মুড়কির ছোট ভাইয়ের নাম উচ্ছে। খুড়তুতো ভাই। বয়েস সাড়ে পাঁচ। সে আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে রাজস্থানে থাকত। রাজস্থানে কোন এক তামার খনিতে তার বাবা, মানে মুড়কির কাকা, ছিল ম্যানেজার। হঠাৎ কী একটা জ্বরে তিন-চার দিন ভুগে উচ্ছের মা মারা যায়। কাকা চাকরি ছেড়ে ফিরে আসে কলকাতায়। যে কম্পানীর খনি, তাদেরই কলকাতার অফিসে কাকা এখন চাকরি করে। কিন্তু অফিসের দেওয়া বাড়িতে না থেকে সে এখন তার দাদার পরামর্শে মুড়কিদের বাড়িতেই থাকে। মুড়কি তাই একটা ভাই পেয়ে গেছে।
সাড়ে পাঁচ বছরের উচ্ছেকে প্রী-স্কুলে ভর্তি করার পরামর্শ যখন আত্মীয়স্বজনরা সবাই দিচ্ছে, কাকা বলল, না, আমি উচ্ছেকে মুড়কির স্কুলে ভর্তি করে দিচ্ছি।
আমার স্কুল? – মুড়কি অবাক। আমাদের স্কুলে তো ক্লাশ ওয়ানের আগে নেয়ই না। অন্তত ছ বছর বয়েস হতে হবে!
সে তো যে স্কুলে তুই পড়িস, কাকা বলে, আমি সে স্কুলের কথা বলছি না। যে স্কুলে তুই পড়াবি সেই স্কুলের কথা বলছি আমি।
সেই থেকে উচ্ছে শুধু মুড়কির ভাই-ই নয়, ছাত্রও। সে মুড়কি দিদির ঘরেই থাকে, মুড়কি দিদির পাশেই শোয়। এক-একদিন যখন মুড়কি দিদি একটু-আধটু বকুনি দেয় তাকে, সেদিন সে রাগ করে বাবার বিছানায় বাবার পাশেই শুয়ে পড়ে। আর মা'র কথা মনে করে ভীষণ কান্না পায় তার যেদিন, জেঠামা সেদিন কোলে করে তাকে নিয়ে যায় নিজের ঘরে। জেঠামার গলা জড়িয়ে সেদিন সে জেঠামার কাছেই শোয়।
মুড়কি দিদির পড়ার টেবিলে সেদিন দুখানা মোটা মোটা বই দেখল উচ্ছে। মুড়কি দিদি ঘরে ছিল না, বই দুটো সে উল্টেপাল্টে দেখতে শুরু করে। এখন সে বানান না-করেও বাংলা পড়তে শিখেছে, দেখল একটা বইয়ের নাম কৃত্তিবাসী রামায়ণ, অন্যটা বাল্মিকী রামায়ণ। বাল্মিকী রামায়ণে লেখা আছে সারানুবাদ রাজশেখর বসু। কথাটার মানে বুঝতে পারল না উচ্ছে। তা ছাড়া, বইটা এমনিতেও বিচ্ছিরি, একটাও ছবি নেই! এবার কৃত্তিবাসী রামায়ণটা খোলে সে, খুলতেই পাতার পর পাতা রংচঙে ছবি। রামায়ণের গল্প সে জানে, মা'র কাছে শুনেছে। পাতা উলটিয়ে ছবিগুলো যখন দেখছে সে, হঠাৎ দেখল, কখন যেন নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে তার পিছনে দাঁড়িয়েছে মুড়কি দিদি।
চোখাচোখি হতেই উচ্ছে বলে, মা তো আমাকে একটাই রামায়ণের গল্প বলেছিল। রামায়ণের কি দুটো গল্প?
মা বলেছিল? – মুড়কি বলে, আচ্ছা বল্ তো দেখি গল্পটা।
লম্বা একটা শ্বাস টানে উচ্ছে। ও এইরকমই। আবৃত্তি করতে বললে একটা শ্বাস টেনে শুরু করে, শুনতে পেলুম পোস্তা গিয়ে...
