সক্কাল সক্কাল খবরের কাগজে পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকার শীর্ষে বার্নিহাট এই নামটা দেখে বেশ অবাক হয়ে গেছিলাম।পাশে তিরঙ্গা জাতীয় পতাকার ছবি ধন্দ আরও বাড়িয়ে দিল সঙ্গে প্রবল অস্বস্তি , জায়গাটা চিনতে না পারায়। হাতের সামনে পাওয়া এ্যাটলাসের পাতা হাতড়াতে হাতড়াতে হাত ব্যাথা, চোখ বিগলিত। তবুও তেনার দেখা নাই। উপায়ান্তর না দেখে আমার এক ছাত্রকে ফোন করলাম। ও এখন কর্মসূত্রে অসম রাজ্যের বাসিন্দা। প্রথম প্রচেষ্টায় ওদিক থেকে কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে আবার তার নম্বর মেলাতে যাব, এমন সময় আমার মুঠোফোন বেজে ওঠে। স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠতেই বাটন টিপে কানের কাছে ফোনটা ধরতেই ওদিক থেকে কথা ভেসে আসে – “বার্নিহাট কোথায় ? -তা জানতেই বোধহয় ফোন করেছেন দাদা ? জায়গাটা আমাদের গুয়াহাটি থেকে প্রায় কুড়ি কিলোমিটার দূরে। অবশ্য শিলং থেকে এই শহরের দূরত্ব প্রায় ৬৫ কিলোমিটার। অসমের গায়ে গা লাগিয়ে থাকা মেঘালয় রাজ্যের রি- ভোই জেলায় মেঘালয় পাহাড়ের ঢাল যেখানে এসে গুয়াহাটির সমতলে মিশেছে সেখানেই এই বার্নিহাট শহর।” খট্ করে আওয়াজ তুলে কলটা কেটে যায়। বুঝতে পারি অসমে থাকার দরুণ বেচারিকে হয়তো শহরের অবস্থান জানাতেই নাজেহাল হতে হচ্ছে। ... ...
উত্তরগোলার্ধ্বে শীতকাল শেষ হয়ে বসন্তের উঁকিঝুঁকি, দক্ষিণ গোলার্ধ্বে সবে শরৎ। বাইরে তাপমাত্রা এখনো গায়ে ছ্যাঁকা না দিলেও দোকানে জিনিষপত্র কিনতে গেলেই হাতে ছ্যাঁকা খাচ্ছেন গৃহস্থ। রোজার দিন শেষ হয়ে এলো প্রায়, গাজনের সন্ন্যাসীদের এখনো দিন কুড়ি চলবে। দু:খী মানুষ সুখী মানুষ উদাসীন মানুষেরা ঘোরেফেরে দোকান বাজারে। কেউ বাধ্য হয়ে কেউ বা শখে কেউ কেনে ঝোলা উপচিয়ে কেউ বা দেখেশুনে রাখে 'পরেরবার ঠিক দেখিস... ' ... ...
ভুয়ো এপিক নিয়ে বিতর্ক যখন তুঙ্গে, নির্বাচন কমিশন তখন তাঁদের গাফিলতি ঢাকার উদ্দেশ্যে সমস্ত রাজনৈতিক দলকে ডেকে মিটিং করে ঘোষণা করলো, তাঁরা আধারের সঙ্গে ভোটার কার্ডের সংযোগ করিয়ে এই ভুয়ো ভোটার কার্ড সমস্যার সমাধান করতে চায়। প্রধান বিরোধী দলের পক্ষ থেকে সমাজ মাধ্যমে এই বিষয়টিকে স্বাগত জানানো হলো। সংসদের বিরোধী দলনেতা নিজে টুইট করে লিখলেন, অবশেষে নির্বাচন কমিশন তাঁদের অভিযোগকে মান্যতা দিল এবং আধারের সঙ্গে ভোটার কার্ডের সংযোগ ঘটানোর মধ্যে দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয়। সঙ্গে অবশ্য তিনি আরও একটা কথা যুক্ত করলেন, এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে কোনও ভোটার যেন বাদ না পড়েন, তা দেখতে হবে এবং সাধারণ মানুষের এই সংযোগ প্রক্রিয়ায় কোনও অসুবিধার সম্মুখীন না হন, সেদিকে নজর দিতে হবে। ... ...
