খুবই চিন্তিত মুখে উচ্ছে বলে, তুমি তাহলে ওই যে লাফ দিয়ে সাগর পেরিয়ে হনুমানের লঙ্কায় যাবার গল্পটা বলেছিলে, দনু কবন্ধর গল্পটা তার অনেক পেছনের গল্প?
কী ভাবে জানলি?
বাঃ, দনু-ই তো রাম-লক্ষ্মণকে বলে দিল সেই পাহাড়টার কথা যেখানে সুগ্রীব তখন থাকে – ঋষ্যমূক না কী যেন নাম বললে তু্মি! সেখানে না গিয়ে তো সুগ্রীব আর হনুমানের সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে না রাম-লক্ষ্মণের। সেই বন্ধুত্ব হবার আগেই কি সীতার খোঁজ করতে সারা পৃথিবীতে বেরিয়ে পড়বে সুগ্রীবের দল? ওরা তো সীতার নামই শোনেনি তখনও। আগে তো রাম-লক্ষ্মণের সঙ্গে সুগ্রীব-হনুমানের আলাপ হবে, বন্ধুত্ব হবে, তারপরেই না সুগ্রীব তার বন্ধু রামের জন্যে নিজেদের দলের বাঁদর-টাঁদরদের পাঠাবে সীতার খোঁজ নিতে! তাই না?
ভেরি গূড, বলে মুড়কি, এতক্ষণে আমি নিশ্চিত হলাম কোন্টা আগের গল্প আর কোন্টা পেছনের গল্প তুই তা নিজে নিজেই বুঝতে পারছিস। ঠিক বলেছিস তুই, এই ঋষ্যমূক পাহাড়ে রাম-লক্ষ্মণ না পৌঁছলে রামায়ণের গল্পটাই হয়তো অন্যরকমের হয়ে যেত। সীতাই যদি না উদ্ধার হয় লঙ্কার থেকে তাহলে আর রামায়ণের থাকে কী?
কিন্তু, কপালে রীতিমতো ভাঁজ ফেলে অনেক চিন্তিত মুখে উচ্ছে বলে, তবে যে তুমি বলেছিলে – মা-ও বলেছিল – সুগ্রীব যে-দেশের রাজা, তার নাম কিষ্কিন্ধ্যা। তাহলে এখন কেন বলছ দনু কবন্ধর সঙ্গে কথা বলে ঋষ্যমূক না কী একটা পাহাড়ে রাম-লক্ষ্মণ এল বাঁদরদের রাজা সুগ্রীবের সঙ্গে দেখা করতে? কিষ্কিন্ধ্যাতে নয় কেন?
এ-ই তো চাই – উচ্ছের চুলে বিলি কেটে দিয়ে আদর করে বলে মুড়কি দিদি, ঠিক ধরেছিস। এই জন্যেই তোকে গল্প বলতে এত ভালো লাগে। সত্যিই তো, কিষ্কিন্ধ্যার যে রাজা, তার সঙ্গে আলাপ করতে রাম-লক্ষ্মণকে ঋষ্যমূক পর্যন্ত যেতে হবে কেন?
আসলে, মুড়কি দিদি বলতে থাকে, কিষ্কিন্ধ্যাতেই রাজত্ব সুগ্রীবের। সুগ্রীবের দাদার নাম বালী। সে-ই প্রথমে রাজা ছিল ওখানকার। একদিন মায়াবী নামে এক দানবের সঙ্গে বালীর লাগল লড়াই। বালী খুবই বড় বীর, কিন্তু মায়াবীও কম যায় না। দাদার সঙ্গে তো সুগ্রীবের খুবই ভাব, লড়াইয়ে সে-ও এগিয়ে এল দাদাকে সাহায্য করতে। এদিকে দুয়েকখানা চড়-থাপ্পড় খাবার পরেই মায়াবী বুঝেছে, ভুল করে কী পালোয়ানের সঙ্গেই সে লড়তে গেছে। এখন বাঁচতে যদি হয়, পালাও!
