

“আঠারোমুড়ার লাল ধুলো আর প্রথম ফাগুনের তাপে সবাই অল্পবিস্তর নাজেহাল। পাহাড় ঘন সবুজ, দুধলি লতার সাদা ফুল। মাঝেমাঝে বেগুনি জারুল, হলুদ সোঁদাল- এখানে নাম বান্দরের লাঠি, কৃষ্ণচূড়ার সময় হয়নি, চৈত্র আসুক তারপরে বড়মূড়া লালে লাল হবে। চম্প্রেন বাজিয়ে লেবঙ্গবুমানি নাচ হবে, বৈশাখে গ্রাম পরিক্রমায় বেরোবেন সোনার দেবতা গড়িয়া, শাদা কুরচি ফুল আর লাল হলুদে পাহাড় কাল বৈশাখী নাচ নাচবে। এখন সবুজ পাহাড় মাঝেমাঝেই অগ্নিভ”।
আঠারোমুড়া পাহাড়। জুমিয়াদের গ্রাম। সিরাজুলি, বেলসিরি, টিউলিপ চাবাগান। চাবাগানের লেবারলোক, তাদের স্বপ্নগুলি একটু যেন আবছা, যেমন আবছা উপত্যকার কুয়াশাজড়ানো শীত। এর-ই মধ্যে গড়িয়ে যায় চাবাগানের গরীব দিন। বয়ে চলা কলাকুচি নদী, দরং জেলার বেলসিড়ির পাড়। নদীর মতই বয়ে চলে কাহিনির স্রোত, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে, অল্প অল্প করে জমে ওঠা দুঃখপলি, ক্ষমতাহীন, উপায়হীনের ইতিহাস। এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটের দিকে।
এই সব-ই উপাদান, এবং এরা সবাই, এই সবুজ পাহাড়, ঐ দুধলি লতা, বেগুনি জারুল, হলুদ সোঁদাল, ছাতিমের সুগন্ধ, পাখপাখালির কলরব, ফ্যাক্টরির মেশিনের আওয়াজ, আগুনের তাপ, লংতরাইয়ের পাকদণ্ডী বেয়ে মুড়ির টিন বাস – এরা সবাই গল্পগুলির চরিত্র - পিরোবতীর গল্পগুলির। ঠিক যেমন গরীবধনী কুলিমালিক সব মানুষের নাচগান, শাপশাপান্ত, ঘুম, অথবা অনর্গল স্নান ও হঠাৎ রুখে ওঠা যুদ্ধ। আর তার-ই মাঝে, সবুজ পাতার ফাঁকে, নদীর স্রোতের তলায় উপলখণ্ডের মত অপেক্ষা করে থাকে দুঃখ। অপেক্ষা করে মৃত্যু। কোথায় যেন পড়েছিলাম, যে মৃত্যুকে নিয়ে যাবতীয় লেখাই, আসলে যেন এক-একটি মোনোক্রোম চিত্রকলা, কিন্তু স্থাপত্য নয়, যাকে দেখা যায় শুধুমাত্র একটিই দিক থেকে। একটিই অমোঘ অন্তিম, তারপর শূন্যতা। এবং কিছু কুয়াশা। সে কিছুটা অবুঝ এবং অস্পষ্ট। সামনে অতল খাদ, তবুও নিচে তাকানোর কী অমোঘ আকর্ষণ। সেইসব গল্পের শেষে আমাদের থামতে হয়, একটুকুন বিশ্রাম, একটু দীর্ঘশ্বাস। এক মুহূর্তের দৈর্ঘ্য তিন সেকেণ্ড। একটি দীর্ঘশ্বাসের – একটি ছোট্ট ভেসে চলা দুঃখের দৈর্ঘ্য কত?
