

ছবি: রমিত
এক
অশনি সঙ্কেত? কোন আকাশে?
গত সেপ্টেম্বর মাসের শেষে গাড়ির সাজ সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী একটি কোম্পানি ফার্স্ট ব্র্যান্ডস গ্রুপ দেউলিয়া ঘোষিত হয়েছে; মোট দেনার পরিমাণ অ্যাসেটের তুলনায় বহু গুণ অধিক। তাদের ব্যবসা মোটর গাড়ির স্পার্ক প্লাগ থেকে ওয়াইপার ব্লেড অবধি যাবতীয় অটো পার্ট সরবরাহ করা। জন্মসূত্রে ভারতীয় ক্যাথলিক, প্যাট্রিক জেমস মালয়েশিয়াতে পড়াশোনা করে আমেরিকা এসে ওহাইওতে ক্রাউন গ্রুপ নামের এক কোম্পানি স্থাপনা করেন। প্রথম কয়েক বছরের মধ্যে বিশেষ করে সাব প্রাইম সঙ্কটের সময়ে বেশ কিছু গণ্ডগোল দেখা যায়; কিন্তু এখান ওখান থেকে টাকা জোগাড় করে পাওনাদারদের সামলে নিজের সুনাম বজায় রেখেছে। আবার মঞ্চে নেমে ২০০৮ সালের টালমাটাল বাজারে সস্তায় বেশ কিছু অটো পার্টের কোম্পানি কিনে ওয়াল স্ট্রিটের সুনজরে এলেন- এর পর থেকে তাঁর উত্থান ধূমকেতুর মতন। মিশিগানে তাঁর ফ্ল্যাগশিপ কোম্পানি ফার্স্ট ব্র্যান্ডস গ্রুপের অফিসের ওয়েটিং রুমে ব্যাঙ্কারদের ভিড়। নিজেদের ব্যাল্যান্স শিটের শক্তিতে নয়, ব্যাঙ্ক বা অন্যান্য ঋণদাতার কাছে পেশ করেছেন তাঁদের পার্টস বিক্রির ফিরিস্তি, ইনভয়েস। যে মাল বিক্রি হয়েছে তার মূল্য ক্রেতা শোধ করবে তিন মাস, ছ মাসের কড়ারে। ধার নেবে ফার্স্ট ব্র্যান্ডস, শোধ হবে পার্টস কেনার খদ্দেরের টাকায়; অফ ব্যাল্যান্স শিট ফাইনান্সিং। মাস কয়েক আগে ওয়াল স্ট্রিটের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কিঙ্গের অন্যতম স্তম্ভ জেফেরিস এই কোম্পানির জন্য ছ বিলিয়ন ডলার তুলতে বাজারে নেমেছিল, খানিক খুঁটিয়ে দেখা গেল হিসেব পত্রে অনেক গোঁজামিল, ফার্স্ট ব্র্যান্ডস ধারের আসল পরিমাণ এগারো বিলিয়নের ডলারেরও বেশি। কেমন করে যেন জে পি মরগ্যান, জেফেরিস এগুলো গত ছ বছরে লক্ষ করেনি; ডাবলিন ব্রাসেলস ব্যাংকক টোকিওর যে নিবেশক এইসব প্যাকেজড প্রোডাক্ট কিনে থাকেন তাঁরা ধরে নেনে কাগজপত্র পড়ে দেখার কাজ ব্যাঙ্কারদের।
মায়ামি ইউনিভারসিটির অ্যাথলেটিক অ্যাডমিনিসট্রেশনের মাস্টার ডিগ্রি পাওয়ার পর ড্যানিয়েল চু ডালাসে ট্রিকলর অটো অ্যাকসেপট্যানস এল এল সির ( লিমিটেড লায়াবিলিটি ) পত্তন করেন ২০০৭ সালে। কোম্পানি শুধু গাড়ি বেচে না, তার জন্য অর্থও সরবরাহ করে; তাদের মটো ‘ বাই হিয়ার, পে হিয়ার ‘ (BHPH)। তার আয়ের সূত্র একাধিক - গাড়ি বিক্রির কমিশন, ফাইনান্সিঙ্গের ফি এবং ধারের ওপরে সুদ। গাড়ির দাম যদি