৩৭টি প্রবন্ধ জুড়ে এ বইয়ে লেখকের বিচরণ। শিরোনামগুলির প্রতিটি একাই যেখানে একাধিক প্রবন্ধের সম্মিলিত বিস্তৃতি নিলে অবাক হওয়ার নয় সেখানে একটি করে প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে লেখক যা করেছেন তা মূলত পাঠকের মনে বিভিন্ন চিন্তাকে উস্কে দেওয়া। তাকে বিভিন্ন সম্ভবপরতার রাস্তার সংযোগস্থলে পৌঁছে দেওয়া। নিজস্ব সরস ভঙ্গিতে সঞ্জয় সেটি করেছেন অনায়াস স্বাচ্ছন্দ্যে। কখনও তা ফুটে উঠছে আমাদের চেতনার রাজনৈতিক-সামাজিক বিবর্তনের ক্যানভাসে আবার কখনও ঘুরে বেড়ায় চলচ্চিত্রের সাদায়-কালোয়, রুপালি পর্দার মিথ সৃষ্টির প্রক্রিয়ার রহস্য অনুসন্ধানে। ... ...
এখান থেকে আবাদানের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো উপায় নেই। অনুকে খবর দেওয়া যাবে না। আর একবার এই অরাজকতা শুরু হলে কবে যে তার শেষ হবে তা কেউ জানে না। আমি তো অনুকে জানি! ও দুশ্চিন্তায় পাগল হয়ে যাবে। স্টিভ বলল, “তুমি এখনই বেরিয়ে পড়। চারটের সময় আবাদানের একটা ট্রেন আছে। চেষ্টা করে দেখ, যদি সেটা ধরতে পার। ট্যাক্সি যদি পাও ভাল, তা না হলে হেঁটেই যেতে হবে।" ... ...
ইন্দিরা গান্ধী জীবিত থাকতে আমার ফুফু কোনওদিন কংগ্রেসকে ভোট দেননি। অমানবিক নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর দিলেন। এটা শুনে আমার আব্বা বললেন, এবার আর রক্ষা নেই। ময়না পর্যন্ত কংগ্রেসের হাত চিহ্নে ছাপ দিলে। তখন ব্যালট পেপারে ভোট হতো। স্ট্যাম্প মারতে হতো পছন্দের প্রার্থীর নামের পর চিহ্নের পাশে। ইভিএম তখন কল্পনাতেও আসেনি। সেবার ৪২টার মধ্যে কংগ্রেস ১৬ টা আসন পেল পশ্চিমবঙ্গে। আর জ্যোতি বসু বললেন, জীবিত ইন্দিরার চেয়ে মৃত ইন্দিরার শক্তি বেশি। একথাও বললেন, জনগণও মাঝে মাঝে ভুল করেন। আবেগের বশে। এই শক্তি বৃদ্ধির কারণেই কিনা জানি না, আর ভুল পরামর্শদাতাদের প্ররোচনায় বামফ্রন্ট সরকারের ওপর খড়্গহস্ত হয়ে উঠলেন রাজীব। সেই পরামর্শদাতাদের অধিকাংশই এখন বিজেপির সঙ্গে। সংসদে শাউটিং ব্রিগেড নামে রাজীবের বন্ধু বান্ধবের একটা দল ছিল। ... ...
সত্তর আশির দশকে পশ্চিমবঙ্গের নানা জায়গায় যাত্রা প্রতিযোগিতা হতো। বাবার কাছে নানা যাত্রার বই আসতো। 'বেগম আসমান তারা'য় দেড় পাতা ব্যাপী একটা সংলাপ ছিল। কী অসম্ভব গভীর অথচ কাব্যিক উচ্চারণ। আমার মতো কিছু তরুণ তখন এইসব মুখস্থ করার চেষ্টা করতো। যাত্রা প্রতিযোগিতা শুনে মনে পড়ল, শ্যামসুন্দর আর নাড়ুগ্রামের মাঝখানে দেবীবরপুর গ্রামে দিনের বেলায় যাত্রা হতো। কেন? সেটা জানতে হবে। আমাদের স্কুলের এক সহপাঠী সেলিম সেদিন হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে লিখল, রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হওয়ায় দিনে যাত্রা হয়েছে বাদুলিয়ায়। ... ...
ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম জঙ্গলের চারটে স্তর। জঙ্গলের মেঝে আগাছায় ভর্তি। এটা হলো প্রথম স্তর। তার ওপরে মাঝারি উচ্চতার গাছ। সেটা হলো দ্বিতীয় স্তর। একেবারে ওপরে আছে অনেক উঁচু উঁচু গাছের সারি। সেটা হলো তৃতীয় স্তর। আর এই তিন স্তরকেই জড়িয়ে আছে নানা রকম লতাপাতা আর অর্কিড। সেটা হলো চতুর্থ স্তর। ... ...
রাম। অভিষেকের এক বছর অতিক্রান্ত হল। এতদিন আমরা চার ভাই এত ব্যস্ত ছিলাম যে তোমাদের সঙ্গে একবারও মিলিত হতে পারিনি। রাজসিংহাসন যাঁরা অলঙ্কৃত করেন তাঁদের জীবনে তোমাদের মতো সুহৃদরা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তোমরা যে শুধুই রাজাকে হাস্যরসে এবং বাক্চাতুরীতে আমোদে রাখো তা-ই নয়, রাজা যদি অন্যায় বা ভুল করেন তাঁকে সে কথা অকপটে বলার লোক শুধু তোমরাই। তাই তোমাদের জিজ্ঞাসা করি, আমরা যখন নির্বাসনে বনবাসে ছিলাম এবং আমার কনিষ্ঠ ভরত প্রজাপালনের দায়িত্বে ছিলেন, তখন অযোধ্যার রাজকর্মে কোন ত্রুটি তোমাদের চোখে পড়েছে কি? ... ...
জাদুঘরে নয়, আন্তনি গাউদি প্রকৃতি, আলো এবং ঈশ্বরকে নিয়ে তাঁর খেলাঘর, তাঁর বৈঠকখানা সাজিয়ে রেখেছেন বার্সেলোনায়; দেখি তাঁর হাতে গড়া বাড়ি, তরঙ্গের মতন ব্যালকনি, ছাদে চীনেমাটির গোল চিমনি, বারান্দার ধাতব রেলিংকে মনে হয় নধর, পেলব, কোমল; যেন অবহেলে এক শিল্পীর আঙ্গুলের মোচড়ে টানা, সিঁড়ি আমাদের একতলা থেকে দোতলা নয়, নিয়ে যায় এক অলৌকিক উচ্চতায়, বসার ঘর অবারিত আলোকের ঝরনাধারায় ভেসে যায় না, আলোর বর্শা আসে কোনাকুনি বল্লমের ফলার মতো, আবিষ্কার করে গৃহকোণের গহন গৌরব। ... ...
কথাবার্তা শুরু হল। বেশীরভাগই কম্পিউটার বিষয়ক, উন্নয়ন ও পরিবর্তনের গতি, ভবিষ্যতে কি হবে বা হতে পারে ইত্যাদি। প্রফেসর অত্যন্ত ভদ্রলোক, সদালাপী, কথা বলতে ভালোবাসেন। ড্রিঙ্ক ও স্ন্যাক্সের সঙ্গে গল্প কথায় মশগুল হয়ে গিয়েছিলাম। সব মিলে বেশ ভালো লাগছিলো, নরম পরিবেশ, শিথিল চিন্তাহীন মস্তিষ্ক। হালকা আমেজে ভরেছে মন। “শ্যাল আই গেট ইয়ু এনাদার ড্রিঙ্ক।“ গ্লাসের উপর হাত রেখে বললাম, আর না, এবার উঠব। আচমকা হঠাৎ প্রোফেসর কালিজুরি জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা খাম বার করে আমার হাতে দিল। এতক্ষণ পরে কাজের কথা, বুঝলাম কি উদ্দেশ্যে এই মিটিং। বলল, “দেখো, তুমি যা যা চেয়েছিলে তা সব আছে এখানে। সই করে দাও।” আমি অবাক। কন্ট্রাক্ট পড়ে দেখি, সত্যি তাই। একটু চিন্তা করে বললাম, “আমি আমার ওয়াইফ-র সঙ্গে কথা না বলে সই করতে পারব না।" প্রফেসর বলল, “আর সময় নেই, কাল ভোরেই আমি চলে যাচ্ছি। এখন সই না করলে আর হবে না।” প্রফেসর নাছোড়বান্দা। ... ...
