

৬
তাহলে আবার ফিরে আসি সেই সমুদ্রের তীরে, মুড়কি দিদি বলে, সেই সমুদ্রের তীরে যেখানে জাম্ববানের কথায় আর অন্যান্য বাঁদর-ভল্লুকদের উৎসাহে ল্যাজ ঝাপটাতে ঝাপটাতে শরীর বড় করতে করতে হনুমান চলেছে মহেন্দ্র পাহাড়ের উদ্দেশে। তোকে তো বলেইছি সমুদ্রের ওপর দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ কেমন নিজের সাইজ বদলিয়ে নাগমাতা, মানে সব সাপের যিনি মা, সেই সুরমাকে ঠকিয়ে, শেষ পর্যন্ত লঙ্কায় পৌঁছল হনুমান। কিন্তু তারপর?
সমুদ্রের ও-পারে লঙ্কা এক আশ্চর্য দেশ, এমনটা হনুমান আগে কোথাও দেখেনি। দেশটা সমুদ্রের তুলনায় খানিকটা ওপরে, ত্রিকূট নামে একটা পাহাড় কেটে কেটে স্বর্গের ইঞ্জিনীয়র স্বয়ং বিশ্বকর্মা তৈরি করেছেন এই দেশ। ভেতরে ঢোকার রাস্তায় বিশাল একটা গেট পেরিয়ে ঢুকতে হবে, কিন্তু গেটটা সব সময়েই বন্ধ। তার মানে হল এই যে, যে-কোন লোক এখানে ঢুকতেই পারবে না। যতক্ষণ দিনের আলো, হনুমান অপেক্ষা করল ততক্ষণ। তারপর অন্ধকার হতেই নিজেকে ছোট করতে করতে প্রায় যখন একটা বেড়ালের সাইজের হল সে, টুক করে তখন ভেতরে ঢুকে গেল গেটের তলা দিয়ে। আর ঢুকতেই, রাগী গলায় তাকে "এই বাঁদরটা" বলে কেউ ডাকছে শুনতে পেল। পেছন ফিরে সে দেখে রাগী চেহারার এক মহিলা আরও রাগী গলায় বলছেন তাকে, "মরবার সাধ হয়েছে নাকিaa কে হে তুমি, বিনা অনুমতিতে ভেতরে ঢুকছ কেন?”
আমি হনুমান, কিন্তু তুমিই বা কে?– জিজ্ঞেস করে হনুমান।
"আমি লঙ্কানগরী, রাবণের আদেশে নিজেই নিজের নামের এই দেশকে চব্বিশ ঘন্টা দুর্বৃত্তদের হাত থেকে রক্ষা করি। বেরোও তুমি, বেরিয়ে যাও এখান থেকে" – বলতে বলতেই ঠাস করে এক থাপ্পড় হনুমানের গালে।
নেহাৎ মহিলা, হনুমান ভাবে মনে মনে, তবুও একটুখানি শিক্ষা বোধ হয় দেওয়া দরকার – ভাবতে ভাবতেই নিজের শরীর বড় করতে থাকে হনুমান – আর যখন মহিলার সমান-সমান হয় সে, তখনই মৃদু এক থাপ্পড় কষায় মহিলার গালে।
সেই এক থাপ্পড়েই মাটিতে গড়াগড়ি, তারপর যতক্ষণে গালে হাত বোলাতে বোলাতে উঠে দাঁড়ায় লঙ্কানগরী, হনুমান আরও খানিকটা বাড়িয়ে ফেলেছে নিজের চেহারা।
বেশ হয়েছে, আমি কিন্তু হনুমানের সাপোর্টার, মন্তব্য করে উচ্ছে।
হুঁ হুঁ, বলে মুড়কি, সে না হয় হলিই, কিন্তু গল্পটা শোন্।
থাপ্পড়টা খাবার পর এবার হনুমানের সামনে জোড়হাত করে লঙ্কানগরী। বলে, এবার বুঝেছি তুমি কে। ব্রহ্মা আমাকে বলেছিলেন, যখনই কোন বাঁদরের হাতে তোমার হার হবে, জেনো, লঙ্কার ধ্বংস হবার সময় এসেছে। তুমি ভেতরে যাও হনুমান, ভালো করে দেখে নাও লঙ্কা, নিজের চোখে দেখে যাও কেমন আছেন সীতা।
