এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • সনাতনীদের জ্ঞাতার্থে এবং পালনার্থে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদি হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত কিছু অত্যাশ্চর্ষ সরস কাহিনির সংক্ষিপ্ত সংকলন

    Ashoke Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ | ৪১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩
    সনাতনীদের জ্ঞাতার্থে এবং পালনার্থে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদি হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত কিছু অত্যাশ্চর্ষ সরস কাহিনির সংক্ষিপ্ত সংকলন

    পৃথিবীতে অদ্যাবধি যতগুলি ধর্ম প্রবর্তিত হইয়াছে, সেইসকল ধর্মের অনুসারীগণ বিশ্বাস করিয়া থাকেন যে, তাহাদের ধর্মপুস্তকে বর্ণিত সৃষ্টিকর্তা এই মহাবিশ্বের স্থাবর-জঙ্গমাদি সকল কিছুই সৃষ্টি করিয়াছেন। মনুষ্য কর্তৃক গৃহীত ও আচরিত বিভিন্ন ধর্মগুলির মধ্যে সনাতন নামক একটি ধর্ম বহুল প্রচলিত। এই ধর্মের আনুসারীগণ মূলতঃ হিন্দু নামে পরিচিত। অধুনা হিন্দুগণের মধ্যে আবার একাংশ নিজেদেরকে সনাতনী বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকেন।

    বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে হিন্দু কিংবা সনাতনীদের পূর্বজগণের মধ্য হইতে কিছু পণ্ডিত রামায়ণ, মহাভারত্, বেদ, উপনিষদ, পুরাণ নামক বিভিন্ন গ্রন্থ রচনা করিয়াছিলেন যাহা হিন্দুশাস্ত্র নামে প্রচলিত। ওই সকল গ্রন্হাদিতে বিভিন্ন দেবতা, দৈবিক শক্তি ও মহিমা, মুনি-ঋষি এবং তাহাদের তপস্যালব্ধ তেজ ও ক্ষমতা, দানব-যক্ষ-রাক্ষস এবং তাহাদের অপশক্তি, বিভিন্ন কালে মহা তেজস্বী বহু রাজাদের কাহিনি বর্ণিত আছে। হিন্দুশাস্ত্র বর্ণিত আছে যে সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি এই চারিটি যুগের অন্তে মহাপ্রলয় সংঘটিত হইয়া সমস্ত সৃষ্টি বিনষ্ট হইবে। বর্তমান কালকে কলিযুগ নামে অভিহিত করা হইয়াছে। কলিযুগে বিভিন্ন পণ্ডিত ভূমণ্ডলে প্রচলিত নানান ভাষায় মূল হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত ঘটনাবলীতে স্বীয় স্বীয় কপোলকল্পনাসম্ভূত পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন ও বিয়োজন করিয়া নূতন আঙ্গিকে উপস্থাপন করিয়াছেন, যাহার ফলে মূল ও পরিবর্তিত-পরিবর্ধিত-সংযোজিত-বিয়োজিত হিন্দুশাস্ত্র পঠনে সনাতনীগণ এবং ভিন্নধর্মাবলম্বী পণ্ডিতবর্গ যত্পরোনাস্তি সংশয়াপন্ন।
    হিন্দুশাস্ত্র পঠনে জানিতে পারা যায় যে, বিভিন্ন দেবতা, মুনি-ঋষি, রাজা সত্যনিষ্ঠ, ধার্মিক, সকলের প্রতি সমদৃষ্টিসম্পন্ন, জিতেন্দ্রিয় ইত্যাদি সকল প্রকার গুণে গুণান্বিত ছিলেন।

    বর্তমানকালে সনাতনীগণ হিন্দুশাস্ত্রকে যেরূপ ভক্তিশ্রদ্ধা করিয়া থাকেন তাহাতে হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত বিভিন্ন দেবতা, মুনি-ঋষি, ক্ষত্রিয় রাজাগণ দ্বারা পুরাকালে আচরিত বিভিন্ন কার্যাবলি সনাতনীগণের অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হওয়া উচিৎ। হিন্দুশাস্ত্রে বর্ণিত দেবতা, মুনি-ঋষি, ক্ষত্রিয় রাজাগণ দ্বারা আচরিত বিভিন্ন কার্যাবলি এবং ভীষ্ম কর্তৃক যুধিষ্ঠিরকে দেওয়া উপদেশাবলী হইতে কিছু কাহিনি নিম্নে উপস্থাপিত হইল –

