ছবি: ঈপ্সিতা পাল ভৌমিক
ব্যাপারটা শুরু হয়েছিল এই ভাবে।
আগে যাকে রুকস্যাক বলা হতো, ইদানিং যে ঝোলাটার নাম হয়েছে ব্যাকপ্যাক, পিঠে সেরকম একটা 'ব্যাগেজ' চাপিয়ে পাড়ার ব্যাঙ্কের বাইরে দশটা বাজার দশ মিনিট আগেই পৌঁছল বাবুয়া, পাড়ারই ছেলে, প্রায় সবাই চেনে তাকে। বন্ধ কোলাপসিব্ল্ গেটের ঠিক বাইরেটায় তখনও-বন্ধ ব্যাঙ্কটার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিলেন হিমাংশুবাবু, তাঁকেও চেনে পাড়ার প্রায় সবাই। হিমাংশুবাবু ডাকতলা হাই স্কুলে অঙ্কের শিক্ষক ছিলেন, রিটায়ার করেছেন কয়েক বছর আগে।
হিমাংশুবাবুর পাশে এসে বাবুয়া বলল, গেটের সঙ্গে যে সেঁটে দাঁড়িয়ে আছেন স্যার! একটু পিছিয়ে দাঁড়ান, আপনার আগে আমার লাইন আছে।
তোমার লাইন কীভাবে থাকলো? – হিমাংশুবাবুর গলায় ঈষৎ উষ্মা, পঁয়তাল্লিশ মিনিট আমি দাঁড়িয়ে আছি এখানে, তোমাকে তো একবারও দেখিনি।
মুখে বাঁ-হাতের তর্জনী ও মধ্যমাটা পুরে অদ্ভুত একটা আওয়াজ বের করে বাবুয়া, তারপর উল্টো দিকের পানের দোকানটার দিকে ফিরে অন্য হাতটার মধ্যমা ও বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের সম্মিলনে একটা শব্দ সৃষ্টি করে সে। পানের দোকানের ছোকরাটি বাবুয়ার মুখনিঃসৃত আওয়াজে আকৃষ্ট হয়ে তাকিয়েছিলো তার দিকে, এখন এই শব্দের সংকেতে দৌড়িয়ে সে চলে আসে বাবুয়ার কাছে।
এখানে কার লাইন ছিল? – বাবুয়া জিজ্ঞেস করে ছেলেটাকে।
তোমার, জবাব দেয় ছেলেটা।
হিমাংশুবাবুর কণ্ঠস্বরের ঈষৎ উষ্মা রূপান্তরিত হয় তীব্র ধমকে, তা কী করে হবে? আমি ন'টা থেকে দাঁড়িয়ে আছে এখানে, ওকে তো দেখিনি।
বাবুয়াদা সকাল আটটায় এসে লাইন রেখে গেছে, আমি সাক্ষী।
প্রবল রাগে প্রায় কথা বলতে পারেন না হিমাংশুবাবু, তোতলাতে শুরু করেন, এমন সময় সিকিউরিটির উর্দি-পরা একজন এসে কোলাপসিব্ল্ গেট-এর পাঁচটা তালা পরপর খুলে ঠেলেঠুলে ইঞ্চি দশেকের একটা ফাঁক তৈরি করে ঢুকে যায় ব্যাঙ্কে।
তার পিছন পিছন প্রথমে বাবুয়া, তারপর হিমাংশুবাবু। ঢুকেই, সোজা পাশবুক আপডেটিঙের ঘুমন্ত মেশিনটার সামনে পজিশন নেয় বাবুয়া, পেছনেই হিমাংশুবাবু।
সিকিউরিটির লোকটা ততক্ষণে একটা একটা করে আলো-পাখা-এয়ার কণ্ডিশনারের সুইচ 'অন' করছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যাঙ্কের ম্যানেজার এবং কিছু কিছু কর্মচারী আসতে শুরু করল, বাথরূমের শব্দ এবং 'আউটার'-এ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লোকাল ট্রেনের সিগন্যাল না-পাওয়ার ও মেট্রোর প্রবল ভীড়ে উঠতে-না-পারার গল্পে ব্যাঙ্কের প্রাণ স্পন্দিত হল, এবং অবশেষে 'ওয়েলকাম' লেখাটা ফুটে উঠে পাশবুক মেশিনটা কাজের দিন ঘোষণা করল। পিঠের ব্যাকপ্যাকটা নামিয়ে অতি মসৃণ সাদা মেঝেতে সযত্নে রাখলো বাবুয়া, এবং মেশিনে ফুটে-ওঠা নিজের পছন্দের ভাষার নামটাতে আঙুল ছুঁইয়ে মেশিনেরই নির্দেশ অনুযায়ী তার হস্তধৃত পাশবুকটার শেষ এন্ট্রির পাতাটা খুলে মেশিনের গহ্বরে ঠেলে দিল। মাত্র একটাই এন্ট্রি হবার ছিল, ছাপা-টাপা হয়ে পাশবুকটা বেরিয়ে আসতে তেত্রিশ সেকেণ্ডের বেশি সময় লাগলো না। ব্যাকপ্যাকটা খুলে তার একটা গহ্বরে আপডেটেড পাশবুকটা চালান করে অন্য আর একটা গহ্বর থেকে দ্বিতীয় পাশবুকটা মেশিনে ঢোকাতে বাবুয়ার সময় লাগলো কমবেশি পঁচিশ সেকেণ্ড।
আপডেটিং বেশ তাড়াতাড়িই হচ্ছে লক্ষ্য করলেন হিমাংশুবাবু, অভ্যস্ত কানে মেশিনগহ্বরের প্রিন্টারের শব্দ শুনে তিনি আন্দাজ করেন, একটা-দুটোর বেশি এন্ট্রি কোন পাশবুকেই হচ্ছে না, এমনকি আদান-প্রদানের অভাবে অনেক পাশবুক ভেতরে ঢোকার পরেও প্রিন্টারের শব্দ হচ্ছেই না একেবারে, ফলত বেশ দ্রুততার সঙ্গেই বেরিয়ে আসছে পাশবুকটা। হিমাংশুবাবুর মনে পড়ে যায় যতীন বাবু ঠিক এরকমটাই বলেছিলেন, আজকাল প্রায় রোজই পাশবুক আপডেট করায় বেশির ভাগ মানুষ, সে আদান-প্রদান হোক বা না হোক।
শুধু যে যতীন বাবু ঠিক বলেছিলেন তা-ই নয়, ঠিক বলেছিল বাবুয়াও, মনে মনে বলেন হিমাংশুবাবু। এই যে এতক্ষণ তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন বাবুয়ার পেছনে, কই তাঁর পেছনে তো তেমন ভীড় নেই। এক-আধজন আসছে বটে মাঝে মাঝে, কিন্তু লাইন ব্যস্ত দেখে ফিরেও যাচ্ছে তারা!