দশ হাজার ডলার, এক দেড় হাজার জমা দিয়ে আপনি নতুন বাহনটি নিজের গ্যারাজে তুলতে পারেন;বাকি টাকা ধার দেবে ট্রিকলর। ক্রেতার ঋণের যোগ্য কিনা জানতে তাঁরা কোন ক্রেডিট চেকিং সংস্থার দ্বারস্থ হন না, এ কাজ তাঁরা নিজেরাই করেন। ড্যানিয়েল দাবি করেন কাগজে কলমে ঋণ গ্রহীতার আয় ব্যয় কতো, ভাড়া থাকেন না নিজের বাড়ি, বাজারে ধার দেনা আছে কিনা এসব অপ্রয়োজনীয় তথ্যের সন্ধান না করে এই গাড়ি কেনার সূত্রে ট্রিকলর অটো ক্রেতার সঙ্গে যে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তোলে সেটি যে কোন ক্রেডিট রেটিঙের চেয়ে বেশি মূল্যবান। গাড়িটি তো বাঁধা রইল, সুদের হার কুড়ি পারসেন্ট অবধি হতে পারে। এবার ট্রিকলর এল এল সি কিছু ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কের সহায়তায় লোনগুলির প্যাকেজ বানিয়ে ব্যাঙ্ক বা প্রাইভেট ক্রেডিট কম্পানিকে বিক্রি করে দেবে। সহজ বিজনেস মডেল। এইরূপ সুদৃশ্য মোড়কে বাঁধা লোনের বান্ডিল যারা কিনেছিলেন তাঁরা ক্রমশ আবিষ্কার করলেন আশানুরূপ গতিতে ধার শোধ হচ্ছে না; কোনো কোনো গাড়ির লোন দুবার চারবার অবধি একই বণ্ডের ভেতরে ঢোকানো হয়েছে, ডাবল ট্রিপল কোয়াড্রুপল
ফাইনান্সিং। দেখা গেল গাড়ির ক্রেতার ন্যূন আনতে পান্তা ফুরোয় অথবা চাকরি নিয়ে টানাটানি চলছে। গাড়িটি ক্রোক করলেও টাকা শোধ হয় না। বিলিয়ন ঋণের বোঝায় ট্রিকলর দোকানের দরজা বন্ধ করেছে সেপ্টেম্বর মাসে।
নিউ ইয়র্কের ক্যারিওকস লিমিটেড লায়াবিলিটি নামের এক টেলিকম কোম্পানি তাদের প্রাপ্তব্য ইনভয়েস আগাম বেচে প্রভূত ঋণ গ্রহণ করেছিল, গুজরাত গান্ধীনগরের খ্যাতনামা টেলিকম এঞ্জিনিয়ার বঙ্কিম ব্রহ্মদত্ত তার প্রোমোটার। ইন্টারনেট ইউ টিউবে তাঁর যশগাথা গাওয়া হয়ে থাকে – পাঁচশ মিলিয়ন ডলার বাকি রেখে তিনি ফেরার হয়েছেন।
কৃত্রিম মেধার অকৃত্রিম, অকল্পনীয় ভবিষ্যতের স্বপ্ন বেচে চলেছেন কুল্লে চার কি পাঁচ মহারথী, তাঁদের নিজেদের মধ্যেই খেলছেন একটি সার্কুলার গেম, একজন বল ঠেলেন আরেকজনকে তিনি কিক মারেন তৃতীয় খেলোয়াড়ের দিকে; আমেদাবাদ, মুম্বাই বিশেষ করে পোর্ট লুই মরিশাসে এর নাম ‘ঘুমানা’। অকুস্থলে ঠিক কী ঘটছে, স্কোর কী তা এই মহা খেলোয়াড়দের প্রশ্ন করাটা মূর্খতা মাত্র। আপাতত দেখুন শেয়ারের দাম মেঘের সীমানা ছাড়িয়ে নীল আকাশে এঁকে চলেছে ছায়া আলোকের আকুল কল্পনা। আমার মতো কয়েকজন গ্রাম্পি ওল্ড মেন ভাবে, এইতো সেদিন এমনি একটা ইন্দ্রজাল দেখেছিলাম না আন্তরজালের আবছা আলোতে?
