

ছবি: রমিত
১.০
এ’মাসে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে যা ভারতের সুপ্রীম কোর্টের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ন্যায়মূর্তি গবইকে জনৈক উকিল আদালতের মধ্যে সর্বসমক্ষে জুতো ছুঁড়ে মেরেছে। একাত্তর বছর বয়সী সেই উকিল এই কৃত্যের জন্য বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত নন। বরং বিভিন্ন চ্যানেলে ইন্টারভিউ দিয়ে গর্বের সঙ্গে বলছেন যে তিনি একজন “সনাতনী” হিন্দু। প্রধান বিচারপতির খাজুরাহো মন্দিরে ক্ষতিগ্রস্ত বিষ্ণুমূর্তির সংস্কারের দাবিতে পেশ করা পিটিশন খারিজ করার সময় উনি বলেছিলেন –এটা আদালতের বিচারণীয় বিষয় নয়, বরং ভগবান বিষ্ণুকে বলে দেখ।
তাতে ওই “সনাতনী”র ধর্মীয় আবেগ “আহত” হয়েছে এবং উনি দৈবী শক্তির নির্দেশে দোষীকে শাস্তি দিতে এই কাজটি করেছেন এবং দরকার হলে আবার করবেন।
নিঃসন্দেহে এটা দলিতের প্রতি উচ্চবর্ণের ঘৃণার প্রকাশ। ওই লোকটির সমর্থনে সোশ্যাল মিডিয়ায় যে কুৎসার বান ডেকেছে তার থেকে ছবিটা স্পষ্ট।
না, উনি গ্রেফতার হন নি। বিচারপতি তাঁকে ক্ষমা করে জুতোজোড়া ফিরিয়ে দিতে বলেছেন।
উল্লেখনীয়, ন্যায়মূর্তি গবই স্বাধীন ভারতে প্রথম চিফ জাস্টিস যিনি উচ্চবর্ণের নন, দলিত সমাজ থেকে এসেছেন।
ওনার মাকে আর এস এসের শতবর্ষ পূর্ণ হওয়ার উৎসবে বিশেষ অতিথির সম্মান দিয়ে আমন্ত্রণ করা হয়। কিন্তু উনি সেই আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়ে জানান যে উনি বাবাসাহেব আম্বেদকরের চিন্তাধারার অনুগামী। তাই, বিপরীত মতাদর্শের প্রোগ্রামে যেতে অপারগ।
আসুন, আমরা কথিত সনাতনীদের চিন্তার তাত্ত্বিক ভিত্তিগুলোকে একটু নেড়েচেড়ে দেখি। আমাদের আলোচনার ভিত্তি হবে মনুস্মৃতি, মায়াবাদ, গীতায় যুদ্ধের নৈতিক যুক্তি এবং সাভারকরের সনাতনী হিন্দুত্বের ধারণা।
২.০
আমাদের দেশে প্রচলিত সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হল হিন্দুধর্ম। স্বাভাবিক ভাবেই কয়েক হাজার বছরের কালখণ্ডে পরিবর্তনশীল সময় ও জীবনযাপনের ধারার অভিঘাতে এতে এসেছে নানা পরিবর্তন। গড়ে উঠেছে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও বিচারধারা এবং সকলেই হিন্দু। আব্রাহামিক ধর্মগুলোর (ইহুদী, খৃস্ট ও ইসলাম) বিপরীতে এতে কোন একটি বই, এবং এক অবতারকে একমাত্র মান্য বলা হয় নি।
চিন্তার ক্ষেত্রে বেদকে প্রামাণ্য মেনেছে ছয়টি দার্শনিক বিচারধারা (ষড়দর্শন), কিন্তু তাদের মধ্যে সাংখ্য, যোগ, ও পূর্ব মীমাংসা প্রমাণের অভাবে কোন ঈশ্বর নামক সৃষ্টিকর্তায় আস্থাবান নয়। ন্যায় ও বৈশেষিক ঈশ্বরকে সৃষ্টির জন্য কেবল গৌণ বা নিমিত্ত কারণ মনে করে। আদি কারণ বা উপাদান কারণ মনে করে না।
