অলংকরণ: রমিত
দার্জিলিঙের ম্যালে বলরামের ঘাড়ে হাত দিয়ে কথা বলার লোক কে আছে! ঘাড় ঘুরিয়ে লোকটাকে দেখার আগের কয়েক মুহূর্ত বলরাম চিন্তা করে নেয়, ভাবতে পারে না কোন চেনা মানুষের নাম। অগত্যা মৃদু হাসি ঠোঁটে নিয়ে ঘোরায় সে ঘাড়টা। স্যুট-টাই পরা একজন, চেহারাতে বাঙালি ছাপ।
বাঃ, তোমার হাসিটাও তো ভারি সুন্দর, বলে লোকটা।
হাসিটা-ও! তার মানে আরো কিছু আছে যা সুন্দর!
কিন্তু লোকটাকে কোথায় দেখেছে মনে করতে পারে না বলরাম। বলে, আপনি?
খেয়াল করনি আমাকে, কিন্তু আমি লক্ষ্য করছিলাম তোমায়। এই দুপুরে ম্যালে একা-একা ঘোরাঘুরি করছ, খাওয়া-দাওয়া হয়েছে?
দার্জিলিঙে এলে দুপুরটা এরকমই কাটে। রোগাটে লম্বা চেহারাটায় একটা টাই পরেছে বলরাম, কিন্তু ও জানে তাতে ওকে মোটেই স্মার্ট দেখায় না। তার ওপর যে ধরণের দোকানে ও রাতের খাওয়াটা সারে, সেখানে বোধ হয় টাই-পরা চেহারাটা দেখলে বসতেই দেবে না। আর দেয়ও যদি, খাবারের দামটা বাড়িয়ে দেবে নির্ঘাত। দুপুরে তাই ও খায় না। পকেটে বিস্কুট রেখে দেয়, ম্যালে ঘুরতে ঘুরতে খায় তারই কয়েকটা আর এক কাপ চা।
লোকটা নিজেই বলে, হয়নি। হয়নি খাওয়া তোমার। চল, গ্লিনারিজে খাবো। আমি হোস্ট।
ছোট টেবিলটায় মুখোমুখি বসে রহস্যটা ভাঙে লোকটা। বলে, আমার নাম কমলেশ দত্ত, ল্যাজারাসের রিজিওনাল ম্যানেজার। ফ্র্যাঙ্ক রস-এ তোমার কাজ দেখছিলাম। মিস্টার খান্না তো দিব্যি বাংলা-হিন্দি জানেন। এম-এন-সি-তে কাজ করে যে রিপ্রেজেন্টেটিভরা – এমনকী তাদের ম্যানেজাররাও – কাউকে কখনও খান্নার সঙ্গে ইংরিজিতে কথা বলতে শুনিনি। পারবেই না তোমার মতো ইংরিজি বলতে! আমার রিপ্রেজেন্টেটিভ বলল, তুমি নাকি বাগড়ি মার্কেটের হোলসেলার মাইতি ব্রাদার্সের দোকানে কাজ কর। পাহাড়ের সব বড় বড় ফার্মাসিস্টরা তোমাকে বস্তা ভরে নাকি অর্ডার দেয়! তোমার জন্যে অর্ডার নাকি রেখে দেয় তারা। মাল ফুরিয়ে গেলেও কেনে না অন্য কারো থেকে। মাইতি ব্রাদার্স যাদের ডিস্ট্রিবিউটর সেই সব কম্পানীর রিপ্রেজেন্টেটিভদের কাছেও নাকি অর্ডার দেয় না। তুমি আসার জন্যে অপেক্ষা করে থাকে! নাম কী ভাই তোমার?
বলরাম চক্রবর্তী।
তো, মাইতি ব্রাদার্সে কাজ কর কেন?
ওখানেই তো পেলাম।
আর কোথাও চেষ্টা করনি?
গ্র্যাজুয়েট ছিলাম না তো, মিনিমাম কোয়ালিফিকেশনটাও ছিল না।
কতদূর লেখা পড়া করেছ? – কমলেশ দত্ত জিজ্ঞেস করে।
এইচ-এস পাশ করেছিলাম কোনরকমে।
কোনরকমে মানে?