এই অবধি পড়ে পাঠক প্রশ্ন করতেই পারেন মিশিগানের কোন অখ্যাত অজ্ঞাত এক স্পার্ক প্লাগ বানানোর কোম্পানি অথবা ডালাসের নাম না জানা গাড়ির হায়ার পারচেজ কোম্পানি তাদের হিসেবের গণ্ডগোলের কারণে দেউলিয়া না হয় হলো, কে এক ব্রহ্মদত্ত কাকে টুপি পরালো তাতে দুনিয়ার অর্থ ব্যবসায়ীদের এমনকি আমাদের মতন আদার ব্যাপারীদের কি এলো গেলো? কৃত্রিম মেধা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তো যাকে বলে গেম চেঞ্জার, সেখানে এই দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী, জ্ঞানী ছটি কোম্পানি সেই গেম খেলছেন। তার শেয়ারের দাম যেখানে যাচ্ছে যাক, স্কাই ইজ দি লিমিট।
তাছাড়া ফার্স্ট ব্র্যান্ডস বা ট্রিকলর যদি এমন গোলমেলে খাতা পত্র লেখে, এমন বেঘোরে না বুঝে শুনে ধার দেয়ই বা কারা? বঙ্কিমের চরিত্র চেহারা কেউ খুঁটিয়ে দেখেনি?
সঙ্গত জিজ্ঞাসা।
প্রথম প্রশ্নের তথ্যগত উত্তর – অনেকের মাথা ব্যথার কারণ এই যে ওয়াল স্ট্রিটের জেফেরিজ আপাতত ৭০০ মিলিয়ন বা সত্তর কোটি ডলারের লোকসান ঘোষণা করেছে; জে পি মরগ্যান কুড়ি কোটি, বারকলেজ ব্যাঙ্ক অন্তত পনেরো কোটি ডলার জলাঞ্জলি দিয়েছে। কয়েকটি আঞ্চলিক ব্যাঙ্ক তাদের খাতায় ফার্স্ট ব্র্যান্ডস ও ট্রিকলরে যে পরিমাণ বকেয়া দেখিয়েছে তাতে শেয়ার হোল্ডাররা ভীত, তাদের শেয়ারের দাম নিম্নগামী। বর্তমান আমেরিকান ব্যাঙ্কিঙ্গের যুগ পুরুষ জেমি ডাইমন দি গ্রিক বলেছেন, লক্ষণ ভালো নয়। লোকসান বাঁচাতে ব্যাপক ভাবে সুদের হার বাড়াতে হবে। ট্রিকলরে কেউ বা সাব প্রাইম ক্রাইসিসের ছায়া দেখেছেন – বাড়ি নয় এবার গাড়ি। তবে গল্পের প্লটটা একই রকমের।
দ্বিতীয় প্রশ্নের সরকারি উত্তর –লোন দেবার জন্য লাইন লাগিয়েছে প্রাইভেট ক্রেডিট, হেজ ফান্ড, প্রাইভেট ইকুইটি, কোল্যাটারালাইজড লোন /ডেট অবলিগেশন ( CLO/CDO সাব প্রাইম হাউসিং সঙ্কটে যাদের বিপুল অবদান দেখা গেছে) – গোল্ডম্যান, জেফেরিজ যা করেন ভেবে চিন্তেই করেন। পিছনে আছেন পেনশন ফান্ড, সমবায় সংস্থা, আপামর জনতা। তাঁরাও সেই সেফটি ইন নাম্বারসে বিশ্বাসী।
তৃতীয়টির বিষয়ে বলতে পারি, আমাদের মতন কিছু ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পায়। এই শতাব্দীর গোড়ায় অনেক মূল্যবান ইন্টারনেট কোম্পানির কাগজকে আমরা ভস্মীভূত হয়ে যেতে দেখেছি। সিটি, মেরিল, লেম্যান গা ঢাকা দেয় নি?
