তিন ছোটুর গপ্পো : পর্ব – ৩ ( অন্তিম পর্ব। )
আমার সাথে প্রায় নিয়মিতই ছোটুদের দেখা হয়। প্রথম প্রথম এই ছোটুদের সংখ্যা ছিল নেহাতই হাতেগোনা, কিন্তু যতদিন যাচ্ছে মনেহচ্ছে এই সংখ্যাটা বেড়ে চলেছে। ভাবছেন তো ছোটুরা কারা? একদা শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম বলেই হয়তো পড়াশোনার পাট মাঝপথে চুকিয়ে মুক্ত পুরুষ হয়ে ঘুরে বেড়ানো সকলেই আমার কাছে ছোটু। এইসব ছোটুদের কারও নাম হয়তো রাজেশ, কেউবা আবার মাণিক, আলম কিংবা গোপীনাথ। এদের সকলেই নানান কারণে স্কুল ব্যবস্থার বাইরে ছিটকে বেরিয়ে আসা ছোটু। এদের প্রত্যেকের নিজের নিজের জীবনের গল্প আছে– সুখ দুখ, আনন্দ বিষাদের কথা আছে, স্বপ্ন আছে, লড়াই আছে। আমি পথে নামলেই এদের সঙ্গে কথালাপে মেতে উঠি। আমার সঙ্গী হিসেবে যাঁরা থাকেন তাঁরা অনেকসময় এই বিশেষ কথোপকথনের পর্বটিকে খুব খুশি মনে মেনে নিতে পারেন না জানি, তবে আমি তাতে কান পাতিনা। ওদের কথা মেনে নিয়ে বাতচিত বন্ধ করে দিলে এতো লেখালেখির খোরাক মিলবে কোথায় ? শুরু করি ওদের গল্প। আজ তৃতীয় তথা অন্তিম পর্ব।
স্টেশন লাগোয়া সদর বাজারে যেতে হলে আমাদের বাড়ি থেকে এক কিলোমিটারের কাছাকাছি পথ হেঁটে রেলগেটের ওপার থেকে টোটো রিক্সায় চাপতে হয়। তেমনটাই হেঁটে এসে অটো স্ট্যান্ডের সামনে এসে দাঁড়াই। সার দিয়ে দাঁড়ানো টোটোর মধ্যে কোনটা আগে যাবে জিজ্ঞেস করতেই ইশারায় একজন একটা টোটো দেখিয়ে দেয়। উঠে বসি ভেতরে। আমরা বসতেই আরও দুজন এসে বসেন। গাড়ি এবার ছেড়ে দেবার কথা অথচ চালকের দেখা নেই। এমন হলে অস্বস্তি বাড়াটাই স্বাভাবিক। আমাদেরও বাড়ছিল।
ভরপুর সওয়ারি অথচ চালকের দেখা নেই। স্ট্যান্ডের অন্যান্য টোটো চালকেরাও অধৈর্য্য হয়ে উঠে ডাকাডাকি শুরু করে। হৈচৈ শুরু হতেই প্রায় মাটি ফুঁড়েই উদয় হয় শ্রীমানের –
– কিরে কার্তিক? কোথায় ছিলি এতক্ষণ? আমরা সবাই কতক্ষণ ধরে তোর জন্য অপেক্ষা করে বসে আছি?
– আরে কাকু! তুমি আমার নাম জানলে কী করে?
– যা খোলতাই চেহারা আর সাজসজ্জা তাতে করে তোর নাম কার্তিক ছাড়া অন্য কিছু হতেই পারেনা। তাই ঐ নামেই ডাকলাম তোকে।
– হেব্বি বলেছো কাকু! ওটাই তো আমার নাম। কার্তিক দাস।
কার্তিক চাবি ঘোরাতেই গাড়ির তিনটি চাকা সদ্য অ্যাসফল্ট ম্যাট বিছানো মসৃণ রাস্তায় গড়াতে থাকে। গাড়ি চলছে, এই অবসরে কার্তিকের সঙ্গে আপনাদের আলাপ করিয়ে দিই বরং। লম্বা ছিপছিপে দোহারা গড়ন। গায়ের রং রীতিমতো উজ্জ্বল, মাথার সীমানা ছাড়িয়ে ঘাড় পর্যন্ত নেমে আসা চুল থেকে ফুলেল তেলের বাস ছড়িয়ে পড়ে টোটোর ভেতরে। অন্ধকারেও কার্তিকের গলায় ঝোলানো মোটা হার থেকে আলো ঠিকরে পড়ছে। সিনেমার হিরোদের মতোই তার পোশাক। সন্ধ্যা বেলায় এমন একটি চরিত্রের সাক্ষাৎ পেয়েও কোনো কথাবার্তা বলবো না! তাকি হয়? আসলে আমি সুযোগের অপেক্ষায় তক্কেতক্কে ছিলাম। খুব বেশি অপেক্ষা করতে হলোনা। আমাদের সহযাত্রী দুজন কিছু সময় পরেই নেমে যেতেই আমি প্রশ্নের ডালি নিয়ে একেবারে হামলে পড়লাম।
– হ্যাঁরে কার্তিক, তোকে দেখে তো বেশ চালাক চতুর মালুম হচ্ছে। তা কতোদিন এই রুটে টোটো চালাচ্ছিস্ ?