লঙ্কার রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে হনুমান অবাক। এমন ঝলমলে সুন্দর, আলোয় আলো-ভরা, সমুদ্র থেকে ভেসে-আসা বাতাসে ঠাণ্ডা স্নিগ্ধ পরিবেশ, চওড়া চওড়া রাস্তা, তার ওপর বিশাল সব প্রাসাদ, রাস্তার একপাশে সবুজ বড় বড় গাছ, আর অন্য পাশে শুধুই ফুলের গাছ, সেই গাছগুলোর তলায় ঝরে পড়েছে নানা রঙের ফুল, আর মাঝে মাঝে কোন কোন গাছে সাদা সুগন্ধী রাতের ফুল আছে ফুটে। এই রাত্তিরে এখন তো ঘুমের সময়, তাই কোন আওয়াজ নেই, পুরো দেশটাই প্রায় নিঃশব্দ – এমন কোন দেশ সে আগে কখনও দেখেইনি। কিন্তু নিজের শরীরকে সে তো ইচ্ছে করলেই ছোট আর বড় করতে পারে, সেই সুযোগে সব প্রাসাদের জানলা-দরজাই তার পক্ষে অবারিত। সে ভাবল সব-কটা প্রাসাদের ভেতরে ঢুকবে সে, তাহলে কোন একটাতে নিশ্চয়ই সীতাকে দেখতে পাবে।
অবারিত কী? মানে কী হল?– জিজ্ঞেস করে উচ্ছে।
অবারিত মানে যাকে বা যেখানে যাওয়া বারণ করা হয়নি বা যায় না। দরজা-জানলা সবই যদি বন্ধও থাকে, নিজের শরীরটাকে এক্কেবারে ছোট্ট করে যে-কোন একটা ফুটো বা ফাটা দিয়েও তো হনুমান গলে যেতে পারবে, তাই সে সব জায়গাতেই অবারিত।
হনুমান সব প্রাসাদেরই ভেতরে ঢুকল, বলতে থাকে মুড়কি দিদি, রাবণ এবং তার পুত্র-কন্যা-ভ্রাতা সবায়েরই প্রাসাদে ঢুকল সে; সব্বাই ঘুমিয়ে আছে, সবাইকেই সে ঘুমন্তই দেখল। মনে মনে তার খুবই আশা, এরই মধ্যে কোথাও-না-কোথাও সীতাকে দেখতে পাবেই, কিন্তু নিরাশ হতে হল তাকে, সীতাকে দেখতে পাওয়া গেল না।
মন খারাপ করে বেরিয়ে আসে হনুমান। তাহলে কি সীতাকে মেরেই ফেলেছে রাবণ? নাকি সমুদ্র পেরোবার সময় রাবণের হাত ফসকে সমুদ্রেই পড়ে গেলেন তিনি, আর হাঙ্গর-তিমিরা খেয়েই ফেলল তাঁকে!
রাস্তায় বেরিয়ে বড় বড় গাছগুলোর একটার মাথায় চড়ে বসল হনুমান; মনে মনে বলল, অত উঁচু থেকে আর একবার লঙ্কাটাকে ভালো করে দেখি।
দ্বিতীয় বারে এই যে লঙ্কা দেখছে হনুমান তখন আর রাত্তির নয়, সারা রাত্তির তো নানান প্রাসাদ তন্ন তন্ন করে দেখে
নিয়েইছে সে। এতক্ষণে ভোর হয়ে এসেছে, তাই ভোরের আলোয় আরও অনেকটা দেখা গেল। হনুমান দেখল প্রাসাদ ছাড়া আরও নানা ধরণের বাড়িও আছে। একটা বাড়ি দেখে মনে হল সেটা বোধ হয় জেলখানা হবে। আচ্ছা, জেলখানায় বন্দী করে রাখেনি তো রাবণ সীতাকে?
এ-গাছ থেকে ও-গাছ সে-গাছে লাফিয়ে খুব অল্প সময়েই হনুমান পৌঁছিয়ে যায় জেলখানায়। জেলখানার পাঁচিল ডিঙিয়ে যখন সে ভেতরে ঢোকে, কেউ বাধা দেয় না, আপত্তিও করে না কেউ। হয়তো এখানেই দেখতে পাব, ভাবতে ভাবতে পুরো জেলখানাটা দেখা হয়ে যায় তার। এখানে সে নিজের চেহারা একটুও বাড়ায়নি, বরঞ্চ একটু কমিয়ে ছোটখাটো এক হনুমান হয়ে পুরুষ মহিলা আর শিশু বিভাগ সে ঘুরে ঘুরে দেখে নিয়েছে: নাঃ, সীতাদেবী কোত্থাও নেই! চোখে প্রায় জল এসে যায় হনুমানের, তাহলে কি শুধু শুধুই এত কষ্ট করে সাগর পেরোনো!