থার্ড ডিভিশনে।
থার্ড ডিভিশনে এইচ-এস পাশ করে এমন ইংরিজি বলতে শিখেছ! কোন্ স্কুলে পড়তে?
তিনকড়ি স্মৃতি উচ্চমাধ্যমিক, জিরাট।
বল কী! জিরাটের স্কুলে পড়ে – তা-ও থার্ড ডিভিশন – এমন ইংরিজি বল!
এই মন্তব্যের কোন উত্তর দেয় না বলরাম। নীরবে কিছুক্ষণ প্রায় একমনে খাওয়ার পর হঠাৎ বলে ওঠে কমলেশ দত্ত, ল্যাজারাসে চাকরি করবে?
ল্যাজারাসে? আপনি দেবেন?
আমি না দিলে আর তোমাকে দেবে কে? মুখের খাবারটা আরও দুয়েকবার চিবিয়ে টেবিলের পানীয়টার সাহায্যে সেটাকে পেটে চালান করে, প্যান্টের হিপ-পকেট থেকে ওয়ালেটটা বের করে কমলেশ। একটা বিজনেস কার্ড রাখে টেবিলে, আমার অফিসের টেলিফোন নাম্বার আর অ্যাড্রেস আছে এখানে। কলকাতায় পৌঁছোচ্ছো কবে?
কাল রাতে দার্জিলিং মেল ধরব, পরশু সকালে ব্যাণ্ডেল।
হ্যাঁ, তোমার তো জিরাটে বাড়ি বললে। গিয়েই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। ট্রেনিং শুরু হবে সামনের মাসের গোড়ায়। তোমার কোন কার্ড আছে?
নিজের নেই। মাইতি ব্রাদার্সের কার্ডে – ঐ একটা রিপ্রেজেন্টেড বাই থাকে না? সেখানে – নিজের নামটা লিখে দিই।
তা-ই দাও একটা।
চার-পাঁচ দিন পর মনোময় মাইতি ডেকে পাঠান বলরামকে। মার্কেট থেকে ফিরে নীচের কাউন্টারে বসে সবে আলুর চপে একটা কামড় দিয়ে মুড়ির ঠোঙাটা দু-কষে লাগিয়ে হাঁ-মুখটায় ঠেলে দিয়েছে, এমন সময় কাউন্টারের ফোনটা। বাচ্চুদা বলল, তোকে বড়বাবু ডাকছে, মুড়িটা রেখে দিয়ে তিন-তলা থেকে ঘুরে আয় একবার।
কোন্ সাহসে তুই ল্যাজারাসে অ্যাপ্লাই করলি? – ওকে দেখেই চেঁচিয়ে উঠলেন মনোময়, ওদের ম্যানেজার কমলেশ তোকে আজই সন্ধেবেলা দেখা করতে বলেছে। এখন যদি তোকে ছুটি না দিই?...
কোন জবাব দেয় না বলরাম।
পাঁচটা অবধি কাউন্টারে থাকবি, দার্জিলিঙের মালগুলো প্যাক করাবি, তারপর যাস যে চুলোয় ইচ্ছে। ওই থার্ড ডিভিশন নিয়ে ল্যাজারাসে ঢুকতে হচ্ছে না তোকে। সামনের মাসে হাজার দেড়েক তোর বাড়িয়ে দেব ভেবেছিলাম, তোর কপালে নেই। যা ভাগ।
ল্যাজারাসের অফিস খুঁজে বের করে কমলেশ দত্তর ক্যাবিনে যখন ঢুকল বলরাম তখন রাত সোয়া আটটা। ওর জন্যেই অপেক্ষা করছিল কমলেশ। গম্ভীর মুখে, ওকে বসতে না বলেই জিজ্ঞেস করল, তোমাকে কার্ডটা দিয়েছিলাম আমার সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যে। করনি কেন? শেষ পর্যন্ত মনোময়বাবুকে ফোন করতে হল। করতে চাইছিলাম না। উনি তোমাকে কী বললেন?
খুব বকুনি দিলেন, আর দার্জিলিঙের মালটা প্যাক করিয়ে, অথবা পাঁচটা বাজার পর – হুইচএভার ইজ লেটার – বেরোতে অনুমতি দিলেন।
এ মাসের মাইনে পেয়েছ?
আমাদের মাইনে হয় দশ তারিখে।
কত পাও?
