গতবারে বাড়ি থেকে জলদাপাড়া ঘুরতে এসে এই অনুভূতি হয়েছিল আমার হাতি সাফারি করার সময়ে। ঘটনাটা খুলে বলি তাহলে। দেখেছিলাম আমাদের যারা পিঠে করে নিয়ে যাচ্ছে তারা চারজনই হস্তিনী, কারণ মদ্দা হাতিকে এভাবে কাজে লাগানো হয়না। আমি বসলাম যে হাতির পিঠে তার নাম প্রিয়দর্শিনী। বাকি তিনটির নাম হল মীনাক্ষী, আম্রপালি আর ডায়না। এই তিনটিই মা হাতি, তাদের ছানারা মায়ের গা ঘেঁষে ঘেঁষে জঙ্গলের পথে চলেছে। মীনাক্ষী আর আম্রপালির ছানাদের বয়স আড়াই আর তিন বছর। শুধু ডায়নার ছানাটাই বড্ড কচি, বয়স মাত্র এগারো মাস। তার কচি মুখ, খাড়া খাড়া চুল আর দুষ্টু চোখ দেখে আমার তাকে খুব আদর করতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু মাহুত বলল যে বাচ্চার কাছে গেলে মা হাতি শুঁড়ে জড়িয়ে আছাড় দেবে, আর পা দিয়ে মাথা থেঁতলে দেবে। শুনে আর এগোলাম না বাবা।
আমাদের পিঠে চাপিয়ে ভেজা ভেজা শুঁড়ি পথ বেয়ে হাতির দল এগিয়ে চলল। এর আগে অবশ্য গরুমারা অভয়ারণ্যেও আমি জিপ সাফারি করেছি। কিন্তু জিপ যায় রাস্তা দিয়ে। গাড়ি গুলোর ভালো রক্ষণাবেক্ষণ হয়না। ভীষণ আওয়াজ হয়। তাই জীবজন্তু দেখা দেওয়ার বদলে আরো দূরে সরে যায়। এখানে সেই সমস্যা নেই।
ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম জঙ্গলের চারটে স্তর। জঙ্গলের মেঝে আগাছায় ভর্তি। এটা হলো প্রথম স্তর। তার ওপরে মাঝারি উচ্চতার গাছ। সেটা হলো দ্বিতীয় স্তর। একেবারে ওপরে আছে অনেক উঁচু উঁচু গাছের সারি। সেটা হলো তৃতীয় স্তর। আর এই তিন স্তরকেই জড়িয়ে আছে নানা রকম লতাপাতা আর অর্কিড। সেটা হলো চতুর্থ স্তর। এমন চারতলা বনে ছোট বড় সব জন্তুই বাস করতে ভালোবাসে। কারণটা খুব সহজ - ওদের বাসাটা শত্রুদের চোখে লুকিয়ে রাখতে পারে, আবার লুকিয়ে লুকিয়ে চলাফেরা, বা নজর রাখাটাও সম্ভব। আমি শহরের মেয়ে। খুব বেশি গাছের নাম জানিনা। রাস্তা দিয়ে জীপে চড়ে গেলে এমন ধীরে ধীরে, দুলকি চালে গহন বনের ভেতরে ঢোকা যায়না। কিন্তু চারিপাশে আজ এত সুযোগ, অথচ অনেক গাছ দেখেও যেন ঠিক দেখা হলো না। বহু কিছু না দেখা রয়ে গেল। চোখে দেখাটা তো সব নয়, দেখে কিছু বুঝতে না পারলে তা না দেখার সামিল। তবে একটা গাছ চিনতে পেরেছি, জঙ্গল ভর্তি কারি পাতা গাছ। কলেজের সঙ্গে থাকলে খুব সুবিধে হয় আমার। আমাদের ছেলেমেয়েরা বেশিরভাগ গ্রাম থেকে আসে তো, অনেক গাছ চেনে। আবার কেউ চিনতে না পারলে চলভাষে গুগল লেন্স বাগিয়ে গাছ চেনার তাগিদ থাকে। অভিজ্ঞতা আর সামর্থ্য অনুযায়ী বায়ো ডাইভার্সিটি রেজিস্টার বানানো হয়। জল, মাটির গুণাগুণ, বাতাসের গতিবেগ, প্রবাহের দিক - কত কী পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু বাড়ি থেকে এলেই অপূর্ণতা তাড়া করে বেড়ায়। কিছুই তো জানা বোঝা হচ্ছেনা। এ জ্বালা বোঝাই কাকে?
