“আলো, তোমায় নমি আমার
মিলাক অপরাধ।
ললাটেতে রাখো আমার
পিতার আশীর্বাদ।
বাতাস, তোমায় নমি, আমার
ঘুচুক অবসাদ,
সকল দেহে বুলায়ে দাও
পিতার আশীর্বাদ।
মাটি, তোমায় নমি, আমার
মিটুক সর্ব সাধ।
গৃহ ভরে ফলিয়ে তোলো
পিতার আশীর্বাদ।” -
এ কথা লিখেছিলেন কবিগুরু। ঈশ্বর, আল্লা, গড বা পরম ব্রহ্ম সত্যি আছেন কিনা জানা নেই, তবে নিজের জীবনে যা দেখেছি, যা বুঝেছি সেকথাই বলি। মাঠা পাহাড়ে শীতের আমেজে কুয়াশার ওড়না সরিয়ে যখন চোখে ঊষার প্রথম আলোর ছটা এসে পড়ে, অথবা বসন্তে অকাল বর্ষণে থমকে যায় কলকাতা শহর আর নন্দন চত্বরে আমের বোলের তীব্র সুবাস হঠাৎ শিথিল করে ব্যস্ত পদক্ষেপ, তখন এক আশ্চর্য অনুভূতি হয়। আমাদের চারিদিকে ছিটিয়ে থাকা খণ্ড মনোযোগ কীসের টানে এক দুই মুহূর্তের জন্য এক বিন্দুতে চলে আসে। সুচিন্তা, কুচিন্তা কোনটাই স্মরণ হয় না। ভারি ভালো লাগে ঐ ক্ষণ। কিন্তু বেশি করে পাওয়া হয় না। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হারিয়ে যায় শান্তির অনুভূতি। বোধকরি এই মুহূর্তগুলোকে বেশি করে পাবার জন্যই ছিল প্রাচীন ঋষিদের সাধনা। খেয়াল করে দেখেছি, এয়ার কন্ডিশন্ড হলে পিন ড্রপ সাইলেন্সের মধ্যে অনেক্ষণ থাকলেও এমন হয় না। কিন্তু বক্সা পাহাড়ের নিচে বিকেলের হলুদ আলো যখন ঘন হয়ে আসে, জয়ন্তী নদীর সাতরঙা নুড়ি পাথরের পাশে বন, আর সে বনের ধনেশ পাখিরা কর্কশ ডাকে এ-ডালে, ও-ডালে - ঠিক তখন, হরিণের জল খাওয়ার শব্দে মনও ঘন হয়ে আসে দুই ভ্রূয়ের সন্ধিতে, চোখ বন্ধ করার প্রয়োজন পড়ে না, দলের সঙ্গে থেকেও নির্জনতা অনুভব করা যায়। ছোটবেলায় পাঠশুরুর আগে প্রার্থনা হত ঠাকুর দালানে। সেখানে না বুঝেই সবাই মিলে সুর মেলাতাম -
সেই কবেকার বৃহদারণ্যক রচনায় মন্ত্র দ্রষ্টা ঋষির বলা কথা - “বায়ু মধু বহন করিতেছে। নদী, সিন্ধু সকল মধুক্ষরণ করিতেছে। ওষধি বনস্পতি সকল মধুময় হউক। রাত্রি মধু হউক, ঊষা মধু হউক, পৃথিবীর ধূলি মধুমৎ হউক। সূর্য মধুমান হউক।”
বরফের উপত্যকায় দাঁড়িয়ে, সোনালি বালিয়াড়ির সামনে গনগনে বালির ছোঁয়ায়, অথবা চোখের সামনে যখন সাগরপারে কোলের কাছে দুরন্ত ঢেউ আর দিগন্তে আকাশ-জলের মিলনরেখা বড় স্থিরভাবে মেশে, সেইসব সময়ে ঐ প্রার্থনা মন্ত্রের স্বরূপ দেখতে পাওয়া যায় নিজের মতো করে। আর দেখতে পেলেই অদ্ভুত মির্যাকল। কিছু সময় বা কয়েক দিন পরে, অনেক না পাওয়া উত্তর মনে ভেসে আসে, অনেক জট আপনা থেকে খুলে যায়। আর একটা ব্যাপার হয়। মন যখন প্রকৃতির কোলে একাগ্র হয়, আগল খুলে যায়, আমরা চারপাশের সহকর্মী আর