আট হাজার। কিছুদিনের মধ্যে আরো দেড় হাজার বাড়ার কথা।
হুঁ, বাড়িতে কে কে আছে? সংসারে খরচ কত?
বিধবা মা। মাকে প্রতি মাসে সাত হাজার দিই।
তোমার চলে কীভাবে?
হাজার টাকা হাতে থাকে, তা ছাড়া সত্তর টাকা ডেলি অ্যালাওয়েন্স, রোজ কিছুটা বাঁচেই।
ব্রীফ কেসটা খোলে কমলেশ। ওয়ালেট আর একটা সাদা খাম বের করে আনে। চল্লিশখানা পাঁচশো টাকার নোট বের করে ওয়ালেট থেকে, মাকে দিও। বলে, স্যালারি পেয়ে আমাকে ফেরত দিলেই চলবে।
ঠিক বুঝতে পারলাম না, বলে বলরাম।
হাঁদাকান্ত, তাই বুঝলে না। তুমি ল্যাজারাসের ট্রেনিঙে যাচ্ছ। আগামীকাল ট্রেন, সন্ধ্যেবেলা। বম্বে মেল ভায়া নাগপুর। আট সপ্তাহের ট্রেনিং। ট্রেনিং যদি মন দিয়ে কর, চাকরিটা না খোয়াও যদি খারাপ পারফর্মেন্সের জন্যে, তাহলে স্যালারি তিরিশ হাজার, ডেলি অ্যালাওয়েন্স দেড় হাজার টাকা, আউটস্টেশন চার হাজার। এই খামটায় তোমার টিকিট আছে, রিজার্ভেশন স্লীপার ক্লাসের, তোমার এনটাইট্ল্মেন্ট যদিও ফার্স্ট ক্লাস অথবা এ-সি টূ-টিয়ার। এক্সপেন্স স্টেটমেন্টে সেটাই চার্জ করবে, এখন তোমার কিছু এক্সট্রা টাকা দরকার। অ্যাকচুয়াল ফেয়ারটা আমার সেক্রেটারির কাছ থেকে জেনে নিও। আর এই টিকিটটা ও-ই কিনেছে, বম্বে থেকে ফিরে টাকাটা দিয়ে দিও, ওকে কাল সকালে টেলিফোন কোরো একবার।
ঠিক কী বলবে বুঝতে পারে না বলরাম, চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
আর হ্যাঁ, আবার কথা বলে কমলেশ, খামটা তো হাতে ধরে আছ, খুলেও দেখলে না, তোমার প্রভিশনাল অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার ওটার মধ্যেই আছে, কপিটায় সই করে আমাকে দিয়ে দাও। ট্রেনিঙের ভেন্যু দেওয়া আছে, গ্র্যাণ্ড হোটেল, ওখানেই তোমাদের অ্যাকোমোডেশন। রোববার সকালে ট্রেন পৌঁছোবে ভি-টি, ট্যাক্সিকে বলবে গ্র্যাণ্ড হোটেল, ব্যালার্ড এস্টেট। সবাই চেনে।
অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারের কপিতে সই করে, হাত বাড়িয়ে টেবিলের উল্টোদিকে বসা কমলেশকে কপিটা দিতে দিতে ঈষৎ বোকা-বোকা গলায় বলে বলরাম, থ্যা-থ্যা-থ্যাঙ্ক য়্যু স্যর।
থ্যা-থ্যা থ্যাঙ্ক য়্যু পরে বোলো, ভা-ভা-ভালো করে ট্রেনিংটা শেষ করে এসো, আমার মু-মু-মুখটা পুড়িও না। অল দ্য বেস্ট।
উঠে দাঁড়ায় কমলেশ। কোন্ সঙ্কেতে কে জানে একটা উর্দি-পরা লোক ঢুকে আসে, কমলেশের ব্রীফ কেসটা নিয়ে এগিয়ে যায়। কমলেশ হেঁটে যায় লোকটার পেছন পেছন।
২
