

দণ্ডবিধি ও পদ্ধতি নিয়ে দু’চারটে কথাঃ
স্কুলে আমার বাংলার মাস্টারমশায় ক্লাসে একটা লিকলিকে বেত এনে দোলাতে দোলাতে শোনাতেনঃ
‘বেত্রবিদ্যা বেত্রপাঠ বেত্র চমৎকার,
ইহার দেখিবে সবে মহিমা অপার’।
সে মহিমা আমরা যথাসময়ে টের পেতাম।
দেখা যাচ্ছে মহর্ষি মনু ও আমার সেই মাস্টারমশায় একই গোত্রের। ইনিও দন্ডের মহিমায় বিশ্বাসী। রাজার শাসনের মূল নীতি হিসেবে ওই চারটে মানে সাম-দান-দন্ড-ভেদের কথা বললেও তাঁর বিশেষ ভরসা ছিল ডান্ডা চালানোয়।
সপ্তম অধ্যায়ের গোড়াতেই আছে রাজশাসনে দন্ডের মহিমা।
দন্ড সকল লোককে শাসন করে, দন্ডই রক্ষা করে। লোক নিদ্রিত থাকলে দন্ড জাগ্রত থাকে; পন্ডিতগণ দন্ডকে ধর্ম বলেছেন(৭/১৮)।
বিবেচনাপূর্বক প্রযুক্ত দন্ড সকল প্রজার মনোরঞ্জন করে। কিন্তু অবিবেচনাপূর্বক প্রযুক্ত হলে সব দিক নষ্ট করে(৭/১৯)।
বিষয়াভিলাষী, ক্রোধপরায়ণ, ছলান্বেষী রাজা দন্ড দ্বারাই নিহত হন(৭/২৭)।
পৃথিবীতে সকল লোক দন্ডের বশীভূত।শুচি লোক সত্যি দুর্লভ। দন্ডের ভয়েই লোকে সমগ্র জগৎ ভোগ করতে সমর্থ হয়(৭/২২)।
রাজাদের জন্যে আরও বলা আছেঃ
রাজা বকের ন্যায় বিষয়সমূহের চিন্তা করবেন, সিংহের ন্যায় পরাক্রম করবেন, নেকড়ে বাঘের মত অপহরণ করবেন এবং বিপরীত পরিস্থিতিতে খরগোসের মত পালিয়ে যাবেন (৭/১০৬)।
ক্ষাত্রধর্ম বোঝাতে গিয়ে মনু বলছেনঃ রাজা কখনও নিদ্রিত, বর্মহীন, উলঙ্গ, নিরস্ত্র, যে শুধু দর্শক যুদ্ধ করছে না এবং অপরের সঙ্গে যুদ্ধরত ব্যক্তিকে হত্যা করবেন না (৭/৯২)।
এই জায়গাটায় থমকে দাঁড়াতে হল। নিরস্ত্র বা অপরের সঙ্গে যুদ্ধরত? নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে ইন্দ্রজিৎ নিরস্ত্র ছিলেন, কিন্তু লক্ষণ তাঁকে ওই অবস্থায় হত্যা করলেন। বালী ও সুগ্রীব দু’ভাই মল্লযুদ্ধ করছিলেন। রাম গাছের আড়াল থেকে বালীকে তিরে বিঁধে বধ করলেন।
এঁরা কি ক্ষাত্রধর্ম জানতেন না? নাকি মনুস্মৃতি ভুল? মৃত্যুর আগে ইন্দ্রজিৎ এবং বালী এঁদের বিরুদ্ধে ক্ষাত্রধর্মের বিপরীত আচরণের অভিযোগই এনেছিলেন।
এবার আমরা মনুস্মৃতির দন্ডনীতির কিছু উদাহরণ তথা মহাপাতক আদি বোঝার চেষ্টা করব।
নারীদের দন্ডঃ
মনু বলছেনঃ স্ত্রীলোকের মুখ সর্বদা শুদ্ধ,(৫/১৩০)।
যাক, এতক্ষণে মেয়েদের সম্বন্ধে একটা ভালো কথা শোনা গেল, নইলে হাঁফ ধরে গেছল!