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসকে নিয়ে লিখতে বসে কবীর সুমন লিখেছিলেন, মার্কেস যেন নিজের ছোটবেলায় শোনা ভূতপেত্নী, গৃহযুদ্ধ, অতীত ঐশ্বর্য্য কিংবা অলীক বিষণ্ণ স্মৃতিকথার ছোট ছোট কাহিনির রঙিন টুকরো, নুড়িপাথরের মত বিছিয়ে রেখেছেন তাঁর সমস্ত কাহিনির পথেই। এবড়ো-খেবড়ো সেইসব নুড়িপাথর পাঠকের পায়ের তলায় কলরব করতে থাকে, অসংখ্য শিলাখণ্ডের ঠোকাঠুকিতে অনেক কালের অনেক কথা সশব্দে বেরিয়ে আসে। বেরিয়ে আসে একটি বৃহৎ মহাদেশের সুখদুঃখ, সংগ্রাম, বেঁচে থাকার তুচ্ছতম রোম্যান্টিসিজ়ম। এবং প্রেম। সবভাঙা প্রেম অপরাজিত।
এইসব-ই মনে হ’ল শক্তি দত্ত রায়ের লেখা পিরোবতীর গল্প পড়তে পড়তে। বৃহৎ মহাদেশের বদলে সিরাজুলি, বেলসিরি, টিউলিপ। শুধু মুগ্ধতাবোধ দিয়ে এই গল্পগুলি পড়ার অনুভূতি প্রকাশ সম্ভব না। মুগ্ধতার ওপারেও কিছু আশ্চর্যবোধ থাকে। একটি ছবি থাকে, যা আমাদের ভীষণ চেনা, অথচ যার চোখে চোখ রাখিনি কোনোদিন। এখন যেন হঠাৎ চোখের উপর পর্দা সরে গিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করছি সেই বিপন্নতার মধ্যে। আর মাঝে মাঝে, ডায়েরিতে টুকে রাখছি এক-একটি অমোঘ বাক্য, “পীরদিদির নাকছাবিতে পিতলের ওপর ছড়ানো লাল পাথরে লেগে থাকা চিরন্তনের মায়া”র মত, এরাও রয়ে যাবে অনেক-অনেকদিন।
“কী আছে পথের শেষে? চাওয়া, পাওয়া এবং পেয়েও না পাওয়ার কুয়াশা। জীবনের ছক যা সত্যি, আবার মিথ্যেও”।
গুরুর এই বইটির দিকে আগ্রহে তাকিয়ে আছি। ধ্বংস এবং হত্যার অন্ধকারের মধ্যে অপেক্ষা করে আছি সুসংবাদের। বইমেলার কিছু আগেই হয়তো বেরুবে। কলকাতা ছেড়ে আসার আগে, এইবার এইটিও সঙ্গে আসবে আশা করছি। অর্ধেক পৃথিবী দূরের অন্য এক মেঘেঢাকা কুয়াশাজড়ানো উপত্যকায় সে সঙ্গ দেবে এই মুগ্ধ পাঠকের।
যাঁরা গুরুর বইপ্রকাশের পদ্ধতিটা জানেন, তাঁরা অবগত আছেন, যে, গুরুর বই বেরোয় সমবায় পদ্ধতিতে। যাঁরা কোনো বই পছন্দ করেন, চান যে বইটি প্রকাশিত হোক, তাঁরা বইয়ের আংশিক অথবা সম্পূর্ণ অর্থভার গ্রহণ করেন। আমরা যাকে বলি 'দত্তক'। এই বইটি যদি কেউ দত্তক নিতে চান, আংশিক বা সম্পূর্ণ, জানাবেন। এই লেখার নিচে। অথবা guruchandali@gmail.com -তে ইমেল করে।
দত্তক প্রসঙ্গে - কী ও কেন >> (https://www.guruchandali.com/comment.php?topic=28892)
প্রসঙ্গত, পিরবতীর নাকছাবি ও অন্যান্য নামে গল্প সঙ্কলন বেরিয়েছিল অন্য প্রকাশনা থেকে কয়েক বছর আগে। সেই সঙ্কলনেরই পরিমার্জিত, কিছু সংযোজন ও বিয়োজনে পরিবর্তিত রূপ এই গুরুচণ্ডা৯ সংস্করণ।