এক জীবনেই দেখলাম গোপাল ভাঁড়ের সেই নিতুই নব বলে কিছু নেই। অতীতের পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে, তার রঙ বদলায়, রঙ্গ বদলায় না। হসরত জয়পুরির কথায়, ইস রঙ্গ বদলতি দুনিয়া মে ইনসান কি নীয়ত ঠিক নহি! একই স্ক্রিপ্টে বার বার ভাঙ্গা গড়ার খেলা দেখতে দেখতে ব্যাঙ্কিং জীবনের পাঁচটা দশক পার হয়ে এলাম। যখন কেউ অর্থনৈতিক আপদ আগত ঐ বলে যদি অ্যালার্ম ঘণ্টি বাজিয়েছেন, অকারণে কুডাক ডেকে জনজীবনে সন্ত্রাস সঞ্চারের অভিযোগে তাঁরা তৎক্ষণাৎ উপেক্ষিত অথবা নিন্দিত হয়েছেন (২০০৫ সালের ২৭শে আগস্ট জ্যাকসন হোলের অধিবেশনে সাব প্রাইম লোনের ওপরে রঘুরাম রাজনের সাবধানবানীতে কেউ কর্ণপাত করে নি )। বাজারে যখন নোট ছাপা হচ্ছে, বাইরে বাজছে তুমুল দামামা, উল্লাসের উচ্ছ্বাস তখন এই বেসুরো বাঁশি শুনবে কে। অগ্নিকাণ্ডের পূর্ব মুহূর্তে দীপের শিখা অসাধারণ উজ্জ্বল। মঙ্গলবার ৩ সেপ্টেম্বর ১৯২৯ ওয়াল স্ট্রিট স্টক ইনডেক্স উঠেছিল তুঙ্গে (৩৮১) আট সপ্তাহ বাদে তার অধোগতির প্রারম্ভ, চলেছিল পুরো চার বছর। যে কোন দামে শেয়ার কেনার লোক যেদিন পাওয়া গেল না, সেটাও মঙ্গলবার, ২৯শে অক্টোবর ১৯২৯। চেনা দুনিয়ার বৃহত্তম মন্দার শুরু। দি গ্রেট ডিপ্রেশন।
পাঠক, আমি দুর্দিনের চারণ, ডুমস ডে প্রফেট নই।দক্ষিণ সিঁথির কাঁটাকল ক্যাম্পাসে মহান অধ্যাপকদের পাদতলে বসে তাত্ত্বিক অর্থনীতির পাঠ নিয়েছি, বুঝেছি সামান্যই। ব্যাঙ্কিংকে পেশা করার সুযোগ যেদিন এলো, আঁকড়ে ধরেছি তাকে; মনে হয়েছে আমার পড়া বিদ্যের ব্যবহারিক প্রতিফলন একমাত্র এই ব্যবসায়, যেটি আমাদের সকলের জীবনকে ছুঁয়ে যায়, প্রত্যহ। দুটো মহাদেশে তিনটে দেশের চারটে ব্যাঙ্কে কাটল কর্মজীবন। আজ সেই দৈনন্দিন চঞ্চলতা থেকে অবসর পেয়ে সারের গ্রামের নিভৃতে বসে পিছন ফিরে তাকালে মনে হয় আমরা যে এত রকমের ভুল ভ্রান্তি করেছি, মানুষের জীবনে এনে দিয়েছি অপ্রত্যাশিত অনর্থ, সে কি জেনে না অজানায়? শেষ অবধি কি আমাদের তাড়িত করেছে একটি মাত্র বাসনা – লোভ?
গ্রিড, ফর দি ল্যাক অফ এ বেটার ওয়ার্ড, ইজ গুড
(গরডন গেকো উর্ফ মাইকেল ডগলাস, ওয়াল স্ট্রিট, ১৯৮৫)
গোলডারস গ্রিন ইউনিটারিয়ান চার্চে একবার একটি দেওয়াল লিখন দেখেছিলাম : উত্তর খুঁজছেন? সব প্রশ্ন যে আমাদেরও জানা নেই!