হনুমান তখন নিজের মনে মনেই ঠিক করে সীতার সঙ্গে যদি দেখা না হয় তাহলে সে আর ফিরবে না। এখানে এসে অবধি সে কিছু খায়নি, যতক্ষণ তাঁর সঙ্গে দেখা না হচ্ছে ততক্ষণ সে খাবেও না কিছু। না খেয়ে যদি মরতেও হয়, তা-ও ভালো। জেলখানা থেকে বেরোবার সময় অস্থির মনে সে সেখানকার পাঁচিলে বসে এইসব ভাবতে ভাবতে আর নিজের ল্যাজ ঝাপটাতে ঝাপটাতে হঠাৎ নিজেকে বড় করতে থাকে। যতই তার শরীর বড় হয় ততই সে আরও অনেক দূর পর্যন্ত দেখতে পায়। এই সময় তার চোখে পড়ে বিরাট জায়গা জুড়ে খুব উঁচু পাঁচিল-ঘেরা একটা বাগান গোছের কিছু। নানা রকমের গাছ, জলাশয়, ইত্যাদি। দূর থেকে দেখে মনে হল ভেতরটা বেশ সাজানো-গোছানো।
জলাশয় কী মুড়কি দিদি?– অনেকক্ষণ চুপ করে গল্প শুনতে শুনতে এবার জিজ্ঞেস করে উচ্ছে।
যেখানে জল থাকে। অনেক জল যেখানে জড় করা আছে সেটাই জলাশয়। সাধারণত আমরা মানুষের তৈরি পুকুর বা খালকে জলাশয় বলি, কিন্তু নদী বা সাগরও জলাশয়, জবাব দেয় মুড়কি।
বেশ সীরিয়স মুখ করে ব্যাখ্যাটা শোনে উচ্ছে, কোন কথা বলে না।
মুড়কি জিজ্ঞেস করে, তুই বুঝতে পারলি?
বুঝেছি তো, জবাব দেয় উচ্ছে, জলাশয় তো দেখেছি অনেক। গঙ্গা দেখেছি। আমাদের লেক, রবীন্দ্র সরোবর, তা-ও তো দেখেছি। ট্রেইনে যেতে যেতেও অনেক জলাশয় দেখেছি। কিন্তু তুমি যখন বললে গাছ আর জলাশয় দেখে হনুমানের মনে হল বাগানের মতো আর বেশ সাজানো-গোছানো, আমার মনে হচ্ছিল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের কথা। সেই আমরা সবাই মিলে গেছিলাম না? বাইরে থেকেই কী সুন্দর! বাগান আর জলাশয়!
তুই ঠিকই ভেবেছিস, বুঝলি উচ্ছে, বলে মুড়কি দিদি, হনুমানেরও ভারী সুন্দর মনে হল; সে পাঁচিল টপকিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। নানা রকমের গাছ, বেশ ঘন বনের মতোই, মনে মনে বলল হনুমান। একটু দূরেই একটা শিশু গাছ ছিল, প্রায় পাতায় ঢাকা। হনুমানের মনে হল ওই গাছটার ওপরে পাতার আড়ালে বসে ভালো করে জায়গাটা – মানে, বনই বলিস বা বাগান – যা-ই হোক, ভালো করে দেখে নিতে হবে। অতএব, গাছের মাথায় উঠল সে, অনেক পাতার মাঝখানে।
এমন সময়, যে-গাছটায় বসে আছে তার ঠিক নীচে হনুমানের চোখ আটকিয়ে যায়। গাছটার একেবারে নীচে একটা বেদী করা। সেই বেদীতে নানারকমের কারুকার্য, আর পুরো বেদীটাই সোনা দিয়ে মোড়া। সেখানে একা একজন মহিলা। হলুদ কাপড়-পরা মহিলাটি হাপুষ নয়নে কেঁদে চলেছেন। কিন্তু নিঃশব্দে। মহিলাটিকে দেখে হনুমানের মনে হল, এই সুন্দরী যেন পৃথিবীর মানুষই ন'ন। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে সে দেখছে, মানুষের মতোই দেখতে, কিন্তু কী যেন একটা আছে এই রূপসীর চেহারার মধ্যে। ইনি কি স্বর্গের দেবী?