– এই তো মাস তিনেক হলো। আমি তো আসলে খেপ খাটি।
– খেপ খাটিস্ মানে? এখানেও এসব চলে?
– চালালেই চলে। এই দুনিয়ায় সব চলে।খালি কায়দা মতো তাকে চালাতে পারা চাই।
– না,বলছিলাম কি! তোর্ যা বয়স, তাতে করে তো তোর এখন স্কুলে থাকার কথা। তা না করে তুই এখন টোটো চালাচ্ছিস্?
– এখন নিজেকে মেনটেন করতে কতো খচ্চা জান?
– খচ্চা? সেলফ মেইনটেনেন্স বাবদ? ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বুঝিয়ে দে তো বাপ!
– এই দেখো কান্ড! এখনকার উঠতি বয়সের ছেলে ছোকরাদের খরচের ফিরিস্তি দিতে গেলে তো তোমাকে নিয়ে আমায় কম করে দশবার এই রুটে আপ ডাউন ভাড়া টানতে হবে। এসব খচ্চার জন্য তো আর সবসময় বাপের কাছে হাত পাতা যায়না। তাই নিজের খচ্চা মেটাতে সন্ধ্যা বেলায় টোটো চালাই। হাত খচ্চা উঠেও কিছু পয়সা বাঁচে।ওটা মাকে দিই।
– স্কুলে যাসনা? একটু লেখাপড়া শিখলে তা কাজে দিতো। স্কুলে গেছিস কখনো?
– তা যাইনি ! আট ক্লাস অবধি পড়েছি ঐ আমাদের পাড়ার …রী স্কুলে। তবে স্কুল আমার মোটেই ভালো লাগেনি। অতো নিয়মকানুন মেনে চলা যায়! বাপ রঙের কাজ করে। এ তল্লাটে মিস্ত্রী হিসেবে তার নামডাক বিস্তর। পড়াশোনা হলোনা দেখে বাবা আমায় তার দলে টানতে চেয়েছিলো। আমি ওই দলেও ভিড়িনি। ধান্দায় আছি একটা বাইক নেবার। বাইক থাকলে নতুন রোজগারের সুবিধা আছে।
– কার্তিক,তোর মাথা তো দেখছি একেবারে সাফ। এমন মাথা এভাবে নষ্ট হয়ে গেলে ভারি দুঃখ হয়।
– আমার মায়ের কথাগুলোই ঠিক তোমার মুখে শুনছি বলে মনে হয়। মাঝেমাঝে কী ভাবি জান?
– কী ভাবিস্ ? বল দেখি,শুনি! এই ভাবনাগুলোর কথা জানাটা খুব জরুরি। বল কার্তিক,শুনি।
– এতো সব বিষয়ের বোঝা না বইয়ে , আমাদের যদি হাতেকলমে কিছু কাজ শেখানোর ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে আমাদের গায়ে স্কুল পালানো ছেলের ছাপটা পড়ে না। যতোই তুমি পড়ালেখা করোনা কেন, শেষ পর্যন্ত তো তোমাকে রোজগারের জন্য পথে নামতেই হবে। এটা কিন্তু আমার মনের কথা। তোমাকে বিশ্বাস করে বল্লাম। তুমি আবার পাঁচ কান করোনা।
সদর বাজারের সামনে এসে কার্তিক টোটো থামায়। আমরা নেমে পড়ি। টোটোতে ওঠার সময় যে কার্তিককে দেখেছিলাম, এখনকার কার্তিক তার থেকে অনেক অনেক আলাদা। খুব সহজেই সত্যি কথাগুলো বলতে পারার জন্যও এক ধরনের বাক্ চাতুর্য,এক অন্যরকম মুন্সিয়ানার প্রয়োজন। ছোট্ট সফরের অবকাশে কার্তিক যেন তার প্রমাণ রেখে গেল আমাদের মতো দুজন অচেনা মানুষের কাছে। ওই মুহূর্তে কার্তিক আমাদের মাস্টারমশাই, আমরা তার ছাত্র। এই অনুভূতির জন্যই মনে মনে অনেক ধন্যবাদ জানাই শ্রীমান কার্তিক দাসকে। কার্তিক তার কথাগুলো পাঁচ কান না করতে অনুরোধ করেছিলো। সেই কথা রাখতে পারলাম না বলে তার কাছে সত্যিই ক্ষমাপ্রার্থী ।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।