    বিভিন্ন জিতেন্দ্রিয় দেবতা এবং মুনি-ঋষিগণের ইন্দ্রিয়াসক্তির কাহিনিঃ

    নারায়ণ এবং তুলসীর কাহিনি

    দানবগণের রাজা শঙ্খচূড়ের স্ত্রী ছিলেন তুলসী। তুলসী ছিলেন পতিগতপ্রাণা এবং নারায়ণের একনিষ্ঠ ভক্ত। শঙ্খচূড় তপস্যা কোরে বর পেয়েছিলেন যে, তাঁর স্ত্রী যতদিন সতী থাকিবেন ততদিন তিনি অবধ্য থাকিবেন। যাহার অর্থ শঙ্খচূড়ের স্ত্রীর সতীত্ব যতদিন বজায় থাকিবে, ততদিন তাহাকে কেহই বধ করিতে পারিবে না। বরপ্রাপ্তির ফলে বলীয়ান শঙ্খচূড়ের উৎপীড়নে সকল দেবগণ অতিষ্ঠ হইয়া ব্রহ্মাকে অগ্রবর্তী করিয়া শিবের সন্নিকটে উপস্থিত হইলেন। দেবাদিদেব মহাদেব তখন শঙ্খচূড়ের উৎপীড়নে উদ্ভূত সমস্যা সমাধান করিবার উদ্দেশ্যে নারায়ণের নিকট উপস্থিত হইলেন। সকল বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া নারায়ণ তখন এই সমস্যার সমাধান করিয়া কহিলেন যে, একদিকে ত্রিশূল দ্বারা মহাদেব শঙ্খচূড়ের সহিত যুদ্ধ করিবেন অপরদিকে আমি স্বয়ং শঙ্খচূড়ের স্ত্রীর সতীত্ব নষ্ট করিবো।

    নারায়ণের উপদেশে শঙ্খচূড় যে সময় যুদ্ধক্ষেত্রে মহাদেবের সহিত সংগ্রামরত অবস্থায় ছিলেন সেই সময়ে শঙ্খচূড়ের রূপ ধারণ করিয়া স্বয়ং নারায়ণ তুলসী দেবীর নিকট উপস্থিত হইলেন। তুলসী দেবী নারায়ণকে তাহার স্বামী শঙ্খচূড় ভাবিয়া ভুল করিলে নারায়ণ তুলসীর সহিত সম্ভোগ করিয়া তাহার সতীত্ব নষ্ট করেন। অপরদিকে স্ত্রী তুলসীর সতীত্ব নষ্ট হইয়া যাওয়ায় মহাদেবের হস্তে শঙ্খচূড় নিহত হইলেন। স্বামীর মৃত্যুর সংবাদ পাইয়া তুলসী দেবী বুঝিতে পারেন যে, নারায়ণ তাহার সহিত ছলনা করিয়াছেন। ক্রোধে উন্মত্তপ্রায় তুলসী দেবী নারায়ণকে অভিশাপ দিলেন যে, নারায়ণ পাষাণে পরিণত হইবেন ও দেবী তুলসী তৎক্ষণাৎ দেহত্যাগ করিবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিলেন। নারায়ণ তুলসী দেবীর এই অভিশাপ হাসিমুখে গ্রহণ করিলেন যার ফলে তুলসীর অভিশাপে নারায়ণ শালগ্রাম শিলায় পরিণত হইয়াছিলেন।

    অভিশাপ দেওয়ার পরমুহূর্তে দেবী তুলসী আপনার ভুল বুঝিতে পারিলেন যে, তিনি নারায়ণকে অভিশাপ দিয়াছেন। তুলসী দেবী কর্তৃক অভিশপ্ত হইবার পর নারায়ণ তখন দেবী তুলসীকে বরদান করিলেন যে, পবিত্র তুলসী বৃক্ষ রূপে তিনি মর্ত্যলোকে পূজিতা হইবেন এবং নারায়ণ শিলার পুজা তুলসীর পত্র ভিন্ন সম্পূর্ণ হইবে না। নারায়ণের বরদানের ফলে দেবী তুলসীর শরীর গণ্ডকী নদীতে পরিণত হইয়াছিল এবং তুলসী দেবীর কেশ হইতে পবিত্র তুলসী বৃক্ষের সৃষ্টি হইল। তদবধি তুলসী দেবী প্রতি ঘরের আঙিনায় বৃক্ষ রূপে অবস্থান করিয়া পুজিতা হইয়া থাকেন।

    নারায়ণ এবং বৃন্দা

    স্কন্দপুরাণে বর্ণিত আছে যে ভগবান নারায়ণ বৃন্দা নামক এক নারীকে ধর্ষণ করেন। অসুরদের রাজা জলন্ধর ক্রুদ্ধ হইয়া দেবরাজ ইন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিল। জলন্ধরের পরাক্রমে দেবতারা তাহার নিকট পরাভূত হইয়াছিল।

    একদা শিবপত্নী পার্বতীর প্রতি মোহিত হইয়া শিবের নিকট হইতে পার্বতীকে লইয়া আসিবার নিমিত্ত জলন্ধর দূত প্রেরণ করিয়াছিল। জলন্ধরের সেই অভিলাষ পূরিত না হইলে জলন্ধর বিশাল সৈন্য লইযা শিবের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করিলে যুদ্ধ চলাকালীন মায়ার প্রভাবে শিবকে জলন্ধর বশীভূত করিলে, সকল অস্ত্র শিবের হস্ত হইতে পতিত হওয়ায় জলন্ধর কামার্ত হইয়া, শিবের রূপ ধারণ করিয়া শিবপত্নী গৌরি নিকট উপস্থিত হইলেন। দূর হইতে পার্বতীকে দর্শন মাত্র জলন্ধরের বীর্য স্খলিত হয়। পার্বতীও শিবরূপী জলন্ধরকে চিনিতে পারিয়া সেইস্থান হইতে পলায়ন করেন। জলন্ধরও শিবের সহিত যুদ্ধ করিবার জন্য ফিরিয়া আসেন। এমতাবস্থায়, পার্বতী নারায়ণকে স্মরণ করায় নারায়ণ উপস্থিত হইলে পার্বতী তাহাকে বলেন, “হে নারায়ণ, দৈত্য জলন্ধর আজ এক অদ্ভুত কর্ম করিয়াছে, তুমি কি সেই দুর্মতি দৈত্যের ব্যবহার বিদিত নহ?” নারায়ণ উত্তর দিলেন, ” হে দেবী, জলন্ধরই পথ দেখাইয়াছে, আমরাও সেই পথের অনুসরণ করিব, ইহা না করিলে জলন্ধরও বধ হইবে না এবং আপনারও পতিব্রাত্য রক্ষিত হইবে না।”