হাতে একটা খাম দিয়ে রিসেপশনের ছেলেটা ৪০১ নম্বরে পাঠিয়ে দিলো ওকে। পরপর তিনখানা খাট। যে ওর ব্যাগটা নিয়ে এসেছে, কাঠের একটা নীচু শেল্ফ্ গোছের জায়গায় সেটা রেখে, সকাল বেলাতেই আলোগুলো জ্বেলে, এ-সিটা চালিয়ে দিয়ে, বাথরূমটা একবার খুলে, চেক-টেক করে, কিছুক্ষণ অযথা দাঁড়িয়ে, চলে গেল। বলরাম বুঝলোও না ও কিছু টিপ্স্ আশা করছিল।
বেশ বড়ো ঘর। একটা টেবিল, চেয়ার তিনটে, ড্রেসিং টেব্ল্, বড়ো একটা ওয়ার্ড্রোব আর স্ক্রীনটা-দেয়ালের-দিকে-ফেরানো একটা টেলিভিশন সেট। চেয়ারে বসে খামটা খোলে বলরাম। একটা চিঠি। ট্রেনিং ম্যানেজার ভৃগু দেশাই লিখেছেন। ওয়েলকাম টু ল্যাজারাস ফার্মা। তারপর হোটেলে থাকবার নিয়মকানুন। সকাল আটটা থেকে নটা পর্যন্ত ডাইনিং হলে ব্রেকফাস্ট; দুপুরে, একটা থেকে দুটো লাঞ্চ, রাত আটটার পর থেকে ডিনার। সন্ধ্যেবেলা ছটা থেকে সাতটার মধ্যে ঘরে ঘরে স্ন্যাক্স্ পৌঁছে যাবে। চা-কফি যত ইচ্ছে, যখন ইচ্ছে। রূম সার্ভিসে ফোন করলেই এসে যাবে ঘরে। টেলিভিশনের লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। এখানে পড়া এবং শেখাই ট্রেনীদের একমাত্র কাজ। ট্রেনিঙের শিডিউল দেওয়া পুরো আট সপ্তাহের। বলরাম লক্ষ্য করে প্রথম আর শেষ দিন বাদ দিয়ে রোজ সকালে একটা পরীক্ষা আধ ঘন্টার, আবার লাঞ্চের পরেও তাই। দেশাই আসবেন রাত আটটায়। ফিরবেন না। থাকবেন ওদের সঙ্গে। সবায়ের সঙ্গে দেখা হবে ডাইনিং রূমে।
প্রথম প্রথম একটু অস্বস্তি আর সঙ্কোচ থাকলেও দুয়েকদিনের মধ্যেই এই জীবনে বলরাম স্বাভাবিক। এমন আরামের জীবন, এতো ভালো খাওয়া-দাওয়া! রোজ সকালে জামাকাপড় নিয়ে যায়, কেচে ইস্তিরি করে ফিরিয়ে দিয়ে যায় রাতে। ফ্রেশ চাদর রোজ, ফ্রেশ তোয়ালে। অতগুলো নানা সাইজের তোয়ালে দিয়ে কী করে লোকে! এমনকী সাবান-শ্যাম্পু-টূথপেস্টও ফ্রী! ওর ঘরে আর যে দুজন আছে তাদের মধ্যে একজন বাঙালি, প্রবীর। কুচবিহারে বাড়ি তার। সে-ও খুশি খুব। তার বাবা কুচবিহারের একটা স্কুলে পড়ান, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, এমন আরাম সে-ও দেখেনি আগে। অন্য ছেলেটি আসামের। সে বোম্বে-টোম্বে ভালো চেনে। প্রায়ই রাতে বেরিয়ে যায়, ফেরে অনেক দেরিতে।
ট্রেনিঙে বলরাম সবার সেরা। স্কুলে সে ইংরিজি ছাড়া অন্য বিষয়গুলোয় দুর্বলই ছিলো, কিন্তু এখানকার ট্রেনারদের গুণেই হোক আর নিজের চেষ্টার জোরেই হোক, সবকিছুই শিখছে চটপট। কয়েকদিন পর বোঝা গেল, সব পরীক্ষাতেই সে ফার্স্ট হবে! তাছাড়া তার চটপটে ইংরিজি কথাবার্তা, আর সদ্য-অর্জিত সংযত স্মার্টনেস সবাইকেই মুগ্ধ করে।
প্রবীর বলে, বাঙালি হয়ে এত ভালো ইংরিজি বলতে শিখলি কী করে বলরাম? কোন স্কুলে পড়েছিস?