মুজতবা আলী সায়েব “দেশে বিদেশে”তে লিখেছেন আফগানিস্থানের কোন বিবাহ সভায় স্বর্গীয় এক গান শোনার স্মৃতিঃ ‘সবি আগর, সবি আগর’—। যদি একবার, শুধু একবার প্রিয়ার মুখচুম্বন করতে পেতাম, তাহলে ‘জোয়ান বলম’, আবার নওজোয়ান হতাম।
তবে স্ত্রীসম্ভোগ করলে পুরুষকে স্নান করতে হবে।(৫/১৪৪)। কি গেরো!
কিন্তু বেদবিরোধী পাষন্ডধর্মাবলম্বী, স্বৈরিণী, গর্ভপাতকারিণী , পতিঘাতিনী, মদ্যপায়িনী নারীদের পারলৌকিক ক্রিয়া নিষিদ্ধ, মানে তাদের আত্মার সদগতির জন্যে শ্রাদ্ধশান্তি ইত্যাদি করা যাবে না! (৫/৯০)
কন্যা উচ্চতর বর্ণের পুরুষকে সম্ভোগার্থে ভজনা করলে দন্ডিত হবেনা, কিন্তু নিম্নবর্ণের লোককে ভজনা করলে তাকে ঘরে আটকে রাখতে হবে। (৮/৩৬৫)।
কোন পুরুষ যদি স্বজাতির কোন কন্যার যোনিতে দর্পভরে অঙ্গুলি প্রক্ষেপ করে তবে তার দুটো আঙ্গুল কেটে ফেলা হবে এবং ৬০০ পণ দণ্ড দিতে হবে(৮/৩৬৭)।
কিন্তু মেয়েটি ইচ্ছুক হলে আঙুল কাটা যাবেনা, শুধু ২০০ পণ দন্ড হবে(৮/৩৬৮)।
কিন্তু কন্যাই যদি অন্য কন্যাকে অঙুলিপ্রক্ষেপে দুষিত করে তবে তার ২০০ পণ দন্ড হবে, ৪০০ পণ বাবাকে দেবে এবং দশ ঘা’ বেত খাবে।(৮/৩৬৯)।
কোন স্ত্রীলোক যদি কন্যাকে অঙ্গুলি প্রক্ষেপ দ্বারা দুষিত করে তবে তার দুই আঙুল কেটে মাথা মুড়িয়ে গাধায় চড়িয়ে ঘোরান হবে(৮/৩৭০)।
ব্যভিচারিণী স্ত্রীকে স্বামী একটি ঘরে বন্ধ করে রাখবেন এবং পরদারগমনে পুরুষের যা প্রায়শ্চিত্ত তা তাকে করাবেন(১১/১৭৬)।
মহাপাতক কাকে বলে?
ব্রাহ্মণহত্যা, (নিষিদ্ধ) সুরাপান, ব্রাহ্মণের সোনাচুরি, গুরুদারগমন (গুরু হওয়ার অধিকার শুধু ব্রাহ্মণের, অতঃ ব্রাহ্মণীগমন) এবং এই চার পাতকের দোষীর সঙ্গে সম্পর্ক (১১/৫৪)।
ব্রাহ্মণের বেদ ভুলে যাওয়া, বন্ধুকে হত্যা করা, জাল সাক্ষ্য দেয়া, অখাদ্য খাওয়া এসব মদ খাওয়ার মতই মহাপাতক।(১১/৫৬)
(অগম্যা-গমন) যেমন সহোদরা ভগিনী, কুমারী, চন্ডালী ও বন্ধুপত্নীতে শুক্রনিক্ষেপ গুরুদারগমন তুল্য।(১১/৫৮)।
গোহত্যা কি মহাপাতক নয়?