    জলন্ধর যখন শিবের সহিত যুদ্ধে রত, তখন নারায়ণ দানবরাজ জলন্ধরের পত্নী বৃন্দার পতিব্রাত্য নষ্ট করিবার অভিলাষে জলন্ধরের রূপ ধারণ করিয়া যেথায় বৃন্দা অবস্থান করিতেছিলেন, সেই পুরমধ্যে প্রবেশ করিলেন।”

    সেইসময়ে জলন্ধরের স্ত্রী বৃন্দা এক দুঃস্বপ্ন দর্শনে তাহার স্বামীর জন্য চিন্তিত হইয়া পড়েন এবং এক ঋষির দর্শন পান। বৃন্দা সেই ঋষির নিকট জলন্ধরের সংবাদ জানিতে চাহিলে, মুনির আদেশে দুইটি বানর জলন্ধরের মস্তক ও শরীর লইয়া উপস্থিত হইল। তদ্দর্শনে বৃন্দা মূর্ছিত হইয়া ভূপতিত হইলেন। সংজ্ঞা ফিরিলে জলন্ধরের স্ত্রী সেই ঋষির কাছে তার স্বামীর প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করিলে ঋষি সেই স্থান হইতে অদৃশ্য হইলে বৃন্দা জীবিত জলন্ধরকে সেই স্থানে দেখিতে পান।
    জলন্ধর জীবিত হইয়া বৃন্দাকে আলিঙ্গন করিয়া তাহার গলদেশে চুম্বন করিল”। “অনন্তর বৃন্দাও স্বামীকে জীবিত দেখিতে পাইয়া সেই কাননমধ্যে তাহার সহিত রতিক্রিয়া করিলেন।”

    একসময় বৃন্দা জলন্ধররূপী নারায়ণকে চিনিতে পারিয়া ক্রোধপরবশ বৃন্দা কহিলেন, “হে নারায়ণ, তুমি পরদারগামিনী তোমার চরিত্রে ধিক!” নারায়ণকে তীরস্কার করিয়া, অভিশাপ প্রদানান্তে, আত্মহত্যা করিবার জন্য বৃন্দা আগুনে প্রবেশ করিলেন। নারায়ণ তাঁহাকে বারণ করিলেও তিনি তাহা শুনিলেন না। অনন্তর নারায়ণ বারংবার তাঁহাকে স্মরণপূর্বক দগ্ধদেহ বৃন্দার ভস্ম-রজো দ্বারা শরীর আবৃত করিয়া সেই স্থানেই অবস্থান করিলেন, দেবতা ও সিদ্ধগণ তাঁহাকে সান্ত্বনা দান করিলেও তিনি শান্তি লাভ করিলেন না।

    ব্রহ্মা ও সরস্বতী

    দেবতাগণের মধ্যে অগ্রগণ্য এবং সৃষ্টিকর্তা হওয়া সত্ত্বেও ব্রহ্মা মর্ত্যলোকে পূজিত হন না। পুরাণে বর্ণিত কাহিনি অনুসারে ব্রহ্মা সৃষ্টিকার্য সম্পাদন করিবার কালে এক অনিন্দ্যসুন্দরী রমণীকে সৃষ্টি করিলেন। তিনি সরস্বতী, শতরূপা, গায়ত্রী, সাবিত্রী বা ব্রহ্মাণী নামে পরিচিতা। সেই অনিন্দ্যসুন্দরী রমণীর রূপদর্শনে ব্রহ্মা কামাসক্ত হইলেন। ব্রহ্মার চক্ষে ঘোর কামদৃষ্টি দর্শন করিয়া সরস্বতী ব্রহ্মার দৃষ্টির অন্তরালে যাইবার চেষ্টা করিতে থাকিলেন। সরস্বতী যাহাতে দৃষ্টির অন্তরালে যাইতে না পারেন তাহার জন্য ব্রহ্মার স্কন্ধের উপর পাঁচদিকে পাঁচটি মস্তক উৎপন্ন হইল।

    সরস্বতী তখন ব্রহ্মার কামাবেগ হইতে আত্মরক্ষা ও সম্ভ্রম রক্ষার নিমিত্ত বিভিন্ন প্রাণীর রূপ ধারণ করিয়া পলায়ন করিতে থাকিলেন। ব্রহ্মাও ক্রমান্বয়ে সেইসকল প্রাণীর পুরুষ রূপ ধারণ করিয়া সরস্বতীর সহিত সঙ্গমে লিপ্ত হইলেন যাহার ফলে বিভিন্ন প্রাণীর সৃষ্টি হইল। অবশেষে সরস্বতী ব্রহ্মার কামলালসা হইতে নিস্কৃতি পাইবার জন্য এক গুহার ভিতরে আশ্রয় লইলেন। ব্রহ্মা সেই গুহাতেই সরস্বতীর সহিত মিলিত হইলেন। সরস্বতী ছিলেন ব্রহ্মার কন্যা। কিন্তু তাঁহার সহিত অবৈধ যৌনাচারের অপরাধে মহাদেব ব্রহ্মার একটি মস্তক কর্তন করিলেন এব‌ং অভিশাপ দিলেন যে, ধরাধামে কেহ কখনও ব্রহ্মার পূজা করিবে না।