এসে গেল গুরুচণ্ডা৯-র নতুন উদ্যোগ 'এ মাসের বই'। প্রতি মাসে নির্বাচিত কিছু বইকে তুলে আনা হবে পাঠকের দরবারে,থাকবে সেইসব বইয়ের উপর বিশেষ ছাড়। সঙ্গে চলুক বইগুলো নিয়ে আড্ডা-তর্ক-গল্প-আলোচনা। ... ...
কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় ঘটে যাওয়া নির্মম হত্যাকাণ্ড স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের অন্যতম শোকার্ত কালো অধ্যায়। গত ২২শে এপ্রিল, ২০২৫ বৈসরন উপত্যকায় যে নৃশংসভাবে নিরীহ পর্যটকদের হত্যা করা হল, তা সমগ্র ভারতবাসীর হৃদয়ের প্রতিটি শিরা-উপশিরা তীব্র শোকার্ত তরঙ্গে প্লাবিত করেছে। অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এই পৈশাচিক হত্যালীলার প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র দেশবাসী একদিকে যেমন স্বজন হারানোর শোকে মুহ্যমান হয়েছে, তেমনি অন্যদিকে এই বর্বরোচিত নৃশংসতার বিরুদ্ধে সমগ্র দেশ তীব্র প্রতিবাদে গর্জে উঠেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার পাতা জুড়ে হতভাগ্য সহনাগরিকদের জন্য সমবেদনার হাহুতাশ এবং বদলার নেওয়ার উদ্বেল আহ্বান। রাষ্ট্র পরিচালকদের বক্তব্য জুড়ে যোগ্য জবাব দেওয়ার অঙ্গীকার। কোন সন্দেহ নেই যে, ঘটনার নারকীয়তার পরিপ্রেক্ষিতে এই সবই অত্যন্ত স্বাভাবিক তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। কিন্তু মৌলিক প্রশ্নটা হল, বদলাটা কার বিরুদ্ধে? কোন পথে? যোগ্য জবাবই বা কোন অর্থে? ... ...
১৯৪৭ এর এক সন্ধ্যায় লেখকের মা তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি স্কুলে যেতে চাও?’ পরিবারে তাঁর দাদা ওয়ালেশ মোয়াঙ্গি এবং কয়েকজন তুতো ভাই অতীতে স্কুলে গেছে, কিন্তু পয়সার অভাবে দু এক বছর বাদেই ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। মেয়েদের অবস্থা তো আরও করুণ, তাঁরা কেউই এক বছরও ক্লাস করে উঠতে পারত না। বাড়িতে অক্ষরজ্ঞান অর্জন করতো যাতে অন্তত বাইবেলটা পড়তে পারে। তাই মা যখন তাঁকে প্রশ্ন করেন তিনি বিহ্বল বোধ করেন। যখন তিনি কোনও মতে সম্মতি প্রকাশ করেন, মা তাঁকে জানিয়ে দেন যে তাঁরা গরীব, এবং তাঁর দুপুরের খাবার নাও জুটতে পারে। ‘কথা দাও ক্ষুধা বা কষ্টের কারণে তুমি কখনো পড়াশোনা ছাড়বে না। এবং তুমি সব সময় তোমার সেরাটা দেবে।‘ স্কুল এবং ইউনিফর্মের খরচ তাঁর মা খেতের ফসল বাজারে বিক্রি করে যোগাড় করলেন। একটি দোকানে পোশাক কিনতে গিয়ে নয় বছর বয়সি বালক দেখল দেয়ালে চশমা পরা এক ভারতীয়ের ছবি টাঙান রয়েছে। কয়েক বছর বাদে জানলেন তিনি এম কে গান্ধী যাঁর সাথে ১৯২১ সালে গঠিত ‘ইস্ট আফ্রিকান এ্যাসোসিয়েশন’-এর নেতা হ্যারি থুকু সংযোগ স্থাপন করেছিলেন এবং সেই সূত্রে স্থানীয় ভারতীয় ও তাঁদের নেতা মণিলাল এ দেশাই-এর সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলে ছিলেন। ... ...