ছাত্রছাত্রীদের অনেক না বলা কথা বলে ফেলি। তারা যা বলে, তা-ও শুনি। দিন কেটে যায় নানা কাজে, রাতে চলে কথোপকথন। ফিল্ড সার্ভের এই কয়েকদিনের চর্চাই হয়ে ওঠে আমাদের বছরের বাকি গতানুগতিক দিনগুলোয় টিঁকে থাকার অক্সিজেন। এইবার পথে আসি। ভূগোলের ছাত্রী হয়ে মাঠে ঘাটে ঘুরছি নয়ের দশকের শুরু থেকে। কম দিন তো হল না। দেশটাকে দেখলাম উলটে পালটে। আজ মনে হয়, কিছু কথা যদি লিখে না রাখি, অপরাধ হবে উত্তর পুরুষের কাছে। জানি না, ঠিক পারম্পর্য রাখা সম্ভব হবে কিনা। নাও যদি হয়, তবু এ হবে আমার সত্য কথন, এই কথাটুকু দিতে পারি। তবে শুরু করি একেবারে কুঁড়ি থেকে।
মানচিত্রের রূপকথা
আমি ভূগোলের প্রেমে পড়েছিলাম পঞ্চম শ্রেণীতে, সেই যেবার নিবেদিতা ইস্কুলের ছোট বাড়ি মানে প্রাথমিক বিভাগ পেরিয়ে বড় বাড়িতে অর্থাৎ মাধ্যমিক বিভাগে এলাম। কাকলিদি ভূগোল পড়াতেন। সেই সময় প্রথম জানলাম ক্লাসের ঘণ্টা পড়লেই দিদি আসার আগে ব্ল্যাকবোর্ডের হুকে মানচিত্র টাঙিয়ে রাখতে হয়। আর ভূগোল ক্লাসে খাতা আনতে ভুলে গেলে তাও কোনোদিন ক্ষমা পেতেও পারি, কিন্তু চণ্ডীচরণের ম্যাপ বই না আনলে ক্ষমা নেই। স্কুলের নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে ঘরের বড় টানাটানি। তার মধ্যে ফাইভ এ আর টিচার্স রুমের মধ্যে আস্ত একটি ঘর রাখা আছে কেবল মানচিত্রের জন্য। সেঘরে ভর্তি কালো ভারি কাঠের সুদৃশ্য সব আলনা। না জামাকাপড় রাখার মতো মোটেই নয়। দুপাশে গোল করে ঘোরানো হ্যাঙারের মতো। প্রতিটা খাঁজে থাকে রোল করে রাখা দেয়াল মানচিত্র। ঘরটায় জানলা ছিল অনেকগুলো। সবকটাই দরজার মতো বড়। পাছে বৃষ্টির ছাটে মানচিত্র ভিজে যায়, তাই জানলা বড় একটা খোলা হতনা। কিন্তু পাল্লাগুলো ছিল পুরোনো আমলের খড়খড়ি দেওয়া, ফাঁক দিয়ে রোদ আসতো। তাই ভিতরে অন্ধকার হতনা। বেশ একটা ঝিলমিলে আলো আঁধারি থাকত। ঐ অদ্ভুত ঘরে ইচ্ছে হলেই ঢোকা যেতনা। তালা দেওয়া থাকত। প্রতিদিন ভূগোল ক্লাসের আগে ছাত্রীদের দুজন প্রতিনিধি দস্তুর মতো অনুমতি নিয়ে ঐ ঘরে প্রবেশাধিকার পেত। এক একটা রোল খুলে কোনটা ইউরোপ, কোনটা এশিয়া, কোনটাই বা ভারতের নদনদী, আমরা খুঁজে বের করতাম। কোনোটা প্রাকৃতিক, আবার কোনটা রাজনৈতিক। কোথাও এশিয়া মাইনর, পামীর মালভূমি আবার কোথাও উত্তর আমেরিকার পঞ্চ হ্রদ কিংবা আফ্রিকায় কঙ্গোর জঙ্গল। ম্যাপ ঘরে ঢুকে পড়লে আমার কল্পনা ডানা মেলতো। খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে আসা রোদ্দুরের রেখা ধরে মন ইস্কুল বাড়ির বাইরে কখনো সাইবেরিয়ায় তুন্দ্রা অঞ্চলে পাড়ি জমাতো, কখনো ভূমধ্যসাগরে জাহাজ ভাসাতো।