হনুমান কোন কথা বলে না, সে পাঁচালির ঢঙে একটা কবিতা বানিয়ে যেন আপন মনেই বলছে এভাবে বেশ একটু জোরে জোরে বলতে থাকে:
হনুমান যখন পাঁচালি পড়ছিল, তখনই সে লক্ষ্য করে, সেই সুন্দরী মহিলা উপর-নীচে সব দিকে যেন কিছু খুঁজছেন। মনে হয়, একটা কথা বলার স্বর আসছে তাঁর কানে, কিন্তু কার সে স্বর বুঝতে না পেরে এধার-ওধার খুঁজছেন তিনি। এটাই মনে মনে চাইছিল হনুমান। যে-পাতার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিল, সেই পাতাটা সে সরিয়ে দেয়, মহিলার সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়। পাঁচালি পড়া শেষ না করেই সে গাছ বেয়ে খানিকটা নেমে আসে। তার জোড়-করা হাত মাথার উপরে রেখে সে বলে, দেবী, আপনি কে? আপনি কি স্বর্গের কোন দেবী? আপনার চোখ দিয়ে ধারার মতো জল পড়ছে আর আপনার চোখে-মুখে ভীষণ কষ্টের ছাপ। সেই কষ্টের ছাপ দেখে আবার ভাবছি আপনি হয়তো স্বর্গের দেবী না-ও হতে পারেন, হলে আপনি এত কষ্ট সহ্য করবেন কেন? আপনি কি কোন রাজকন্যা অথবা রানি? আপনি কি দেবী সীতা? দেবী সীতা হলে আমার কথার উত্তর দিন।
ওই মহিলা বললেন, আমি রাজা দশরথের পুত্রবধূ, তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রামের পত্নী। আমার বৃদ্ধ শ্বশুর রামকে রাজত্ব দেবার জন্যে যেদিন তাঁর অভিষেকের আয়োজন করেন সেই দিনই রামের বিমাতা কৈকেয়ীর ইচ্ছেয় একরকম বাধ্য হয়েই রাজত্বের বদলে রামের চোদ্দ বছর বনবাসের আদেশ দেন তিনি। রামের কনিষ্ঠ এক ভাই লক্ষ্মণ এবং আমি অনুগামী হই। বনে আমরা এতদিন সুখেই ছিলাম, কিন্তু দণ্ডকারণ্যে বাসের সময় রাক্ষসরাজ রাবণ আমাকে অপহরণ করে। সে আমাকে দু' মাস সময় দিয়েছে, তার পরেই আমাকে মরতে হবে।
শুনে হনুমান বলল, আমি রামেরই দূত। তাঁরই আদেশে আমি সাগর পেরিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আপনি কেমন আছেন জানতে তিনি ব্যাকুল। লক্ষ্মণও আপনাকে প্রণাম জানিয়েছেন। এই কথা শোনার পর সীতার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, মুখে হাসি ফুটল। সীতার হাসিমুখ দেখে খানিকটা নিশ্চিন্ত মনেই হনুমান তরতর করে গাছ বেয়ে নেমে আসে মাটিতে, প্রণাম করে সীতাকে। এক মুহূর্তের জন্যে দণ্ডকারণ্যের কথা মনে পড়ে গেল সীতার। সেখানে মুনির সাজে যখন সীতাকে জোর করে রথে তুলে চুরি করেছিল রাবণ, তার আগে এক মুহূর্তের জন্যেও রাবণকে কি তাঁর সন্দেহ হয়েছিল? এখন হনুমান সেজে সে-ই যে আসেনি তার কী ভরসা? ভয় পেয়ে সেই কথা তিনি হনুমানকে বলেই দিলেন। বললেন, তুমি, তুমিই, দণ্ডকারণ্যে এসেছিলে আমাকে চুরি করতে। আমাকে আবারও কেন কষ্ট দিতে চাও?
তারপরেই সীতার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে আবার। হনুমানকে তিনি বলেন, কী জানি কেন, তোমাকে দেখে, তোমার সঙ্গে কথা বলে, আমার আনন্দ হচ্ছে খুব। তুমি যদি সত্যিই রামের দূত হও, মঙ্গল হবে তোমার। এখন বল, তোমার সঙ্গে রামের পরিচয় হল কীভাবে?
বলছি, হনুমান বলে, তার আগে আমি যে রামেরই দূত তার প্রমাণ দিই আপনার কাছে।
হনুমানের গলায় একটা আংটি সরু সোনার তার দিয়ে ঝোলানো ছিল। সেটাকে খুলে সীতার হাতে দেয় হনুমান, বলে, রাম বলেছেন এই অঙ্গুরীয়ই আমার পরিচয়।
এই আংটি হাতে নিয়েই সীতার কান্নাভেজা মুখ আনন্দে একেবারে বদলিয়ে গেল। তিনি হেসে বললেন, আমার ভয় দূর হয়েছে। তুমি রাম-লক্ষ্মণের কথা বল। কেমন আছেন রাম-লক্ষ্মণ? কোথায় আছেন তাঁরা? তোমার এতটুকু শরীর, তাই নিয়ে তু্মি একাই সমুদ্র পেরিয়ে এলে কীভাবে?