তখনো আই সি এল পুরোপুরি ভারতীয়করণ হয়নি। আই সি এল-স্বার্থ লন্ডনের হেড অফিসই দেখাশুনা করত। ভারতীয়করণের পর একদিন ভারতবর্ষের আই সি এল স্বাধীন হল। ম্যানেজমেন্ট সব ভারতীয়, ম্যানেজিং ডাইরেক্টর এক পার্সী ইঞ্জিনীয়ার, প্রেম শিবদাসানী। কিন্তু লন্ডন আই সি এল তখনও ভারতীয় ব্যবসায়ের বড় অংশীদার এবং ভারতীয় আই সি এল দেখাশুনা করে। লন্ডনে আই সি এল-র ইন্ডিয়া অফিসের ডাইরেক্টর মিঃ জ্যাকসন। ইন্ডিয়া অফিস বা ইন্ডিয়া ট্রেডিং-র ম্যানেজার অমলেন্দু বিশ্বাস, আমি। এই পদের ক্ষমতা বেশি ছিল না কিন্তু মর্যাদা ছিল অনেক। সেই সঙ্গে ছিল অনেক দায়িত্ব ও কাজ। দুই দেশের ব্যবসায়িক আদান প্রদান এই অফিস তথা আমার মাধ্যমেই হত। ... ...
আসলে আমাদের সামনে তেমন ভালো এবং নিয়মিত পাঠচক্র ছিল না। কয়েক বছরের ব্যবধানে একটা দুদিন বা তিনদিনের রাজনৈতিক ক্লাস হতো। তাতে বক্তারা মিনিট পনেরো পরই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ এইসব ছেড়ে সহজ টার্গেট কংগ্রেসে চলে যেতেন। তবে বিনয় কোঙার আধ ঘণ্টা পর্যন্ত বিষয়ে ছিলেন। আর একটা উপকার করেছিলেন, দিগিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করে। পড়ি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা নীললোহিত খুব টানতো। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ভালো লাগে, বলা অন্যায় মনে হতো। নয়ের দশকের শুরুতে সুভাষ চক্রবর্তী টাউন হল ময়দানের এক সমাবেশে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গদ্যরচনার খুব প্রশংসা করলেন। মনোভাব বদলাল। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা ছিল খুবই প্রিয়। যেকোনো প্রতিযোগিতায় তাঁর শ্রেষ্ঠ কবিতা পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হতো। আমি এই বই, শিবনারায়ণ রায়ের বই, একাধিক সংখ্যায় পেয়েছি। যদিও এই দুজন ছিলেন পার্টিতে অপ্রিয়। ... ...
রাম। রাক্ষসপুরীর যাবতীয় ক্লেশ এবং অপমান যেন সীতা ভুলে গেলেন এই আশ্রমে অবতারণের সঙ্গে সঙ্গেই। সেই যে তাপসীরা সঙ্গে করে বিভিন্ন কুটীর-অভ্যন্তরে পরিক্রমা করাচ্ছেন তাঁকে, কেউ ডাকছে সখী, কেউ জানকী, কেউ বা বধূ আর নাম ধরেও কেউ যে সীতা সম্ভাষণ করছেন, তাঁদের সঙ্গে কথা আর যেন শেষই হচ্ছে না তাঁর! (অন্দরের দিকে তাকিয়ে) ঐ যে আসছেন। তাপসী। এই নাও তোমার স্বামী, এত লড়াই করে তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে এল, আহা, শ্যামবর্ণ যেন কালি! ... ...