সত্যি কথাটা পুরোপুরি বলে না বলরাম; বলে তিনকড়ি স্কুল, জিরাটে। আসলে ব্যাণ্ডেলের ডন বস্কো স্কুলে ও পড়েছে ক্লাস টেন অবধি, কিন্তু বুঝে গেছে, ডন বস্কোর ব্যাকগ্রাউণ্ডটা না বললেই লোকের মনে ছাপ পড়ে অনেক বেশি। পড়াশোনায় খুব একটা ভালো ছিলো না, শুধু ইংরিজি ছাড়া। ইংরিজিতে ফার্স্ট হতো ক্লাসে, আর বলতোও ভালো। ডিবেটিং টিমের ক্যাপটেন ছিল, অনেক প্রাইজও পেয়েছে। আই-সি-এস-ই পাশ করে যখন ক্লাস ইলেভেনে, তখন ওর বাবা মাতাল হয়ে পড়ে যায় পাড়ার একটা পুকুরে। ভেসে যখন ওঠে তখন সে বেঁচে নেই আর। বাবা কী করত, জানতো না মা-ও ঠিক। মারা যাওয়ার পর বোঝা গেল এক পয়সাও তার নেই কোত্থাও, তার দায়ের ছোট একটা অংশও নেবার জন্যে পৃথিবীতে নেই কেউ! বলরাম স্কুল ছাড়ল, পাড়ার এক দাদা আশ্চর্য এক পেশা চেনাল তাকে। জিরাট এবং তার আশপাশে যত ছোট ছোট স্টেশনারী, লজেন্স-বিস্কুট, ওষুধ আর রকমারি দোকান ছিল, তাদের হয়ে কলকাতার বাগড়ি মার্কেট, চিনেবাজার আর নানা রকমের হোলসেল বাজারে গিয়ে শস্তায় মাল কিনে আনা। মিলতো কমিশন। মায়ে-পোয়ে চলে যাচ্ছিল একরকম। কয়েকবছর পর তিনকড়ি স্কুলের হেডমাস্টার ওর নাম নিয়ে নিলেন স্কুলের রেজিস্টারে। স্কুলে যেতে হত না, কিন্তু পরীক্ষা দিয়ে থার্ড ডিভিশনে পাশও করল। এভাবেই আরো বছরখানেক চলার পর ওই বাজার-সরকারি করতে করতেই আলাপ মনোময়বাবুর সঙ্গে।
ট্রেনিঙের তিন-চার সপ্তাহ কেটে যাবার পর এক আশ্চর্য ব্যাপার লক্ষ্য করে বলরাম। এয়ারকণ্ডিশনে থাকছে চব্বিশ ঘন্টা, রোদ্দুর লাগে না গায়ে, রংটা বেশ ছেলেবেলার মতো ফর্সা হয়ে আসছে। রোজই সকালে মনে হয় কেমন যেন একটা পাতলা কালচে পর্দা সরে যাচ্ছে মুখ থেকে। একদিন লক্ষ করে ডান দিকের কপালের উপর দিকটায় যেখানে কপালের শেষে শুরু হয়েছে মাথাটা, ঠিক সেখানে কালো একটা বড়োসড়ো টিপের মতো। ওটা কী? মুখের যাবতীয় ময়লা নাকি? জড় হয়েছে ওখানে?