ডাকতলা হাই স্কুলে হিমাংশুবাবু ছিলেন অঙ্কের শিক্ষক আর যতীনবাবু খেলার স্যার, ফিজিকাল ইনস্ট্রাক্টর। যতীনবাবুর সঙ্গে তেমন কিছু হৃদ্যতা ছিল না হিমাংশুবাবুর তখন, কিন্তু একই পাড়ার বাসিন্দা, রিটায়ারমেন্টের পর এখন ওঁরা বেশ ঘনিষ্ঠ। অঙ্কের প্রাক্তন শিক্ষক হিসেবে সংখ্যা-টংখ্যার ঊর্ধ্ব-এবং অধো-গমনের রহস্য হিমাংশুবাবুরই বেশি বোঝা উচিত, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে তিনি লক্ষ্য করেছেন এসব ব্যাপারে খেলার স্যার যতীনবাবুর প্রতিভা অনেক বেশি। কিন্তু সেই যতীনবাবুই কীভাবে হঠাৎ পঞ্চাশ হাজার টাকা 'চোট' খেয়েছিলেন, সেই কাহিনীই শুনিয়েছিলেন হিমাংশুবাবুকে।
মাসে সাধারণত একবারই ব্যাঙ্কে যেতেন যতীনবাবু। পেনশনের টাকাটা ঠিক মত জমা পড়েছে কিনা সেটা পাশবুক আপডেট করে দেখে নিতেন এবং জমা পড়ে থাকলে, সারা মাসের সংসারের ব্যয় বাবদ তুলে আনতেন কিছু টাকা। ইদানিং নানা মিউচুয়াল ফাণ্ড এবং আরও কয়েকটা জনহিতৈষী ফাণ্ডেও কিছু কিছু টাকা খাটাচ্ছেন তিনি। সেই টাকা থেকে কিছু আয় হলো কিনা, আর হলে তা কতটা, সেটাও সেই মাসিক আপডেটিঙের দিনেই জানা যেত।
এইরকমই একটা দিনে যতীনবাবু আবিষ্কার করেন তাঁর অ্যাকাউন্ট থেকে আগের মাসের আপডেটিঙের পরই, একই দিনে দু দফায়, পঁচিশ হাজার করে টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। টাকাটা কে তুলেছে, বা কীভাবে তোলা হয়েছে বুঝতে না পেরে তিনি দেখা করেন ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের সঙ্গে। কোন ভূমিকা না করেই পাশবুকের পাতাটা খুলে ম্যানেজার সাহেবের সামনে মেলে ধরেন যতীনবাবু, দু বারে একই দিনে এই পঞ্চাশ হাজার টাকা কে তুললো?
অ্যাকাউন্টটা কার?
আমার।
তাহলে আপনিই তুলেছেন।
কিন্তু আমি তো তুলিনি, তা-ই আপনার কাছে জিজ্ঞেস করতে এলুম।
আপনার ছেলে কী করে?
তার সঙ্গে এই প্রশ্নের কী সম্পর্ক?
আমি একটা প্রশ্ন করেছি, সেটার উত্তর দিন।
যতীনবাবু বোঝেন, প্রশ্নের উত্তর তাঁকে দিতেই হবে। তাঁর টাকা হারিয়েছে, যে টাকা ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের জিম্মায় থাকে। সেই ম্যানেজার প্রশ্ন করছেন, কাজেই উত্তর দেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
ছেলে নেই, একটাই মেয়ে, মিনিমিন করে জবাব দেন যতীনবাবু, তার বিয়ে হয়ে গেছে বছর বিশেক আগে।
আপনার এ-টি-এম কার্ডটা জামাইয়ের হাতে পৌঁছল কীভাবে?
এ-টি-এম কার্ডের ব্যাপারটা জানেন যতীনবাবু। এই ব্যাঙ্কেই যেখানে পাশবুক আপডেটিঙের মেশিনটা থাকে, সেখানেই, সেই মেশিনটার পাশেই, টাকা তোলার মেশিন। একটা প্লাস্টিকের কার্ড – যাকে এ-টি-এম কার্ড বলছেন ম্যানেজার
সাহেব – সেটা ঢুকিয়ে মেশিন থেকে বের করে নেওয়া যায় টাকা, যতীনবাবু জানেন।
কিন্তু আমার তো এ-টি-এম কার্ড নেই!