সেই ছোট বয়সেই বুঝতে পেরেছিলাম যে জিনিসের জন্য ইস্কুলে একটা আলাদা তালা দেওয়া ঘর থাকে সে জিনিস মহামূল্যবান।
আমাদের প্রধান শিক্ষিকা ছিলেন প্রব্রাজিকা স্বরূপপ্রাণাজী। তাঁর আসল নাম কৃষ্ণা। তিনি ছিলেন ভীষণ কড়া ভূগোলের দিদিমণি। আমরা তাঁকে ভয় করতাম, কিন্তু দেখতাম অন্য বয়স্ক দিদিরা অনায়াসে তাঁকে ডাকনামে কালো বলে ডাকছেন। হোস্টেলেও তাঁকে সবাই কালোদি বলেই চিনত। আমাদের ইস্কুলে ঢুকতেই বাঁদিকে দেয়াল জোড়া বিশাল ভারতের ম্যাপ ছিল। ছিল বলা ভুল, এখনও আছে। কাগজে ছাপা নয়। কাগজের মণ্ড দিয়ে তৈরি, অপূর্ব রং করা দেয়ালে বসানো মানচিত্র। শুনেছি ঐ মানচিত্র স্বরূপপ্রাণাজীই উদ্যোগ নিয়ে কোনকালে তৈরি করিয়েছিলেন। হিমালয়ের পর্বতশ্রেণীর শিখর, উপত্যকাগুলো সেখানে উঁচু - নিচু হয়ে আছে। সেই ত্রিমাত্রিক চিত্রের সামনে দাঁড়িয়ে দিদি আমাদের সাগর কেমন করে চঞ্চলতা ছেড়ে পাথরের মূর্তি মানে পাহাড় হল, সেই গল্প শোনাতেন। তিব্বতের মালভূমির এক ঠেলায় টেথিস সাগরের জল চলকে উঠেছিল যেদিন, সেদিন প্রলয়ের ডঙ্কা বেজেছিল। তখন আদিভূমি গন্ডোয়ানার কোলে বঙ্কিম ভঙ্গিতে স্থির হয়ে, নিজের গর্ভে পলির উথাল পাথাল সামলে তিব্বতের আঙ্গারা ভূমিকে আশ্রয় দিয়েছিল সে - থমকে দিয়েছিল গন্ডোয়ানা আর আঙ্গারা দুই বিপরীতমুখী ভুখন্ডের যুদ্ধ। সৃষ্টিকর্তা সেই আত্মত্যাগে খুশি হয়ে তরুণ টেথিস সাগরকে বর দিয়েছিলেন, তার সেই ক্ষণের ঢেউগুলো পাবে অমরত্ব। অনেকদিন পরে আসবে মানুষ। সে প্রকৃতির ভাষা বুঝবে, পুজো করবে, যত্ন করবে সেই স্থির হয়ে যাওয়া ঢেউগুলোকে, ঋষিরা তারই কন্দরে বসে সাধনা করে খুঁজে বার করবেন জগতের কল্যাণসাধনের পথ। ধীরে গরম ধরিত্রী শীতল হয়ে আসবে। থমকে যাওয়া পাথরের তরঙ্গের ওপরে বসবে তুষারের লেপ - হিমেল পরশ লাগবে বাতাসে - সে হবে হিমের আলয়, হিমালয়। আমরা অবাক হয়ে সেই মানচিত্রের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কোটি বছর আগে সেই ধুন্ধুমার লড়াই যেন দেখতে পেতাম সিনেমার মত। হিমালয়ের প্রথম পর্বতশৃঙ্গ নাঙ্গা পর্বত থেকে শেষ শৃঙ্গ নামচাবারোয়া পর্যন্ত যে কোনো শিখরই সেই মানচিত্রে ছুঁয়ে দেখা যেত। সমভূমি ছিল নিচু, মালভূমি উঁচু। সেই ছোটবেলাতেই বুঝেছিলাম বইয়ের মানচিত্র যেমন দ্বিমাত্রিক হয়, তেমনই এই ভূপ্রাকৃতিক মডেল হিসেবে মানচিত্র ত্রিমাত্রিকও হতে পারে। পরে বড় হয়ে পড়েছি মানচিত্রবিদ্যা যতটা বিজ্ঞান ঠিক ততটাই শিল্প। "Cartography is the science and art of map making."
