ঘৃণা, হিংসার এই বাতাবরণে একজন লেখক কী করবেন? রুশদি মিথিক্যাল গ্রিক পয়গম্বর, সংগীতকার অরফিউয়াসকে স্মরণ করছেন। তাঁর মাথা ছিন্ন করে যখন তাঁকে হেব্রাস নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল তখনও অরফিউয়াস গান থামাননি, তাঁর সংগীত দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই ভয়াবহতার আবহে আমাদেরও আজ গান গেয়ে যেতে হবে, জোয়ারের দিক পরিবর্তনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ... ...
‘আমার জার্মানি’ বইটা পড়ে শেষ করার পর খানিকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকা ছাড়া উপায় নেই। তবে হ্যাঁ, যদি কেউ বলেন যে আমি এই বইটা এক নিঃশ্বাসে পড়ে শেষ করেছি তাহলে তাঁকে বলতেই হবে যে ক্ষমা করবেন মহোদয়, আপনার বোধহয় কোথাও ভুল হচ্ছে’, কারণ ওটা সম্ভব নয়। এ বই পড়তে হবে থেমে থেমে , রসিয়ে রসিয়ে, অনুভব করে করে, প্রত্যেকটা অনুচ্ছেদের মর্ম অনুধাবন করে। ... ...
প্রায় ষাট বছর আগের এই ফলকে বানান অন্য রকম হলেও জওহরলাল নেহরুকে চিনলাম। ইংরেজি বাদে প্রায় কোনো ইউরোপীয় ভাষায় ‘জ’ ধ্বনির সমার্থক কোন অক্ষর নেই। স্লোভাকে ডি জেড দিয়ে সেই ধ্বনি সৃষ্টি করা হয়েছে (জার্মান ভাষায় এই একই ধাঁচে লেখা হয়) কিন্তু নেহরুর পরে যিনি উল্লেখিত,তাঁকে আমরা চিনি অন্য নামে। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির নাম পরিবর্তন করে তাঁকে গান্ধিওভা বানানো হয়েছে। তাঁরও ছাড় নেই, তাঁকেও পরিচিত হতে হবে স্লোভাক কায়দায়,স্বামীর নামের সাথে ‘ওভা’ যুক্ত হয়ে। বিশ বছর বাদে,১৯৫৮ সালের কার্লোভি ভারি (জার্মান কারলসবাদ,চার্লসের স্নানাগার!) ফিলম ফেস্টিভালে মাদার ইন্ডিয়া ছবির জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার পেলেন নারগিসোভা! এখানে একটু শর্টকাট নেওয়া হয়েছিল,সঠিক আইন মানলে পুরস্কার ফলকে লেখা হতো নারগিস রাশিদোভা (তাঁর বাবার নাম আবদুল রাশিদ) সুনীল দত্তের সঙ্গে ততদিনে বিয়েটা হলে তিনি হতেন নারগিস দত্তভা (প্রসঙ্গত এক মেক্সিকান অভিনেত্রীকে বাদ দিলে কার্লোভি ভারি ফেস্টিভালে নন কমিউনিস্ট দেশের কেউ পাত্তা পেতেন না – নারগিস সেই ট্র্যাডিশন ভাঙ্গেন,এর পরে ১৯৭২ সালে রঞ্জিত মল্লিক ইন্টারভিউ ছবির জন্য বেষ্ট অ্যাকটর এ্যাওয়ার্ড পান)। স্লোভাকিয়াতে ফিল্মের পোষ্টারে,খবর কাগজে,টেলিভিশনে শ্যারন স্টোন হন শারনে স্টোনোভা, মেরিলিন মনরো হয়ে যান মেরিলিন মনরোভা। ... ...