'আমাদের দিনগুলিও অপূর্ণ, অপূর্ণ আমাদের রাত্রি, তবুও হাত ফস্কে জীবন চলে যায় যেন অকম্পিত ঘাসের মধ্যে একটি মেঠো ইঁদুর।' লিখেছিলেন এজরা পাউন্ড। জীবনের দিকে, এবং বারবার এই সন্ধেবেলায় নিজেদের দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছে সত্যিই অদ্ভুত ঘটনাহীন জীবন যেন নিস্তরঙ্গ দুপুরের উঠোন। পুকুরের বুক চিরে ব্যাঙাচি খেলার মত একটা করে ঢিল ছুটে যায় মাঝেমাঝে - সত্যিই কি জলের স্তর চিরে যায়? চেরে না। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবন যেন ঐরকম, কত কিছু হয়ে যায় দাগ পড়ে না। তবু সেইসব নিস্তরঙ্গ দিনগুলোর মধ্যে একদিন একটা বিপর্যয় ঘটে যায়। আমরা বোঝার আগেই একটা অন্য পৃথিবীতে গিয়ে পৌঁছুই। আর জেনে যাই - সময় দুইরকম হয়। বিপর্যয়ের আগে, আর বিপর্যয়ের পরে। 'যেমন অসত্য ছিল দীর্ঘ গতকাল, যেমন অসত্য হবে অনন্ত আগামী'। ঋতেনদার সাথে আমার আলাপ ২০০৩ সালের আগস্ট মাসের কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে। আমাদের বিস্ট্যাটের ক্লাস শুরু হয়েছে সেদিন, লাঞ্চব্রেকের আগেই অমর্ত্য দত্তর ক্লাসে গ্যালোয়ার টাওয়ার অফ ফিল্ড-টিল্ড শুনে তখন কান দিয়ে ধোঁয়া-টোঁয়া বেরোচ্ছে, এই অবস্থায় ক্যান্টিনের রাস্তায় আকর্ণবিস্তৃত নিষ্পাপ হাসি মেখে একজন ভালোমানুষ গোছের দাদা এগিয়ে এলেন। ঋতেনদা। ... ...
সাতগাঁয়ের পুরাতাত্ত্বিক ইতিহাসের মতই এই কাহিনীতে বাস্তবের সাথে মিলেমিশে আছে পরাবাস্তব, ইতিহাসের টুকরো টাকরা। এখানে কলার মান্দাসে ভেসে আসা মেয়ের পাছায় থাকে হার্মাদদের ক্রীতদাসত্বের সিলমোহর, পর্তুগিজ ভাষায় খিস্তি করা কাকাতুয়া মানুষমেয়েকে গর্ভবতী করতে পারে। বাপ্পার দিদিমা গঙ্গায় ডুব দিয়ে দূরবর্তী আত্মীয়া, বান্ধবীদের সাথে কথাবার্তা বলতে পারেন, সাতগাঁয়ের অন্য মেয়েদের সে কৌশল শিখিয়ে দিতেও পারেন। ... ...
যে তিনটি গ্রাম পঞ্চায়েত নিয়ে মহম্মদবাজারের এই কয়লা খনি এলাকা ধরা হচ্ছে, সেখানে আদিবাসী, তফসিলি এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের বাস বেশি শুধু নয়, তারাই প্রায় ৯০ শতাংশ। দেওয়ানগঞ্জ, হরিণসিঙ্গা অঞ্চলের তিন হাজার পরিবারের প্রায় ২১ হাজার মানুষ প্রাথমিকভাবে এই প্রকল্পের জন্য নিজের এলাকা থেকে উৎখাত হবেন। যদিও তাঁরা বিকল্প বাসস্থান এবং খোলা মুখ খনিতে কাজের সুযোগ পাবেন বলে সরকার জানিয়েছে। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন আবার জুনিয়র কনস্টেবলের চাকরি পাবেন - সরকার এমনও ঘোষণা করেছে। বিবাদ বেঁধেছে এখানেই। সরকারের এই প্রতিশ্রুতিতে গ্রামবাসীদের অধিকাংশের সায় নেই। তাঁরা কোমর বেঁধে নেমেছেন। খোলা মুখ খনিতে কতটা দূষণ হবে, কয়লা উত্তোলন ও পরিবহনের ফলে যে দূষণ হবে, তার জন্য কতটা জমির ফসল নষ্ট হবে, সে তো পরের কথা। মমতার সিঙ্গুর আন্দোলনের যে মূল কথা ছিল, মানুষ না চাইলে সরকার কোনও শিল্প প্রকল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করবে না, সেই আপ্তবাক্যই এখন মমতা সরকারের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েক লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ, বিকল্প বাসস্থান - কোনও কথাতেই চিঁড়ে ভিজছে না। মহিলারা সামনে এগিয়ে এসে পুলিশের সামনেই বলছেন, আমরা ভিটে জমি দেব না। তার জন্য দরকারে প্রাণ দেব। এটা আসলে আদিবাসী গাঁওতার সিদ্ধান্ত। ... ...