    ব্রহ্মা ও অমোঘা

    শান্তনু নামে একজন ঋষি ছিলেন, তাহার রূপবতী পত্নীর নাম অমোঘা। একদিন শান্তনু ফলমূল সংগ্রহ করিবার জন্য বনে গমন করিলে ব্রহ্মা অমোঘার নিকট উপস্থিত হইলেন। কামপীড়িত ব্রহ্মা ইন্দ্রিয়ের নিয়ন্ত্রণ হারাইয়া মহাসতী অমোঘাকে সম্ভোগ করিবার উদ্দেশ্যে ধাবিত হইলে অমোঘা ব্রহ্মাকে নিষেধ করিয়া তাহার পর্ণশালায় প্রবেশ করিলেন। অমোঘার পশ্চাদ্ধাবন করিয়া সেই পর্ণশালায় প্রবেশ করিলেন। পর্ণশালায় প্রবেশমাত্র অমোঘা ব্রহ্মাকে কহিলেন “আমি পতিব্রতা মুনিপত্নী, কখনো নিন্দনীয় কাজ করিব না, যদি জোরপূর্বক তুমি আমাতে উপগত হও, তাহা হইলে আমি তোমাকে অভিশাপ দিব।”

    অমোঘা এইপ্রকার কহিতে থাকিলে শান্তনু মুনির আশ্রমেই ব্রহ্মার বীর্য পতিত হয়। বীর্যপাত হইবামাত্র ব্রহ্মা তাহার হংসযানে আরোহন করিয়া শান্তনু মুনির আশ্রম ত্যাগ করিলেন।
    ব্রহ্মা চলিয়া যাইবার পর শান্তনু মুনি আশ্রমে ফিরিয়া আসিয়া আশ্রমের বাহিরে হংসের পদচিহ্ন দেখিতে পাইলেন । তাহার আশ্রমে ঠিক কি ঘটিয়াছিল, তাহা শান্তনু অমোঘার নিকট জানিতে চাহিলে, অমোঘা শান্তনুকে কহিলেন “একজন কমণ্ডলুধারী চারিটি মস্তকবিশিষ্ট ব্যক্তি হংসবিমানে আরোহন করিয়া আশ্রমে আসিয়া আমার সহিত সহবাস করিতে চাহেন। আমি শঙ্কিত হইয়া পর্ণশালায় প্রবেশপূর্বক তাহাকে ভর্ৎসনা করিলে তখন সেই ব্যক্তি বীর্যপাত করিয়া আমার অভিশাপের ভয়ে পলায়ন করিয়াছে।” অমোঘার নিকট বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া শান্তনু বুঝিলেন, পিতামহ ব্রহ্মাই তাহার আশ্রমে আসিয়াছিলেন।

    বৃহস্পতি ও মমতা

    পুরাণে বর্ণিত বেদজ্ঞ মহামুনি উতথ্যের স্ত্রী অনিন্দ্যসুন্দরী মমতা আর তাঁহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা ছিলেন দেবপুরোহিত বৃহস্পতি। একদিন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা উতথ্যের অনুপস্থিতিতে বৃহস্পতি কামাবিষ্ট হইয়া গর্ভবতী জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পত্নী মমতার সহিত সম্ভোগ করিতে উদ্যত হইলে মমতা তাঁহার দেবরকে যথাসাধ্য নিবৃত্ত করিতে প্রয়াস করিলেন। মমতা বৃহস্পতিকে ইহাও জানাইলেন যে তিনি তাঁহার স্বামী উতথ্য ঋষির ঔরসে গর্ভবতী হইয়াছেন। অতএব, একই গর্ভে দুই সন্তানের স্থান অসম্ভব হওয়ায় এবং বৃহস্পতিও অমোঘরেতাঃ হওয়ার কারণে বৃহস্পতির সাথে মিলিত হওয়া অধর্ম ও অসম্ভব। মমতা বৃহস্পতিকে আরও কহিলেন, “হে মহাভাগ! আমি তোমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার দ্বারা গর্ভবতী হইয়াছি, অতএব তুমি আমার সহিত সঙ্গম করিবার ইচ্ছা সংবরণ করো। আমার গর্ভের মধ্যে উতথ্যের পুত্র ষড়ঙ্গবেদ অধ্যয়ণ করিতেছে। তুমি এই দুষ্কর্ম হইতে নিবৃত্ত হও।

    কিন্তু বৃহস্পতির কামোন্মাদনা তখন উত্তুঙ্গে। মমতা বৃহস্পতিকে বিভিন্ন ভাবে নিবৃত্ত করিবার চেষ্টা করিয়াও বিফল হইলেন। পরিশেষে বৃহস্পতি সবলে মমতার সহিত সংগমে লিপ্ত হইলেন। মমতা যখন বিধ্বস্ত এবং বৃহস্পতির চরম মূহুর্ত সমাগত, তখন মমতার গর্ভস্থ পুত্র তাহাকে বাধা প্রদান করিয়া কহিল, ”হে পিতৃব্য, আপনি ক্ষমতাবান হইতে পারেন, কিন্তু এই মাতৃজঠরে আমি পূর্ব হইতেই উপস্থিত। অতএব, আপনার বীর্য সংবরণ করুন।“