আমার কর্মকালে প্রতি দশ বছরে দেখেছি অঘটন - ১৯৭৯-৮০র মন্দা, ১৯৮৭ সালের শেয়ার বাজারি ধস, ১৯৯৭/৯৮ সালের রাশিয়ান/ পূর্ব ইউরোপ, পূর্ব এশিয়ান ক্রাইসিস, লং টার্ম ক্রেডিট ম্যানেজমেন্ট নামক প্রথম বিশাল হেজ ফান্ডের বিলুপ্তি, ১৯৯৯-২০০১ ইন্টারনেটের উত্থান পতন, ২০০৭/৮ সালে ভুবন তোলপাড় করা সাব প্রাইম সঙ্কট। একদা এইরূপ আপদ ছিল আঞ্চলিক কিন্তু আজকের পৃথিবী এক অদৃশ্য সূত্রে জুড়ে গেছে - তাই কোভিদের মতন এক দেশের এক প্রকারের রোগের বীজাণু সংক্রমিত হয় সর্বত্র। বন্ডের ঝড় ঝঞ্ঝা ভুবন ফেলে ছেয়ে, দলে দলে মেষ শাবক ধেয়ে চলে গভীর খাদের দিকে।
আজ ২০২৫ সালের শেষে কি আবার অতল জলের আহ্বান কি শুনতে পাচ্ছি?
প্লুই সা শঁজে, প্লুই সে লা মেম শোষ – ফরাসি প্রবাদ
(যতোই বদলাও, বদলায় না কিছু)
অয়মারম্ভ না পুনরারম্ভ?
সিটি ব্যাঙ্কে আমাদের দফতরের কোন গোলযোগ ঘটলে তার ময়না তদন্তের সভায় জো ম্যাকেভিতস জিজ্ঞেস করতেন না এই কাণ্ডটি কে করিয়াছে? কাউকে সরাসরি নয়, সিধে দেওয়ালের দিকে চেয়ে বলতেন, হাউ ডিড উই গেট হিয়ার? সাব প্রাইম জনিত কেচ্ছা কেলেঙ্কারির কিসসা আমাদের জানা। চোখ কান খোলা রেখে দিবারাত্র ইন্টারনেটের পাতা স্ক্রোল করেও কীভাবে সেই অতল খাদের কিনারায় পৌঁছেছিলাম?
হাউ ডিড উই গেট দেয়ার?
কারণ কতকগুলি ঋষি বাচনকে প্রশ্ন করি নি। আমাদের বলা হয়েছিল রিয়াল এস্টেট, সি এল ও বন্ডে টাকা লাগাও, জমি বাড়ির দাম কমে না, দাম কমলেও সর্বত্র সমান হারে কমে না, এক হাজার বন্ধকি বাড়ির মালিক এক সঙ্গে দেউলে হতে পারে না, বাজারে টাকার সাপ্লাই অঢেল, তার স্রোত অন্তহীন, মনে রেখো মেরিল, গোল্ডম্যান, লেম্যানের পণ্ডিত ব্যাঙ্কাররা যা করেন ভেবে চিন্তেই করেন ( বেঞ্জামিন শালোম বেরনানকে, ফেডারাল রিজার্ভ, নিউ ইয়র্ক, ২০০৫)।
সুসময়ে সবচেয়ে বিপদজনক ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়ে থাকে, ভয়াবহ অর্থনৈতিক পরিণামের বীজটি সুখের দিনেই রোপিত হয়।
আমরা ফিরে তাকাই না কেন? বিগত চল্লিশ বছর চারপাশে প্রায় প্রতি দশকে ব্যাঙ্কিঙ্গে এবং তজ্জনিত অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখলাম অনেকবার – এক বিপর্যয়ের বীজাণু কবে কীভাবে শরীরে ঢুকেছে তার খোঁজ রাখি নি। সর্বনাশ সমুৎপন্ন হলে গেল গেল রব তুলেছি।