প্রাণপণ দৌড়োতে থাকে মায়াবী। কিষ্কিন্ধ্যা ভর্তি ছড়ানো নানা আকারের পাহাড়, ছোট বড় মিলিয়ে হাজার হাজার। মায়াবী নামটা শুনেই বুঝতে পারছিস, অনেক রকমের ভেল্কি জানে এই মায়াবী দানব, দৌড়োতে দৌড়োতে যখনই সে হাঁপিয়ে যায়, তখনই সে নিজের আসল চেহারাটা বদলিয়ে একটা পাহাড়ের টিলার মতো দেখতে হয়ে যায়। সেই অবস্থায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিশ্রামও হয়, ঠকানোও হয় বালীকে! কাজেই যতই বীর হোক, তাকে হারানোটা মোটেই সহজ নয় বালীর পক্ষে। সুগ্রীব যতই বলে, দাদা, আমিও থাকব তোমার সঙ্গে, বালী কিন্তু আপত্তি করে! তুই ছাড়্ না, আমি একাই যথেষ্ট ওর পক্ষে, বলে বালী।
ঋষ্যমূক পাহাড়ে যেবার প্রথম গেল রাম-লক্ষ্মণ – আগের দিন তোকে একটু একটু বলেছি, দনু রাক্ষস রাম-লক্ষ্মণকে বলেছিল সুগ্রীবের সঙ্গে দেখা করতে ওদের ঋষ্যমূকেই যেতে হবে – কীভাবে গেল সে গল্পটা পরে বলব – কিন্তু মনে রাখিস সুগ্রীবের সঙ্গে তার দাদা বালীর ভুলবোঝাবুঝিটা কীভাবে হয়েছিল সেটা সেবার খুবই বিশদে রাম-লক্ষ্মণকে বলেছিল সুগ্রীব। আমি বলছি তোকে সেই গল্পটা, কিন্তু তার আগে মায়াবীর সঙ্গে লড়াইটাতে কী হল সেটা শুনে নে।
লড়াই তো চলছে আর প্রাণভয়ে পালানোও চলছে মায়াবী দানবের। চলতে চলতেই একদিন হঠাৎ একটা পাহাড়ের গুহার মধ্যে ঢুকে পড়ল মায়াবী। দেখতে পেয়ে ঢোকে বালীও, সুগ্রীবও আসে পিছু পিছু। বালী তখন সুগ্রীবকে বলল, তোকে আর ভেতরে আসতে হবে না ভাই, তুই বাইরেই দাঁড়িয়ে থাক। এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবি, মায়াবীটাকে মেরে আমি ফিরে আসব, তারপর দু' ভাইয়ে ফিরব একসঙ্গে। বলেই, দৌড়িয়ে গুহার মধ্যে ঢুকে গেল বালী।
এদিকে গুহার বাইরে সুগ্রীব দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। এক বছর পেরিয়ে গেল, গুহার অন্ধকারে উঁকি ঝুঁকি দিয়ে কিছুই ঠাহর করা যায় না। শোনা যায় না কোন শব্দও। কিন্তু দাদা তাকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেই বলে গেছে, যতদিন সে না ফেরে। এমন সময় একদিন খসখসে একটা আওয়াজ শুনে গুহার ভেতরে তাকায় সুগ্রীব, অন্ধকারে একটা ছায়ার মতো কিছু দেখতে পায় সে। কে? বালী, না কি মায়াবী? বোঝা যায় না ঠিক কিছুই, যদিও সুগ্রীব বোঝে, লড়াই চলছে এখনও।
আরও কয়েকটা দিন কেটে যায়, হঠাৎ সেই দিন সুগ্রীব দেখে, গুহার ভেতর থেকে গড়িয়ে গড়িয়ে বেরিয়ে আসছে রক্তমাখা ফেনা – হ্যাঁ, রক্তই তো, অনেকটা! রক্ত যখন অতটাই, মরেছে নিশ্চয়ই কেউ একটা। মায়াবীই হবে, বালীকে মারা অত সহজ নয়! কিন্তু আরও কয়েকদিন অপেক্ষা করবার পরেও বেরোল না কেউই – না বালী, না মায়াবী! আশ্চর্য!