আমরা দু'বোন এক বাড়িতে থাকি/ অনেক সুখের সেই একটি সুখ,/ অ্যাস্ট্রোনমির অঙ্ক কষে দিদি/ সেই গর্বে নাচে বোনের বুক। সূর্য-তারা বোনের কবিতায়/ দিদির অঙ্কে তারাই আসে-যায়,/ আমরা জানি আমরা কেমন দেখি/ অন্যে বলে অন্ধ? ― তা বলুক! ... ...
এরিক ফান রিবেকের ডাচ অনুগামীরা সিদ্ধান্ত নিলেন ওই দ্বীপে জেলখানা বানিয়ে শাস্তি প্রাপ্ত অপরাধী, অবাঞ্ছিত, পূর্ব এশিয়া, মাদাগাস্কার ও কেপ কলোনির রাজনৈতিক বন্দিদের যদি সেখানে নির্বাসন দেওয়া হয় তাহলে ডাঙ্গায় ইট গেথে কাঁটা তার ঘিরে জেলখানা বানানো ও ডজন ডজন প্রহরী পোষার খরচাটা বাঁচে। রোবেন আইল্যান্ড কেপ টাউন থেকে দূরে নয়, বাইনোকুলার দিয়ে নজর রাখা যায়, কিন্তু পথ দুর্গম; তার আশে পাশে অজস্র মগ্ন মৈনাক, ঝোড়ো হাওয়ায় আকস্মিক উচ্ছলিত আটলান্টিকের জলরাশি, পালাবার পথ নাই। অন্তত দু ডজন জাহাজ ডুবেছে এখানে নোঙর বাঁধতে গিয়ে। কারাগারে পাহারাদার লাগবে কম। ওই দ্বীপ থেকে কেউ সাঁতরে কেপ টাউন পৌঁছুতে তো পারবেই না বরং হাঙরের মেনুতে পরিণত হবে। চিন্তাটি সঠিক। তিনশো বছরে নৌকা যোগে মাত্র দুটি সফল পলায়নের কাহিনি জানা যায়, তবে কোন বন্দীর সাঁতরে কেপ টাউন পৌঁছুনোর রেকর্ড নেই। ... ...
আমি ভূগোলের প্রেমে পড়েছিলাম পঞ্চম শ্রেণীতে, সেই যেবার নিবেদিতা ইস্কুলের ছোট বাড়ি মানে প্রাথমিক বিভাগ পেরিয়ে বড় বাড়িতে অর্থাৎ মাধ্যমিক বিভাগে এলাম। কাকলিদি ভূগোল পড়াতেন। সেই সময় প্রথম জানলাম ক্লাসের ঘণ্টা পড়লেই দিদি আসার আগে ব্ল্যাকবোর্ডের হুকে মানচিত্র টাঙিয়ে রাখতে হয়। আর ভূগোল ক্লাসে খাতা আনতে ভুলে গেলে তাও কোনোদিন ক্ষমা পেতেও পারি, কিন্তু চণ্ডীচরণের ম্যাপ বই না আনলে ক্ষমা নেই। ... ...