মধুসূদনের প্ল্যান অনুযায়ী মাদারিহাটে সমীক্ষা ও জরিপের ফাঁকে একদিনের আধবেলা রাখা হয়েছিল জলদাপাড়ার জঙ্গল ঘোরার জন্য। ঠিক একমাস আগে এই অরণ্যে এসেছিলাম বাড়ির লোকের সঙ্গে। সেবার হাতির পিঠে চড়ে ঘুরেছিলাম। কিন্তু এবারে আর হাতি সাফারি নয়, জিপে করে ঘোরা। ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, শিক্ষিকা সব মিলিয়ে দলের সদস্য একচল্লিশ। একদিনে ভোর থেকে তিনবার হাতি সাফারি হত তখন। তখন মানে সালটা ২০১৮। ... ...
লন্ডনের বিভিন্ন ব্যাঙ্কের আন্তর্জাতিক লোন সিন্ডিকেশন বিভাগের অধিপতিদের মাসে একবার সমবেত হয়ে গল্প-গুজব মতান্তরে পারস্পরিক এস্পিওনাজ করার জন্য একটি আনঅফিশিয়াল সংস্থান দীর্ঘদিন যাবত ধুনো জ্বালিয়ে রেখেছে, যার নাম সিন্ডিকেট ম্যানেজার’স ফোরাম। আমাদের দেখা সাক্ষাৎ হতো পালা করে এ মাসে এক ব্যাঙ্কের অফিসে পরের মাসে আরেক ব্যাঙ্কের খাবার ঘরে। যে বার যাদের ব্যাঙ্কে মিটিং তারা সেদিন আমাদের বরযাত্রী সুলভ আদর আপ্যায়ন করতো, দেখে শুনে হাম ভি কম নহি বলে একাধিকবার আমাদের বোর্ড ডিরেক্টরদেরও হাজির করেছি! এই এ বাড়ি ও বাড়ি আসা যাওয়ার ব্যাপারটা ক্লান্তিকর হয়ে গেলে একবার স্থির হলো আমাদের একটা আউটিং হোক, দূরে কোথাও চলে যাই। স্যান্ট্যান্ডার ব্যাঙ্কের আউসিন্দে বললে, “চলো বার্সেলোনা!” গৌরি সেনের পয়সায় দু’দিন চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া যাবে, সেই সঙ্গে শহর ঘুরে দেখা। ততদিনে আমার বার্সেলোনা বার তিনেক ঘোরা হয়ে গেছে। তাতে কি, এক গুনাহ আউর সহি! ... ...
একদিন সন্ধ্যায় আমার শ্বশুর মহাশয়ের মৃত্যুর খবর এল। অনু কান্নাকাটি করছে, আমার মনটাও ভারাক্রান্ত। পর দিন সকালে অফিসে গেছি– মুখে একটা বিষাদের ছায়া আছে যা লুকানো যায় না। মিস্টার ফ্রেন্ড প্রতিদিন সকালে সকলকে “গুড মর্নিং” করেন, সেদিনও করলেন। আমার ডেস্কের কাছে এসে একটু দাঁড়িয়ে বললেন, “কী হয়েছে তোমার? মুখটা এত শুকনো কেন?” আমি বললাম কী হয়েছে। তিনি মনোযোগ দিয়ে শুনলেন, তারপরে দুঃখ প্রকাশ করে চলে গেলেন। লাঞ্চের পর তিনি আবার এলেন আমার কাছে। বললেন, তিনি আমার স্ত্রী ও দুই পুত্রের জন্য তিনটি টিকিটের ব্যবস্থা করেছেন, কলকাতা যাওয়ার জন্য। বলা বাহুল্য এর জন্য আমায় কোনো মূল্য দিতে হবে না। সে যুগে সদ্য-আসা আমার মতো কোনো বঙ্গসন্তানের তিনটি টিকিট কেনার মতো সামর্থ্য থাকত না। খবরটা শুনে আমার চোখে প্রায় জল আসে। কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাবো তা ভেবে পেলাম না। ভারি গলায় শুধু বললাম, “থ্যাঙ্ক ইউ, মিস্টার ফ্রেন্ড।” আশ্চর্য মানুষ! নতুন কাজে আমার তখনও ছ’মাস হয়নি সুতরাং আমার কোনো ছুটি নেই। অনুকে তাই দুটি ছেলেকে নিয়ে একাই যেতে হবে। ... ...