মনে আছে সুনীলদা আর ভাস্করদার সঙ্গে এক রাত্রি ব্যাপী আড্ডায় কি ভাবে যেন ড্রাইভিঙের কথা উঠলো। কাজে অকাজে পশ্চিম ইউরোপে গাড়ি চালিয়ে বেড়াই, শুনে সুনীলদা একটু অবাক হয়েছিলেন। ভাস্করদা বললেন বাহাদুরি রাখো, বরং একটু সাবধান করে দিই হীরেন। লং ড্রাইভে যদি কোথাও তোমার গাড়ি অচল হয়ে পড়ে তুমি প্রথমেই ক্ষেপে যাবে, ভাববে হঠাৎ এই অঘটন ঘটল কেন? এমন তো কথা ছিল না। মনে রেখো তোমার গাড়ির অপরাধী অংশটি হয়তো অনেক আগে থেকেই বিগড়োতে শুরু করেছে, তুমি সেটা জানতে না, গাড়ির সর্বাঙ্গের চেক আপ তুমি প্রত্যহ করো নি - সারা রাস্তা অটোমেটিক গাড়ির অ্যাক্সিলারেটরে পা দাবিয়ে কার স্টিরিওতে গান শুনেছো।
ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় আমরা সকলে গভীর আস্থা রাখি। ব্যাঙ্ককে টাকা ধার দিয়ে বলি টাকা জমা করেছি। সে ব্যাঙ্ক ঠিক কীভাবে কোন পদ্ধতিতে চলে, তার বিজনেস মডেল নিয়ে কোন প্রশ্ন করি না। পাড়ার অটো চালককে একশ টাকা ধার দিলে সপ্তাহে সপ্তাহে জানতে চাই সে কবে শোধ দেবে। একটি বেসরকারি ভারতীয় ব্যাঙ্ক রাশিয়ান ওয়াইল্ড ইস্টে দোকান খুলে কোটি টাকা অপচয় করলে অথবা সরকারি ব্যাঙ্ক লক্ষ কোটি টাকার কর্পোরেট দেনাকে ইরেজার দিয়ে মুছে ফেললেও ভ্রুক্ষেপ করি না।
আল ইজ ওয়েল।
জলপাইগুড়ি, শ্যামবাজার ব্রাঞ্চ, স্টেট ব্যাঙ্কের এক নম্বর স্ট্র্যানড রোডের অফিসে, ফ্রাঙ্কফুর্টে যে ব্যাঙ্কিং দেখেছি, শিখেছি সেটার সঙ্গে আমার লন্ডন নিউ ইয়র্কের বাজারের অভিজ্ঞতা মেলানো গেল না। শিখছি জানছি এমন কিছু যা আমার চেনা জগতের সহস্র যোজন দূরের। কিন্তু মনে করেছি এর মধ্যে নিশ্চয় কোন গভীর অর্থ আছে! সুধী, আমি ধরে নিচ্ছি আমার কাছে সে সময় যা ছিল নতুন অভিজ্ঞান তা ইতিমধ্যে আপনাদের অনেকেরই জানা। নোবেল পুরস্কার নিয়ে লেখা আমার বইটি যারা পড়েছেন তাঁদের কাছে কিছুটা পুনরাবৃত্তি মনে হতে পারে। শেষ চল্লিশ বছরের প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে একাধিক অর্থনৈতিক উত্থান পতনের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয় আমরা আরেক সঙ্কটের খুব কাছাকাছি এসে পৌঁছেছি – তার চরিত্র এবং চেহারা একটু আলাদা! যেমনটা হয়ে থাকে। ইতিহাস ঠিক একই ছন্দে দেখা দেয় না আর বার।
স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া বা কনটিনেনটাল ব্যাঙ্ক ফ্রাঙ্কফুর্টে দেখে এসেছি সাদা মাটা, ব্রেড অ্যান্ড বাটার ব্যাঙ্কিং - টাকা জমা, ধার দেওয়া, ফরেন এক্সচেঞ্জ, মানি ট্রান্সফার, আমদানি রপ্তানির সুবিধার্থে লেটার অফ ক্রেডিট। ব্যবসা তবে বাড়ে কিসে? মার্কেটিং, অধিক খদ্দেরের টাকা জমা ধার দেওয়া, আরও সস্তায় আমাদের