বিস্ময়সূচক এই মন্তব্যের কোন উত্তর দেন না ম্যানেজার সাহেব, টেবিলের নীচের দিকে হাত নিয়ে গিয়ে একটা সুইচ টেপেন, ঘরের বাইরে থেকে একটা শব্দ ভেসে আসে, কিছুক্ষণ পরেই দরজা ঠেলে ঢোকে একটা লোক।
এ-টি-এম রেজিস্ট্রার, যতীনবাবুর দিকে একটা চোখ রেখে ধীরে ধীরে উচ্চারণ করেন ম্যানেজার।
লোকটা বেরিয়ে যায়, একটু পরেই ফিরে আসে মোটা একটা বাঁধানো খাতা হাতে নিয়ে, টেবিলের ওপর সেটা রেখেই বেরিয়ে যায় ঘর থেকে।
যতীনবাবুর পাশবুকটা কাছে টেনে নেন ম্যানেজার, সেটার সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে কয়েকটা পাতা বার বার উল্টে দেখেন
এ-টি-এম রেজিস্ট্রারে, তারপর মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করেন যতীনবাবুকে, অনলাইনে ট্রাঞ্জাক্শন করেন নাকি আজকাল?
অনলাইনে? ম্যানেজারের প্রশ্নের উত্তর দেবার আগেই যতীনবাবুর মনে পড়ে যায় রিটায়ারমেন্টের কয়েকমাস আগের একটা ঘটনার কথা। সদ্য ইংরিজির মাষ্টার হয়ে আসা এক ছোকরার নামে একটা পার্সেল এসেছিল স্কুলে। এর আগে স্কুলে কোন মাষ্টারমশায়ের ব্যক্তিগত নামে পার্সেল আসতে দেখেনি কেউ, যা আসতো মাঝে মাঝে, সে সবই ওই হেডমাস্টারের নামে। সুদৃশ্য মোড়কটা পাশে রেখে দিয়ে ছোকরা একটু উচ্চ কণ্ঠে স্বগতোক্তি করে, স্ট্রেইট ফ্রম দ্য স্টেট্স্, অনলাইনে কিনলুম। র্যাক থেকে চক-ডাস্টার নিচ্ছিলেন অঙ্কের শিক্ষক হিমাংশুবাবু, তিনি মন্তব্য ছুঁড়ে দেন, আবার 'নে' কেন? অনলাই-'নে'?
'নে' শব্দটার ওপর বিশেষ জোর দেন হিমাংশুবাবু।
ঈষৎ হেসে হিমাংশুবাবুর দিকে তাকায় ছোকরা, ইংরিজিতেই বলা উচিত ছিল, জানি। কিন্তু কথাটা কী হবে? ইন না অ্যাট অনলাইন? নাকি ওভার অনলাইন?
লাইন-এর সঙ্গে অন শব্দটা প্রিপোজিশন হিসেবেই মিলিয়ে দেওয়া আছে, আবার ডবল কেন? – বলতে বলতে পরের ক্লাসের উদ্দেশে বেরিয়ে যান হিমাংশুবাবু।
প্রশ্ন যেটা তুলেছিলেন হিমাংশুবাবু, তার সমাধান হয়নি সেদিন, কিন্তু আজ ব্যাঙ্কের ম্যানেজার সাহেবের কথায় 'অনলাইনে' শুনে যতীনবাবু বুঝলেন, ঠিকই বলেছিল ছোকরা।
যতীনবাবু নিজে কিন্তু বললেন, ব্যাঙ্কেও অনলাইন আছে স্যার? টাকা-পয়সা তুলতে বা জমা দিতে আর ব্যাঙ্কে আসবার দরকার নেই?
যতীনবাবুর দিকে কয়েক সেকেণ্ড নিঃশব্দে তাকিয়ে ম্যানেজার জিজ্ঞেস করেন, নেট ব্যাঙ্কিং করেন আপনি?
ব্যাঙ্কের নেট-গ্রস!? এসব আমি বুঝিনা স্যার। আজকাল ছোটখাটো একটু-আধটু টাকা খাটাচ্ছি ঠিকই, তা-ও কিন্তু ঐ অরবিন্দবাবুর উপদেশ মতো। অরবিন্দবাবু আমাদের স্কুলের কমার্সের মাষ্টা'মশাই ছিলেন, উনিই এসব ভালো বুঝতেন।
কথা আর বাড়ালেন না ম্যানেজার সাহেব, বললেন দুদিন পরে আসতে।
দুদিন পর ম্যানেজার আর দেখা করলেন না যতীনবাবুর সঙ্গে, সোজা পাঠিয়ে দিলেন অ্যাকাউন্ট্যান্টের কাছে।
অ্যাকাউন্ট্যান্ট অল্পকথার মানুষ, সহজ কথায় বুঝিয়ে দিলেন যতীনবাবুর যা গেছে তা গেছে, অল্পের উপর দিয়েই গেছে। এটা একটা অনলাইন ফ্রড-এর কেস, যতীনবাবু যদি লিখিত আবেদন করেন – করাই উচিত – ব্যাঙ্ক তাহলে একটা
এফ-আই-আর করাবে, সাইবার ক্রাইম ডিভিশন তদন্ত করবে, তবে তাঁর টাকা ফেরত পাবার আর আশা নেই, এক সপ্তাহের মধ্যে আবেদন করলে ব্যাঙ্ক দায়িত্ব নিতো।
যতীনবাবু ইদানিং আগের তুলনায় অনেক বেশি বুদ্ধিমান হয়েছেন, অযথা তর্ক করেননি। স্কুলে যখন চাকরি করতেন, স্কুল ফুটবল লীগে ডাকতলা হাই স্কুলের সঙ্গে পঞ্চাননপুরের ফাইনাল খেলায় স্পষ্ট একটা অফ্সাইড গোলে যখন তাঁর স্কুল হেরে যায়, তখন অনেক লেখালিখি করেছিলেন তিনি। লেখালিখিটা এমন পর্যায়ে উঠেছিল যে হেড মাষ্টারমশাই একদিন ডেকে সাবধান করে দিয়েছিলেন ওঁকে: কর্তৃপক্ষ চায় না এ ব্যাপার নিয়ে আর বাড়াবাড়ি হোক। এমন হলে আমাদের এন্ট্রিই নেবে না পরের বছর। আপনি মশাই খেলার মাষ্টার, খেলা জেতাবার মাষ্টার ন'ন। পরের বছর আপনার এন্ট্রি না নিলে কী কাজটা করবেন আপনি? আর তো কয়েকটা বছর, তারপর তো রিটায়ার করেই যাবেন। কী দরকার এসব ঝামেলার!