না ; গোহত্যা উপপাতক বা গৌণপাপ যার এক লম্বা লিস্টি রয়েছে। যেমন, পরদারগমন, বিনা মৈথুন কোন কন্যার যোনিতে অঙ্গুলি প্রক্ষেপ, বৌকে বেশ্যাবৃত্তি করিয়ে জীবিকার্জন, সুদের পয়সায় জীবনযাপন, পড়ানোর জন্যে মাইনে নেয়া ও দেয়া, বাপ-মা-বৌ-ছেলেমেয়েকে ত্যাগ করা, নিষিদ্ধ দ্রব্যের ভক্ষণ, চুরি, ঋণ শোধ না করা, গবাদিপশুর অপহরণ, মদ্যপায়ী স্ত্রী অভিগমন, নারী-শূদ্র-বৈশ্য-ক্ষত্রিয় হত্যা, নাস্তিকতা আদি প্রায় ৬০টি(১১/৬৬, ৬৭)।
এছাড়া ব্রাহ্মণকে লাঠিপেটা, অখাদ্য ও মদের ঘ্রাণ নেয়া এবং পুরুষের সঙ্গে মৈথুন করলে নিজের জাত যায় (১১/৬৭)।
বোঝাই যাচ্ছে, ধারা ৩৭৭ যখন ক্রিমিনাল অ্যাক্ট রইল না তখন বিভিন্ন চ্যানেলে অনেক গেরুয়াধারী কেন এর নিন্দে করেছিলেন।
মহাপাতকের প্রায়শ্চিত্তঃ
অন্য জাতির কেউ ব্রহ্মহত্যা করলে মৃত্যুদন্ড। কিন্তু ব্রাহ্মণ যদি ব্রহ্মহত্যা করে?
অজ্ঞাতসারে করলে হয় পর্ণকুটির বানিয়ে হত ব্যক্তির বা অন্য কারও করোটি নিয়ে ভিক্ষা করে ১২ বছর বনবাস করবে।(১১/৭২)। অথবা অশ্বমেধ, বিশ্বজিৎ বা আরও অনেকগুলো যজ্ঞ করবে(১১/৭৪), অথবা এই ধরণের নানা কৃচ্ছসাধন করে পাপমুক্ত হবে। যেমন ১২ বছর ধরে স্ত্রীসম্ভোগাদি রহিত হয়ে হবিষ্যান্ন খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে পাপ মুক্ত হবে।(১১/৭৭, ৭৮, ৭৯)।
জ্ঞাত সারে ব্রহ্মহত্যা করলে ব্রাহ্মণকে এর দ্বিগুণ প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে(১১/৮৯)।
চোরে ব্রাহ্মণের স্বর্ণ এবং সর্বস্ব হরণ করলে সেই ধন উদ্ধারের জন্য দরকার হলে তিনবার যুদ্ধ করে (অকৃতকার্য হলেও) হৃত ধন বা তার সমপরিমাণ ধন ব্রাহ্মণকে দিয়ে রাজা পাপমুক্ত হবেন।(১১/৮০)।
সুরা হল অন্নের মল এবং মল পাপস্বরূপ, তাই ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য সুরাপান করবেন না। (১১/৯৩)
সুরাপান করলে দ্বিজের (উক্ত তিনবর্ণের)অন্যতম প্রায়শ্চিত্ত হল জ্বলন্ত সুরাপান করে নিজদেহ দগ্ধ করে পাপমুক্ত হওয়া বা জ্বলন্ত গোমূত্র, জল দুধ, ঘি ও গোময়জল মৃত্যু পর্যন্ত পান করা(১১/৯১)।
মনে হয়না ব্রাহ্মণ ভিন্ন এই বিধি নিষেধ কেউ মেনে চলতেন। কোন পুরাণে সুরাপান মহাপাতক বা নিষিদ্ধ বলে চোখে পড়েনি।
গুরু্দারগমন বা গুরুপত্নী গমন হল মহাপাতক।
দোষী পাপ ঘোষণা করে উত্তপ্ত লৌহশয্যায় শোবে,জ্বলন্ত লৌহনির্মিত স্ত্রী-প্রতিকৃতি জড়িয়ে ধরে মৃত্যুর মধ্যে শুদ্ধ হবে।(১১/১০৩)।
অথবা নিজ লিঙ্গ ও অন্ডকোষ ছেদন করে অঞ্জলিতে নিয়ে শরীরপাত না হওয়া পর্যন্ত সোজা নৈঋত দিকে গমন করবে(১১/১০৪)।
পুরাণকথা অনুযায়ী দেবগুরু বৃহস্পতির স্ত্রী তারার(গুরুদারা) সঙ্গে ছাত্র চন্দ্রের প্রণয় জন্মিয়াছিল। দুইজনে ইলোপ করিয়াছিলেন। তারপর কি হইল জানে শ্যামলাল!