ট্রেনিঙের শেষে ওকে একদিন আলাদা করে ডাকলেন সেল্স্ ম্যানেজার শেষাদ্রি। কলকাতায় না, ওর পোস্টিং হবে মাদুরাই। ওর প্রতিভার স্ফুরণ হবে সেখানেই সবচেয়ে বেশি, সেখানেই ওর প্রতিভা মূল্য আর সম্মান পাবে। জীবনে উন্নতি করতে হলে বাড়ির বাইরে বেরোতে হয়, আর পাঁচটা বাঙালি ছেলের মতো ঘরকুনো ও হবে না নিশ্চয়ই! কলকাতার টিকিট এখন পাবে ঠিকই, কিন্তু মায়ের সঙ্গে দেখা করে সাত দিনের মধ্যেই আসতে হবে চেন্নাই, সেখানে রিজিওনাল ম্যানেজার সুব্বারাও প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা করে দেবেন।
৩
সুব্বারাও বললেন, খুব ভালো করেছ আজ এসেছ। কাল শনিবার, রিজিওনাল অফিসে ছুটি। তোমার হেডকোয়ার্টার কোথায় জান তো? মাদুরাই। আমার সেক্রেটারী আবিরও বাড়ি সেখানে। প্রতি শুক্কুরবার যায়, সোমবার সকালে চলে আসে। ওর সঙ্গে চলে যাও, তোমার বস সুধাকরণের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবে, তারও হেডকোয়ার্টার মাদুরাই। তারপর থেকে সুধাকরণ তোমার ফ্রেণ্ড-ফিলোসফার-গাইড! আজ দুপুরে আমার সঙ্গে লাঞ্চ করো, সন্ধ্যে থেকে আবি ইজ য়্যোর বস! তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে ক্যাবিনের দরজাটা ফাঁক করে ডাকেন, আবি। নারীকণ্ঠে উত্তর শোনা যায়, কামিং স্যর।
টেক চার্জ অফ য়্যোর ওয়ার্ড, গার্ল, হেসে বলেন সুব্বারাও।
এলিস নগরে এগজিকিউটিভ লজ নামে একটা ছোট হোটেলে ওর থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে চলে গেল আবি, বলে গেল পরের দিন সকালে আসবে। ছোটখাটো খাওয়া ট্রেনেই হয়ে গিয়েছিল, শুয়ে পড়লো বলরাম।
পরের দিন সকাল আটটাতেই সুধাকরণ আর আবি হাজির। আলাপ হল। আবি বলল, আজ সারাদিন তোমার প্রোগ্রাম সুধাকরণের সঙ্গে। আজ শনিবার আমার ছুটি, তোমাদের নয়। মার্কেটে যাও, কাজকম্মো শেখো, কাল সকালে আমি আবার আসব।
ডাক্তারের লিস্ট আর প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র নিয়ে এসেছিল সুধাকরণ, আবি চলে গেলে ঘন্টা দেড়েক আলোচনার পর বেরোলো ওরা। ডাক্তারের সঙ্গে বলরামের কথাবার্তা – ডিটেলিং যার চালু নাম – শুনে সুধাকরণ অবাক। বলল, ট্রেনিঙে তুমি খুব ভাল করেছ আমি শুনেছি। কিন্তু এত ভাল! দুপুরে খাইয়ে দিলো ওকে সুধাকরণ।
রবিবার সকালে সাতটার মধ্যে চানটান সেরে বলরাম রেডি। সুধাকরণ বলেছে আজ ও আসবে না। আজ ফ্যামিলি ডে। আবার সোমবার দেখা হবে।
বলরাম আবির অপেক্ষায়। আবির অপেক্ষায়। আবির অপেক্ষায়। চকচকে-পালিশ-করা-আবলুশ-কাঠ-রঙা আবি। চকচকে ইলিশের আঁশের মতো রৌপ্যদন্তিনী আবি। সকালে আসবে বলেছিল, আবির সকাল কটায় হয়?
এগারটায় এল আবি, বলল, চল তোমার বাড়ি দেখিয়ে আনি।
আমার বাড়ি?
লজে থাকবে নাকি চিরকাল?
যেখানে হোক থাকলেই হল। একা মানুষ।
একদিন একা থাকার পর চেহারাটা দেখেই মালুম হচ্ছে, একা থাকার মানুষ বটে!
তাতে তোমার কী? তুমি যেখানে বাড়ি দেখাবে সেখানেও তো একা। আমার সঙ্গে থাকবে কে?
তুমি যদি কাউকে জোটাও সে থাকবে। সে এলেম যদি না থাকে, অন্তত শনি-রবি পাশের বাড়িতে আমাকে তো পাবে।
তোমার পাশের বাড়ি?
ইয়েস স্যর, প্রভাইডেড দ্য ল্যাণ্ডলর্ড লাইকস য়্যু।
আবি একা থাকে। দুপুর বেলা বাড়ি নিয়ে গেল। খিদে পেয়েছে?
জানিনা। এ প্রশ্ন এগারোটায় আসেনি যার মাথায়, সে এখন কেন শুধোয়?