    বৃহস্পতিকে এবম্প্রকারে নিষেধ করিয়া মমতার গর্ভস্থ পুত্র স্বীয় পদদ্বারা বীর্য প্রবেশের পথ রুদ্ধ করিয়া দেওয়ার ফলে বৃহস্পতির স্খলিত বীর্য বাহিরে ভূমিতে এবং সেই পতিত বীর্য হইতে ভরদ্বাজের জন্ম হইল। মমতার গর্ভস্থ পুত্রের দ্বারা এইরূপে বাধাপ্রাপ্ত হইলে বৃহস্পতি ক্ষিপ্ত হইয়া মমতার অনাগত সন্তানকে অভিশাপ দিলেন, “আমাকে বাধা দেওয়ার জন্য তুই দীর্ঘ তমোরাশির মধ্যে প্রবেশ করবি।” যথাসময়ে ভূমিষ্ঠ হইবার পরে বৃহষ্পতি প্রদত্ত ‘দীর্ঘ তমোরাশি’ অর্থাৎ চির অন্ধকারের অভিশাপের কারণে সেই সন্তান জন্মান্ধ হইল। তাহার নামকরণ হইল দীর্ঘতমা। কালক্রমে দীর্ঘতমা একজন বেদজ্ঞ ঋষি হইয়া উঠিয়াছিলেন।

    অপরদিকে ভরদ্বাজের জন্মের পরে, স্বামীর ঔরসজাত পুত্র নহে এবং স্বীয় গর্ভজাতও নহে বলিয়া মমতা তাঁহাকে পরিত্যাগ করিলেন। তখন বৃহস্পতি ভরদ্বাজেকে উতথ্যের ক্ষেত্রজ পুত্র হিসাবে প্রতিপালনের পরামর্শ দিলে মমতা বৃহস্পতির পরামর্শ গ্রহণ না করিয়া ভরদ্বাজকে পরিত্যাগ করিলে বৃহস্পতিও ভরদ্বাজকে ত্যাগ করিলেন। তারপর মরুৎগণ এই পুত্রটিকে পালন করিয়াছিলেন। মরুৎগণের ভুত বা ভর হইয়াছিলেন এবং দ্বাজ বা সঙ্কর পুত্র বলিয়া তাহার নামকরণ হয় ভরদ্বাজ।

    চন্দ্র ও বৃহস্পতিপত্নী তারা

    ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে বর্ণিত আছে যে চন্দ্রমা ভাদ্রমাসে শুক্লপক্ষের চতুর্থী তিথিতে বৃহস্পতিপত্নী তারাকে হরণ করিয়া কৃষ্ণপক্ষের চতুর্থী তিথিতে পরিত্যাগ করিলে গুরু বৃহস্পতি তারাকে গ্রহণ করিয়া গর্ভবতী তারাকে ভর্ৎসনা করিলে তারা লজ্জিত হইয়া সক্রোধে কামাতুর চন্দ্রকে এই বলিয়া অভিশাপ প্রদান করেন যে, তুমি আমার অভিশাপে কলঙ্কী হও এবং যে দেহী তোমাকে দর্শন করিবে সেও কলঙ্কী হইবে।”

    অশ্বীনিকুমার ও ব্রাহ্মণপত্নী-গোদাবরী

    একদা শান্তপ্রকৃতি বলবান সূর্যপুত্র অশ্বীনিকুমার এক পরমাসুন্দরী ব্রাহ্মণীকে তীর্থযাত্রায় গমন করিতে দেখিয়া তাহার প্রতি সাতিশয় কামাসক্ত হইলেন এবং বারংবার ব্রাহ্মণী কর্তৃক নিবারিত হইয়াও বলপূর্বক নিকটস্থ এক পুষ্পোদ্যানে আনয়ন করিয়া ব্রাহ্মণীতে উপগত হইয়া তাহার গর্ভাধান করিলেন।

    অনন্তর ব্রাহ্মণপত্নী লজ্জিত এবং ভীত হইয়া সেই গর্ভ মোচন করিবামাত্র সেই রমণীয় পুষ্পোদ্যানে এক মনোহর পুত্র জন্মিল। তখন সেই ব্রাহ্মণী পুত্রস্নেহবশতঃ নবজাতককে ক্রোড়ে লইয়া সলজ্জে স্বামীর নিকটে উপস্থিত হইয়া পথিমধ্যে যে ঘটনা ঘটিয়াছিল তাহা সবিশেষ কহিলে ব্রাহ্মণ অতি ক্রুদ্ধ হইয়া সেই পুত্রের সহিত ব্রাহ্মণীকে পরিত্যাগ করিলেন। এইরূপে পরিত্যাক্ত হইবার পরে ব্রাহ্মণপত্নী সাতিশয় লজ্জিতা ও দুঃখিতা হইয়া যোগাবলম্বনপূর্বক দেহত্যাগ করিয়া গোদাবরী নামে স্রোতস্বতী হইলেন। এদিকে অশ্বীনিকুমার স্বীয় পুত্রকে মাতৃহীন দেখিয়া স্বয়ং তাহাকে সযত্নে রক্ষা করতঃ চিকিৎসা শাস্ত্র ও নানাবিধ শিল্প এবং মন্ত্রবিষয়ে সবিশেষ শিক্ষা দান করিলেন। পরবর্তীকালে সেই অশ্বিনীকুমার বংশোদ্ভব কোনো ব্যক্তি ক্রমশ বৈদিক ধর্ম পরিত্যাগ করিয়া নিরন্তর জ্যোতিঃশাস্ত্র গণনা দ্বারা বেতন গ্রহণ করায় এই ভূমণ্ডলে গণক নামে প্রসিদ্ধ হন। তদ্বংশীয় অন্য ব্রাহ্মণ লোভপ্রযুক্ত শূদ্রদিগের অগ্রে দান গ্রহণ ও প্রেতশ্রাদ্ধাদির সামগ্রী স্বীকার করায় অগ্রদানী নামে পরিচিতি লাভ করিয়াছেন।