হনুমান সীতার কাছে রাম আর লক্ষ্মণের সঙ্গে কীভাবে বানররাজ সুগ্রীব এবং তার অনুচরদের বন্ধুত্ব হল তা বর্ণনা করল। বলল, সুগ্রীব প্রতিজ্ঞা করেছেন রাবণকে বধ করে আপনাকে উদ্ধার করবেন। ফিরে গিয়ে আমি ঠিক কোথায় কিভাবে আপনি আছেন তা তাঁদের জানাব। তারপর বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে সমুদ্র পেরিয়ে রামের নেতৃত্বে আমরা সবাই এখানে ফিরে আসব। অথবা, আপনি যদি অনুমতি দেন, আজই, এই মুহূর্তেই আপনাকে পিঠে বসিয়ে আমি সমুদ্র পার হয়ে শ্রীরামচন্দ্রের কাছে নিয়ে যেতে পারি।
শুনে উচ্ছে হাততালি দিয়ে বলল, সেটা তো দারুণ হত মুড়কি দিদি, করল না কেন?
মুড়কি বলল, সমুদ্র পেরোবার সময় যদি রাবণ বা তার চেলাদের কেউ দেখতে পেয়ে আকাশেই আক্রমণ করত? পিঠে সীতাকে বসিয়ে হনুমান কি লড়াই করতে পারত? হয়তো পিঠে-সীতা আর হনুমান – দুজনেই পড়ে যেত সমুদ্রের জলে!
একমত হয়ে ধীরে ধীরে মাথা নাড়ে উচ্ছে। মুড়কি বলে, কাজেই সীতা বললেন, রাম যদি সৈন্যদল নিয়ে এসে লড়াই জিতে সীতাকে ফিরিয়ে নিয়ে যান, সেটাই ভালো, সেটাই অনেক সম্মানের হবে।
হনুমান বলল, হ্যাঁ, আমিও মানছি সে কথা, তবে যাবার আগে আমার ক্ষমতার একটুখানি আপনাকে দেখাতে চাই। বলেই, ওই অশোক বনের মাটিতে দাঁড়িয়েই সে ল্যাজ আছড়াতে আছড়াতে নিজেকে বড় করতে থাকে। যথেষ্ট বড় হবার পর সে অবলীলায় পাঁচিলের ধারে বড় হওয়া একটা নারকোল গাছ হাত দিয়ে টেনে তুলে নেয়, তারপর একটা কাঠি ভাঙার ভঙ্গিতে সেটাকে দু-টুকরো করে টুকরো দুটোকে একটু দূরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। সীতা অবাক হয়ে দেখেন। তাঁর মুখের হাসি দেখে সে সীতাকে বলে, মা, আপনি যদি অনুমতি দেন আমি তাহলে আমার দুটো ছোট ইচ্ছে পূরণ করতে চাই। এক, লঙ্কার খানিকটা ক্ষতি করব। আর দুই, এখানকার রাক্ষসদের বোঝাব, রাবণ যত বড় রাক্ষসই হোক-না-কেন, রামচন্দ্রের পায়ের ধুলোর সমানও সে নয়। এই কথা বলে সীতার পায়ে মাথা রেখে সে প্রণাম করে। সীতা তাঁর শাড়ির আঁচল থেকে একটা ছোট, সোনার চেয়েও ঝকঝকে, পাথরের টুকরো হনুমানকে দিলেন। বললেন, হনুমান, রামের সঙ্গে যখন দেখা হবে এটা তুমি তাঁকে দিও। এটার নাম দিব্য চূড়ামণি, আমার বিয়ের সময় আমার মায়ের কাছ থেকে নিয়ে বাবা এই মণি আমার শ্বশুর মশাই দশরথকে দিয়েছিলেন। এটা দেখলেই রামের তিনজনের কথা মনে পড়বে: আমার মা, রাজা দশরথ আর আমাকে।
হনুমান সীতাকে আর একবার প্রণাম করে নিজের শরীরটা বড় করল, তারপর ভাঙা নারকোল গাছের দু-টুকরোর মধ্যে যেটা বড় সেটা কুড়িয়ে নিয়ে, ওইখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়েই পাঁচিলটা ডিঙিয়ে বেরিয়ে গেল। ওই গাছের বিরাট টুকরো দিয়েই অনেক কিছু সে ধ্বংস করতে শুরু করল। সে জানে, এই খবর রাবণের কাছে পৌঁছবে, এবং অনেক রাক্ষস-বীরের সঙ্গে তাকে লড়তে হবে। এই লড়াইটাই যে আসল লড়াই নয় তা জানতো হনুমান। তার ইচ্ছে, সে এখন ধরা পড়ে এবং রাবণের কাছে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়।
অনেক বীর রাক্ষস আর রাবণের অনেক ছেলেপুলে হনুমানের হাতে মারা যাবার পর লঙ্কার সবার চাইতে বড় বীর ইন্দ্রজিৎ এল তার সঙ্গে লড়াই করতে। বহু দেবতা অনেক অস্ত্র দিয়েছিলেন ইন্দ্রজিৎকে। হনুমানের তখন ধরা পড়ার ইচ্ছে, আর লড়াই চায়ও না সে। ব্রহ্মার কাছ থেকে পাওয়া ব্রহ্মাস্ত্র দিয়ে ইন্দ্রজিৎ বেঁধে ফেলল তাকে। তারপর ভালো করে দড়িদড়া দিয়ে হনুমানকে বাঁধা হল, বন্দী হনুমানকে রাবণ রাজার কাছে নিয়ে যাওয়া হবে এবার। মনে মনে হনুমান খুবই খুশি, নিজের শরীর ছোট করে ফেললেই তো বাঁধন আলগা হয়ে যাবে, কিন্তু রাবণের কাছে তো আপাতত সবায়ের কাঁধে চড়েই যাওয়া যাক!