এই ঘটনা হতবাক করে দিল গ্রামকে। ইটপূজা হল গাজন তলা তথা ওলাইচণ্ডী পূজার বারোয়ারি তলায়। বারোয়ারি তলায় বর্ষার পর একটা বাঁশের মাচা করা হতো আড্ডার জন্য। দুগোদার মুদি দোকান বড়দের দখলে থাকতো বেশিরভাগ সময়। ১৫-২৫ ভিড় করতো বাঁশের মাচায়। হিন্দু মুসলমান একসঙ্গেই আড্ডা। বন্ধুদের আবার হিন্দু মুসলমান কী? কিন্তু সেই বন্ধুদের কেউ কেউ ইটপূজার উদ্যোক্তা। কদিন আগেই একসঙ্গে কার্তিক ঠাকুর ফেলেছে নতুন বিয়েওলা বাড়িতে। তাঁদের কেউ কেউ পূজা না করে ঠাকুর ফেলে দেওয়ায় একসঙ্গে সেই ঠাকুর তুলে এনে খিচুড়ি খাওয়া হয়েছে। আর তাদের কেউ কেউ বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রামমন্দির গড়ার জন্য ইট পাঠাচ্ছে গ্রাম থেকে! ... ...
১৩ ই মার্চ। লিভিংস্টোনের সাথে আমার থাকার শেষ দিন চলে এল আর পেরিয়েও গেল। শেষ রাতে আমরা একসঙ্গে থাকব, পরের দিনটাকে তো আর এড়ানো যাবে না! যদিও আমার মনে হচ্ছে, যে-ভাগ্য আমাকে তাঁর থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে সেই ভাগ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করি। মিনিটগুলো দ্রুত পেরিয়ে যাচ্ছে, জমে জমে ঘণ্টা হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দরজা বন্ধ, আমরা দুজনেই নিজের নিজের চিন্তায় ব্যস্ত। তিনি কি ভাবছেন জানি না। আমারগুলো দুঃখের। আমার দিনগুলো যেন স্বর্গসুখে কেটেছে; নাহলে কেনই বা আমি বিদায়ের ঘণ্টার এগিয়ে আসতে এত গভীর কষ্ট পাব? আমি কি পরের পর জ্বরে ভুগি নি, ইদানীংকালে দিনের পর দিন কাতর হয়ে শুয়ে থাকিনি ? ... ...
আমরা এই তথাকথিত ভদ্রলোকেরা যেমন কেন্দাডি পাহাড়টার মাথায় একটা শিবের মন্দির গড়ে তার নাম সিদ্ধেশ্বর পাহাড় করে দিয়েছি তেমনি জাদুগুড়া কিংবা জাদুগড়াকে জাদুগোড়া করে দিয়েছি। এক সময় এই জাদুগুড়া ছিল বন্য হাতিদের আদি বাসস্থান। হাতিদের বাসস্থান অর্থেই জায়গাটার নাম জাদুগুড়া। এই জাদুগুড়া আসলে ঝাড়খণ্ডের যাকে বলে সোনার খনি। আমরা যখন কলকাতার দিক থেকে ঝাড়খণ্ডে প্রবেশ করছি তখন বহড়াগুড়ার কাছাকাছি এলাকা থেকে প্রথমে বাঁহাতি তারপর ডানহাতি দুটি পাহাড়শ্রেণী দেখতে পাই। আসলে এই গোটাটাই দলমা পাহাড়শ্রেণী বা দলমা রেঞ্জের অন্তর্ভুক্ত। ঝাড়খন্ড প্রবেশের মুখটায় এই দলমা যেন অনেকটা হাঁ করে আমাদের প্রবেশের জায়গা করে দিচ্ছে। ধলভূমগড় থেকে আমরা সেই হাঁ-এর ভেতর ঢুকে যাচ্ছি। ঘাটশিলা থেকে গালুডি হয়ে জামসেদপুর আমরা সেই হাঁ-এর ভেতরেই থাকছি। ... ...
অথচ, সেভাবে পাওয়া হলো না আপনাকে! //যৌবন যখন /শৈশব থেকে কৈশোরে ছুটে গেল /প্রৌঢ়ত্বের আকাশে ঘনিয়ে এল /গোধূলি /এগোতে এগোতে /এক দীর্ঘ গভীর /আফসোসের রেখা টানতে টানতে /আপনার দিকে /ছুটে গেছি বারবার... /প্রেমে /প্রত্যাখানে /বিচ্ছেদে /আদরে /শিক্ষায় /অশিক্ষায় /কলঙ্কে /অপমানে /সম্মানে /অসম্মানে /রাতের কান্নায় /সকালের ঘাসফুলে /সুন্দর যখন সুন্দরের চেয়েও সুন্দর /এবং যাপন /যখন একাকী ... ...