    বরুণ ও উতথ্যের স্ত্রী ভদ্রা

    চন্দ্রদেবের ভদ্রা নাম্নী এক সর্বাঙ্গসুন্দরী কন্যা ছিলো। চন্দ্র অনেক অনুসন্ধানের পর মহর্ষি উতথ্যকে ঐ কন্যার উপযুক্ত পাত্র বলিয়া স্থির করিয়াছিলেন। ঐ কন্যাও উতথ্যকে আপনার উপযুক্ত পতিরূপে পাইবার অভিলাষে অতি কঠোর তপস্যায় প্রবৃত্ত হইলেন। কিয়দ্দিন পরে মহর্ষি অত্রি উতথ্যকে আহ্বানপূর্বক ভদ্রাকে তাহার হস্তে সম্প্রদান করিলেন। জলাধিপতি বরুণের মনে ভদ্রার পাণিগ্রহণের অভিলাষ ছিলো। সেই ইচ্ছা পূর্ণ না হওয়াতে বরুণ নিতান্ত দুঃখিত হইলেন। অনন্তর একদিন ভদ্রাকে যমুনাজলে অবগাহন করিতে দেখিয়া বরুণ বলপূর্বক তাহাকে হরণ করিয়া স্বীয় পুরমধ্যে আনিলেন। ঐ পুরী ছয়লক্ষ হ্রদে সুশোভিত, বিবিধ সুরম্য প্রাসাদ সমাকীর্ণ ও সর্বকামসম্পন্ন। জলেশ্বর বরুণ ভদ্রাকে সেই পুরীর মধ্যে আনিয়া তাহার সহিত পরমসুখে বিহার করিতে লাগিলেন।

    এদিকে দেবর্ষি নারদ এই বৃত্তান্ত উতথ্যকে জানাইলেন। উতথ্য নারদের মুখে স্বীয় পত্নীহরণসংবাদ শ্রবণ করিয়া কহিলেন, নারদ! তুমি অবিলম্বে বরুণের নিকট গমন করিয়া বল যে, তুমি লোকপালক, চন্দ্রদেব উতথ্যকে যে কন্যা সম্প্রদান করিয়াছেন তুমি কেন সেই কন্যা অপহরণ করিলে? বরুণ নারদের মুখে উতথ্যের এইরূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, নারদ! তুমি উতথ্যকে কহিও যে, এই সর্বাঙ্গসুন্দরী আমার নিতান্ত কাম্য। আমি ইহাকে কদাচ পরিত্যাগ করিব না। বরুণ এই কথা কহিলে মহর্ষি নারদ অচিরাৎ উতথ্যের নিকট যাইয়া কহিলেন, বরুণের নিকট যাইয়া তোমার পত্নীকে প্রত্যর্পণ করিতে সবিশেষ অনুরোধ করিয়াছিলাম, তাহাতে সে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া আমাকে অপমানিত করিয়া বিতাড়িত করিয়াছে। সে কিছুতেই তোমার পত্নীকে প্রত্যর্পণ করিবে না। অতঃপর তোমার যাহা কর্তব্য হয় করো ।

    দেবর্ষি নারদ এই কথা কহিবামাত্র মহর্ষি উতথ্য বরুণের প্রতি নিতান্ত ক্রুদ্ধ হইয়া অচিরাৎ সমুদায় সলিল স্তম্ভন পূর্বক পান করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় জলাধিপতি বরুণ উতথ্যকে সমুদায় সলিল পীয়মান দেখিয়া এবং সুহৃদগণ কর্তৃক বারংবার তিরস্কৃত হইয়াও উতথ্যের পত্নীকে পরিত্যাগ করিলেন না।

    অনন্তর মহর্ষি উতথ্য ক্রোধভরে ভূমিকে আহ্বান পূর্বক কহিলেন, তোমার সেই ছয় লক্ষ হ্রদযুক্ত স্থান কোথায়? মহর্ষি উতথ্য এইরূপ কহিবামাত্র সমুদ্র তৎক্ষণাৎ বরুণের পুরী হইতে অপসৃত হইল এবং সেই স্থান উষর ক্ষেত্রের ন্যায় দৃশ্যমান হইল। তখন মহর্ষি উতথ্য সরস্বতীকে সম্বোধন পূর্বক কহিলেন, ভদ্রে! তুমি অবিলম্বে এই স্থান হইতে অপসৃত হইয়া মরুদেশে প্রবাহিত হও। এই স্থানটি তোমা কর্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া অপবিত্র হউক। স্রোতস্বতী সরস্বতী উতথ্যের এইরূপ আদেশ প্রাপ্ত হইবামাত্র তৎক্ষণাৎ তথা হইতে অপসৃত হইলেন। তখন বরুণ স্বীয় পুরী জলশূণ্য দেখিয়া ভীতচিত্তে উতথ্যের পত্নীকে উতথ্যকে প্রদান করিয়া তাহার শরণাপন্ন হইলেন। মহর্ষি উতথ্য পত্নীকে পুনরায় প্রাপ্ত হইয়া প্রসন্নভাব ধারণপূর্বক সমুদায় জগতকে জলকষ্ট হইতে ও বরুণকে এই বিপদজাল হইতে মুক্ত করিয়া দিলেন।