বহু অভিজ্ঞতায় প্রাজ্ঞ যতীনবাবু অযথা আর তর্ক অথবা কাকুতি-মিনতি না করে এবং অ্যাকাউন্ট্যান্টের আবেদনের প্রস্তাবটা মনে মনে প্রত্যাখ্যান করে মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নেন এবার থেকে রোজ পাশবুক আপডেট করাবেন তিনি।
হিমাংশুবাবুকে তাঁর এই সিদ্ধান্তটা জানাবার সময় পুরো ঘটনাটাই বলেন যতীনবাবু। হিমাংশুবাবুও একই সিদ্ধান্ত নিলেন তৎক্ষণাৎ। সেই থেকে রোজই নিজের পাশবুক আপডেট করাচ্ছেন তিনি, যদিও প্রায় প্রতিদিনই পাশবুকটা তাঁকে ফিরিয়ে দিয়ে মেশিনটি বলে ওঠে, শেষ আপডেটিঙের পর কোন আদান-প্রদান না হবার ফলে তাঁর পাশবুকে ছাপবার মতো কিছুই নেই!
তা – তা হোক, হিমাংশুবাবু বোঝান নিজেকে, নিশ্চিন্ত তো হওয়া গেল, সাইবার ক্রাইমের শিকার তো হতে হলো না তাঁকে, আর তা ছাড়া হতোও যদি ক্রাইম কিছু, সঙ্গে সঙ্গেই জানতে পারতেন তিনি। এক সপ্তাহের মধ্যে কেন, সেই মুহূর্তেই তিনি জানিয়ে দিতেন ব্যাঙ্ককে, আর ব্যাঙ্ক তো বলেইছে দায়িত্ব নিত তারা!
মনে মনে নিজের ভাগ্যকে ধন্যবাদ দেন হিমাংশুবাবু, যতীনবাবুর মতো কপাল তো তাঁরও হতে পারতো। আজ যে এমন নিশ্চিন্ত আছেন তিনি, সে শুধুমাত্র ভাগ্যদুষ্ট যতীনবাবুরই আনুকূল্যে! যতীনবাবু যদি পঞ্চাশ হাজার টাকার চোট না খেতেন এবং সমস্ত ঘটনাটা আনুপূর্বিক না বলতেন হিমাংশুবাবুকে, তাহলে আজ এত নিশ্চিন্ত তিনি থাকতে পারতেন কি? কাজেই, নিজের ভাগ্যকে শুধু নয়, যতীনবাবুকেও মনে মনে ধন্যবাদ জানান তিনি।
কিন্তু পকেটে পাশবুক নিয়ে যেদিন থেকে ব্যাঙ্কে রোজ আসতে শুরু করেছেন হিমাংশুবাবু, সেদিন থেকেই একটা আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ্য করছেন তিনি। প্রত্যেকবারই মেশিনের সামনের লাইনটা আগের দিনের তুলনায় দীর্ঘতর! কেন? যতীনবাবুর ঘটনাটা কি সবাই জেনে গেল? সবাই কি তাঁরই মতো সাবধানী হয়ে গেল হঠাৎ? যতীনবাবুকে জিজ্ঞেস করায় তিনি যা বললেন তাতে নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে করল হিমাংশুবাবুর। ইদানিং পাড়ার লাইব্রেরি থেকে পুরোনো দিনের বাংলা উপন্যাস নিয়মিত ধার করা শুরু করেছেন তিনি। সেই উপন্যাস যখন গোগ্রাসে গেলেন তিনি প্রত্যেক সন্ধ্যেবেলায়, ঠিক সেই সময়েই নাকি টেলিভিশনের নানা চ্যানেলে নানা রকমের খবরের প্রোগ্রাম চলে। হিমাংশুবাবুর ধারণা ছিল, সন্ধ্যেবেলার টেলিভিশন বাড়ির মহিলাদের জন্যেই সম্প্রচারিত হয়। তিনিও তাঁর স্ত্রীকে সন্ধ্যেটা এতদিন টেলিভিশনের সামনে বসে থাকার অবাধ স্বাধীনতা দিয়ে এসেছেন, খবরও রাখেননি যে প্রত্যেক সন্ধ্যেতেই গড়ে অন্তত তিনটে সাইবার ক্রাইমের ঘটনা শোনানো হয় বাংলা নিউজ চ্যানেলে! সেইসব ঘটনার কোন খবরই রাখতেন না এতদিন হিমাংশু বাবু! যাঁরা খবর রাখেন আতঙ্কিত সেই ভদ্রলোকরা পরের দিন থেকেই তাঁদের নিজ-নিজ ব্যাঙ্কের পাশবুক-মেশিনের সামনে লাইন দেন সকালবেলায়! সাপের মতো পেঁচিয়ে যাওয়া লাইনে প্রায়ই গণ্ডগোল হয় নানা রকমের। লাইন টপকে যাওয়া, লাইনে একবার দাঁড়িয়ে বাজারটা সেরে এসে আবার লাইনের দখল চাওয়া – ইত্যাদি নানা গণ্ডগোল! এই তো সেদিন হিমাংশুবাবুর সামনেই ব্যাঙ্কে প্রায় মারামারি হবার জোগাড়! কয়েকজনকে একাধিক পাশবুক নিয়ে মেশিনের সামনে দেখা গেল। পেছনের মানুষরা আপত্তি করলেন। জবাবে কেউ কেউ বললেন তাঁর একাধিক অ্যাকাউন্ট আছে একই ব্যাঙ্কে, প্রতিটাই তিনি আপডেট করাচ্ছেন। কেউ বললেন তিনি তাঁর অসুস্থ স্ত্রীর পাশবুকটাও নিয়ে এসেছেন। বুড়ো বয়েসে এটা কি কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না?