তবে কি দুজনেই মরল? নাহলে, একজন তো অন্তত বেরোবে। নিজেকেই তখন বোঝায় সুগ্রীব, দাদা তাকে বলে গিয়েছিল মায়াবীকে মেরে সে বেরিয়ে আসবে গুহাটার এই দিক দিয়েই, কিন্তু মায়াবীর জন্যে তো কেউ আর অপেক্ষা করে থাকবে না! মায়াবীই তাহলে শেষ অবধি জিতেছে লড়াইয়ে, আর তার নিজের ইচ্ছে মতো যেখান দিয়ে খুশি বেরিয়েও গেছে সে। তবুও, আরও দুটো দিন আশায় আশায় অপেক্ষা করল সুগ্রীব, শেষ পর্যন্ত মন খারাপ করে একা-একাই ফিরে এল কিষ্কিন্ধ্যায়। আসবার আগে বড় একটা পাহাড় ভেঙে সেই পাহাড়ের অর্ধেকটা দিয়ে গুহার মুখটা সে বন্ধ করে আসতে ভুললো না।
কিষ্কিন্ধ্যায় ফিরতে প্রধান প্রধান বাঁদররা ঘিরে ধরে সুগ্রীবকে, বালী মহারাজ কোথায়? মহারাজের কী হয়েছে? এতদিন ধরে কোথায় ছিলে তোমরা?
সুগ্রীবের মুখে সব শুনে খুবই দুঃখ পায় বাঁদররা। তারপর বালীর শ্রাদ্ধ-টাদ্ধ হয়ে যাবার পর সবাই মিলে সুগ্রীবকেই কিষ্কিন্ধ্যার রাজা করে দেয়। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন ফিরে আসে বালী। সুগ্রীবকে সে বলে, তোমাকে আমি গুহার বাইরে আমার জন্যে অপেক্ষা করতে বলেছিলাম, তুমি নিজে রাজা হবার লোভে আমার অবাধ্য হয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে নিজেই কিষ্কিন্ধ্যার রাজা হয়েছ। আমার জন্যে গুহার বাইরে তোমার অপেক্ষা করার কথা ছিল, আমি মায়াবীকে হারিয়ে গুহার বাইরে আসতে গিয়ে দেখলাম, একটা বিরাট পাথর দিয়ে গুহার মুখটা বন্ধ। অনেক ভেবে বুঝলাম, মুখটা বন্ধ করেছ তুমিই, যাতে আমি না বেরতে পারি। আমি ঘুঁষি আর লাথির জোরে সেই পাথর ভেঙে বাইরে বেরিয়ে তোমাকে দেখতে না পেয়ে সোজা দৌড়িয়ে এখানে এসেছি। তুমি মিথ্যেবাদী, লোভী। আমাকে ঠকিয়ে তু্মি আমার রাজত্ব দখল করতে চাও, তোমাকে আমি উচিত-শিক্ষা দেব।
এই বলে, সুগ্রীব বলতে থাকে, আমার দাদা বালী আমাকে মারবার জন্যে ধরতে এল, আর আমিও ভয়ে দৌড়োতে দৌড়োতে এই ঋষ্যমূক পাহাড়ে পালিয়ে এলাম।
তুমি দৌড়িয়ে পালিয়ে এলে, রাম তখন বললেন, আর বালীর মতো বীর তোমাকে ধরতে পারল না? কত দূর কিষ্কিন্ধ্যা থেকে ঋষ্যমূক?
বেশি নয়, যোজনখানেক দূর, বলে সুগ্রীব। আসলে দূরত্বটা কথা নয়, এটুকু তো দাদা নিমেষেই দৌড়িয়ে ধেয়ে আসতে পারত, কিন্তু অন্য অসুবিধে ছিল।
এই পর্যন্ত বলে মুড়কি দিদি জিজ্ঞেস করে উচ্ছেকে, যোজন বুঝতে পারলি?
মাথা নাড়ে উচ্ছে, সে বোঝেনি।
ন' মাইলের একটু বেশি, দশ মাইলই ধর। দশ মাইল কতটা, তোর ধারণা আছে?
ঠোঁট উলটিয়ে উচ্ছে বুঝিয়ে দেয়, তার ধারণা নেই।
এই ধর, মুড়কি বলে, আমাদের এই দেশপ্রিয় পার্কের বাড়ি থেকে শ্যামবাজার। তোর মনে আছে, একটা রোববার আমরা বাড়ির সবাই মিলে গোলবাড়ির মাংস খেতে গিয়েছিলুম, শ্যামবাজারে? মনে আছে তোর?