    সূর্য ও কুন্তী

    রাজা কুন্তিভোজ শূরসেন কন্যা কুন্তীকে বাল্যাবস্থায় নিজ কন্যারূপে লালন পালন করেন। কুন্তীর কিঞ্চিৎ বোধের উদয় হইলে তাহাকে অগ্নিহোত্রীয় অনলের পরিচর্যায় নিয়োজিত করিলেন। পরে এক দিবস চাতুর্মাস্য ব্রতাবলম্বী দুর্বাসা ঋষি সেই স্থানে উপস্থিত হইলে, কুন্তী তাহার সেবা করায় তিনি অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া তাহাকে একটি মন্ত্র প্রদান করেন। এই মন্ত্র পাঠ করিয়া যে কোনো দেবতাকে আহ্বান করিলে তিনি সমাগত হইয়া আহ্বানকারীর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করিয়া থাকেন। অনন্তর, দুর্বাসা প্রস্থান করিলে কুন্তী মন্ত্রের পরীক্ষার্থে কোন দেবতাকে আহ্বান করিবেন ইহা ভাবিতে লাগিলেন। হেনকালে সূর্যকে উদিত দেখিয়া কুন্তী সেই মন্ত্র পাঠ করিয়া তাহাকে আহ্বান করিলে সূর্যদেব মন্ত্রপ্রভাবে নিজ মন্ডল হইতে অতিসুন্দর মনুষ্য মূর্তি ধারণ করিয়া কুন্তীর সম্মুখে অবতরণ করিলেন। কুন্তী সূর্যদেবকে সমাগত দেখিয়া অতিশয় বিস্ময়ান্বিত হইয়া কাঁপিতে কাঁপিতে তৎক্ষণাৎ রজঃস্বলা হইয়া পড়িলেন এবং কৃতাঞ্জলি হইয়া বলিলেন, দেব! আপনার দর্শনেই আমি কৃতার্থ হইয়াছি এক্ষণে আপনি প্রস্থান করুন।

    এই কথা শ্রবণ করিয়া সূর্য কহিলেন, কুন্তী! তুমি মন্ত্রদ্বারা কিজন্য আমাকে আহ্বান করিলে এবং আহ্বান করিয়া কিহেতু আমাকে ভজনা করিতেছ না? হে চারুলোচনে, আমি এক্ষণে কামার্ত হইয়াছি, তোমার প্রতি আমার প্রেমাসক্তি হইয়াছে, অতএব আমার কামনা পূর্ণ করো। আমি মন্ত্রবলে তোমার অধীন হইয়াছি, অতএব রতিক্রিড়ার জন্য আমাকে গ্রহণ করো। সূর্যদেবের এই কথা শ্রবণ করিয়া কুন্তী কহিল, হে ধর্মজ্ঞ! এক্ষণে আমি অনূঢ়া কুলকন্যা বলিয়া জানিবেন, অতএব কোনোরূপ দুর্বাক্য বলিবেন না।

    সূর্যদেব ইহা শুনিয়া কুন্তীকে কহিলেন, যদি আমি অদ্য বৃথা ফিরিয়া যাই তাহা হইলে সমস্ত দেবগণের নিকট নিন্দাভাজন হইব এবং ইহা আমার অতিশয় লজ্জার বিষয় তাহাতে সন্দেহ নাই। কুন্তি! অদ্য তুমি যদি আমার অভিলাষ পূর্ণ না করো তাহা হইলে তোমাকে এবং যে ব্রাহ্মণ তোমাকে এই মন্ত্র প্রদান করিয়াছে তাহাকে অতি কঠোর অভিশাপ প্রদান করিব। আর যদি তুমি আমায় অভিলাষ পূর্ণ করো তাহা হইলে আমার বরে তোমার কন্যারূপ ও ধর্ম অপরিবর্তিত থাকিবে, কেহই এই বিষয় জানিতে পারিবে না এবং আমার সদৃশ তোমার একটি তেজোদীপ্ত সন্তান হইবে।