কিন্তু বর্তমানে হিন্দুধর্মের একটি একপেশে মনগড়ন্ত ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়ে সেটাকেই একমাত্র খাঁটি হিন্দুধর্ম বলে প্রচার করা হচ্ছে। এই ব্র্যান্ডটি মূলতঃ নিষেধাত্মক। হিন্দু পরিচয়কে এঁরা দাঁড় করিয়েছেন নেহাত আচারসর্বস্বতায়। যেমন নবরাত্রিতে মাছ-মাংস খাওয়া চলবে না। জোর করে সবাইকে কিছু নির্ধারিত শ্লোগান দিতে হবে। এবং অন্য ধর্মের লোককে চিহ্নিত করে মন্দির, পুজাস্থল, সাংস্কৃতিক আয়োজন এবং খাবার জায়গা থেকে দূরে রাখতে হবে।
দু’হাজার বছর আগের ভারতে প্রচলিত মনুসংহিতার গুণগান করা হচ্ছে। মূলতঃ ব্রাহ্মণ্যধর্মের গুণগান ও জাতি হিসেবে ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করা মনুসংহিতাকে আজকের আচার-আচরণের মাপকাঠি বলা হচ্ছে। ফলে দলিতদের প্রতি ঘৃণা বেড়ে চলেছে। যদিও মনুস্মৃতিতে কী লেখা আছে কেউ পড়ে দেখেন না।
চিন্তার ক্ষেত্রে আজকের ব্রাহ্মণ্যধর্মের দার্শনিক ভিত্তি হচ্ছে শংকরাচার্যের মায়াবাদ (অদ্বৈত বেদান্ত) আর ধর্মাচরণে হিংসার যৌক্তিকতা নিয়ে ভগবদগীতার উল্লেখ করা হচ্ছে বলা হচ্ছে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রেরণা ছিল গীতা। এমনকি জনৈক নিত্যানন্দ সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি স্বরচিত সংস্কৃত শ্লোককে গীতার শ্লোক বলে প্রচার করছেন। তাতে বলা হচ্ছে অহিংসা পরমো ধর্ম, কিন্তু ধর্মের জন্য হিংসা শ্রেয়ষ্কর।
সত্যিটা হোল এমন কোন শ্লোক গীতাতে নেই। বরং তিনবার বলা হয়েছে “অহিংসা পরমো ধর্ম”।
এছাড়া এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সাভারকরের রাজনৈতিক তত্ত্ব –‘হিন্দুত্ব’ যা সাভারকরের মতে হিন্দুধর্মের থেকে আলাদা। সাভারকর আবার গরুকে মাতা বলে পুজো করাকে ‘বুদ্ধিনাশ’ মনে করেন এবং শাস্ত্রগ্রন্থ কুলুঙিতে তুলে বিজ্ঞান পড়তে বলেন এবং আচারসর্বস্বতার নিন্দে করেন।
এসব সত্ত্বেও আজ এই চারটে তত্ত্বের উপর নির্ভর করে এক ব্রাহ্মণ্যবাদী প্রচারকে সনাতনী হিন্দুধর্ম বলে দাবি করা হচ্ছে।
বর্তমান প্রবন্ধের উদ্দেশ্য এক এক করে চারটেকেই খুঁটিয়ে দেখা—আজকের আধুনিক ভারতের বিকাশে এগুলো কতটুকু উপযুক্ত। সবচেয়ে আগে জানা দরকার মনুস্মৃতিতে কী আছে? মায়াবাদের দার্শনিক ভিত্তি কতখানি মজবুত? শংকরাচার্য দলিতদের ব্যাপারে কী বলেন? গীতায় বর্ণাশ্রম নিয়ে কী বলা হয়েছে? এবং সাভারকরের হিন্দুত্বের তত্ত্ব আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে কতখানি খাপ খায়।
স্বল্প পরিসরে বিবরণ দেয়া হলেও আবশ্যক ফুটনোট এবং শ্লোক সংখ্যার উল্লেখ করা হয়েছে যাতে পাঠক চাইলে যাচাই করে নিতে পারেন। আমার ব্যাখ্যার সঙ্গে সহমত হওয়া জরুরী নয়। দরকার মূল বই পড়া এবং নতুন করে চিন্তাভাবনা করা।
বিতর্ক সবসময় স্বাগত এবং বিতর্ক আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অনুসারী।
সচেতন পাঠক আমার ভুল ধরিয়ে দেবেন এই আশায়—
(চলবে)