কাঁধে চড়েই পৌঁছল হনুমান, কিন্তু সহজে ভেতরে ঢোকা হল না। প্রাসাদের প্রধান গেট-এ যে পাহারাদাররা ছিল, তাদের আপত্তি। বীর রাক্ষসরা একটা বাঁদর বন্দীকে ধরে নিয়ে এসেছে তো হয়েছেটা কী! ভেতরে জরুরি মীটিং চলছে, গোপন মীটিং, মহারাজের নিজের অনুমতি ছাড়া কারো ঢোকার প্রশ্নই নেই।
ঠিক আছে, বলে রাক্ষসরা, ভেতরে খবর দাও, অনুমতি করিয়ে নিয়ে এস।
সভাগৃহের বাইরে একটা চওড়া ঘোরানো বারান্দা। পাহারাদাররা বলল, তোমরা ওই বারান্দায় অপেক্ষা কর, আমরা দেখছি কী করা যায়। বারান্দার একটা বাঁক ঘুরে ভেতরে চলে গেল তারা।
হনুমান তো আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধাই ছিল। তাকে ধরে এনেছে যারা, ধমক দিয়ে তারা বলল হনুমানকে, এই ব্যাটা বাঁদর, চুপচাপ বসে থাক এখানে। আমরা একটা জরুরি কাজ সেরে আসছি। বলেই, গট গট করে গেট পেরিয়ে বেরিয়ে গেল তারা।
হনুমান দেখল, এই সুযোগ, এবার আমি খুব ছোট্ট করে নেব নিজেকে, তারপর সভাগৃহের ভেতরে ঢুকে, কী হচ্ছে ভেতরে বুঝে আসব ব্যাপারটা। যেই ভাবা সেই কাজ, একটা বড়সড়ো পিঁপড়ের সাইজের হনুমান তড়বড় করে মেঝে দিয়ে প্রায় গড়িয়ে বড় ঘরটার নীচের ফাঁকটার তলা দিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে।
ভেতরে তখন কারো সঙ্গে তক্ক চলছিল রাবণের। কিছুক্ষণ তক্ক শোনার পর হনুমান বুঝল, যার সঙ্গে তক্ক, সে রাবণের ভাই, বিভীষণ। সে বারবার করে রাবণকে নিষেধ করছে রামের সঙ্গে শত্রুতা করতে। সে বলছে, রাম যার শত্রু তার বাঁচার কোন উপায়ই নেই। সীতাকে যদি সে মুক্তি দেয়, তাহলে রামের মতো ধার্মিক, বীর আর জনপ্রিয় রাজার সঙ্গে সে বন্ধুত্ব করতে পারবে। রাবণ তো শুনে রাগে ফেটে পড়ছে, সে বিভীষণকে বলছে, নিজের লোক শত্রু হলে সে ভয়ঙ্কর বিষধারী সাপের চেয়েও ভয়ানক হয়। আমার নিজের ভাই না-হলে আজ এই মুহূর্তেই তোমার প্রাণ যেত। রামের ছেলে ইন্দ্রজিৎ, তার প্রধান সেনাপতি প্রহস্ত আর আরো অনেকে রাবণকে উৎসাহ দিচ্ছে আর বিভীষণকে ভয় দেখাচ্ছে। আর উৎসাহ পেয়ে রাবণ ঐ একই কথা বারবার বলে চলেছে: আমার ভাই না-হলে আজ এই মুহূর্তেই তোমার প্রাণ যেত। এমনটা শুনতে শুনতে হঠাৎ গদাহস্তে চারজন সঙ্গীসমেত বিভীষণ ওই উঁচু ঘর থেকে উপরে, আরো উপরে উঠে গেল। যাবার সময় বলে গেল, তোমার কথাবার্তা আমি বুঝতে পারছি না। আমি চললুম, তোমার মঙ্গল হোক।
হনুমান জানে, এবারই তার খোঁজ পড়বে। মনে মনে ফিরে যাবার আগে রাবণের পায়ে একটা মোক্ষম কামড় দেবার ইচ্ছে ছিল তার, কিন্তু সেই ইচ্ছে দমন করে দরজার তলা দিয়ে আবার তড়িঘড়ি বেরিয়ে গিয়ে চেহারা বড় করে বাঁধন-টাধন ঠিক মতো লাগিয়ে ভালোমানুষের মতো মুখ করে চুপচাপ বসে রইল সে।
এদিকে হয়েছে কি, গেটের বাইরে গিয়ে একটু ফুর্তি-টুর্তি ঘোরাঘুরি করে হনুমানকে বহে এনেছিল যারা তারা ফিরে দেখেছে হনুমান নেই, দড়ি-দড়া যা ছিল সবই পড়ে রয়েছে। তাহলে হলটা কী? বাঁদরটা পালালো কোথায়? কীভাবে? বাঁদর পালালে এবার তো তাদের গর্দান যাবে!