এক যে ছিল রাজা, শুরু করে উচ্ছে, তার নাম দশরথ। তার তিন রানি, চার ছেলে। রাজা একদিন বুড়ো হল, সে ঠিক করল, আর রাজা থাকবে না সে, বনে গিয়ে তপস্যা করবে, আর তার বদলে তার বড় ছেলে রাম হবে রাজা। এদিকে রাজার এক রানি, কৈকেয়ী নাম তার, সে রাজার খুব অসুখের সময় অনেক সেবা করেছিল। রাজা তখন তাকে দুটো প্রাইজ দিতে চেয়েছিল, সে নেয়নি। এখন এতদিন পর সে চাইল সেই প্রাইজ। তার ছেলে ভরতকে রামের বদলে করে দিতে হবে রাজা – এক নম্বর। আর দু নম্বর প্রাইজ হল, রামকে পাঠাতে হবে বনে, চোদ্দ বছরের জন্যে।
তা-ই হল। রাম, তার বউ সীতা আর এক ছোট ভাই লক্ষ্মণ চলে গেল বনে। সেই বন থেকে একদিন রাবণ নামে এক রাক্ষস সীতাকে ধরে নিয়ে গেল। নিয়ে গেল একেবারে সাগর পেরিয়ে, যে দেশের সে রাজা, সেই লঙ্কায়। তারপর অনেক বন-জঙ্গল অনেক দেশ পেরিয়ে বাঁদরদের দেশ কিষ্কিন্ধ্যায় পৌঁছল তারা। সেখানকার রাজা – কী যেন নাম ভুলে গেছি – তার সাহায্যে লঙ্কায় গিয়ে রাবণকে মেরে সীতাকে উদ্ধার করে ফিরে এল রাম-লক্ষ্মণ। তখন ভরত রাজত্ব ফিরিয়ে দিল রামকে।
চোখ বড় বড় করে এতক্ষণ মুড়কি শুনছিল উচ্ছের গল্প। তুই এতটা জানিস – অবাক হয়ে বলে মুড়কি – তাহলে তো তুই জানিসই রামায়ণ।
জানি, যেন গভীর চিন্তায় চিন্তিত এমন ভাবে বলে উচ্ছে, কিন্তু তোমার মোটা মোটা রামায়ণ বইয়ের গল্পগুলো তো জানিনা। ওগুলো বুঝি তোমাদের ইশকুলে পড়ায়?
মুড়কি একটুখানি বিলি কেটে দেয় উচ্ছের চুলে। বলে, না, পড়ায় না ইশকুলে, কিন্তু তবুও পড়তে হয়। আমি তো অনেক উঁচু ক্লাশে পড়ি, ক্লাশ নাইনে, তাই ইশকুলে যা পড়ায় না তেমন বইও আমাদের পড়তে হয়।
কেন?
একটুখানি চিন্তা করে মুড়কি, উচ্ছেকে কি বোঝানো যাবে কেন ইশকুলের বইয়ের বাইরেও ওদের অন্য বই পড়তে হয়? তারপর ওর মনে পড়ে যায় ডাক্তার কাকার কথা। ডাক্তার কাকা বলেছিল, “তুই বুঝবি না” কিংবা “বড় হলে বুঝবি” বলে ছোটদের প্রশ্নের উত্তর না-দেওয়াটা খুব অন্যায়। প্রশ্ন যখন করেছে কেউ, তার উত্তর দিতেই হবে। সে ভেবেচিন্তে বলে, আমাদের মতো উঁচু ক্লাশে যারা পড়ে তাদের প্রোজেক্ট করতে হয়, বাইরের বই না পড়লে প্রোজেক্ট করা যায় না।
খুব যেন বুঝেছে, এমন ভাবে মাথা নেড়ে বলে উচ্ছে, কীভাবে কর তুমি পোজেক্ট?
মুড়কি বলে, কথাটা পোজেক্ট নয়, প্রোজেক্ট। বল্ প্রোজেক্ট।
“ প্রোজেক্ট,” বলে উচ্ছে।
তুই যে রামায়ণের গল্পটা বললি, ওই গল্পটার পেছনে আরও অনেক গল্প আছে। সেই গল্পগুলো পড়ছি আমি এই মোটা মোটা বই দুটো থেকে। সেগুলো মিলিয়ে হবে আমার প্রোজেক্ট।
তুমি আমাকে ঠকাচ্ছ, যেন ধরে ফেলেছে এমন ভঙ্গিতে বলে উচ্ছে, গল্প কি হাঁটতে পারে যে তার পেছন পেছন হেঁটে হেঁটে আসবে অন্য গল্প?