তথাকথিত নীচু জাতের নারীর সঙ্গে তথাকথিত উঁচু জাতের পুরুষের বিয়ে হলে তাদের সন্তানের জাত কী হবে সুপ্রিম কোর্টে এইরকম একটি কেস উঠেছিল (civil appeal no 654 of 2012, decided on January 18, 2012)। সুপ্রিম কোর্টের অবজারভেশনের একটি অনুবাদ নীচে রইল। ইন্টারকাস্ট ম্যারেজ যদি আদিবাসী এবং অ-আদিবাসীর মধ্যে হয়, তাহলে ধরে নেওয়া হয়, সন্তান পিতার কাস্টেই পরিচিত হবে। এই ধরে নেওয়াটা জোরদার হয়, যদি এইরকম বিয়েতে পুরুষটি উঁচু জাতের হয়। কিন্তু এই ধরে নেওয়া সিদ্ধান্ত হিসেবে কখনই অপরিবর্তনীয় নয়। এইরকম বিয়ের সন্তানের প্রমাণ করার স্বাধীনতা থাকবে যে সে শিডিউল কাস্ট/ ট্রাইবের মায়ের দ্বারা আজন্ম পোষিত হয়েছে। উঁচু জাতের পিতার সন্তান হয়ে সে জীবনে কোনো সুযোগ সুবিধেই পায়নি, উপরন্তু বঞ্চনা, অমর্যাদা, অপমান এবং বাধার সম্মুখীন হয়েছে, যেমনটি তার মায়ের কাস্টের লোকেরা হয়ে থাকে। ... ...
পুলিশ যখন তাঁকে রাস্তায় প্রথম দেখতে পায় তখন ভোর হয়ে আসছে। ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড ধরে ব্যারাকপুরের দিক থেকে কলকাতার দিকে তিনি আসছিলেন হেঁটে হেঁটে। এখন যুদ্ধের সময়, বড় বড় মিলিটারি ট্রাক রাতের ফাঁকা রাস্তায় দ্রুতগতিতে আসা-যাওয়া করছে। নজরুলের চলার ভঙ্গি খানিকটা মাতালের পদক্ষেপের মতো ছিল। যে-কনস্টেব্ল্ প্রথম তাঁকে দেখে, সে একজন মাতাল বলেই মনে করেছিল তাঁকে, এবং লোকটা যখন-তখন লরির ধাক্কায় পড়ে যেতে পারে এই আশঙ্কাতেই তাঁকে থামিয়েছিল। কথাবার্তা এতই অসংলগ্ন যে, কিছুই না-বুঝতে পেরে, আরও দুয়েকজনের সাহায্যে সে তাঁকে থানায় নিয়ে আসে। ... ...
এমন একটা দিন যায় না যেদিন অন্তত একবার তাঁর গানের কোন কলি, কবিতার কোন পংক্তি, নাটকের কোন সংলাপ বা কোন চিত্রকর্মের কথা স্মরণ করা হয়নি। অথচ এমন ত নয়, তাঁর বিপুল সৃষ্টির এক কুচির বেশী কিছু পড়া হয়েছে আমার! আবার তাঁকে বাদ দিয়ে আর কিছুই পড়িনি, শুনিনি, দেখিনি এমনও ত নয়! তবু তাঁর কাছে না এসে উপায় থাকে না। তবে তাঁর যে সৃষ্টি সেই শৈশব-কৈশোর-প্রথম যৌবনে আদৌ সেভাবে বুঝিনি তা হচ্ছে তাঁর গান। যত দিন গেছে, জীবন যত পাক খেয়েছে, তলিয়ে গেছে, আর ভেসে উঠেছে, তত বেশী করে আমার আশ্রয় মিলেছে তাঁর গানে। ছোট বেলায় গানের চরণগুলি আসত-যেত, হাওয়া যেমন আসে, যায়, সহজ-সরল, সাবলীল, একান্তই পরিচিত। যত দিন গেল, গানগুলি বয়ে আনতে লাগল অনাঘ্রাত সুগন্ধ, অশ্রুত বাণী, অদেখা রূপ। একেক বিকেলে, সন্ধ্যায়, মোহন সিংয়ের কন্ঠে যখন অমৃত-বাণী ছড়িয়ে পড়ে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় আমার চেতনা, আমার শরীর বসে থাকে চুপটি করে, আর অঝোর ধারে কোথা হতে উপচে আসে শ্রাবণ, বন্ধ দু চোখ বেয়ে। নাই থাকল আমার কোন জীবনদেবতা। আমার নিজস্ব বেদনা আরও কোন বৃহত্তর বেদনায় মিলেমিশে আমায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ... ...