পুরো জঙ্গল জুড়ে হলং নদীর অনেকগুলো ধারা আছে। স্বচ্ছ কাঁচের মত হলং নদীর জলধারার আড়াআড়ি মাঝখান দিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম। হঠাৎ দেখি মীনাক্ষী আর আম্রপালির ছটফটে ছানা দুটো মায়ের পাশ ছেড়ে জলে খেলা করতে শুরু করেছে। আর মা হাতিরাও দাঁড়িয়ে পড়েছে। মাহুত ছড়ি ঘুরিয়ে বলে উঠল “মিলে মিলে”, জিজ্ঞাসা করে জানলাম মিলে মানে এগিয়ে চলো। নদী পেরিয়েও ছানাদের খেলার নেশা গেল না। তারা দুজনে দুজনকে ঠেলাঠেলি করতে লাগল - খুব দুষ্টু। তাতে দুই মা হাতিই “ঘাঁক ঘাঁক” আওয়াজ করে ছানাদের বকে দিল। আমার বেশ মজা লাগল। কচি ছানাটা এসব কিছু দুষ্টুমি করতে পারেনি। তার মাহুত মাঝে মাঝে মাকে একটু পাশে নিয়ে যাচ্ছে। কচি ছানাটা কিছুটা হাঁটার পরেই মায়ের দুধ খাচ্ছে। আমি আগে কখনো হাতির ছানার দুধ খাওয়া দেখিনি। বড় ছানাগুলোকেও তাদের মায়েরা যেসব লতাপাতা পছন্দ হচ্ছিল, সেগুলো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়াচ্ছিল। মা আর সন্তানের সম্পর্ক সব প্রাণীর ক্ষেত্রে তো একই। এই পাতা খাওয়ানোর জন্য মা হাতিরা মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে পড়ছে। মাহুত বলছে, “বেরি, বেরি, মিলে মিলে”, মানে ছাড়ো ছাড়ো, এগিয়ে চলো। জঙ্গলের এত সরু পথ দিয়ে আমরা চলেছি, যে গাছের ঝুরি, শক্ত ডাল, পাতা আমাদের মুখে চোখে লাগছে। মাহুত তাই তার হাতের ছড়ি দিয়ে ডাল পাতা ঠেলে রাখছিল। এই করতে গিয়ে একজন মাহুতের হাত থেকে তার ছড়ি পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মাহুত বলে উঠল, “ধাইর, ধাইর”, মানে ধরো ধরো। হাতি অমনি শুঁড়ে করে লাঠিটা নিয়ে মাহুতের হাতে তুলে দিল। আবার মাহুত ইঙ্গিত দিলে হাতি মট মট করে ডাল ভেঙ্গে পথ করে নিচ্ছিল।
জল পেরোনোর সময়টাতে - কী আর বলি, জলে নামার জন্যে আমারও হাত পা নিশপিশ করছিল। আরে না না অবগাহন - টাহন নয়। নদীটা ছোট। ডোবার ঝুঁকি নেই। জলটা পরিষ্কার। ভালো স্রোত আছে। মুর্শিদাবাদের গঙ্গার মত কাজ করতে গিয়ে খাড়া পাড় ভেঙে নিচে পড়ার ভয় নেই। মেজারিং টেপটা ধরে হাতে স্টপ ওয়াচ অন করে পাঁচ মিটার দূরে দূরে কয়েকজনকে দাঁড় করাতে যদি পারতাম! আহা রে, বনে কত বড় বড় পাতা। সুবিধে মত একটা পাতা নিয়ে প্রথম জন ঘড়িতে সময় দেখে জলে ভাসিয়ে দিল। তারপর দ্বিতীয়, তৃতীয় পর পর যার সামনে দিয়ে