নদীর নাম ইছামতী। খুব বড় নদী নয়, খুব ছোটোও নয়; এপার ওপার দুপারই পরিষ্কার দেখা যায়। কিন্তু মাঝে মাঝে এই শান্ত নদী মাতাল হয়ে উঠে। কালবৈশাখী ঝড়ে এর রূদ্র রূপ চমক লাগায়। বর্ষায় এ হয়ে উঠে ভয়ংকর – পাড়ের জমি ভেঙ্গে পড়ে নদীর বুকে, গাছপালা বাড়ী ঘর কারো রেহাই নেই। বসিরহাটে আমাদের বাড়ী ছিল এই নদীর ধারে। ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের বাড়ীর সামনে বেশ বড় একটা বাগান, গাছ পালা ভর্তি। সেই বাগানে আমরা খেলাধুলা করতাম। বাগানের শেষে নদীর পাড়। প্রতি বছরই ইছামতী এই বাগানের ভাগ নিত একটু একটু করে। প্রতি বর্ষায় নদীর পাড় ভাঙত; ইছামতী গ্রাস করত জমি। নদীর ধারে একটা বকুল গাছ ছিল। গ্রীষ্ম কালে প্রচণ্ড গরমে গুমোট ঘরে থাকা যেত না; পড়ায় মন বসত না। সন্ধ্যাবেলা এই বকুল গাছের নীচে মাদুর বিছিয়ে হারিকেনের আলোতে পড়শুনা করতাম। নদীর ধারে মৃদু হাওয়া শরীর জুড়িয়ে দিত --- কি অভাবনীয় প্রশান্তি! একদিন সকালে উঠে দেখি সেই বকুল গাছটার শিকড় উপড়ে গেছে; পদচ্যুত বৃক্ষ মুখ থুবড়ে ইছামতীর জলে পড়ে আছে। মনটা আমার খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেদিন। পরে সরকার নদীর পাড় বাঁধাবার কাজে উদ্যোগী হয়েছিল। ইছামতী করুণা করে আমদের বাড়ী গ্রাস করে নি; কিন্তু মানুষ করেছিল। মানুষের হাত থেকে আমরা রেহাই পাই নি। ... ...
“মা বাইরে তাকিয়ে দ্যাখো না, বৃষ্টি হচ্ছে?” “হচ্ছে, কিন্ত জোরে নয়, উঠে পড়।“ “আর পনের মিনিট, মা। তুমি দশ মিনিট পরে আবার জানালায় যেও। যদি দেখ প্রাইমারির ছেলেমেয়েরা ফিরছে, তাহলে ডেকো না, তাহলে রেনি ডে। যদি না ফেরে তাহলে ডেকো। “রেনি ডে হলেই বা কী? সকাল সকাল উঠে পড়, বাড়িতেই পড়বি। আর এক মাস পরে তোর ফার্স্ট টার্ম না? এ কথার জবাব দিতে গেলে সকালের মিষ্টি আলতুসি ঘুমটা মাটি হয়। ঝিমলি মুখের ওপর চাদরটা টেনে দিয়ে পাশ ফিরে শুল। মা গজগজ করতে করতে মশারি খুলতে থাকে। ক্লাস ইলেভেন টুয়েলভের পড়া, এত কম পড়ে কী করে হয় কে জানে। স্কুলটুকু বাদ দিলে সারাদিনই তো হয় ঘুরে বেড়াচ্ছে নয় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে, অথবা গল্পের বইয়ে মুখ দিয়ে বসে আছে। এত বন্ধু যে কোত্থেকে আসে? আবার কারুর না কারুর জন্মদিনের পার্টি লেগেই আছে। আজকাল নাকি এরপরে সব আলাদা হয়ে যাবে বলে, জন্মদিন পালনের বেশী ঘটা। রাত্রি দশটা এগারোটায় সবাই ঘুমোতে গেলে, তিনি আলো জ্বালিয়ে বই খাতা নিয়ে নাকি পড়তে বসেন । অত রাতে কী ছাই পড়া হয় অমন করে কে জানে! ... ...