পারেই তো, বলে মুড়কি, তাই গল্প এগোতে এগোতে এক সময় থেমে যায়, মানে শেষ হয়ে যায়। ওই যে তুই রামায়ণের গল্প বললি, এক ছিল রাজা, তার নাম দশরথ, সেখানে কি থেমে গেলি তুই? থামলি না মোটেই। বললি, তার ছিল তিন রানি, চার ছেলে। এই ভাবেই তোর গল্প এগিয়ে গেল। তুই যে বললি রাম-লক্ষ্মণ বনে যাবার পর সীতাকে চুরি করে নিয়ে গেল রাবণ, আর বাঁদরদের রাজার সাহায্যে সাগর পেরিয়ে রাবণকে মেরে সীতাকে রাম-লক্ষ্মণ ফিরিয়ে আনল, সেটা হল কী করে? রাম কীভাবে পেরিয়েছিল সাগর? উড়োজাহাজে? এরোপ্লেনে?
তাহলে কী ভাবে? – প্রশ্ন করে উচ্ছে।
সেটা যেই জানতে পারবি তখনই তোর সাগর পেরোবার পেছনের গল্পটা জানা হয়ে যাবে, ভারিক্কি চালে বলে মুড়কি।
তাহলে বল, পেছনের গল্পটা বল তুমি, উচ্ছে নড়েচড়ে গল্পটা শোনবার জন্যে তৈরি হয়ে বসে।
মুড়কি বলে, বলব, বলব তো নিশ্চয়ই, কিন্তু তারও পেছনে একটা গল্প আছে।
তার পেছনেও? – খানিকটা যেন অবাক উচ্ছে।
থাকবে না? এই যে সাগর পেরিয়ে গেল রাম-লক্ষ্মণ, তারা জানল কীভাবে যে সাগর পেরিয়ে লঙ্কায় গেলেই পাওয়া যাবে সীতাকে?
কীভাবে?
শুনবি? শোন্ তাহলে, একটু গলা খাকারি দিয়ে টেবিলে রাখা গেলাসটা থেকে এক ঢোক জল খায় মুড়কি, আর শুরু করে তারপর।
ওই যে বাঁদরদের রাজার কথা বলছিলি তুই, যার নাম তুই ভুলে গেছিস, সে হল সুগ্রীব। কিষ্কিন্ধ্যার রাজা। আগে সে রামকে চিনত না, কিন্তু চুরি-যাওয়া সীতাকে খুঁজতে খুঁজতে রাম যখন জঙ্গল পাহাড় নানা দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে, রামের সঙ্গে তখন প্রথম আলাপ হল তার। সেই আলাপের সময়েই রাম তার মস্ত একটা উপকার করেছিল। সেই থেকে বন্ধুত্ব। যে রাম তার উপকার করেছে তারই বউ চুরি হয়েছে! সে বলল রামকে, সীতাকে খুঁজে বের করতে আমি তোমাকে সাহায্য করব। তার রাজসভায় ছিল অনেক জ্ঞানী-গুণী বীর বাঁদর, তাদের সে পাঠিয়ে দিল নানা দিকে সীতার খোঁজ করতে। পুবে গেল এক দল, এক দল পশ্চিমে। তেমনি উত্তরে আর দক্ষিণেও গেল এক-এক দল। তবু সীতাকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। পুব পশ্চিম আর উত্তরে যারা গিয়েছিল একে একে ফিরে এল তারা। সবাই মিলে অপেক্ষা করতে লাগল দক্ষিণের দলের পথ চেয়ে। এই দলে ছিল হনুমান। সুগ্রীবের রাজসভায় সবার চাইতে চালাক আর বীর সে। হনুমান আর তার দলবল অনেক ঘুরে, অনেক হেঁটে, অনেকবার পথ হারিয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছোলো বিন্ধ্য নামের এক পাহাড়ে। সেই পাহাড়ের যেখানে পৌঁছেছিল ওরা, তার কাছেই বিরাট এক সাগর।
এর আগে তো কখনও সাগর দেখেনি হনুমান আর তার দলবল, অবাক হয়ে তারা দেখতে লাগল সাগরের চেহারা। এত জল! জলের যেন শেষই নেই! নীল জল, মাঝে মাঝে বড় বড় ঢেউ, আর কেমন যেন আওয়াজ! এই কি তাহলে পৃথিবীর শেষ?