হিমাংশুবাবু অবিশ্যি লাইন-এর দৈর্ঘ্যে বিচলিত ন'ন। রিটায়ারমেন্টের পর তাঁর আর কীই বা কাজ! সকালে বাজারটুকু নিয়মিত করেন, খবরের কাগজটা পড়েন খুঁটিয়ে, আর ব্যাঙ্কে যান। বাজারের পর বেশিক্ষণ বাড়িতে না-থাকাই ভালো। স্ত্রী যখন বাজার তুলবেন তখন তার সমালোচনা হবেই। তার থেকে বাকবিতণ্ডা, এবং অশান্তি। কী দরকার! ব্যাঙ্কে যাওয়াই ভালো। ব্যাঙ্ক থেকে ফিরে স্নান-খাওয়া সেরে দুপুরে নিয়মিত ঘুম, বিকেলে চা-পান, এবং সন্ধ্যেবেলা লাইব্রেরি খোলার সঙ্গে সঙ্গেই আগের দিনের বইটা ফেরৎ দিয়ে আর একটা উপন্যাস নিয়ে আসা!
বেশ চলছিল, এরই মধ্যে একটা কাণ্ড ঘটলো একদিন। আজ ব্যাঙ্কে বাবুয়া নামের যে ছেলেটার সঙ্গে দেখা হয়েছে হিমাংশুবাবুর, তার ভালো নাম সার্থক। ডাকতলা হাই স্কুলে সে তাঁর ছাত্র ছিলো। আজকালকার অন্য অনেক স্কুলের সঙ্গে ডাকতলা হাই-কে গুলিয়ে ফেলা চলবে না। শিক্ষা দপ্তরের নানা রকমের চাপ সত্ত্বেও ডাকতলা হাই-এর হেডমাষ্টারমশাই কখনো অভিভাবককে বুঝিয়ে, কখনো পাড়ার কোন কোন বিজ্ঞ ব্যক্তির সাহায্য নিয়ে, প্রতি ক্লাশেই এক-আধজন ছাত্রের ক্লাশ-প্রমোশন আটকিয়ে দেন। বিশেষ করে মাধ্যমিক এবং উচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবার যোগ্যতাসূচক যে 'টেস্ট' পরীক্ষা হয়, তাতে সব বিষয়ে পাশ না করলে কিছুতেই 'ফাইনাল' পরীক্ষায় বসতে পারে না তাঁর স্কুলের ছাত্ররা। মাধ্যমিকের 'টেস্ট'-এ ইংরিজি বাংলা এবং অঙ্কে সার্থক পাশ করেনি। ধরাধরি করার পর ইংরিজি আর বাংলার স্যাররা তাকে পাশের নম্বর দিয়ে দিতে রাজি হয়ে যান, কিন্তু হিমাংশুবাবু অনড়। সার্থকের মতে, ইংরিজি এবং বাংলাতে ভুল লিখলেও যদি ছাত্রদরদী স্যাররা তাকে পাশ-মার্ক দিতে পারেন, তাহলে অঙ্কের স্যার পারবেন না কেন? হিমাংশুবাবু তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেন, বাংলা এবং ইংরিজিতে প্রশ্নের উত্তরের যথার্থতার বিচার অনেক সময়েই দুজন স্যার দুরকম করতে পারেন, এমনকি একই স্যারের পক্ষেও ভিন্ন সময়ে বিভিন্ন করা সম্ভব, কিন্তু অঙ্কে তা হয় না। অঙ্কের উত্তর সব সময়েই ঠিক অথবা ভুল, তা সময়নিরপেক্ষ, একেবারেই অবজেকটিভ। সার্থক অভিজ্ঞ ছাত্র, বহু ক্লাশেই সে একাধিক বছর কাটিয়েছে, সে জানায় অবজেকটিভ পরীক্ষা কাকে বলে তা তার ভালো মতোই জানা আছে, বহু অবজেকটিভ পরীক্ষা সে এ যাবৎ পাশ করেছে, সে জানে অবজেকটিভ পরীক্ষা ঢ্যারা দেবার পরীক্ষা, অঙ্কের পরীক্ষাটাই একমাত্র পরীক্ষা যা অবজেকটিভ নয়, সেখানে অঙ্কটা পুরোপুরি কষতে হয়, শুধু ঠিক বা ভুলের জায়গায় ঢ্যারা দিয়ে দিলেই চলে না। এত যুক্তিতেও হিমাংশুবাবুকে কিন্তু বোঝানো যায়নি, বিরক্ত সার্থক অতএব মাধ্যমিক পাশ করার চেষ্টাও করেনি আর। এমনিতেই কয়েকটা ক্লাশে এক বছরের বেশি সময় কাটাবার ফলে তার বয়েস সাধারণ ছাত্রের তুলনায় একটু বেশি, কাজেই পাশ করার ব্যাপারে কোনরকমের ঝুঁকি না নিয়ে পড়াশোনায় ইতি দেওয়াটাই সে মনে করেছে বুদ্ধিমানের কাজ। তা ছাড়া পাড়ার নেতা অমুক গাঙ্গুলি সম্প্রতি মন্ত্রী হবার পর থেকে তাঁর সহকারী-ইন-চীফ তমুক নস্কর পাড়ায় বিকল্প রোজগার যোজনার প্রধান হয়েছে। তমুকদার সঙ্গে তার বিশেষ খাতির। তমুকদা তাকে কথা দিয়েছেন, বিকল্প রোজগারের স্কীম-এ তার একটা ব্যবস্থা তিনি করে দেবেন। সকালে মাত্র কয়েকঘন্টা কাজ করলেই তার যথেষ্ট রোজগার হবে, বাকি সময়টা সে সামাজিক ক্রিয়াকলাপে এবং পরোপকারে ব্যস্ত থাকতে পারবে।