আগে ছেলেরা বিয়ে করত আর মেয়েদের বিয়ে হত। মেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকেই নানারকমের রাজপুত্রের গল্প শুনিয়ে চাগিয়ে দেওয়া হত। সে নাকি পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চড়ে আসবে। সঙ্গে বলা হত যে মেয়েরা আধ হাত ঘোমটা টেনে দশভুজার মতো সংসারের সব কাজ করবে; সেবা করবে। যেন বিবাহেই তাদের মোক্ষ। আর ছেলেদের পছন্দ ছিল টুকটুকে বউ। “টুকটুকে বউ আনবে আমার ভাই / গলা ছেড়ে গান গেয়ে যাই”। এখন অবশ্য বাইক একটা ব্যাপার হয়ে উঠেছে। তখনকার দিনে কারুর বিয়ে না হলে মনে করা হত যে সে হতভাগ্য; তার জীবনের আর কোনও মানেই নেই। বিবাহিত কুলীনদের মধ্যে সে ম্লেচ্ছ! আবার কুলীন ব্রাহ্মণেরা একগাদা বিবাহ করতেন। কমল কুমার মজুমদারের অন্তর্জলী যাত্রার কথা মনে পড়ছে। এখন অবশ্য আবার যারা ‘একবার’ বিয়ে করেছেন তাদেরকে অবাক চোখে দেখেন ‘চার-পাঁচবার’ বিবাহ করা মানুষজনেরা। বিয়েতে গায়ে হলুদ একটা বিরাট ব্যাপার। সেইরকমই এক বিয়েতে বরকে হলুদ মাখাচ্ছে। একজন ইওরোপীয়ান গেস্ট ব্যাপারটা খুব আগ্রহ নিয়ে দেখছিলেন। শেষে নিজেকে আর সামলাতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলেন, “হোয়াই হি হ্যাজ বিন স্মিয়ারিং উইথ স্পাইস? টারমেরিক, অয়েল?” একজন উত্তর দিলেন, “হি হ্যাজ বিন ম্যারিনেটেড ফর রোস্টিং”। ... ...
হয়তো সেই কারণেই, ঋতেন নিজের গল্পগুলো তার বন্ধুদের নাম দিয়ে বলত। ঋতেনের বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা, যাপন ও উপলব্ধির কথাগুলোকে আমরা বলতাম ঋতেনের বন্ধুদের কথা। ফেসবুক, অরকুটে, গুরুচন্ডা৯র ভাটিয়ালিতে ও বিভিন্ন টইতে এই বন্ধুদের বকলমে ঋতেন যে কতকিছু লিখে গেছে তার ইয়ত্তা নেই। পারিবারিক দিক থেকে সে ছিল কমিউনিস্ট নেত্রী ইলা মিত্রের পৌত্র এবং কবি রাম বসুর দৌহিত্র। পারিবারিক পরিমণ্ডলের সূত্রে যে সম্পদ তার কাছে ছিল, তার ছটাও আমরা ঋতেনের বন্ধুদের গল্প হয়ে পেয়েছি। ... ...
আমার দাদুকে বেশ ভাল মনে আছে । দাদু দীর্ঘায়ু ছিলেন , এক শত বছর এ ধরাধামে জীবন কাটিয়ে দেহ রেখেছিলেন । দাদু ছিলেন সুপুরুষ এবং সৌখীন । আমি যখন দেখেছি বার্ধক্য তখন দাদুকে ছুঁয়েছে । ধবধবে ফর্সা পক্ককেশ কালোপাড় শান্তিপুরী ধুতি পাঞ্জাবীতে ভূষিত সেই মানুষটিকে দেখলে আপনিই শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে । মায়ের কাছে দাদুর গল্প শুনেছি । দাদুর যখন বয়স পনেরো-ষোল তখন পিতা আনন্দ মোহন পরলোকগমন করেন । দাদু বংশের জ্যেষ্ঠ সন্তান ও উত্তরাধিকারী । ভায়েরা সব অল্পবয়সী নাবালক । একান্নবর্তী পরিবারের দায় দায়িত্ত্ব ও রক্ষণাবেক্ষণের গুরুভার দাদুর উপরেই । সেই সঙ্গে জমিদারি ও তার তত্বাবধান । বিত্তবান অল্পবয়সী জমিদারের তথাকথিত শুভাকাঙ্ক্ষী ও উপদেস্টার অভাব হয় নি । আমাদের সে সময় কলকাতার ট্যাংরা অঞ্চলে একটি বড় বাগানবাড়ি ছিল । বাড়িটি প্রধানত: জমিদারের বিনোদনের জন্যই বব্যহৃত হত । মোসাহেবের অভাব ছিল না --- তাদের নিয়ে নাচ গান বাজনার আসর বসতো । সেই বাড়ি দেখাশুনাআর জন্য এক দম্পতি ছিল । বাবা তাদের বাগানের খুড়িমা বাগানের খুড়ো বলতেন । দাদুর সঙ্গে বেশী নগদ টাকা থাকত না । নাচ গানের আসরে বখশিস বা মুজরো দেওয়ার দরকার হলে বাগানের খুড়োর কাছ থেকে তৎক্ষণাৎ টাকা নিতেন । টাকা দিয়ে খুড়ো এক টুকরো কাগজ দিত এগিয়ে দাদুর দিকে । দাদু তখন আসরে মশগুল , সরল মনিবের মত সেই কাগজে সই করতেন । কিছুকাল পরে সেই বাগানের খুড়ো খুড়িমা বাগান বাড়িটা দখল করে নিল । অজুহাত দিয়েছিল দাদু নাকি অনেক টাকা ঋণ নিয়েছিলেন । প্রমান স্বরূপ তদের কাছে দাদুর সই করা কাগজগু্লো আছে । ... ...