মন খারাপ করে ফিরে আসে হনুমানরা, পৃথিবীর শেষই যখন হয়ে গেল সীতাকে আর পাবে কোথায়! বিন্ধ্য পাহাড়ের আশপাশে ঘুরে বেড়ায় তারা। এমন করে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ একদিন দেখে বিরাট এক পাখি, দেখে মনে হয় পাখিটার অসুখ করেছে। জঙ্গল থেকে যোগাড় করা অনেক খাবার তাদের কাছে ছিল, সেই খাবার আর জল-টল খাইয়ে পাখিটাকে সুস্থ করল তারা। পাখি বলল তার নাম সম্পাতি, অসুস্থ অবস্থায় শুয়ে শুয়ে সে একদিন লঙ্কার রাজা রাবণকে আকাশে দেখতে পায়, সে খুব সুন্দরী এক মেয়েকে চুরি করে আকাশ দিয়ে পালাচ্ছিল। মেয়েটা জোরে জোরে কাঁদছিল রাম আর লক্ষ্মণের নাম ধরে। সম্পাতি বলল, এখন বুঝছি সে-ই সীতা। আমি তোমাদের বলে দিচ্ছি এই রাবণ কোথায় থাকে। সামনে এই যে সাগর দেখতে পাচ্ছ, তার ওপারে শ' দুই মাইল গেলে দেখতে পাবে তার রাজত্ব। খুব সুন্দর দেশ, স্বর্গের ইঞ্জীনিয়র স্বয়ং বিশ্বকর্মার নিজের হাতে তৈরি। এই দেশেরই নাম লঙ্কা। আমার মনে হয় রাবণ সীতাকে নিজের দেশেই নিয়ে যাচ্ছিল। তোমরা কেউ যদি লঙ্কায় পৌঁছতে পার, সীতাকে দেখতে পাবে।
হনুমান আর তার দলবল ফিরে গেল সাগরপারে। সাগর পেরোতে হবে। কিন্তু পেরোবে কে? আর, কী ভাবেই বা?
জান্ববান ছিল হনুমানের বন্ধু, বয়েসে একটু বড় কিন্তু খুবই বন্ধু তারা, সে-ও ছিল এই দলে। সে বলল, হনুমান, তুমিই পেরোবে সাগর। তোমার নিজের গায়ের জোর আর ক্ষমতার কথা ভুলে গেছ তুমি। তুমি কি জান এক লাফে তুমি কতটা যেতে পার?
কতটা?
তোমার যখন জন্ম হয়েছিল জঙ্গলের এক গুহার মধ্যে, তখন গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্যকে দেখে তুমি মনে করেছিলে লাল টুকটুকে কোন পাকা ফল। দেখে, লোভ হল তোমার। এক লাফে তুমি পৌঁছে গেলে সূর্যের প্রায় কাছাকাছি। কামড় প্রায় দেবে দেবে এমন সময় দেবতাদের রাজা ইন্দ্র দেখলেন এ তো মহা বিপদ, সূর্য গেলে তো আর বাঁচবে না কিছুই। তখন তিনি মেঘের ভেতর থেকে টেনে বের করলেন তাঁর সবচেয়ে বড় বাজটা। বাজ জান তো? মেঘে মেঘে ঘসাঘসি হলে সেই ঘসাঘসির জোরে জায়গাটা হয়ে যায় খুব গরম, জ্বলে ওঠে আগুন। কিন্তু গরম কিছু তো আর মেঘের মধ্যে থাকতে পারে না, তখন মেঘের বাইরে আকাশের মধ্যে বেরিয়ে আসে গনগনে গরম সেই আগুনটা, তাকে বলে বাজ। সেই বাজ ইন্দ্র মারলেন তাক করে তোমার মুখের উপর। তোমার বিশেষ কিছু হল না, শুধু মুখের বাঁদিকের উঁচু হাড়টা, যাকে আমরা হনু বলি, সেটা গেল ভেঙে। সেই থেকে তোমার নাম হনুমান। সূর্যকে কামড়াতে গিয়েছিলে, কাজেই বুঝতেই পারছ তোমার হাঁ-মুখটা কত বড় হয়ে গিয়েছিল সেই সময়! তোমার একরত্তি চেহারার সিকিরত্তি হাঁ-মুখ দিয়ে তো আর সূর্যকে কামড়াতে পারতে না।
তারপর খানিকটা থেমে মুখটা গম্ভীর করে চোখ বুজে বলে জাম্ববান, এতক্ষণে তাহলে কী বুঝলে বল দেখি।
নিজের চেহারা আর সূর্যকে কামড়াতে যাওয়ার গল্প শুনে হনুমানের চোখ তো ততক্ষণে ইয়া-বড়। সে বলল, কী? কী বুঝব?
