সাতসকালের খবর এবং স্মৃতিপথে হাঁটাহাঁটি। ( প্রথম পর্ব)
তখনো বিছানায় কম্বলের তলায় শুয়ে আড়মোড়া ভাঙার পর্ব চলছে। আমাদের মফস্বল এলাকায় এখনও ঠাণ্ডার দমক খানিকটা বেশি। সারারাত যতোই ঘুমোও না কেন, ভোরের আলো বেশ সজাগ হয়ে ওঠার আগে এই যে জম্পেশ করে শয্যার ভোগদখল ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে উপভোগ করার মজা যে পায়নি তাঁর প্রতি সমবেদনা জানাই। তা যাইহোক আজও তেমনটাই ছিলাম। অপেক্ষা করছিলাম গিন্নি কখন এসে খবরের কাগজটা মশারির ফাঁক গলিয়ে দিয়ে যাবেন।এ তো অনেক অনেক কালের অভ্যাস, বুড়ো হয়েছি বলে তাকে এখনও বিদায় করতে পারিনি। এই অভ্যাসেরও তো প্রায় আমার মতো বয়স হলো।
আজকাল মাথার কাছেই তিনি থাকেন। এখন প্রায় সারাদিনই তো এনাকে আগলে নিয়ে সময় কাটে দুনিয়াবাসীর। আমারও। নিতান্তই অভ্যাসের বশে ফোনটা চালু করতেই স্ক্রিনে ফুটে ওঠে খবরটা। উত্তেজনায় চিৎকার করে বলে উঠি – ……. মশাই। আমরা জিতে গিয়েছি ! আপনি আমাদের ঠিক পথেই এগিয়ে দিয়েছিলেন। We marched in the right path. আমরা জিতে গেছি।
সাতসকালে এমন উচ্ছ্বসিত উল্লাস ধ্বনি শুনে তড়িঘড়ি সম্মার্জনি হাতে গিন্নি ছুটে এসে হাজির হন – বলি হোলো কি? আমি কোনো কথা বলিনা, কেবল হাতের মুঠোয় ধরে থাকা ফোনটা তার দিকে এগিয়ে দিই। তিনি পড়তে থাকেন। আপনারাও পড়ুন —
Newspaper Reading Now A Must For Students in. UP Government Schools.
উত্তরপ্রদেশে সরকারি বিদ্যালয়ে পাঠরত শিক্ষার্থীদের খবর কাগজ পড়া এখন থেকে বাধ্যতামূলক করা হলো।
আগে এমন এক সংবাদের প্রসঙ্গে আসি।পরে সাতসকালেই আমার বালখিল্যতার ( এই শব্দভাষ্যের উৎস আমার গিন্নি) কারণ নিয়ে দুই একটা কথা বলবো। প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে যে উত্তরপ্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ সরকার আগামী শিক্ষাবর্ষে সমস্ত সরকারি সেকেন্ডারি স্কুল এবং প্রাথমিক স্কুলে সংবাদপত্র পড়াকে আবশ্যিক বলে ঘোষণা করেছে। প্রশ্ন উঠবেই যে হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণের কারণ কী?
সরকারি নির্দেশিকায় খুব স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাঠ্যাভ্যাস গড়ে তোলা, দীর্ঘ সময় মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে চোখকে আটকে রাখা এবং তাদের মধ্যে ক্রিটিক্যাল এবং লজিক্যাল চিন্তার দক্ষতা বাড়ানোর জন্যই শিক্ষা দফতর এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রাজ্যের অ্যাডিশনাল চিফ সেক্রেটারি শ্রী পার্থসারথি সেন শর্মা ডিসেম্বরের ২৩ তারিখে এই মর্মে এক বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জানিয়েছেন, এখন থেকে প্রতিদিন ইংরেজি এবং হিন্দি সংবাদপত্র পড়াকে বিদ্যালয় সংস্কৃতির আবশ্যিক অঙ্গ হিসেবে গণ্য করতে হবে। অর্থাৎ এখন থেকে স্কুলে স্কুলে সংবাদপত্র পাঠ ও বিভিন্ন ধরনের খবর নিয়ে আলোচনা করতে হবে শিক্ষার্থীদের।
প্রতিবেদনটি থেকে জানা গেছে যে এমন ঘোষণা মোটেই আকস্মিক নয় কেননা গত নভেম্বর মাসে একটি অর্ডারে স্কুলে স্কুলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে রিডিং হ্যাবিট বা পাঠ্যাভ্যাসের সংস্কৃতি কীভাবে গড়ে তোলা যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। ডিজিটাল বিশ্বে এখন সবকিছুই স্ক্রিন নির্ভর।অতিমারি কালে বাধ্য হয়েই এমন ব্যবস্থাকে মেনে নিতে হয়েছে।অতিমারির পর্ব অতিক্রান্ত হলেও আমাদের চোখ এবং মন ঐ স্ক্রিনেই আটকে রইলো। এর ফল যে ভয়ঙ্কর হতে চলেছে তা টের পাচ্ছে গোটা দুনিয়া। স্ক্রিন টাইম বেড়ে যাওয়ায় মনের ওপর লাগাম টানা আর সম্ভব হচ্ছে না। অথচ এর দরুণ নানান ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। সকালের খবর কাগজ নিয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ আজ তলানিতে। সাম্প্রতিক