তুমি সকাল থেকে না খেয়ে আছ? ও মাই –
বড়ো বড়ো টুকরো শুওরের মাংস রেঁধেছে আবি। আর ভাত।
শুওর? জিজ্ঞেস করে বলরাম।
কেন, খাও না? আমি শুনেছি বাঙালিরা সব খায়।
যদি মুসলমান হতাম?
চক্রবর্তীরা ব্রাহ্মণ হয়। আমি জানি।
খেতে খেতে আবির নিজের কথা। নিজের সঙ্গে বাবার নাম জুড়ে দিয়ে ওর নাম আবি মুরুগণ। জাতে আসলে কাল্লা, ছোটর চেয়েও ছোট জাত। জন্ম দিতে গিয়ে মা মরেছিলো। ও যখন দুই, তখন বাবাও। ক্রীশ্চান মিশনারীরা মানুষ করেছে ওকে, লেখাপড়া শিখিয়েছে। সবে গতবছর নিজের ইচ্ছেয় ক্রীশ্চান হয়েছে ও।
সূর্য পশ্চিমে ঢলার আগেই জোর করে বাড়ি থেকে বের করে ও বলরামকে, দুজনে নদীর ধারে বেড়ায় একটু, তারপর বলরাম ফেরে লজে। আনমনা। একা একা।
পরের শুক্কুরবার মাদুরাই স্টেশনে ট্রেন থামতেই সামনে বলরাম। দেখতে পেয়ে হাত নাড়ে আবি। হাঁটতে হাঁটতে বলরামের বাড়ি। বলরাম রেঁধে রেখেছে। শুওরের মাংস আর ভাত।
তুমি ভাবলে আমি আর কিছু খাই না! হাসতে হাসতে বিষম খায় আবি।
এটা তো খাও জানি, তাড়াতাড়ি জল এগিয়ে দেয় বলরাম।
এখন এটাই রুটিন। শুক্কুরবার স্টেশন থেকে হেঁটে হেঁটে আসা, বলরামের রান্না ডিনার – এখন শুওরই শুধু নয় – আর পরের দুদিন দুজনে প্রায় সারাক্ষণ এক সঙ্গে, কিন্তু বাড়ি আলাদা, থাকা আলাদা। আবি খবর আনে সুধাকরণের রিপোর্ট অনুযায়ী বলরাম শুধুই সুপারলেটিভ। সেল বেড়েছে গতবছরের তুলনায় দ্বিগুণ।
পোঙ্গলের ছুটিতে আবি এসেছে তিন দিনের জন্যে। একদিন বলে, বেড়াতে যাবে? আমি প্রতি বছর যাই।
কোথায়?
বেশি দূর নয়, পালমেড়ু, মাইল পনেরো-ষোল।
কী হবে সেখানে?
এক রকমের খেলা, জালিকাটু।
একদল কালো কালো মেয়েপুরুষের সঙ্গে ছোট ট্রাকে ওঠে ওরা। কেউ কেউ চেনে আবিকে, হাসে। আবি বলে, এরাই আমার আপনজন। ছোটখাটো কাজ করে মাদুরাইতে। বছরে একদিন সবাই মিলে পালমেড়ু যাই।
বিরাট মাঠে থিকথিকে ভীড়। একদিকে বাঁশ দিয়ে ঘেরা একটা জায়গায় সারিসারি ষাঁড়, তাদের গলায় মালা, শিং দুটোর মাঝখানে একটা মেডেল, ছেলের দল তোয়াজ করছে তাদের।
একটা একটা করে ষাঁড়কে ছাড়া হয়, খালি-গায়ে লেংটি-পরা একজন লাফিয়ে উঠে চেষ্টা করে ষাঁড়টার পিঠের কুঁজটাকে জড়িয়ে ধরে কপাল থেকে মেডেলটা খুলে নিতে। তিরিশ-চল্লিশ জনের মধ্যে একজন পারে, বাকিদের এক ঝটকায় ফেলে দেয় ষাঁড়, গুঁতিয়ে রক্তপাতও ঘটায় কখনো কখনো। মাঠে প্রবল উত্তেজনা, বলরামেরও ছোঁয়াচ লাগে। আবির চোখে জল, দুহাতে মুখ ঢাকা।
কষ্ট পাও, তাহলে আসো কেন?
বাবার মৃত্যু দেখতে আসি। এইভাবে মরেছিল আমার বাবা। কেন যে মরল!