রাজধানী শহর থেকে প্রায় পঁচিশ যোজন দূরের অনন্তপুর চটিতে ভল্লা যখন পৌঁছল, রাত্রি তখন প্রথম প্রহর পেরিয়ে গেছে। রাজধানী থেকে সে রওনা হয়েছিল শেষ রাত্রে। তারপর একটানা ঘোড়া ছুটিয়ে এতদূরে আসা। অবশ্য মাঝে জঙ্গলের মধ্যে এক সরোবরের ধারে গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়েছিল। বিশ্রাম দিয়েছিল তার ঘোড়াটাকেও। সরোবরের তীরে প্রচুর সবুজ আর সতেজ ঘাসের সন্ধান পেয়ে, ঘোড়াটা তার সদ্ব্যবহার করতে বিলম্ব করেনি। ওই অবসরে সেও দুপুরের খাওয়া সেরে নিয়েছিল। পুঁটলিতে বাঁধা চিঁড়ে সরোবরের জলে ভিজিয়ে গুড় দিয়ে মেখে সপাসপ মেরে দিয়েছিল। তারপর গামছা পেতে গাছের ছায়ায় বিশ্রাম। ঘুম নয়, বিশ্রামই। প্রথম কথা ঘোড়াটাকে চোখে চোখে রাখতে হচ্ছিল। দ্বিতীয় কথা বিগত রাত্রিতে সে একবিন্দুও ঘুমোতে পারেনি, তার ওপর এই দীর্ঘ পথশ্রম। চোখের পাতা একবার বন্ধ করলেই, সে নির্ঘাৎ ঘুমিয়ে পড়বে – সেক্ষেত্রে তার যাত্রাভঙ্গ হবে। যে চটিতে আজই রাত্রে তার পৌঁছনোর কথা সেখানে পৌঁছতে পারবে না। অতএব অর্ধ প্রহর বিশ্রামের পর সে ঘোড়ায় চড়ে ছুটতে শুরু করেছিল তার নির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে। ... ...
সন্ধেবেলা দয়াময়ীর এই কথাটুকু মনে পড়ল দয়াময়ীর দয়াময়ী ছাড়া কেউ নেই। আজানে তখন আকাশ ফেটে গেছে, গলে গলে নামছে অন্ধকারের প্রথম দিককার রঙ। পেয়ারা ফুলের মতো মুখ নিয়ে ও কান পেতে শুনল সরসর করে কোথাও কিছু একটা বাজছে। বোঝা গেল, একেবারে একা একটা তালগাছ মাঠের মাঝখানে হাওয়ায় পাতাদের কাঁপাচ্ছে। ভাত খেতে বসে ওঁর বুক উদাস হয়, একজন কেউ থাকলে ভালো হত। এই এতবড়ো নীলসাদা রঙীন বাড়ি,দেওয়ালে সদ্য চুনকামের গন্ধ বুকে উঠে আসে। চিরকাল মাটির ঘরে, পাতার ঘরে দিন কেটেছে। সরকারি প্রকল্পের একা একা বিধবার মতো ফাঁকা বাড়িতে অস্বস্তি হয়, সন্ধ্যামালতী ফুলের চেয়েও নরম মা দেখে যেতে পারল না এই ঘরদোর। নিজেকে নিজের জল গড়িয়ে নিতে হলে, ভাতের পাতে কাঁচালঙ্কা-নুন বারবার আনতে যেতে হলে ভালো লাগে না। এতো যত্নে করা রান্নাবান্না অর্থহীন হয়ে পড়ে যতোক্ষণ না কেউ সেই খাবার খেয়ে একমুখ হাসিতে তারিফ করে ওঠে। চিংড়ি মাছের মাথার চচ্চড়ি তারিফ না করলেও মুখ তুলে অন্তত বলুক বিচ্ছিরি হয়েছে খেতে, এ রান্না খাওয়া যায় না। পরের দিন সে সব মায়ামমতা ঢেলে এমন মোচাঘন্ট রাঁধবে সেদ্ধ ছোলার তুক কাজে লাগিয়ে যে, কর্তাকে থালা অবধি চেটে খেতে হবে। ... ...