লাইফ ব্লাড, অর্থের সরবরাহে। ব্যবসা ডোবে কিসে? দুর্যোগে, দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্র বিপ্লবে, ঋণের ভুল বিচারে, ভুল বিনিয়োগে, আভ্যন্তরীণ ও সরকারি দুর্নীতিতে। দেশ ছাড়ার আগে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার বেশ কিছু রুগ্ন দেনদার দেখে এসেছি; এমনকি আমাদের সিক ইন্ডাস্ট্রিজ ইউনিট অবধি ছিল। রুগ্ন ইন্ডিয়ান অ্যালুমিনিয়াম কোম্পানির বোর্ডে তখন স্টেট ব্যাঙ্কেরও সিট ছিল; আর কাউকে না পেয়ে গুপ্ত সাহেব একদিন আমাকে পাঠালেন ব্যাঙ্কের প্রতিভূ হিসেবে। যশোর রোডে অফিসে তাদের বোর্ড মিটিঙে আমি? আমার বয়েস ছাব্বিশ; সমবেত বোর্ড মেম্বারদের গড় বয়েস পঞ্চাশ। গুপ্ত সাহেব বললেন, আঃ, বোর্ড মিটিঙে যাবেন আমাদের টাকা আটকে আছে বলে, সেদিন মুখ খুলবেন না, শুধু শুনে যাবেন, নোট নেবেন।
ব্যাঙ্কের প্রাজ্ঞ ব্যাঙ্কারবেশি ডাক্তাররা এমনি অনেক রুগীর দেখাশোনা করতেন। তারা ছিল স্টেট ব্যাঙ্কের সন্ততি, তাদের ছোঁয়াচ সচরাচর অন্য ব্যাঙ্কে ছড়াত না। ফ্রাঙ্কফুর্টে এসেও তাই দেখলাম। সব ব্যাঙ্কেই নির্বোধ বা লোভী পিতা এবং তাঁদের রুগ্ন সন্তান থাকে। দেশে হোক বিদেশে হোক, ঋণজনিত বিপর্যয় মোটামুটি, লোকালাইজড, প্যানডেমিক নয়। আজ যাকে আমরা আজ ফাইনান্সিয়াল ইনোভেশন বা ফাইনাইন্সিয়াল এঞ্জিনিয়ারিং বলে জানি চাকরি জীবনের প্রথম বারো বছর সেটি আমার একান্ত অচেনা ছিল।
১৯৮৫ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট নামক ব্যাঙ্কিঙ্গের প্রায় নিস্তরঙ্গ ব্যাক ওয়াটার্স থেকে কোলাহল মুখরিত লন্ডনের সিটি ব্যাঙ্কে যোগ দিয়ে শুনলাম নতুন নতুন শব্দমালা যা এতদিন জানতাম না বলে সবিশেষ লজ্জিত হয়েছি। ট্রেজারিতে কানে আসে – কারেন্সি সোয়াপ, ইউরোপিয়ান, আমেরিকান অপশন, ডেরিভেটিভ, ওয়ান ইয়ার্ড, ক্যাপ অ্যান্ড কলার; কর্পোরেট ব্যাঙ্কে শুনি লেভারেজড ডেট, মার্জার অ্যাকুইজিশন, ডেট ইকুইটি সোয়াপ, বৈদেশিক দফতরে শুনি লন্ডন ক্লাব, প্যারিস ক্লাব, সভারেন রিস্ক।
সিটি ব্যাঙ্কে জাপানি কর্পোরেট ক্লায়েন্ট দেখতেন প্রবীণ হিরোশি ইকেনাগা। নিউ ইয়র্কে ট্রান্সফার তখন আসন্ন তাই তাঁর অ্যাকাউনটগুলির গুরুভার আমার স্কন্ধে চড়াবার আদেশ দিয়েছেন জো ম্যাকেভিতস। ইকেনাগা-সানের (( সম্মানার্থে, ইকেনাগা বাবু )সঙ্গেই আমার কর্পোরেট জাপান আবিষ্কার - মিতসুই, মিতসুবিশি ( আক্ষরিক অর্থে তিন হীরে ), সুমিতোমো, ইতোচু, টয়ো মেনকা কাইশা, মারুবেনি, নিশো