সেই যেখানে মাংস খেয়ে আমার ঝাল লাগল আর রামলাল না কার দোকান থেকে বাবা সন্দেশ কিনে আনল? সে তো আমরা গাড়ি করে গিয়েছিলাম।
হ্যাঁ, আমরা গাড়িতে গিয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু তখনকার দিনের এই সব বীর বাঁদররা, এক-এক লাফেই নিশ্চয়ই চলে যেতে পারত এই দূরত্বটুকু।
উচ্ছে জবাব দেয় না, দেশপ্রিয় পার্ক থেকে শ্যামবাজারে গাড়ি চড়ে যাওয়ার বদলে লাফ দিতে দিতে যাওয়াটা মনে মনে তুলনা করছে সে তখন। ঠিক তখনই সে শুনল মুড়কি দিদি বলছে, রামচন্দ্র তাই বললেন সুগ্রীবকে, এ তো বালীর কাছে শুধুই একটা লাফের ব্যাপার, সে ধরতে পারল না তোমাকে?
ধরার চেষ্টাই করতে পারল না, বলে সুগ্রীব, এখানে একটা ভয়ের ব্যাপার ছিল দাদার।
ভয়? কিসের ভয়?– রাম জিজ্ঞেস করেন।
দুন্দুভি নামে এক অসুর ছিল, আপনি শুনবেন তার কাহিনী?
দুন্দুভি যদি স্বাভাবিক ভাবে আসে এই ইতিহাসে তাহলে শুনতে হবে বৈকি, বলেন রাম।
এক সময়ে দুন্দুভির ধারণা হয়, তার চেয়ে বড় পালোয়ান স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালে আর নেই। লম্বা-চওড়ায় পাহাড়ের মতো একটা মোষের রূপ ধরে তাই সে পালোয়ান খুঁজে বেড়ায়; এমন একজন, পালোয়ান হিসেবে যে বিখ্যাত। দুন্দুভির ইচ্ছে, তার সঙ্গে লড়াই করে সেই লড়াইয়ে জিতে নাম কিনবে সে। একে-ওকে জিজ্ঞেস করে, এখানে-ওখানে খোঁজখবর নিয়ে, সে বালীর কাছে আসে একদিন।
ষষ্ঠীচরণকে মনে আছে তোর? – মুড়কি দিদি হঠাৎ জিজ্ঞেস করে উচ্ছেকে।
খেলার ছলে ষষ্ঠীচরণ হাতি লোফে যখন-তখন? সেই ষষ্ঠীচরণ?
ষষ্ঠীচরণ যদি হাতি লোফে, মুড়কি দিদি বলে, বালী তাহলে লোফে পাহাড়। তার মর্ণিং ওয়ক হচ্ছে পৃথিবীর এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত দৌড়োনো রোজ সকালে, আর হাতির বদলে পাহাড়ের মাথা ভেঙে সেই পাহাড়চূড়াটাকে আকাশে ছুঁড়ে ছুঁড়ে বারবার লুফে নেওয়া হচ্ছে তার ব্যায়াম।
দুন্দুভি এসেছে যখন, বালীর তখন ঘুম পাচ্ছিল। সে শুতে যাবে, দুন্দুভি এসে লড়তে চাইল তার সঙ্গে। বালী বড় বড় দু-চারটে গাছ উপড়ে নিয়ে তাই দিয়ে পেটালো দুন্দুভিকে, তারপর একটা আস্ত পাহাড় তুলে মাথায় ঠুকে দিল তার, আর শেষমেশ তার মোষের শিং দুটো ধরে কয়েকপাক ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দিল এক যোজন দূর। ততক্ষণে দুন্দুভির নাক-কান দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করেছে, সেই রক্তের এক ফোঁটা হাওয়ায় উড়ে পড়ল ঋষ্যমূক পাহাড়ের কাছে মতঙ্গ নামে এক মুনির আশ্রমে। কোথা থেকে এই অপবিত্র রক্তের ফোঁটা এল এখানে? অভিশাপ দিলেন মুনি, যে দূষিত করেছে আমার আশ্রম, এই আশ্রমের এক যোজনের মধ্যে এলেই তার মৃত্যু।
সুগ্রীব বলল, তাই পৃথিবীর সর্বত্র গেলেও আমার দাদা বালী ঋষ্যমূক পাহাড়ের কাছাকাছিও কখনো আসবে না। আমি জানতুম এই ঘটনাটা, দাদাই বলেছিল আমায়। আমার মনে পড়ে গেল দাদার হাত থেকে বাঁচতে হলে পৃথিবীতে একমাত্র ঋষ্যমূকই নিরাপদ আমার পক্ষে, চারজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে ঋষ্যমূকে পালিয়ে এলুম আমি।