কলকাতার রয়াল হোটেলে লোকে খুব শখ হলে বিরিয়ানি খেতে যায় বা নিউ মার্কেটে আমিনিয়ায়। রয়াল হোটেল তখন খুব নামী। সেখানে ত্রিশ টাকা প্লেট খাসির বিরিয়ানি। লোকে মাটন বিরিয়ানি বলতো না। চিকেন তখনও মুরগি ছিল। কথায় কথায় এত ইংরেজিয়ানা ছিল না। আমরা পরিকল্পনা করলাম, ত্রিশ টাকা দাম নিচ্ছে! হোস্টেলে তখন মিল চার্জ এক টাকা আশি পয়সা হলেই ধুন্ধুমার বেধে যায়। অডিট হয়। এত কী করে হলো? ... ...
টেনের রেজাল্ট বেরোনোর পর থেকেই জয় এই শহরের হীরো হয়ে গেল, যে বাড়িতে যাও, সেখানেই শুধু তাকে নিয়ে আলোচনা। একদিন দাদার কাছে এসেছিল ইলেভেনের ফিজিক্সের কী ডিফিকাল্টি বুঝে নিতে। রাস্তায় জিজ্ঞেস করতে দাদাই বাড়িতে এসে ভালো করে বুঝে নিতে বলেছিল। সে কী বিপত্তি, মা দাদা বৌদি সব এসে জড়ো হল। তার মধ্যে দাদার চিৎকার, "দ্যাখ, এভাবেই ওরকম রেজাল্ট হয়, জয় এসেছে পড়া বুঝে নিতে আর তোকে ডেকে ডেকেও বই নিয়ে বসানো যায়না।" মাও মহা উৎসাহে যোগ দেয়, "শুধু কী তুই, কারুর কাছেই তো পড়তে চায়না, কী যে হবে ওর! এই তো জয় শরাফ স্যরের কাছে অংক করছে, শহরের সব ভালো ভালো ছেলেমেয়েরা তার কাছে অংক করে ইঞ্জিনিয়ারিং মেডিক্যাল পায়। আর এই মেয়ে একদিন গিয়ে বলে, শরাফ স্যর নাক খোঁটে, ওর কাছে পড়বনা। বালাসুন্দরমের কাছে কেমিস্ট্রী পড়বেনা কেন না সে এম কে ইয়াম আর এন কে ইয়ান বলে, কে বি গুপ্তা নাকি বই মুখস্থ করায়। হাজারটা বায়নাক্কা এর, এমন মেয়ে দেখেছিস জয়?" চশমার সরু স্টাইলিশ ফ্রেমের আড়ালে ঝকঝকে উজ্জ্বল চোখের, আপাতগম্ভীর মুখে কি চাপা হাসির আভাস? কিন্তু সে ছাই ভালো করে দেখার উপায় আছে এদের জ্বালায়! কী যে ভাবছে ওর সম্বন্ধে, ধরণী দ্বিধা হও ব্যাপার স্যাপার, ঝিমলি মানে মানে সরে পড়ে সেখান থেকে। ভাবছে কি, হয়ত ভাবছেই না, বয়ে গেছে তার, ওর মত বিচ্ছিরি, লেখাপড়ায় ফাঁকিবাজ, কোনোকিছুতেই ভালো নয় মেয়ের কথা ভাবতে! ... ...
