহিত্যে নয়।
এনেছিলেন মহাযানী বুদ্ধিজমের দুই দিকপাল দার্শনিক -নাগার্জুন (শূন্যবাদ) এবং বসুবন্ধু (বিজ্ঞানবাদ)। এবং তাঁরা ও ধর্মকীর্তি শংকরের কয়েক শতাব্দী আগে ওই প্রশ্নগুলোকে নিজের নিজের অবস্থান থেকে ভালভাবে পেশ করেছিলেন।
আরেকটি কথা। শংকর বারবার মনুস্মৃতিকে বিশেষ সম্মান দিয়েছেন। তাই শাস্ত্রকে সঠিক জ্ঞানের একমাত্র উৎস(শাস্ত্রয়োনিত্যাৎ) বলেও মনুর কথা মেনে সমাজের খেটে খাওয়া বড় অংশ শূদ্রদের ওই জ্ঞানচর্চা থেকে বঞ্চিত রাখার বিধান দিয়ে গেছেন। কারণ যাদের উপনয়ন-সংস্কার হয় না (শূদ্র ও সমস্ত বর্ণের নারীরা)তারা বেদপাঠের অধিকারী নয়।
শুধু তাই নয়, মনুস্মৃতি মেনে অনুমোদন করছেন যে শূদ্র যদি কান দিয়ে বেদ শোনে তবে শাস্তিস্বরূপ তার কানে গরম সীসে ঢেলে দিতে হবে, বলা বাহুল্য অন্য শাস্তিও অনুমোদিত- “শ্রবণাধ্যয়নার্থপ্রতিষেধাৎ শৃতেশ্চ”।
আমার প্রশ্ন যদি সবই ব্রহ্মময় হয়, যদি ব্রহ্মের সঙ্গে নম্বুদ্রিব্রাহ্মণ শংকরাচার্য্য ও শূদ্রের কোন ভেদ না থাকে তাহলে তাদের জ্ঞানপ্রাপ্তির প্রচেষ্টায় শাস্তি দেওয়ার বিধান কেন? তাহলে কি ব্যবহারিক দুনিয়া শংকরাচার্য্যের জন্যেও বিশেষভাবে অস্তিত্ববান?
আর দার্শনিক স্তরে যদি জাগ্রত ও স্বপ্নের দুনিয়ার মধ্যে ফারাক করা কঠিন হয় এবং সর্পে রজ্জুভ্রমেরও সমান সম্ভাবনা থাকে, তাহলে ব্যবহারিক দুনিয়া যে সত্যি এবং পারমার্থিক দুনিয়া স্বপ্নবৎ হবে না সেটা কে বলতে পারে?
(চলবে)