ইন্দিরার জেল হল কদিনের জন্য। এবং এই ঘটনাই মানুষের মধ্যে সহানুভূতির বান ডাকল। তার কিছুদিন আগে, আমিও পোস্টার মেরেছি, স্বৈরাচারী ইন্দিরা গান্ধীর শাস্তি চাই। সেটা মারতে দেখে আমার কংগ্রেস নেতা বড় মামা বলেন, বড়ভাই ম্যাট্রিক পাস করেছে, এটা তাও করবে না। বাপের মতো পার্টি করে বেড়াবে। এবং আমার প্রিয় বন্ধু বড় মামার বড় ছেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হল, মেশা যাবে না। এতে ফল উল্টো হল। আমার মামাতো ভাই বাবাকে খুব ভয় পেলেও মনে মনে এবং কাজে কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক হয়ে গেল। এবং এতে ক্ষুব্ধ বড় মামা মেরে পা ভেঙ্গে দিলে সে ১৯৭৮ এ পঞ্চায়েত ভোটের দিন মামার প্রিয় বন্ধু কংগ্রেস প্রার্থীর বিরুদ্ধে আমাদের বুথে সারাদিন বসে রইল। ইতিহাস আশ্চর্য। ... ...
বিদেশ যাত্রার প্রস্তুতি সারা হল। বেশি জিনিসপত্র নেওয়ার ইচ্ছা নেই – আমার কিছু নেইও। দু-একটা শীতের জামাকাপড় আর আমার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। একটা বড় স্টিলের ট্রাঙ্ক আর আমার বন্ধুদের দেওয়া সেই স্যুটকেস। অনু বলল ওর হারমোনিয়াম আর তানপুরাও নিতে হবে। বুবাই তখন একেবারে শিশু। বললাম, এত সব আমি সামলাব কী করে? অনু বলল, তানপুরা আর হারমোনিয়াম না নিয়ে গেলে ও-ও যাবে না। বুঝলাম হারমোনিয়াম-তানপুরা ছাড়া ও স্বর্গে যেতেও রাজি নয়। সুতরাং একরাশি গানের খাতা, বই আর তানপুরা, হারমোনিয়ামও আমাদের সঙ্গী হল। ... ...
নতুন দেশ, নতুন জীবন। আবার সব প্রথম থেকে শুরু করতে হবে। জীবন ধারণের জন্য অর্থ উপার্জন, আকাঙ্ক্ষার রূপায়ণ, মা-ভাই-বোনদের সংসারের চিন্তা -আমার সমস্ত সময় ও শক্তি লুটে নিয়েছিল। দেশের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেল। তবু মাঝে মাঝে দু-একজনের চিঠি পেতাম। আর দেশে গেলে দেখা হতো। শুধু দীপু একমাত্র ব্যতিক্রম। চিঠি, টেলিফোন ও নিয়মিত সাক্ষাৎকার মিলিয়ে আমাদের হৃদ্যতা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকল যা জীবনের এই শেষ প্রান্তে এসেও অটুট আছে। দীপুকে প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলাম। দেশ ছাড়ার পর দেশে যাইনি অনেক বছর। ও কেমন আছে, কী করছে কিছু ভালো করে জানতাম না। কফি হাউসের সেই অনার্সের বই বিক্রি করার ঘটনার পর দীপুর বিষয়ে কোনো সঠিক ধারণা ছিল না। কিছুদিন পরে শুনেছিলাম দীপু বাচ্চুকে (রীণা) বিয়ে করেছে। ... ...