

শংকরাচার্য্যের মায়াবাদঃ ধারে কাটে কি ভারে!
১.০ প্রস্তাবনা
আজ যখন গোটা দেশ জুড়ে ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নামে কেবল হিন্দুধর্ম, এবং একপেশে ভাবে তার একটা খন্ডিত বিকৃত রূপের প্রচার হচ্ছে তখন একটা কথা বারে বারে হাটেবাটে শোনা যাচ্ছে, তা’হল ‘সনাতন হিন্দুধর্ম’। কাজেই জরুরি হয়ে পড়েছে ওই ‘সনাতন হিন্দুধর্ম’ নামপদটির প্রচারক শংকরাচার্য্যের দার্শনিক উপস্থাপনা ‘মায়াবাদ’ কতটা যুক্তির কষ্টিপাথরে টেঁকে সেটা খুঁটিয়ে দেখা।
মনে করুন, আগামিকাল অফিসে গিয়ে দেখলেন সব কিছু বদলে গেছে। ওটা আর আপনার চেনা অফিস নেই, হয়ে গেছে একটা রেস্তোরাঁ বা মল; - কেমন লাগবে? ছিল রুমাল, হয়ে গেল বেড়াল! গিয়ে জানতে পারলেন আসলে কোন একটা ভুলে আপনি ভুল নামে ভুল ঠিকানায় ভুল অফিসে এতদিন চাকরি করেছেন। এমনকি আপনি এতদিন নিজেকে যা ভাবতেন আদতে তাও নন। আপনার নাম-গোত্র-পিতৃমাতৃ পরিচয় সব আলাদা। কোথাও কম্পিউটারে আপনার বায়োডেটা, আইডিনটিটি, সিভি সব পালটে গেছে।
এতদিন ঘুমঘোরে ছিলেন, এখন জেগে উঠলেন। তারপর? হয় পাগল হয়ে যাবেন, নয় আত্মহত্যা করবেন!
আরেকটা তৃতীয় পথ খোলা আছে- জানতে চাইবেন আসলে আপনি কে? কোনটা আপনার সঠিক পরিচয়—আগের আপনি, নাকি আজকের? কিন্তু আগে তো ঠিক করতে হবে সঠিক/বেঠিক মাপার পদ্ধতি কী হবে, কী করে বোঝা যাবে কোনটা ভুল বা কোনটা নিশার স্বপন? তাও নাহয় হল, এরপরে জানতে চাইবেন এই বিভ্রমের জন্যে দায়ি কে? আপনি নিজে? নাকি অন্য কেউ? যদি নিজে হন, তো এর কারণ কি আপনার মধ্যেই নিহিত, যেমন ব্রেনে টিউমার বা চোখে ছানি-অথবা বাইরের কোন শক্তি যা আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে?
এই তৃতীয় পথটি দর্শনের ছাত্রের পথ।
এতসব ভণিতা কেন করছি? কারণটা হল ভারতে বেদে আস্থাবান ছ’টি ‘আস্তিক’ দর্শনের মধ্যে একটি ঠিক এমনই কথা বলছে—ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা। বলছে আপনার চারদিকের যে নামরূপের জগৎ তা’ আসলে অস্তিত্বহীন, একটা বিভ্রম বা মিথ্যে। ঠিক যেমন আলো-আঁধারিতে আমরা রজ্জুতে সর্প দেখে আঁতকে উঠি বা মরুভূমির উত্তপ্ত বালুতে সরোবর দেখে খুশি হই। একটু পরে ভুল ভেঙে যায়।
এই দর্শনটির নাম অদ্বৈত বেদান্ত বা উত্তরমীমাংসা। এর প্রবক্তা হলেন আদি শংকরাচার্য, যদিও এই দৃষ্টিভঙ্গী ওঁর আগে বেদবিরোধী বৌদ্ধদর্শনের মহাযানী শাখার দুটি স্কুল—শূন্যবাদ ও বিজ্ঞানবাদে বিকশিত হয়েছে।তাই ওঁর অদ্বৈত বেদান্ত মতকে অনেকে ‘প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধমত’ও বলে থাকেন।
এই দর্শনটি নিয়ে কথা বলার দুটি কারণ।
এক, ভারতে হিন্দু সমাজে সনাতন ধর্মচর্চার আজ সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক স্কুল হল এই অদ্বৈতবেদান্ত, যদিও এর চর্চা মুষ্টিমেয় লোকের মধ্যে সীমাবদ্ধ। আম জনতা এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে জগতকে সত্যি ধরে নিয়ে নানা পালপার্বণে মেতে থাকে, কিন্তু এর দার্শনিক প্রভা থেকে ঠিকরে পড়া কিছু চকমকির সামনে—যেমন ব্রহ্ম সত্য, জগত মিথ্যা; ব্রহ্ম হলেন ‘অবাঙ্মনসগোচর’, অর্থাৎ বর্ণনা এবং ধরাছোঁয়ার বাইরে-নির্বিচারে মাথা ছোঁয়ায়।
দুই, এই দর্শনের মূল কথাটা—‘এ সংসারটা ধোঁকার টাটি’ যদি মেনে নেই তাহলে আমাদের দেশ-কাল-সমাজ-ইতিহাস, আমাদের সুখ-দুঃখ, দৈনন্দিন জীবনসংগ্রাম সব তুচ্ছ অকিঞ্চিৎকর হয়ে যায়। আমাদের বেঁচে থাকা অর্থহীন হয়ে যায়। ‘কা তব কান্তা, কস্তে পুত্রাঃ’ অর্থাৎ ‘কে তোমার প্রিয়া, কে তোমার সন্তান’ ভাবলে আমাদের বাস্তব জীবনে দুঃখের নিদান খোঁজা অর্থহীন।যখন বাস্তবে বাহ্যজগতের অস্তিত্বই নেই তবে কিসের দুঃখ, কিসের জীবনসংগ্রাম? মাথাই নেই তো মাথাব্যথা!