যে-ই কথা সে-ই কাজ। সেদিনই বিকেলে লাইব্রেরির সামনে হিমাংশুবাবুকে ধরলো সার্থক ওরফে বাবুয়া এবং তমুক। পাড়ার বয়স্কদের অনর্থক পরিশ্রমের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যে সম্প্রতি এক বিশেষ প্রকল্প নিয়েছে পাড়ার ক্লাব। এই যে ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে পাশবুক-মেশিনের সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা রোজ লাইন দিতে বাধ্য হচ্ছেন বয়স্করা, এ কি চলতে দেওয়া যায়? আজও তো তিনজন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, ব্লাড-প্রেশার বেড়ে গিয়ে হাসপাতালেও ভর্তি হয়েছেন একজন। ক্লাব তাই ঠিক করেছে, প্রতিদিন সকালে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রত্যেক সীনিয়র-সিটিজেন ও মহিলার পাশবুক সংগ্রহ করে আনবে পাড়ার ছেলেরা, আপডেট করে আবার বিকেলে পৌঁছিয়ে দেবে ঘরে ঘরে। মাত্র পাঁচ টাকা প্রতি পাশবুক প্রতি দিনে!
হ্যাঁ-না হ্যাঁ-না করতে করতে লাইব্রেরিতে ঢুকে পড়েন হিমাংশুবাবু কোনরকমে, পেছন থেকে শুনতে পান বাবুয়া এবং তমুকের কণ্ঠস্বর: কাল সকালে তাহলে দেখা হচ্ছে স্যার!
বাবুয়া এবং তমুকের সঙ্গে একটু-আধটু বাদানুবাদের ফলে নিজেকে কেমন একটু অসুস্থ লাগে লাইব্রেরিতে ঢোকার পর; ক্যাটালগটা দেখতে গিয়ে মাথাটা কেমন টিপ-টিপ করতে থাকে, বেরিয়ে পড়েন হিমাংশুবাবু, এবং আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছিয়ে যান যতীনবাবুর বাড়ি। এক গ্লাস জল খেয়ে একটু সুস্থ হবার পর যতীনবাবু জিজ্ঞেস করেন, আপনার বাড়িতেও গিয়েছিল নাকি?
হ্যাঁ, ওই তমুক, আর সঙ্গে বাবুয়া, তবে বাড়িতে ঠিক নয়, কিন্তু আপনি বুঝলেন কীভাবে?
আমার কাছেও এসেছিল, আরো দুয়েকজনের বাড়িতেও গিয়েছিল শুনেছি। তবে আমি রাজি হইনি। সরকার রিটায়ার করিয়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু আমি বলে দিয়েছি আমার স্বাস্থ্য ভালোই আছে, বাবুয়া-টাবুয়াদের চেয়ে জোর কিছু কম নেই গায়ে। তবে আপনার শরীর যেমন দেখছি...
কী দেখছেন যতীন বাবু? – মনে মনে ভাবেন হিমাংশু – উনি না হয় ফিজিকাল ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন স্কুলে, তাই বলে কি উনি একাই স্বাস্থ্যবান?
সেই কথাই মুখের উপর বলে দিয়েছেন হিমাংশুবাবু বাবুয়াকে – বাবুয়া পরের দিন এসেছিল সকালেই, সঙ্গে আরেকটি ছেলে, সে-ই নাকি রোজ হিমাংশুবাবুর বাড়ি থেকে পাশবুকটা নিয়ে যাবে – যতো অথর্ব তোমরা মনে করছো আমাকে ততটা হইনি এখনো!
তারপর থেকে আর কেউ আসেনি। হিমাংশুবাবু রোজই যাচ্ছেন ব্যাঙ্কে। তবে এ-ও ঠিক, রোজ কাজ হচ্ছে না তাঁর। মাঝে মাঝেই ব্যাঙ্কে গিয়ে দেখেন পাশবুক-মেশিনের সামনেটা ফাঁকা, কাছে গিয়ে দেখেন হাতে লেখা একটা কাগজ সাঁটা মেশিনটার ওপর, তাতে লেখা “আউট অব অর্ডার!” আজ তাই সকালেই হাজির হয়েছেন তিনি! ব্যাঙ্ক খোলার পনের মিনিট আগেই!
বাবুয়ার ব্যাগ আর খালিই হয় না। একটা করে পাশবুক আপডেট হচ্ছে, সেটা ঢুকছে মেঝেতে শায়িত ব্যাকপ্যাকের গহ্বরে, আর সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাকপ্যাক থেকে বেরিয়ে অন্য এক পাশবুক ঢুকছে মেশিনের গহ্বরে! যেন অনন্ত আসা-যাওয়ার খেলা!
ঘন্টাখানেক পর খানিকটা ধৈর্য হারান হিমাংশু বাবু। বাবুয়ার পিঠে আলতো করে তর্জনীর চাপ দিয়ে বলেন, আমার তো একটাই সার্থক, করে নিই?
