

"সবার বুকেই নিজস্ব আকাশ থাকে
মাথায় ঘর গেরস্থালি, চোখে মুখে জানলা-দরজা
পেটে পিঠে উঠোন-বাগান, হাতে-পায়ে নদীনালা।"
সারাদিন জীবিকা সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে একজন আত্মহারা বেঁচে থাকা কবির সঙ্গে খ্যাপাটে শব্দদের দেখা হয়ে যায়। বেওয়ারিশ চায়ের দোকানের কুকুরের মত তারা পায়ে পায়ে ঘোরে। চৈত্রমাসের বাজারে প্রাক্তন বাঁধাকপি, কাতলার মাথা কাটা ফিনকি রক্ত, বিউলির ডালে মৌরি ফোড়নের গন্ধ, চলন্ত বাসে হারিয়ে যাওয়া মুখ আর হিঙের কচুরি ভাজার সামনে দাঁড়িয়ে তার মনে পড়ে সে কাল অনেকটা ঝড়বৃষ্টি খেয়ে ফেলেছে। সাতটা আটত্রিশের লোকাল আর জেলখানা ঘুরে জামার তিন নম্বর বোতামের জায়গায় ছোলার ডালের ফোঁটা নিয়ে দুপুরের পর তার আর অফিস করতে ভাল লাগে না। হাসপাতালের ভিজিটিং আওয়ার্স পেরিয়ে সন্ধ্যা নামলে সে বাড়ি ফিরে ঠিকানাবিহীন রান্নাঘর সাজায়, তেপায়া প্রেমের টেবিলে রাখা ওষুধের শিশি খোলে।
তখন সে জানে লিফটে একজন অদৃশ্য মানুষ থাকে যে সকালের দিকে স্কুলগামী বাচ্চাদের টিফিন বাক্সে ঢুকে ঢুকে খাবার চেখে দেখে। তার মনে হয় 'বিদ্যুতের মাঝামাঝি একটা প্রশান্ত দ্বীপ আছে / কালো বালির উঠোন, সামান্য গাছপালা /একটা গাছের গুঁড়ি নিজে নিজে চেয়ার টেবিল হয়ে বসে/ দিবারাত্রি সমুদ্রের তরঙ্গ গোণে।'
সমুদ্রের ঢেউয়ের এক গল্পে একটি ঝিনুক তার বন্ধু ঝিনুকের সঙ্গে পরিচিত হয়, কথাবার্তা হয়, একসঙ্গে ইচ্ছামত একটু ঘুরে বেড়ায় সারাদিন কাজের শেষে। সে জানে একজন পূর্ণবয়স্ক কবি দিনে চার পাঁচটা কবিতা লিখতে পারে, এমনিতে বর্ণহীন তথা অদৃশ্যপ্রায়। তবে পুরস্কারে হলদে, রাগে লাল বা ঘেন্নায় সবুজ হয়ে গেলে জ্যোৎস্নার খাঁড়িতে লুকোনো এদের কবিতার মাড়িগুলো পচে যেতে থাকে। সে কি কখনো তোমাদের জিজ্ঞেস করেছে - "একটা সময়ের চোঙের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি সকলে?"
‘শব্দের পরের স্টেশন নির্জন’, যেখানে সে শব্দের টেবিল সাজিয়েছে। যে মৃত সমুদ্রবেলায় স্টেশনে লোকে প্রাতঃভ্রমণে আসে। সে বোঝে এই বেলাভূমি যথেষ্ট নয়, চোরাবালিরা পৃথিবী ছাড়িয়ে গেছে সাবলীল অন্ধত্বের হাত ধরে, নির্ভয়ে। পৃথিবী ছাড়িয়ে অন্য কোথাও শুধু তার জন্য আজ রান্না বসছে, ট্রেন ছাড়ছে - ‘সাধারণতম রাস্তায় লোকাল বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে তার এক শূন্যের দোকান খুলে রাখা’।
"পৃথিবীর এখন বয়স হয়েছে -
সিঁড়ির তলার ঘরে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকে,
ঘোলাটে চোখে কী যেন বিড়বিড় করে আর ঢোলে।
কে জানে কতক্ষণ সে একা একা জাগে, কতক্ষণ ঘুমোয়?
কার কী যায় আসে, সে একা একা ফোঁপালে?"
"আলোচাল" এবং "ফোনঘর"র পর এইসব সাবলীল কবিতাযাপনের দৈনন্দিন দিয়ে তৈরী সুমন মান্নার নতুন কবিতার বই -"নৈঃশব্দের তর্জমা", গুরুচন্ডা৯ বার করতে চলেছে ২০২৬ বইমেলায়।