মানুষ এই জীবনকে একটা স্বপ্নের ঘোরে থাকা ধরে নিয়ে অপেক্ষা করবে কবে তার মোহমায়া থেকে মুক্তি মিলবে।
কাজেই একটু খুঁটিয়ে দেখতে চাই যে শংকরের ‘মায়াবাদ’ দার্শনিক স্তরে কতটা যুক্তিসম্মত। কীভাবে দেখব?
২.০ আমাদের খুঁটিয়ে দেখার পদ্ধতি
২.১
আমরা প্রথমে দেখব মায়াবাদের মূল ধারণা এবং বৈশিষ্ট্যের বর্ণনা কোন পারস্পরিক সংগতিপূর্ণ অর্থ বহন করে কিনা। অর্থাৎ, মায়াবাদ বলতে শংকর যা বলছেন সেটা কি সাধারণ যুক্তি-বুদ্ধির অগম্য? অথবা একটি যুক্তিপূর্ণ অন্তর্বিরোধহীন ধারণা। সোজাকথায় এর সংজ্ঞার কাঠামোটি বা ontological status কতটুকু মজবুত বা নড়বড়ে।
তারপরে আমরা দেখব এর জ্ঞানতত্ত্বের(epistemology) দিকটি; অর্থাৎ এই তাত্ত্বিক মডেল দাঁড় করাতে গিয়ে শংকর কোন পদ্ধতিকে প্রমাণ মেনেছেন এবং তার সংগতি/অসংগতির মাত্রা(degree of consistency)। এরপরে দেখব ভারতীয় ন্যায়দর্শনের যে প্রমাণশাস্ত্র বা লজিক তার অন্য কোন মাপদণ্ডে এই মডেল বাধিত হচ্ছে কী?
২.২
উপনিষদ ঠিক রীতিবদ্ধ দার্শনিক বিতর্কের গ্রন্থ নয়। তাতে বিভিন্ন আখ্যানের মধ্যে দিয়ে নানান দার্শনিক এবং কখনও কখনও পরস্পর বিরোধী উক্তি ও বিচার রয়েছে। কিন্তু উপরোক্ত বেদকে প্রামাণ্য মানা ছয়টি আস্তিক দর্শনের প্রত্যেকের নিজস্ব সূত্র গ্রন্থ রয়েছে। যেমন সাংখ্যসূত্র, ন্যায়সূত্র, মীমাংসাসূত্র, ব্রহ্মসূত্র ইত্যাদি। তার আবার টীকাটিপ্পনির গ্রন্থগুলোর নাম ভাষ্য বা কারিকা,তার আবার মেড ইজি হল বর্তিকা এবং দীপিকা। এই গ্রন্থগুলোতে প্রত্যেক দার্শনিক স্কুলের নিজস্ব মতের বর্ণনা(অন্টোলজি), তারা প্রমাণ এবং ভ্রান্তি বলতে কী বোঝেন( এপিস্টেমোলজি) এবং বিরোধীমত(পূর্বপক্ষ) ও বিরুদ্ধমত খন্ডন(উত্তরপক্ষ) স্পষ্ট ভাবে রয়েছে।
যেমন বেদান্ত বা উত্তরমীমাংসার আকরগ্রন্থ হল ব্রহ্মসূত্র। আবার এই ব্রহ্মসূত্রের শংকরকৃত অদ্বৈতমতের ভাষ্যের নাম ‘শারীরকভাষ্য’ ও রামানুজাচার্যকৃত বিশিষ্টাদ্বৈত মতের ভাষ্যের নাম ‘শ্রীভাষ্য’।
এই স্বল্প পরিসরের আলোচনায় আমরা এড়িয়ে যাব তৎকালীন বিভিন্ন দার্শনিক স্কুলের সঙ্গে শংকরের ‘পূর্বপক্ষ-উত্তরপক্ষ’ করে টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি বিতর্কগুলি। কিন্তু অনেক জায়গায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কে তাদের থেকে অসংকোচে যুক্তি ধার নেব। সেটুকুই আমাদের ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।
(চলবে)