আবার বাইরে বেরলো তারা। পালিয়ে কতদূর আর যাবে! খূঁজে পেতেই হবে বাঁদরটাকে। তারপর নিজেদের মধ্যেই কথাবার্তা বলে ওরা। এখনই যদি ডাক আসে সভাগৃহ থেকে, আর দূত যদি দেখতে পায় বাঁদরও নেই আর নেই আমরাও, তাহলে কী হবে ভাবতে পারছিস? তার চেয়ে ফিরে যাই চল্। তাতে অন্তত বোঝা যাবে আমরা কোথাও বেরিয়ে যাইনি। বাঁদর পালিয়েছে তার নিজের যাদু-টাদুর জোরে। হয়তো তাহলে আমরা প্রাণে বেঁচে যেতেও পারি।
যখন ফিরল ওরা, দেখল হনুমান দিব্যি বাঁধন-টাধন নিয়েই বসে বসে ঢুলছে। আরেঃ! কী ব্যাপার! এ কি ভূত-টুত নাকি! একবার দেখি নেই, একবার দেখি আছে, নির্ঘাত ভূত! ওদের মধ্যে একজন তখনই কাঁপতে কাঁপতে জপ করতে থাকে, ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি, রাম-লক্ষ্মণ বুকে আছে করবে আমার কী!
আরে করিস কী করিস কী?– ফ্যাসফেসে গলায় বলে ওঠে আরেকজন, গণ্ডগোলটা তো রাম-লক্ষ্মণের সঙ্গেই, তোর তো ডবল গর্দান! নির্ঘাত!
সে বেচারা ভয় পেয়ে যায়। তাড়াতাড়ি শুধরে নিয়ে বলে, ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি, রাবণরাজা বুকে আছে করবে আমার কী!
দূত আসে ঠিক সেই সময়েই, বাঁদরটাকে নিয়ে ভেতরে যাও, ডাক পড়েছে।
কোনরকমে হনুমানকে প্রধান দরজার দুয়াররক্ষকের হাতে সঁপে দিয়ে পালায় হনুমানবাহকরা। হনুমান ধীর পায়ে হেঁটে মঞ্চে উপবিষ্ট রাবণকে মঞ্চে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করার পর হাত জোড় করে বলে, মহারাজ, আমি শ্রীরামচন্দ্রের দূত। তিনি তাঁর মিত্র এবং সহযোগীদের সঙ্গে ইতোমধ্যেই সমুদ্রের অপর পারে পৌছেছেন। তিনি আমার মারফৎ আপনাকে যে বার্তা পাঠিয়েছেন তা সংক্ষেপে এই: আপনি আজই যদি দেবী সীতাকে রামের হাতে সমর্পণ করার উদ্যোগ নেন, তাহলে তাঁর শত্রুতা থেকে আপনি নিজেকে মুক্ত করতে পারেন। অন্যথায় আপনার, আপনার আত্মীয়স্বজনের এবং লঙ্কাপুরীর ধ্বংস অনিবার্য। স্বয়ং বিষ্ণুর তুল্য তিনি, আপনি কেন, কেউই তাঁর প্রতিযোদ্ধা হতে পারে না।
রাবণ খুবই তর্জন-গর্জন করল হনুমানের কথা শুনে। তারপর তাকে শাস্তি দিল। অনুচরদের সে বলল, হনুমানের ল্যাজে আগুন দিয়ে ওকে ছেড়ে দাও। ওই ল্যাজের আগুনেই মরবে হনুমান।
গল্প শুনতে শুনতে প্রথমে খানিকটা আনন্দে, পরে উত্তেজনায় এবং দুশ্চিন্তায় চোখে জল এসে গেছে উচ্ছের, সত্যিই তো, এবার তো হনুমানের নিজের ল্যাজের আগুনেই পুড়ে মরবে হনুমান!