জাম্ববান হেসে বলে, প্রয়োজন হলেই তোমার চেহারা আকাশের মত বড়ও হতে পারে, আর হতে পারে কড়ে আঙুলের মত ছোটও। এখন যা বলছি শোন, এখানে দাঁড়িয়েই নিজের চেহারাটা বড় করতে যেও না, আমরা যারা নিজেদের সাইজ বাড়াতে-কমাতে পারিনা, তারা তোমার নিশ্বাসের হাওয়াতেই উড়ে যাব তাহলে। এই কথা বলে একটু দূরে বিরাট বড় একটা পাহাড়ের দিকে আঙুল দেখায় সে। বলে, ওই পাহাড়টার নাম মহেন্দ্র পাহাড়। ওটার একেবারে মাথায় চড়ে নিজের শরীরটাকে যতটা পার বড় করে মারো লাফ। মনে রাখবে, এক লাফে পেরোতে হবে এই বিরাট সাগরটা, এক লাফে! সেই বুঝে বাড়াতে হবে তোমার নিজের শরীর। কিছু নয়, মনে মনে নিজের মায়ের কথা ভাবতে ভাবতে চেষ্টা কর, হয়ে যাবে।
শুনে, প্রবল উৎসাহে ল্যাজ ঝাপটাতে ঝাপটাতে হনুমান দৌড়োল মহেন্দ্র পাহাড়ের দিকে। ল্যাজটা এখনই ফুলতে আর বাড়তে শুরু করেছে। ভয়ে একটু পিছিয়ে এসেও বাঁদররা হাততালি দিয়ে উৎসাহ দিল হনুমানকে।
পাহাড়ের মাথায় চড়ে নিজের মায়ের নাম করে হনুমান দিল এক লাফ।
এক লাফে সাগর পেরোনো! কখনও কেউ শুনেছে এমন কথা? স্বর্গের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন সব দেবতারা। পারবে কি হনুমান? তাঁরা ডেকে পাঠালেন নাগমাতা, মানে সব সাপের যিনি মা, সেই সুরমাকে। বললেন, হনুমানকে আমরা পরীক্ষা করতে চাই। তুমি সাগরের একেবারে মাঝখানটায় চলে যাও, দেখ তো হনুমানকে আটকাতে পার কিনা।
সুরমার একটা বিশেষ গুণ ছিল, দেবতারা তা জানতেন। হনুমানের মতো নিজের শরীরটাকে বাড়াতে-কমাতে পারত সুরমাও। সে মাঝ সমুদ্রে মাথা তুলে হনুমানকে বলল, হনুমান, দেবতারা সবাই বলেছেন তুমি আমার খাদ্য। আমার খিদে পেয়েছে, আমি হাঁ করছি, তুমি আমার মুখে এস।
হনুমান বলল, এখন আমার সময় নেই, আমি সীতার খোঁজে লঙ্কায় যাচ্ছি। তুমি অপেক্ষা কর, আমি লঙ্কা থেকে ফেরার পথে তোমার মুখে ঢুকব।
সুরমা মানে না। তা কি হয়? – বলে সে – আমার খিদে পেয়েছে, আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না।
তখন কী আর করে হনুমান! সে বলল, ঠিক আছে, খেতে যদি হয়ই, তাহলে একটা শর্ত আছে।
কী শর্ত?
আমাকে এক গ্রাসে খেতে হবে, আমার শরীরের সমান হাঁ করতে হবে তোমাকে, বলে হনুমান। আর বলেই নিজের শরীর বাড়াতে বাড়াতে প্রায় দুশো মাইল লম্বা হয়ে যায় সে।
সুরমাই বা কম কিসে? সেও তার হাঁ-মুখ বড় করতে থাকে হনুমানের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। এইভাবে তার হাঁ-মুখ প্রায় দুশো মাইলের কাছাকাছি যেই না এসেছে, কেউ কিছু বোঝার আগেই হনুমান হঠাৎ নিমেষে নিজেকে ছোট করে ফেলে হাতের কড়ে আঙুলের মতো। ছোট্ট হনুমান চট করে এবার ঢোকে বিরাট ওই হাঁ-মুখটার মধ্যে, আর সুরমা মুখটা বোজাবার আগেই বেরিয়ে আসে হাসতে হাসতে। স্বর্গের বারান্দা থেকে দেখছিলেন যে দেবতারা তাঁরা খুশি হয়ে হাততালি দিতে দিতে ফুলের বৃষ্টি ঢালতে থাকেন হনুমানের মাথার ওপর। সাগর আনন্দে জল ছিটিয়ে তাকে আরাম দেয়, আর সুরমা আশীর্বাদ করে বলে, ধন্য তুমি হনুমান, যাও, সীতার খবর নিয়ে ফিরে এসে দাও রামকে।