এমন তো কথা ছিলো না স্যার।
পাক্কা সাড়ে তিন ঘন্টার শেষে মেশিন ছেড়ে ব্যাকপ্যাক পিঠে ঝুলিয়ে বেরিয়ে যায় বাবুয়া। ব্যাঙ্কের ঘড়িটা একটা মাত্র ঘন্টা বাজিয়ে জানিয়ে দেয় মধ্যাহ্ন-ভোজের বিরতি। ক্যাশ-কাউন্টারের বাইরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে কিছু মানুষ, কাউন্টারের ভদ্রলোকটি তাঁর ছোট্ট জানলাটায় চাবি লাগিয়ে বেরিয়ে যান, আরো কেউ কেউ বিভিন্ন কাউন্টার থেকে ধীরে ধীরে বেরোতে থাকেন, হাতে-লেখা একটা সাদা কাগজ নিয়ে সিকিউরিটির উর্দি-পরা একজন প্রায় দৌড়োতে দৌড়োতে পৌঁছোয় পাশবুক মেশিনটার সামনে, এবং হিমাংশু বাবু কিছু বুঝে ওঠবার আগেই কাগজটা সেঁটে দেয় মেশিনের ওপর। তাতে লেখা: “আউট অব অর্ডার!”
মানে? – গর্জিয়ে ওঠেন হিমাংশু বাবু।
মানেটা তো লেখাই আছে, কাগজটা দেখিয়ে জবাব দেয় সিকিউরিটির লোকটা।
আউট অব অর্ডার কি টিফিনের সময়টুকুর জন্যে, না তার পরেও থাকবে?
তা তো বলতে পারছি না, জবাব দেয় লোকটা, টিফিনের পর কী হবে তা তখনই জানা যাবে।
এ-ধার ও-ধার ঘোরাঘুরি করতে থাকেন হিমাংশু বাবু, তিনি জানেন তাঁর স্ত্রী উদ্বিগ্ন হচ্ছেন, কিন্তু কিছুই করার নেই তাঁর। তিনি বা তাঁর স্ত্রী মোবাইল ফোন ব্যবহার করেন না, ছেলে বহুবার বলা সত্ত্বেও নতুন একটা যন্ত্র ব্যবহার করতে রাজি হননি তিনি।
আধ ঘন্টার পর টিফিনের শেষে সোজা মেশিনটার সামনে গিয়ে দাঁড়ান হিমাংশু বাবু। কাগজটা মেশিনের গায়ে সাঁটা আছে এখনো, সরানো হয়নি। সিকিউরিটির লোকটার নাম তিনি জানেন না, দাঁড়িয়েই থাকেন মেশিনের সামনে, আর তাঁর ব্যগ্র চোখ খুঁজতে থাকে তাকে। কিছুক্ষণ পর লোকটাই দেখে তাঁকে, এবং হাসিমুখে তাঁর সামনে এসে দাঁড়ায়।
আপনি দাঁড়িয়েই আছেন এখনো? আউট অব অর্ডার মেশিন কি সেদিনই ঠিক হয়? কাল সকালে আসুন।
হঠাৎ তীব্র একটা ঝনঝন শব্দে সচকিত হয়ে ওঠে ব্যাঙ্কে সকলেই। হিমাংশু বাবু অথর্ব হননি এখনো, তাঁর মোকাসিন-পরা লাথির প্রবল আঘাতে মেশিনটা এখন সত্যিই আউট অব অর্ডার!
দৌড়োদৌড়ি শুরু হয় ব্যাঙ্কে, অনেকে দৌড়িয়ে আসে মেশিনটার কাছে, সেখানে সিকিউরিটির লোকটা হিমাংশু বাবুর দুহাত শক্ত মুঠিতে ধরে আছে। ম্যানেজার বেরিয়ে আসেন, তাঁকে সিকিউরিটির লোকটাকে কিছু একটা নির্দেশ দিতে দেখা যায়। অ্যাকাউন্ট্যান্ট ফোনে ধরতে চেষ্টা করেন স্থানীয় থানার ডিউটি-অফিসারকে। এমন সময় ধীর পায়ে হেঁটে আসতে দেখা যায় তমুককে।
শুধু ব্যাঙ্কের অফিসার এবং কর্মচারীরাই নয়, তমুককে চেনে প্রায় সবাই। সে মন্ত্রী অমুকের সহকারী-ইন-চীফ। বেশ জোরে ধমক দিয়ে সিকিউরিটির লোকটাকে সে বলে, কার হাত ধরে আছ তুমি জানো? উনি আমাদের স্কুলের অঙ্কের মাষ্টারমশাই। হাত ছাড়ো ওঁর।
থতমত লোকটা হাত ছেড়ে দেয় হিমাংশু বাবুর। ম্যানেজারকে তমুক বলে, স্যারের কোন অপমান সইব না আমরা। আইন আইনের পথে চলবে। পি-এস-কে খবর দিন, বলুন আমি এখানে আছি, আই-সি যেন এখনই আসে।
ম্যানেজার অ্যাকাউন্ট্যান্টের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। দুজনের কিছু কথা হয়, তারপর ফোনটা ম্যানেজার নিজে ওঠায়।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আই-সি ব্যাঙ্কে পৌঁছোয়। তার পরনে সাদা প্যান্ট আর চেক-শার্ট। এর মধ্যে হিমাংশু বাবুকে একটা চেয়ারে বসানো হয়েছে। তমুক, আই-সি, ম্যানেজার আর অ্যাকাউন্ট্যান্ট ম্যানেজারের ঘরে ঢুকে যায়। কিছুক্ষণ পর অ্যাকাউন্ট্যান্ট বেরিয়ে এসে হিমাংশু বাবুকে ডেকে নিয়ে যায় ঘরের ভিতর। একটু পর মাথাটা চুলকোতে চুলকোতে হিমাংশুবাবুর হাত ধরে বেরিয়ে আসে তমুক – আই-সি, অ্যাকাউন্ট্যান্ট আর ম্যানেজার তাঁদের পেছনে।
কৌতূহলী জনতা তখনো দাঁড়িয়ে। মেশিনটার সামনে তমুক দাঁড় করিয়ে দেয় হিমাংশু বাবুকে, তাঁর কানে কানে কিছু বলে, একটু সরে এসে সে মাথা নীচু করে দাঁড়ায়।
হিমাংশু বাবুর চোখ শুধু তমুকের দিকেই নিবদ্ধ। একটু দাঁড়ান তিনি, তারপর ধীরে ধীরে নতজানু হন। হাত জোর করেন। তাঁর চোখে জল। অনেকগুলো মোবাইল ফোনের ফ্ল্যাশ জ্বলে ওঠে।
হাত ধরে হিমাংশু বাবুকে ব্যাঙ্কের বাইরে নিয়ে এসে তাঁর বাড়িতে পৌঁছিয়ে দেয় তমুক। তাঁকে দেখে কেঁদে ওঠেন তাঁর স্ত্রী।
এক ঘন্টার মধ্যেই অফিস থেকে গম্ভীর মুখে বাড়ি ফেরে ওঁদের পুত্র, অশোক। তার মুখ উদ্বিগ্ন, সে জিজ্ঞেস করে, বাবার কী হয়েছে, মা?