(মাইকেল রচিত বীরাঙ্গনা কাব্যে ‘চন্দ্রের প্রতি তারা’ নামক পত্রকবিতা দ্রষ্টব্য)।
উপপাতক গোহত্যার প্রায়শ্চিত্ত
গোহত্যাকারী একমাস যবের মাড় খাবে, মাথা মুড়িয়ে দাড়িগোঁফ কামিয়ে নিহত গাইয়ের চামড়ায় গা ঢেকে গোচারণ ভুমিতে বাস করবে(১১/১০৮)।
দ্বিতীয় মাসে গোমূত্র দ্বারা স্নান করবে, সংযতেন্দ্রিয় হয়ে একদিন উপোস করে দ্বিতীয় সন্ধ্যায় হবিষ্যান্ন খাবে।(১১/১০৯)।
এভাবে তৃতীয় মাস পর্যন্ত দিনে গাভীদের পেছন পেছন যাবে, দাঁড়িয়ে তাদের খুরের ধূলির স্বাদ নেবে তাদের সেবা করে ও নমস্কার করে রাত্রে বীরাসনে বসবে।
এভাবে তিনমাসে গোহত্যাজনিত পাপ দূর করে তিনি বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণকে একটি বৃষ ও দশটি গাভী (দক্ষিণাস্বরূপ) দেবে। গাভী না থাকলে ব্রাহ্মণকে সর্বস্ব দেবে(১১/১১৫, ১১৬)।
উপসংহার
আমরা দেখলাম মহর্ষি মনু কোথাও গরুকে মাতা বলেননি। গো-হত্যাকে মহাপাতক বলেননি, গোহত্যাকারীকে মৃত্যুদন্ডের বিধান দেননি।আবার বৃহদারণ্যক উপনিষদে দেখছি ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য গরুকে গোধন বলছেন। সর্বত্র দেখছি গরু সম্পত্তির একক। মহাভারতে বিরাট পর্বে ‘উত্তর গোগৃহ’ রণে গরু লুঠেরাদের থেকে বিরাট রাজার কয়েক হাজার গরুকে বাঁচাতে অর্জুন (বৃহন্নলা) গান্ডীব তুলে নিলেন।
গরু মাতা হলে কি তাকে বিক্রি করা বা দান দেয়া যায়?
এই রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ‘হিন্দুত্ব’ ধারণার প্রণেতা সাভারকর কখনই গরুকে মাতা বলতে রাজি হননি। বলেছেন চারপেয়ে পশুটি উপকারী, কিন্তু আমার মা হবে কি করে? তাহলে কোন শাস্ত্রের দোহাই দিয়ে গরু গোমাতা হচ্ছে বা তার বধের জন্যে মানুষের প্রাণ নেয়া হচ্ছে?
(চলবে)
স্বপন সেনগুপ্ত ( ঝানকু ) | 223.185.***.*** | ০৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ২৩:১৪736396
অরিন | 122.15.***.*** | ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৩:৪৯736400
dc | 2401:4900:915f:de9a:ec9e:cf94:5a8a:***:*** | ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ১১:৩৪736408
অরিন | 122.15.***.*** | ০৪ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৪:৩০736415