ধরা যাক আমাদের n-সংখ্যক ভোটার আছে, n বিজোড় সংখ্যা (অর্থাৎ “টাই” অসম্ভব)। প্রত্যেক ভোটারের ঠিক বিকল্পে ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা ধরা যাক pc, এবং সবার ভোট পড়ে গেলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে “মেজরিটি রুল” অনুযায়ী, অর্থাৎ যে সবথেকে বেশি ভোট পাবেন, সেটিই আমাদের গণতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত। কনডরসে-র উপপাদ্যে এও ধরে নেওয়া হয়, যে, প্রত্যেক ভোটার ‘স্বতন্ত্র’, ‘দক্ষ’ এবং ‘আন্তরিক’। ‘স্বতন্ত্র’ – অর্থাৎ যে যার নিজের ভোট দিচ্ছেন বা একজনের পছন্দ আরেকজনকে প্রভাবিত করে না। ‘দক্ষ’ – অর্থাৎ, প্রত্যেকের ঠিক বিকল্প খুঁজে নেওয়ার সম্ভাবনা অর্ধেকের থেকে বেশি, যত সামান্যই হোক, এক্কেবারে র্যান্ডম গ্যেস অর্থাৎ ইকির-মিকির-চামচিকির করে আন্দাজে যা-ইচ্ছে-তাই একটা বোতাম টিপে দেওয়ার থেকে তার প্রজ্ঞা বা দক্ষতা একচুল হলেও বেশি। আর শেষ অ্যাজ়াম্পশনের কথা আগেও লিখেছি, ভোটার-রা ‘আন্তরিক’, সিরিয়াস-ও বলা যায়—কেউ ইচ্ছে করে ভুলভাল ভোট দিয়ে নষ্ট করছেন না। ... ...
স্টেট ও চার্চকে সম্পূর্ণ পৃথক করে দিতে হবে। রাজ্য পরিচালনার কাজে চার্চ হস্তক্ষেপ করতে পারবে না এবং রাজ্যও চার্চের কাজে হস্তক্ষেপ করবে না। রাজ্য পরিচালনার কাজে রোমান ক্যাথলিক চার্চ সরাসরি হস্তক্ষেপ করত। নিয়ম-শৃঙ্খলা বলবৎ ছিল, যাকে বলা হত খৃষ্টীয় অনুশাসন। কিন্তু পরবর্তীতে স্টেট ও চার্চের এই বিযুক্তিকরণই ছিল সেকুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষতার আদি সংজ্ঞা। নিয়ম-শৃঙ্খলা অর্থাৎ অনুশাসনের ভাবনা নিশ্চয়ই আদিম যুগে ছিল না, গুহামানবের যুগে ছিল না। জৈবিক বিবর্তনের পথ ধরে সমাজ তৈরি হয় এবং সেই পথেই কোনো একসময় নিশ্চয়ই নিয়ম- শৃঙ্খলা বা অনুশাসনের ভাবনা এসেছিল। ধর্মের উৎপত্তি ও সামাজিক অনুশাসন কি যমজ সন্তান! প্রাচ্যের প্রাচীন ধর্মগুলিই হোক বা আব্রাহামিক (সেমেটিক) ধর্মগুলিই হোক, পাপ-পুণ্যের ভয় দেখানো ব্যাপারটা ধর্মীয় অনুশাসন কায়েম রাখার পিছনে কাজ করত, তা হয়ত অস্বীকার করা যাবে না। ... ...