ইওয়াই। ইকেনাগা-সান জানালেন এই কাজের জন্য আমার বিশেষ যোগ্যতা আছে কেন না আমি থাকি লন্ডনের উত্তর পশ্চিমে, গোলডারস গ্রিনে; সেখানে ইহুদি এবং জাপানি গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বাস করতেন বলে তার মুখ চলতি নাম ছিল জুস অ্যান্ড জাপানিজ টাউন ( সংক্ষেপে জে অ্যান্ড জে টাউন, এখন শুধুই জে টাউন )। ইহুদি সেথায় দীর্ঘদিনের বাসিন্দা কিন্তু জাপানিরা নবাগত। ক্যামডেন টাউনে শনিবার জাপানি স্কুল বসে, তাই সমস্ত জাপানি এক্সপ্যাটরিয়ট নিজেদের পুত্র কন্যাকে মাতৃভাষা শেখানোর সুবিধে দেওয়ার জন্য বাসা খুঁজতেন নিকটস্থ গোলডারস গ্রিনে। এবার সেই সব জাপানি কোম্পানির ট্রেজারার সি এফ ও দের সঙ্গে টিউবের কামরায় প্রত্যহ দেখা হবার সম্যক সম্ভাবনা। হিরোশি ইকেনাগা এই সঙ্গ সুখ হতে বঞ্চিত, তিনি থাকতেন একেবারে উলটো দিকে, দক্ষিণে, উইম্বলডন কমনের পাশে ক্লকহাউস লেনে।
ইকেনাগা-সান ছিলেন মনে প্রাণে চির টুরিস্ট। লাঞ্চের সময়ে আমাদের ৩৩৬ নম্বর স্ট্র্যানড অফিস থেকে তাঁর সঙ্গে অনেকদিন হাঁটতে বেরিয়েছি। তার সঙ্গে প্রথম পদব্রজে ওয়াটারলু ব্রিজ অতিক্রমণ,আমাকে লিঙ্কনস ইনে নিয়ে গেছেন। সিটি ব্যাঙ্কে আমাদের অফিসে এয়ার কনডিশনার ছিল না, গরমের দিনে হাই কোর্টের চমৎকার আরামদায়ক শীতল কক্ষে বসে আমরা সম্পূর্ণ অজানা মামলার শুনানি দেখেছি! নতুন নতুন টারমিনোলোজি নিয়ে কথা হয়; একদিন তিনি আমায় বলেছিলেন, ‘হীরেন ব্যাঙ্কিঙ্গ ব্যবসা দাঁড়িয়ে আছে যার ওপর তার নাম ক্রেডিট, জানবার চেষ্টা করো ধার কাকে দিচ্ছ কেন দিচ্ছ কি বুঝে দিচ্ছ। সব সিদ্ধান্ত সঠিক হয় না, কিন্তু চেষ্টাটা যেন সচেতন থাকে। আজকাল যা দেখছি তাকে ব্যাঙ্কিং বলে মনে হয় না; এ এক রকমের কাসিনো। আজ লাভ, কাল লোকসান। ‘ পঞ্চান্ন বছর বয়েসি এই প্রবীণ ব্যাংকারকে সেদিন রক্ষণশীল মনে হয়েছিল চলতি হাওয়ার বিপরীত পন্থী। বহু বছর বাদে ওসাকায় দেখা হলে বলেছিলাম হয়তো আপনি ভবিষ্যৎকে সেদিন সঠিক চিনেছিলেন।
এরপর আমরা আসব সিন্ডিকেউটেড লোন, কোল্যাটারাল লোন আর প্রাইভেট ক্রেডিট- প্রাইভেট ইকুইটির গল্পে। লোন দেওয়ার সময় দায়িত্ব তো কাঁধে নিচ্ছে সবাই, কিন্তু সেই এটলাসের ভার কোন কৌশলে শেষমেশ কার কাঁধে এসে পড়ছে সেই রহস্যটিও দুর্দান্ত। সেইসব কুশীলবদের স্বরূপ উন্মোচন হবে আগামী পর্বগুলিতে।
ক্রমশ
হীরেন সিংহরায় | ০১ নভেম্বর ২০২৫ ২০:৪৫735404
Debanjan | 2409:4060:e9e:3af6:9aac:2ae9:d868:***:*** | ০১ নভেম্বর ২০২৫ ২২:০৯735407