যখন পাতাটা ভেসে যায়, তখন যে যার মত সময়টা দেখে নিলেই কেল্লা ফতে। মোটামুটি ওখানে হলং নদীর জলের বেগ মেপে নেওয়া যেত। মনে মনে এসব কল্পনা করে মশগুল হয়ে ছিলাম। সমতল অথচ এমন উপযুক্ত জায়গা খুব কম পাওয়া যায়। কারণ সমতলের নদীগুলো হয় বিশাল বিশাল। ছেলেমেয়েদের কাজ করানো রিস্ক হয়ে যায়। আবার পাহাড়ে কোথাও এসব করতে গিয়ে পা না ভাঙুক, মচকায় তো বটে। সেখানে ওপরে জল সোজা দেখালেও তলায় পট হোলে পা পড়ার ভয়ও থাকে ষোলো আনা। হায়রে তোদের নিয়ে কোনদিনও কি এখানে আসতে পারবো রে। হাতিতে চড়ার অনেক খরচ, আর জীপে চড়ে এলে এসব জায়গায় পৌঁছনো অসম্ভব।
হঠাৎ লক্ষ্য করলাম জঙ্গলের ঘনত্ব কমে আসছে। তারপর দেখি জঙ্গল আর নেই। বড় বড় ঘাসের মধ্যে এসে পড়েছি। আমরা যে হাতির পিঠে এত উঁচুতে বসে আছি, কিছু কিছু ঘাস আমাদের মাথার থেকেও লম্বা। সামনে এক হাতি সওয়ারির থেকে চাপা চিৎকার শোনা গেল, “ঐ যে, ঐ যে”, দেখলাম ঘাসের মধ্যে এক বিশাল একশৃঙ্গ গণ্ডার। কিন্তু একি!!! গণ্ডারটার সারা শরীর রক্তাক্ত। মাহুত বলল অন্য গণ্ডারের সঙ্গে লড়াই করে ওর এই অবস্থা হয়েছে। তাকে ছেড়ে ঘাসের জঙ্গলে এগিয়ে চললাম। দেখলাম ঘাসের মধ্যে বড় বড় কাশ ফুলের মত শিষ, কিন্তু একটু শুকনো। এবারে দ্বিতীয় গণ্ডারের দেখা পেলাম। ঘাসের দৈর্ঘ্য বেশি হলেও তা গাছের জঙ্গলের মত দৃষ্টি আটকায়না। তাই দেখলাম দিকচক্রবালে মেঘের মধ্যে পাহাড়ের সারি। পেঁজা মেঘের আড়ালে ঝকঝকে নীল আকাশ। নীল সাদার মধ্যে রুপোলী চিকচিকে কি ও? দেবতাত্মা হিমালয় কি আজ আমাদের ওপরে এতটাই প্রসন্ন!! না! আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। দূরে বরফে ঢাকা আবছা পর্বতশ্রেণীর মধ্যে ঐ দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। কিছুদূর যেতে তৃতীয় গণ্ডারের দেখা পাওয়া গেল। কিন্তু শরীরী ভাষা দেখে বোঝা গেল তার মন ভালো নেই। যে হাতি এগিয়ে গিয়ে গণ্ডার স্পট করেছিল, তার মাহুত একটু দূরে অপেক্ষা করতে লাগল। কাছে গেলনা। বাকি তিনটে হাতি এসে পৌঁছলে ভালো করে পর্যটকদের গণ্ডার দেখানোর জন্য একসঙ্গে এগোল। মাহুত বলল রাগী গণ্ডার আক্রমণ করতে পারে। তাই দল বেঁধে চলতে হবে। গণ্ডারটা একধরনের লালচে ঝোপের মধ্যে আড়াল নিল। ঝোপটায় খুব চেনা চেনা কিন্তু একটা ঝাঁঝালো গন্ধ পাচ্ছিলাম। ও হো, অনেকটা জায়গা জুড়ে এ যে বন তুলসীর ঝোপ!