এখন এই বেলা আড়াই প্রহরে রাজপথে পথচারীর সংখ্যা বেশ কম। কয়েকজন রাজপুরুষ ঘোড়ার পিঠে দুলকি চালে নগর পরিদর্শন করছে। সকালের প্রথম প্রহরান্ত থেকেই বিপণিতে ক্রেতাদের ভিড় জমতে থাকে। এখন পথের দুধারের বিপণিগুলিও প্রায় ক্রেতাহীন। সূর্যের তেজ যত বাড়তে থাকে নাগরিক ক্রেতারা গৃহাভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে। এই সময় বরং আশপাশের গ্রাম থেকে আসে গ্রাম্য লোকজন - ঘোড়া কিংবা গোশকটে। তাদের আশাতেই বণিকরা শূণ্য বিপণিতে ধৈর্য ধরে বসে থাকে। পড়শি বণিকদের সঙ্গে গল্পসল্প করে সময় কাটায়। সাধারণতঃ এই গ্রাম্য ক্রেতারা সরল হয়। কথার তুবড়িতে তাদের ভুলিয়ে ফেলা যায় সহজেই। তাদের সঙ্গে কিছুটা তঞ্চকতা করে, নাগরিক ক্রেতাদের তুলনায় বেশ দুকড়ি উপরিলাভ করে নিতে পারে বণিকেরা। তবে আজকাল গ্রাম্য ক্রেতারাও শহরমুখো হচ্ছে কম। আজকাল কিছুকিছু বণিক, গাধার পিঠে, বলদের গাড়িতে পসরা সাজিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ায়। ঘরের মেয়েরা সরাসরি তাদের পছন্দ মতো বাসন-কোসন, রান্নার সরঞ্জাম, মশলাপাতি, কাপড়চোপড়, প্রসাধনী সামগ্রী হাতে নিয়ে, নেড়েচেড়ে, দেখেশুনে কিনতে পারে। কারণ শহরে আসে পুরুষরা। ... ...
সেদিন সকালে তেতলার পিসিমার ঘরে বসে এক মনে ড্রয়ার ঘাঁটছিল ছেনু। ওটা আসলে মহারাজ ছনেন্দ্রনাথের রত্ন ভান্ডার। যত রাজ্যের উদ্ভট জিনিসের ভিড় থেকে মনমতো জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে একটা বল্টু লাগানো লম্বা স্ক্রু ভারি পছন্দ হয়েছে, বল্টুটা খুলতে যাবে, ঠিক এমন সময় দোতলা থেকে হইচই কানে এল। শেয়ালদার মতো ব্যস্ত এলাকায় হট্টগোল তো সর্বক্ষণ লেগেই আছে, কিন্তু এই হইচই এর শব্দটা ভারি মিঠে, আর তার মধ্যে একটা চেনা চেনা গলাও উঁকি দিচ্ছে, তাই ছেনু আর থাকতে পারলো না, স্ক্রুটা ফেলে রেখে সিঁড়ি দিয়ে এক দৌড়ে নিচে নেমে এল। ... ...
একদা ইউরোপের মাঝখানে কোথাও বসবাস করতেন স্লাভ জাতি। কালে খাদ্যের অকুলান হলো, নিয়মিত তুরকিক অভিযানে জীবন বিপর্যস্ত–দেড় হাজার বছর আগে ভাগ্য সন্ধানে তাঁরা ইউরোপের তিন দিকে বেরিয়ে পড়লেন। পোল্যান্ডের প্রচলিত লোকগাথা অনুযায়ী তিন স্লাভিক ভাই, লেখ চেখ রুশ গেলেন তিন দিকে–উত্তর দিকে লেখ, পুবে রুশ দক্ষিণে চেখ। লেখ বাসা বাঁধলেন আজকের পোল্যান্ডে (লেখ নামক বিয়ার তাঁর নামকে অমর করে রেখেছে) বেলারুশ; রুশ যেখানে থামলেন সেটি আজকের রাশিয়া, ইউক্রেন (আক্ষরিক অর্থে সীমানা), চেখ ভাই গেলেন দক্ষিণে, আজকের বলকান অবধি। কালক্রমে খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করলেন সকলে। পশ্চিমে কেন যান নি তার কোন ব্যাখ্যা পাই নি। হয়তো বর্বর গথ ভিসিগথ জাতির নৃশংস আচরণের কাহিনী শুনেছিলেন অথবা এই তিন অঞ্চলে তাঁরা পেলেন বাসযোগ্য ভূমি; লোভ বাড়ান নি। ... ...