অনেকে হয়তো ভাবছেন, ভারতের স্থান কত? ২০২৩ সালে ভারতের স্থান ছিল ১৬২ আর ২০২৪ সালে ভারত ১৫৯তম স্থান পেয়েছে ১৮০টি দেশের মধ্যে। আসলে কোনও দেশের সরকারই গণতান্ত্রিক নয়। ভারতে যদি হিন্দুত্ববাদী শক্তির উত্থান হয়ে থাকে, তুরস্কে তেমনি মুসলমান মৌলবাদী শক্তি ক্ষমতায় আছে, এই সূচকে যাঁদের স্থান ভারতের একটু আগে- ১৫৮। এ যেন কে কত খারাপ হতে পারে তার প্রতিযোগিতা চলছে। বিশ্বের বেশীরভাগ সরকার সোশ্যাল মিডিয়া এবং ইন্টারনেটের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ বাড়িয়েছে, সেই ইন্টারনেট কারা ব্যবহার করবেন তার সীমা নির্ধারণ করেছে, অ্যাকাউন্ট ব্লক করেছে এবং সংবাদ ও তথ্য বহনকারী বার্তাগুলিকে দমন করেছে। ভিয়েতনামের সাংবাদিকদের বক্তব্য যা সোশ্যাল মিডিয়ায় আসে তাকে পদ্ধতিগতভাবে বন্ধ করা হয়েছে৷ চীনে বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় বেশি সাংবাদিককে আটক করার পাশাপাশি, সরকার বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করা চ্যানেলের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ করেছে। অনলাইন বিষয়বস্তু নিয়ন্ত্রণের জন্য সেন্সরশিপ এবং নজরদারি নীতি প্রয়োগ করে এবং সংবেদনশীল বা দলীয় লাইনের বিপরীত বলে বিবেচিত তথ্যের বিস্তার সীমিত করেছে। কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী সাংবাদিকদের অপমান, অসম্মান এবং হুমকি দিয়ে তাদের প্রতি ঘৃণা ও অবিশ্বাসকে উস্কে দেওয়ার কাজটাও করে চলেছে। অন্যরা মিডিয়া ইকোসিস্টেম দখলের আয়োজন করছে, তা তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন মিডিয়ার মাধ্যমে হোক, বা বেসরকারি মালিকানাধীন মিডিয়া বন্ধু ব্যবসায়ীদের দ্বারা অধিগ্রহণের মাধ্যমে হোক। জর্জিয়া মেলোনির ইতালি (৪৬ তম) - যেখানে ক্ষমতাসীন সংসদীয় জোটের একজন সদস্য দ্বিতীয় বৃহত্তম সংবাদ সংস্থা (এজিআই) অধিগ্রহণ করার চেষ্টা করছেন – তার ফলে ঐ সূচকে এই বছর পাঁচটি স্থান নেমে গেছে। রাজনৈতিক দলগুলি প্রায়শই প্রচারের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে চলেছে, এমনকি বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার উসকানিও দিচ্ছে। সূচকে মূল্যায়ন করা দেশগুলির তিন-চতুর্থাংশেরও বেশি (১৩৮টি দেশ) বেশিরভাগই রিপোর্ট করেছেন যে তাদের দেশের রাজনৈতিক নেতারা প্রায়শই প্রচার বা বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার সাথে জড়িত ছিল। এই সম্পৃক্ততাকে ৩১টি দেশে "পদ্ধতিগত বিষয়" হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ... ...
বিনা ব্যয়ে শিক্ষার অধিকার আইন বলে একটি আইন হয়েছিল এই দেশে। তার পরই সকলের জন্য শিক্ষার বিষয়টা নিয়ে ভালোরকম নাড়াচাড়া হয়। স্কুলের পরিকাঠামোর কিছু উন্নতি হয়, প্রাথমিক স্তরে শিক্ষক নিয়োগ হয়। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত তো বটেই তার পরেও বিনামূল্যে বই খাতা দেওয়া হয়। মিড ডে মিল ইত্যাদি তো আছেই। এই সময় থেকে ছাত্রছাত্রী সংখ্যাও বাড়ে। যাবতীয় সরকারি দপ্তরে সংবেদনশীলতা বাড়ানো হয়, হিসাব রাখার জন্য পোর্টাল খোলা হয়, প্রত্যেক ছাত্রছাত্রীর ইউনিক আইডি দেওয়া হয়। ... ...