গণ্ডারটার আমাদের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে ছিলনা। এমন হতেও পারে সেই রক্তাক্ত গণ্ডারের সঙ্গে লড়াইতে ও হেরে গেছে, তাই মন খারাপ। উচিৎ ছিল ওকে ওর মত থাকতে দেওয়া। কিন্তু মানুষের লোভ, অন্যের মনের কথা শুনতে চায় না। আমাদের তাড়নায় গণ্ডার বেচারা বড় গাছের জঙ্গলে মিলিয়ে গেল।
ফেরার পথ আগের মতই, তবে উপরি পাওনা হলো ময়ূরের ঝাঁক আর তাদের পেখম তুলে নাচ।
ফিরে এলাম হলং বাংলোর সামনে। এক অনির্বচনীয় অভিজ্ঞতা পেলাম। হাতির পিঠ থেকে নেমে পর্যটকরা খুশি হয়ে মাহুতদের বখশিস দিতে চাইলে তার হাতি শুঁড় বাড়িয়ে দিল। শুঁড়ে টাকা দিলে পর্যটককে অভিবাদন করে শুঁড় তুলে হাতিরা তাদের মাহুতের হাতে টাকা জমা করল।
এতক্ষণ শুধু আনন্দ হচ্ছিল। কিন্তু হাতির পিঠ থেকে নেমে, এই বিশাল প্রাণীকে মানুষ কিভাবে দাসত্ব করাচ্ছে ভেবে খুব খারাপ লাগল। হাতির পিঠে গদি, তার ওপরে বসার চেয়ার। আমরা গদির ওপরে পা রেখেছিলাম, যাতে হাতির গায়ে পা না লাগে। কিন্তু দেখছিলাম অন্য হাতিতে লম্বা চওড়া মানুষজন পা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। হাতির চলার দুলকি চালে তাঁদের পাও দুলছিল। ভারী ভারী স্নিকার্স পরা পাগুলো বার বার জোরে জোরে হাতির গায়ে লাগছিল। বসার আসনগুলোও একেবারে যেন আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ো, হাতির পিঠে ঠিক মত বসেওনা। তার ওপর আবার চারজন দর্শক আর মাহুত - পাঁচ পাঁচটা মানুষের ওজন - বিশাল প্রাণীটা সেটা সহ্য করেই নীরবে কচি বাচ্চা নিয়ে মানুষের দাসত্ব করছিল। মা আর সন্তান - তাদের জীবনের ভালো মন্দ, নিভৃত সম্পর্কের রসায়ন - এসব তো কারোর উল্লাস উপভোগের বিষয় হওয়াটা ঠিক নয়। আর এই সহ্য করা শিখতে গিয়ে না জানি প্রাণীগুলোকে অল্প বয়স থেকে কত কঠিন শিক্ষা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। আবার ছোট গাড়িতে জঙ্গলের গণ্ডি পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। মনে প্রশ্ন জাগল, বনকে বিব্রত করে এই আনন্দ পাওয়ার কি সত্যি আমাদের ভীষণ দরকার ছিল? একথা সত্যি বনকে কাছ থেকে না দেখলে তার প্রতি ভালোবাসা আনা মুশকিল, আর সাধারণ মানুষের ঐ ভালোবাসাটা আজকের দিনে বনকে বাঁচাতে বড়ই দরকার। পয়সা খরচ করে আনন্দ না পেলে তারা আসবেই বা কেন। কিন্তু এটাও যে একজায়গায় পড়লাম, এমন ভার বইতে বইতে হস্তিনীদের শিরদাঁড়ায় চোট লাগে। আমারো তো বয়স হচ্ছে। শিরদাঁড়ার ব্যথা কী জিনিস ভালো করেই জানি। সেই আমিই তো ওর পিঠে উঠে আনন্দ করলাম। এসব কথা যখন ভাবতে বসি মন খারাপ করে।