মাত্র পনেরো মিনিট। একে একে হিমাংশু বাবুর বাড়িতে আসতে থাকে মানব, পল্টু, অজয়, গৌতম, সোমেন, নচিকেতা আর আরো অনেকে। এরা সবাই হিমাংশু বাবুর ছাত্র।
ধীরে ধীরে সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে শুরু করেন হিমাংশু বাবুর স্ত্রী। নীলডাউন (নতজানু) হয়ে, হাত জোর করে, ক্ষমা চাইতে হয়েছে হিমাংশু বাবুকে, আর তাঁর সেই অবস্থার ছবি মোবাইল ফোনের দৌলতে ভাইরাল হয়েছে পনের মিনিটের মধ্যেই। সেই ছবি নিজের মোবাইলে দেখে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে এসেছে অশোক। মানব-পল্টু-নচিকেতারা হিমাংশু বাবুর ছাত্র, তারাও দেখেছে সেই ছবি, এবং ক্ষুব্ধ হয়ে দেখা করতে এসেছে স্যারের সঙ্গে।
এমনটা চলতে দেওয়া যায় না, মানব-পল্টুরা একমত। স্যারের এই অপমানের প্রতিবাদ হওয়া এখনই দরকার। অশোককে তারা বাবামায়ের সঙ্গে বসিয়ে রেখে বেরিয়ে যায়, ফিরে আসে ঘন্টা দেড়েক পর হিমাংশু বাবুর আরো অনেক ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে। প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জন, হাতে তাদের নানা রকমের পোস্টার, স্যারের অপমান তারা সইবে না। এবার অশোককেও সঙ্গে নেয় তারা, মিছিল ঘুরবে সমস্ত পাড়ায়।
মিছিল বেরিয়ে যাবার মিনিট দশেকের মধ্যেই হিমাংশু বাবুর বাড়িতে আসে বাবুয়া আর তমুক। তমুকের হাতে ভীম নাগের সন্দেশের একটা বাক্স, আর বাবুয়ার হাতে গরম ফিশ-ফ্রাই। স্যার আর মাসিমা আজ নিশ্চয়ই কিছু খাননি জেনেই তারা নিয়ে এসেছে এগুলো। জোর করে তারা তাঁদের খাওয়াতে শুরু করে, ব্যাঙ্ক ডাকাতির চেষ্টার অভিযোগে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার এবং নিশ্চিত আট বছরের হাজতবাসের হাত থেকে তমুক উদ্ধার করেছে স্যারকে, যেটুকু কষ্ট স্যারকে পেতে হয়েছে তার জন্যে, সেটুকু না করলে চলতো না, পুলিশ মানতো না কিছুতেই। বার বার ক্ষমা চায় ওরা, হাউ হাউ করে কেঁদে ওঠেন মাসিমা, স্যারের চোখেও জল। অনেক সান্ত্বনা দিয়ে, দুজনের মুখেই হাসি ফুটিয়ে, ধোপ-দুরস্ত এক জোড়া ধুতি-পাঞ্জাবি পরিয়ে স্যারকে নিয়ে বেরিয়ে যায় ওরা।
সমস্ত পাড়া পরিক্রমার শেষে মানব-পল্টুদের মিছিল এখন ধীরে ধীরে ঢুকছে হিমাংশু বাবুর বাড়ির গলিটাতে। একটু ঢুকেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে মিছিল। স্যারের বাড়ির সামনে ওরা কারা? যে সিঁড়িটা দিয়ে উঠতে হয় হিমাংশু বাবুর বাড়ির সামনের বারান্দায়, তার ঠিক সামনেই হিমাংশু বাবু! সকালের সেই ভাইরাল হয়ে যাওয়া ছবিটার মতো না? পরনে শুধু পাট-ভাঙা ধুতি-পাঞ্জাবি, নতজানু হয়ে হাত জোড় করে নতমস্তকে বসে আছেন তিনি। তাঁর দুপাশে দুজন দাঁড়িয়ে। তমুকের হাত ছুঁয়ে আছে তার বাঁ-কাঁধটি আর বাবুয়ার হাত তাঁর ডান কাঁধে!