অমলেন্দু বিশ্বাস সেই প্রজন্মের লোক যাদের সম্পর্কে ঠাট্টা করে বলা হতো যে তাঁদের জীবনের সংকল্প ছিল ‘আমার এই দেশেতে জন্ম, যেন ওই দেশেতেই মরি’। কিন্তু ঠাট্টায় যেটা ধরা পড়ে না তা হলো এই জন্ম আর মৃত্যুর ঠিকানা আলাদা হয়ে যাওয়া ব্যাপারটা সহজ নয়। যাঁরা এর মধ্যে দিয়ে গেছেন, এবং যাবার সময়ে ভেবেছেন যাওয়াটা কিরকম, কোথায় যাচ্ছি, যেতে যেতে আমার আমিটার কি হচ্ছে - তাঁদের নিজের জীবন সম্পর্কে লেখার, আমাদের জগতে, একটা বিশাল প্রয়োজন আছে। একশো বছর আগে যা লেখা হতো সেগুলো ইউরোপ যাত্রীর পত্র, বা স্বল্প প্রবাসের কথা, সে প্রবাস যে বাসিন্দা তার সত্তাকেই পরিবর্তিত করে দেয় না। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে এই প্রবাস অতি সাধারণ; অনেক সময় মনে হয় মধ্যবিত্ত ব্যক্তিদের জীবনের প্রথমটা এই প্রবাসেরই সুদূর ভূমিকা বা প্রস্তুতি। মনে রাখতে হয় অবশ্যই এই প্রবাসও পরিবর্তনশীল - ষাট-সত্তরের পাশ্চাত্য সমাজ এখনকার পাশ্চাত্য সমাজের মতো ছিল না; ষাট সত্তরের মধ্যবিত্ত বাঙালি সত্ত্বাও তার এখনকার অবতারের থেকে আলাদা ছিল। তার থেকেও বড়ো কথা, প্রত্যেক ব্যক্তিমানুষ এই প্রবাসের ইতিহাসকে নিজের মতো করে তৈরী করে নেয়। এই সততভিন্নতার জন্যেই একজন ব্যক্তির এক বিশাল ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে যাত্রার কাহিনী আমাদের পড়তে ভালো লাগে। ... ...
এই উপন্যাসে প্রত্যক্ষ ও প্রচ্ছন্ন দু’ভাবেই রাজনীতির অবিসংবাদিত ভূমিকা। প্রথমত, দেশভাগ ও তার পরবর্তী কালের দুই বাংলার রাজনীতি ; দ্বিতীয়ত, এই বাংলার সাম্প্রতিক কালের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা। অখণ্ড ভারতের দ্বিখন্ডীকরণে তৎকালীন অনেক রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থান্ধ সক্রিয়তার পাশাপাশি কয়েকজন নেতা ও সাধারণ মানুষের যথার্থ দেশপ্রেম এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিশ্বস্ত বাস্তবতা এখানে ধরা পড়েছে। লেখকের কাছে আতিকুজ্জমান ও তার দুই ছেলে কাহিনিতে গান্ধী,নেহেরু ও জিন্নারই রূপকপ্রতিম হয়ে উঠেছে। বাবার ‘হাঁটানো মেয়েকে’ পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে বড়ো ছেলে রব বন্ধুকে দিয়ে তাকে হত্যা করেছে। শুধু তাই নয়, এই হত্যাকে সামনে রেখে কট্টরবাদী রব চেয়েছে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে। আতিকুদ্দিন আর তার অন্য ছেলে রহিম কিন্তু এই সর্বনাশা ক্রিয়া-কর্মের বিরোধী। এভাবেই লেখক অত্যন্ত সাবলীলভাবে বাস্তবতার ভারসাম্য রক্ষা করেছেন, আলাদা করেছেন মৌলবাদীদের সঙ্গে সাধারণ মানুষকে। ... ...