প্রকৃতি একটু একটু করে খুলে দিচ্ছিল তার জাদু-দরজা। ঘরের একদিকের দেয়ালের পাশে ছিল লম্বা লম্বা পাতার কিছু গাছ। তাতে অদ্ভুত দেখতে কিছু কলি। ধীরে ধীরে কলিরা বড় হচ্ছিল। হঠাৎ এক সকালে দেখি, কলি নয়, ফুল। কি অবিশ্বাস্য সুন্দর ফুল! বাবাকে গিয়ে ধরলাম, কি ফুল বাবা? বাবা বলল, কলাবতী। এমন ও ফুল হয়, এমন ও নাম হয়! আমার চেতনার কূল ভাসিয়ে বাজতে থাকে কলাবতী, কলাবতী, কলাবতী। তারপর একদিন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি নামে। গায়ে সেদিন অল্প অল্প জ্বর। মা বলে, – আজ আর দুজনের কারো, স্কুলে গিয়া কাজ নাই। আমি চাদর মুড়ি দিয়ে হাত-পা ঢেকে বিছানায় বসে থাকি, জানালার পাশে। দেখি, কলাবতী বৃষ্টিতে স্নান করে। পাতার গা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে – টুপ – – টুপ, টুপ টুপ। ফুলের গা বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে – টুপ – – টুপ, টুপ টুপ। ঠাকু’মা এসে পাশে দাঁড়ায়। – কেমন আছ অহন? – ভালো। – জলীয় বাতাস লাগাইও না। জ্বর বাড়ব। জানালার পাল্লা অনেকটা বন্ধ হয়। একটু ফাঁক রাখা থাকে–নাতির জন্য, কলাবতীর জন্য। ছোট দু’ ভাই এবার ঘিরে আসে, – ঠাকুমা গল্প বলো। ... ...
এই মুহূর্তে বার বার একটা নাম শোনা যাচ্ছে। সোনাম ওয়াংচুক। অনেকেই হয়তো বলবেন যে লাদাখ নিয়ে নতুন রাজনীতির আবর্ত তৈরি হচ্ছে এই নামটিকে ঘিরে। কিন্তু যে আন্দোলন শুরু হয়েছে, সেটা সফল হলে এবং বিভিন্ন জায়গায় আরও কয়েক দশক আগে শুরু হলে হিমালয়ের প্রকৃতি কিছুটা হলেও বাঁচত। ... ...
বাংলার উদ্বাস্তু প্রধান এলাকাগুলিতে কান পাতলেই শোনা যায় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে নানা গুঞ্জন। চব্বিশের লোকসভা ভোটে এই অঞ্চলগুলিতে জিততে বিজেপির মাস্টার্স স্ট্রোক এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)। বিজেপি বারবার করে বলছে, সিএএ নাগরিকত্ব প্রদানের আইন, নাগরিকত্ব হরণের নয়। আর সেই আশাতেই বুক বেঁধেছে এক বিরাট সংখ্যক উদ্বাস্তু মানুষ। সিএএ-র বিষয়ে সম্যক ধারণা ছাড়াই। তবে দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত সাহ দেশবাসীকে যেভাবে ক্রোনোলজি বুঝিয়েছিলেন, তা থেকে অতি সহজেই অনুমান করা যায় যে বিজেপির মনোবাসনা কেবল সিএএ -তে থেমে থাকবার নয়। প্রথমে সিএএ, তারপর এনআরসি (জাতীয় নাগরিক পঞ্জী)। আর যার পরিণতি হতে পারে উদ্বাস্তুদের জন্য ভয়ানক। ... ...