সত্যিই তো, মাপজোখে নির্ভুল হলেও একটা বিশ্রী দেখতে মানচিত্র কি আমরা দোকান থেকে কখনো কিনব?
শ্রদ্ধাপ্রাণাজী ঐ ত্রিমাত্রিক মানচিত্রে আমাদের ভারতের নদনদীর প্রকৃতি বুঝিয়েছিলেন। ভারতের উত্তরে হিমালয় উঁচু। মধ্যভারতের মালভূমিও উঁচু। মাঝখানে নিচু খাঁজ গঙ্গানদীর পলি দিয়ে ভরে উঠেছে। সেটাই তো গঙ্গা বিধৌত সমভূমি। দুপাশের দুই উচ্চভূমি থেকে অনেক জলধারা গড়িয়ে এসে নিচু গঙ্গার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সেগুলিই তো গঙ্গার উপনদী। আবার দাক্ষিণাত্যের মালভূমি পূর্বে বঙ্গোপসাগরের দিকে ঢালু। তাই মহানদী, কৃষ্ণা, গোদাবরী আর কাবেরী চার নদীবোন তাদের সহচরী উপনদীদের হাত ধরাধরি করে বঙ্গোপসাগরের দিকে দৌড় দিয়েছে। কিন্তু আর দুবোন পারেনি। নর্মদা আর তাপ্তী। তাদের বন্দী করেছে বিন্ধ্য আর সাতপুরা পর্বত শ্রেণীর পাশে থাকা দুই গ্রস্ত উপত্যকা। এইজন্য তারা বাধ্য হয়েছে উল্টোদিকে আরবসাগরমুখী হতে। শৈশবের স্মৃতি আজ এতদিন পরেও একই রকম জীবন্ত। প্রধান শিক্ষিকা ভালো পড়িয়েছিলেন সন্দেহ নেই। কিন্তু তা চোখের সামনে বাস্তব করে তুলেছিল সেই বিশাল ত্রিমাত্রিক ম্যাপ। কোনো অচেনা জায়গার দৃশ্যকল্প তৈরি করতে, বৈজ্ঞানিক চেতনা, নির্ভুল ধারণা তৈরি করাতে মানচিত্রের জুড়ি মেলা ভার। তবে মজার কথা হল, প্রাচীন ভারত নর্মদা - তাপ্তীর এই বিপরীত যাত্রা ব্যাখ্যায় তৈরি করেছে এক রুদ্ধশ্বাস পৌরাণিক থ্রিলার। সময়মত বলব গল্পটা।
আশ্চর্য হল মানচিত্রের গুরুত্ব সেই সভ্যতার আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত একই রকম। আদিম গুহামানবও গুহাচিত্রে চিহ্ন দিয়ে পশু আর নিজের অবস্থান চিহ্নিত করেছে। কাগজ যখন আবিষ্কার হয়নি, তখনও প্যাপিরাসের গায়ে বা মাটির টালির ওপরে সেযুগের মানুষ স্থানাঙ্ক বোঝাতে চেয়েছে। ছাপাখানা আবিষ্কারের কত আগে রোমের মানুষ তাদের পরিচিতির মাপ অনুযায়ী স্থানীয় নয় পৃথিবীর মানচিত্র আঁকার সাহস দেখিয়েছে। আজ বিশ্বব্যাপী অন্তর্জালের দৌলতে মানচিত্র আর বইয়ের পাতায় বন্দী নেই। সে আমাদের মুঠোফোনের মধ্যে থেকে আমাদের সর্বক্ষণের সঙ্গী হয়েছে। অচেনা কোথাও যেতে হলে চেনা মানুষের দিকনির্দেশের তুলনায় এখন আমরা গুগল ম্যাপ আর ফোনের জি পি এস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) কে বেশি ভরসা করি।