    সূর্যদেব এই কথা বলিয়া একাগ্রচিত্তা এবং অতিলজ্জিতা কুন্তীকে সম্ভোগান্তে অভিলষিত বর প্রদান করিয়া প্রস্থান করিলেন। অনন্তর কুন্তী গৃহে থাকিয়া গর্ভধারণ গোপন রাখিয়া গৃহমধ্যে অবস্থান করিতে লাগিল। ইহা কেবল তাহার প্রিয় ধাত্রী ভিন্ন অন্য কেহ এমন কি তাহার মাতা পর্যন্ত জানিতে পারেন নাই। এইরূপে কিছুদিন অতিবাহিত হইলে অতি গোপনে সেই গৃহে একটি মনোহর পুত্র জন্মিল। পুত্রটি সুরম্য কবচ ও কুণ্ডলশোভিত এবং সূর্যের ন্যায় তেজঃপুঞ্জসম্ভূত কলেবরবিশিষ্ট হইল। তদ্দর্শনে কুন্তী অতিশয় লজ্জিতা হইলে ধাত্রী তাহার হস্ত ধারণপূর্বক কহিল, সুন্দরি! যখন আমি রহিয়াছি তখন তোমার চিন্তা কি? অনন্তর সন্তানটিকে পরিত্যাগ করিতে ইচ্ছুক হইয়া মঞ্জূষামধ্যে তাহাকে রক্ষা করিয়া কুন্তী বলিল, পুত্র! আমি দুঃখিতা হইলেও প্রাণাধিকস্বরূপ তোমাকে পরিত্যাগ করিতেছি, কি করি এক্ষণে আমি এমনই মন্দভাগ্য হইয়াছি যে সর্বসুলক্ষণান্বিত তোমাকে পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হইতেছি। পুত্র, আশীর্বাদ করিতেছি, সেই গুণাতীতা ও গুণময়ী সর্বেশ্বরী বিশ্বজননী কাত্যায়নী অম্বিকা আমার অভিলাষ পূর্ণ করিবার জন্য তোমাকে স্তন্যদুগ্ধ প্রদান করিয়া রক্ষা করুন। হায়! আমি এক্ষণে দুষ্টা স্বৈরিনীর ন্যায় তোমাকে নির্জন বনে পরিত্যাগ করিয়া জানিনা কবে আবার প্রাণ অপেক্ষাও প্রিয় তোমার এই মুখপদ্ম দর্শন করিব। পুত্র! নিশ্চয়ই আমি পূর্বজন্মে ত্রিজগতের মাতা জগদম্বিকার আরাধনা করি নাই, সেই জন্যই আমি ভাগ্যহীনা হইয়াছি। প্রিয় পুত্র এক্ষণে তোমাকে বনে পরিত্যাগ করিয়া স্বকৃত এই পাপ স্মরণ করিয়া নিরন্তর সন্তাপে দগ্ধ হইব।

    ইন্দ্র ও অহল্যা

    সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা অহল্যা নাম্নী এক অপরূপা রমণীকে সৃষ্টি করিয়াছিলেন। ‘অহল্যা’ শব্দের অর্থ ‘অনিন্দনীয়া’। ‘যাহার অবয়বে কোনো বিরূপতা নাই তিনিই অহল্যা’। ‘অহল্যা কাহার পত্নী হইবেন - এই বিষয়ে ব্রহ্মা চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছিলেন। দেবতাদের রাজা হইবার কারণে ইন্দ্র ভাবিয়াছিলেন, অহল্যা তাহারই পত্নী হইবেন, কিন্তু ব্রহ্মা অহল্যাকে গৌতম মুনির নিকট রাখিবার সিদ্ধান্ত লইলেন এবং বহুকাল অতিক্রান্ত হইবার পরে গৌতম অহল্যাকে ব্রহ্মার হস্তে প্রত্যার্পণ করেন। গৌতমের সংযম দর্শনে ব্রহ্মা অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া অহল্যাকে গৌতমের সহিত বিবাহ দিলেন। অহল্যাকে গৌতমের পত্নীরূপে দেখিয়া দেবতারা হতাশ হইলেন। ইহাতে দেবরাজ ইন্দ্র ভীষণ ক্রুদ্ধ হইয়া গৌতমের আশ্রমে উপস্থিত অহল্যাকে দেখিতে পাইলেন এবং কামপীড়িত হইয়া অহল্যাকে বলাৎকার করিলেন।

    অহল্যাকে বলাৎকারান্তে পলায়নকালে গৌতম ইন্দ্রকে দেখিতে পাইয়া ক্রোধপরবশ ইন্দ্রকে অভিশাপ দিলেন, “ইন্দ্র! তুমি পরিণাম না ভাবিয়া নির্ভয় চিত্তে আমার পত্নীকে বলাৎকার করিয়াছ। সুতরাং দেবরাজ, আমার অভিশাপে তুমি সমরে শত্রু কবলিত হইবে এবং তোমার শরীরে যোনীর ন্যায় ক্ষত সৃষ্টি হইয়া গাত্রবেদনায় অশেষ যাতনা ভোগ করিবে। মর্ত্যবাসী ও মুনি ঋষিগণ তোমার সেই রূপ দর্শন করিয়া উপহাস করিবে। এরপর গৌতম তার পত্নী অহল্যাকে অতীব তিরস্কার করিয়া কহিলেন, “আমার আশ্রমে তুমি সৌন্দর্যহীনা পাষাণ হইয়া থাকো। এই কথা শুনিয়া অহল্যা সরোদনে কহিলেন, “বিপ্রশ্রেষ্ঠ! স্বর্গবাসী ইন্দ্র তোমার রূপ ধারণ করিয়া আমাকে বলাৎকার করিয়াছে, ইহাতে আমার কোনোরূপ প্ররোচনা ছিলোনা”। গৌতম কর্তৃক অভিশপ্ত হইবার পর ইন্দ্র সহস্র বর্ষ সূর্যের আরাধনা করিয়া তাহার বরে গাত্রের সহস্র যোনিচিহ্ন সহস্র নেত্ররূপে পরিণত হওয়ায় সহস্রাক্ষ নামে প্রসিদ্ধ হইয়াছিলেন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ai | 169.38.***.*** | ২০ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৯:০৩736824
  • তপস্যা কোরে -> তপস্যা করে :  হলে ভাল হত না ?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক প্রতিক্রিয়া দিন