সরকারি নির্দেশিকায় সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে – ‘A 10- minute slot should be allocated for “ news reading” from newspapers during the daily morning assembly. Students, on a rotational basis, will read out the main points of editorial articles and major positive news from national, international, and sports events.’ অর্থাৎ প্রতিদিনের প্রারম্ভিক জমায়েতের সময় দশ মিনিটের একটি খবরের ক্লাস থাকবে যেখানে পর্যায়ক্রমে জাতীয়, আন্তর্জাতিক এবং খেলাধুলা বিষয়ক মুখ্য খবরগুলো পাঠ করা হবে।
এখানেই শেষ নয়। নির্দেশিকায় খুব স্পষ্ট করে ও সুনির্দিষ্ট ভাবে সংবাদপত্র পাঠের উপযোগিতা সম্পর্কে এবং কীভাবে এই সিদ্ধান্তগুলোকে অর্থবহ ও ফলদায়ী করা সম্ভব সেই বিষয়ে কিছু প্রয়োজনীয় টিপস দেওয়া হয়েছে। যেমন নিয়মিত খবরের কাগজ পড়ার উপযোগিতা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে –
শিক্ষার্থীদের সাধারণ জ্ঞান এবং সাম্প্রতিক ঘটনাবলী সম্পর্কে জানতে সাহায্য করবে যা কর্মজীবনে প্রবেশের জন্য প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সফলতা অর্জনের সহায়ক হবে।
ভাষাজ্ঞান বৃদ্ধির পক্ষে উপযোগী। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কোনো বিষয় নিয়ে ক্রিটিক্যাল এবং লজিক্যাল চিন্তার দক্ষতা বাড়াতে সহায়ক হবে।
কাগজ উল্টেপাল্টে পড়ার অভ্যাস একজন মানুষের জীবনের লক্ষ্য এবং অধ্যাবসায় বাড়াতে সহায়ক হবে।
সামাজিক ও বৈশ্বিক সংযোগ স্থাপন করতে সুবিধা হবে।
মানুষের জীবন যাপনের পূর্ণাঙ্গ ইতিবৃত্ত সহানুভূতি ও সমানুভূতি বাড়িয়ে তুলবে যা এক দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবে।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত পাজল,শব্দছক ইত্যাদি সমাধানের মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষার্থী বাস্তব জীবনের সমস্যাগুলোকে নিরসনের দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
পাশাপাশি কীভাবে এই লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে সেই উপায়ও বাতলে দেওয়া হয়েছে নির্দেশিকায়। এই অংশটি নিয়ে আলোচনায় যাচ্ছিনা কেননা সরকারি ফরমানে অনেক অনেক উচ্চাশার কথা বলতে হয়। উচ্চতর আদর্শ আর লক্ষ্য সামনে না রাখলে তার গরিমায় টান পড়ে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে এমন সব উচ্চ আদর্শ আর কাঙ্ক্ষিত সাফল্যের কথা বলেন আমাদের প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা যাঁরা মাটির কাছাকাছি থাকা বাস্তবতাকে জানেন না বোঝেন না। স্বপ্ন দেখানোর নামে তাঁরা গোটা ব্যবস্থাকেই ঘুলিয়ে দেন। এই বিষয়টিরও হয়তো তেমনই এক পরিণতি অপেক্ষা করছে যদিও আমি কায়মনোবাক্যে চাইবো যে এই ধরনের পরীক্ষা নিরীক্ষা সফলতা অর্জন করুক যদিও জানি গোটা দেশের সরকার পরিপোষিত স্কুলগুলো এখন যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে তাতে করে সংবাদপত্রের প্রতিবেদন পড়ে শিক্ষার্থীদের স্ক্রিন বিমুখ করা সম্ভব হবে না। ভাবতে হবে, ভাবতে হবে। অনেক গভীরে ডুব দিয়ে ভাবতে হবে।
** এই নিবন্ধের পরবর্তী অংশ প্রকাশিতব্য।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।