মুড়কি দিদি বলল, তাই কি কখনো হয়? তাহলে রামায়ণের গল্পটা দাঁড়াবে কী করে বল্!
এদিকে ছাড়া পেয়েই আবার নিজের শরীর বড় করে তার জ্বলন্ত ল্যাজ দিয়ে বড় বড় প্রাসাদে আগুন ধরাতে শুরু করল হনুমান। কান্নাকাটি পড়ে গেল লঙ্কায়। একা হনুমানই পুরো দেশটাকে ধ্বংস করতে পারে দেখে সবাই বিচলিত। কথাটা অশোকবনে সীতার উপর নজর রাখত যে রাক্ষসীরা তাদের কাছ থেকে সীতারও কানে গেল। তিনি চোখ বুজে অগ্নিকে স্মরণ করলেন, বললেন, হে হুতাশন, হনুমানকে তুমি রক্ষা কোরো।
যত আগুন বাড়ছে তত হাওয়াও বাড়ছে। হনুমান নিজেও জানে এই হাওয়া বাড়তে বাড়তে প্রথমে ওর পুরো ল্যাজটা, আর তারপর ধীরে ধীরে ওর সমস্ত শরীরটাই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। নিজেকে শাসন করে হনুমান বলে, ঘাবড়াও মৎ। ভালো কাজের জন্যে যদি হনুমানকে মরতেও হয়, কুছ পরোয়া নহী!
আর, তার পরেই অবাক কাণ্ড!
যত হাওয়া ওর গায়ে লাগছে, সবই কেমন যেন ঠাণ্ডা হাওয়া! আর আগুনটাও ল্যাজে ছ্যাঁকা দিচ্ছেনা, বেশ আরামই লাগছে। মনে হয় যেন শীতকালের পাহাড়ের তুষার!
একটা সময় হনুমানের মনে হল, অনেক হয়েছে। আমার এবার ফেরাও দরকার। জাম্ববান দাদা আর অন্যান্য সবাই নিশ্চয়ই মহেন্দ্র পাহাড়ের সামনে দাঁড়িয়েই আছে আমার ফেরার অপেক্ষায়। এবার মা-সীতার সঙ্গে আর একবার দেখা করে ফিরে যেতে হবে।
আর সীতার কথা মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দুশ্চিন্তায় পড়ে হনুমান, এত যে প্রাণী – রাক্ষস আর মানুষ আর জঙ্গলের পশুপাখি – মারা পড়ল ল্যাজের আগুনে, মা সীতা কেমন আছেন? তাঁর কিছু হয়নি তো?
একটা দীঘি আছে শহরের মধ্যেই। ওই দীঘিতে ল্যাজটা ডুবিয়ে আগুন নিভিয়ে তাড়াতাড়ি অশোক বনে ফেরে হনুমান। বনের অনেক ক্ষতি হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ওই শিশু গাছ আর তার সোনার বেদীর কোন ক্ষতি হয়নি! সীতা বসে আছেন তাঁর সেই আগের জায়গাতেই, হনুমানকে দেখে খুশি হয়ে একগাল হাসলেন তিনি। হনুমান সীতাকে প্রণাম করে বলল, আমার কাজ আপাতত সাড়া মা, আমি এখন ফিরব মহেন্দ্র পাহাড়ে যেখানে আমার বন্ধুরা সব অপেক্ষা করছে আমার জন্যে। এখান থেকে ওই যে দূরে পাহাড়টা দেখা যাচ্ছে ওর নাম অরিষ্ট। ওই অরিষ্ট পাহাড়ের চূড়ায় এখন উঠব আমি। শরীরটাকে বড় করলেই খুব তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব চূড়ায়, এত বড় করব যে তু্মি এখানে বসেই দেখতে পাবে। আরেকবার সীতাকে প্রণাম করে হনুমান।
কয়েকমিনিট পরেই পাহাড়ের চূড়া থেকে হনুমানকে লাফাতে দেখেন সীতা, দেখেন সমুদ্র ফুলে উঠে গায়ে জল ছিটিয়ে তাকে যেন আশীর্বাদ করছে!
চলবে...