তোমার বাবা! এই ভয়ঙ্কর খেলায়? কেন?
কেন? শুনবে? টেনে টেনে বলে আবি –
পাগলা হাতির চেয়েও পাগল
সহজে সে মানবে হার?
বৃষ, তাইতো বৃষস্কন্ধ,
ওর উপমা কী হয় আর?
ওর কুঁজ আজ জেতো যদি
এক জোড়া কুঁজ পুরস্কার!
নিষ্পলক দেখে বলরাম আবিকে, এক জোড়া কুঁজ পুরস্কার, এক জোড়া কুঁজ! কিন্তু তোমার তো বাবা, তখনই তো বাবা!
মা মরেছে আমাকে জন্ম দিতে গিয়ে, দুবছর আগে। বাবা তখন তেইশ।
ফেরার পথে কথা বলে না কেউ।
বাড়ি ফিরে আবি বলে, একটু বোসো, আমি গা ধুয়ে আসি।
একটু দাঁড়াও, বলে বলরাম। চেয়ার থেকে উঠে সে হাঁটু মোড়ে আবির সামনে, মুখ উঁচু করে বলে, আমার দিকে তাকাও আবি। কোন কিছু জেতার ক্ষমতা নেই আমার, তবু ঐ এক জোড়া কুঁজ আমার... দেবে না?
ঘরে ফিরে বলরাম দেখে তার কপালে ডানদিকের কালো টিপটার মতো আরেকটা টিপ বাঁদিকেও!
৪
একেবারে বিয়ে করে ফেললে! সুব্বারাও বলেন, এখন তুমি থাকবে চেন্নাই, বলরাম মাদুরাই, মানে হয়!
সুধাকরণ বলেছেন বলরাম চেন্নাইয়ে আরও এফেকটিভ হবে। ওকে এখানে নিয়ে আসুন না।
হুঁ!
ট্রেন যখন ঢুকছে, দূর থেকে বলরামকে কেমন যেন দেখায়, কী হয়েছে, বলরাম?
টেলিগ্রাম পেয়েছি, মা মরণাপন্ন। কাল সকালেই রওনা দেব, চেন্নাই থেকে প্লেন। সুধাকরণ অনুমতি দিয়েছেন।
দাঁড়াও, যাব আমিও। একটা পাবলিক কল অফিসে চল, চেন্নাইয়ে ফোন করতে হবে।
৫
ঘরে ঢুকতে মা ডুকরে কেঁদে ওঠে। এই তোর বউ?
মুখে আঙুল দিয়ে চুপ করতে বলে বলরাম, তোমার কী হয়েছে?
সেই যে পাড়ার দাদা, বাজার-সরকারি শিখিয়েছিলেন বলরামকে, টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন তিনিই। তাঁর কাছ থেকেই শোনা গেল সব কিছু। ক্রীশ্চান মেয়ে বিয়ে করেছে শুনেই ওর মা মাথা ঘুরে পড়ে যায়। দুদিন পর উঠেছে, কিন্তু আচ্ছন্নর মতো পড়ে থাকে সারাদিন। কথা বলে না কারো সঙ্গে।
এদিকে চেন্নাই থেকে কলকাতায় বলরামের মায়ের অসুস্থতার খবর এসেছে, এখানে-ওখানে যোগাযোগ করে কমলেশ দত্ত
এস-এস-কে-এম-এ ভর্তির ব্যবস্থা করে রেখেছেন। বলরাম টেলিফোনে কথা বলে কমলেশের সঙ্গে, আগামীকাল সকালে নিয়ে যাব হাসপাতালে, একটা অ্যাম্বুলেন্স তো লাগবে।
ঠিক আছে, এস-এস-কে-এম-এ কাজ করে আমাদের যে রিপ্রেজেন্টেটিভ আর ওর যে ম্যানেজার, ওরাই ব্যবস্থা করে রাখবে। অ্যাম্বুলেন্স আজই ঠিক করে ফেল, যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি এস কাল। ওদের সঙ্গে আমিও থাকব।
থ্যাঙ্ক য়্যু স্যর।
ছেলেকে দেখেই কি মা একটু ভালো আজ? আবিকে বলে, রান্না করতে জানো?
আবি বোঝে না কিছুই। তবুও হাসি হাসি মুখে আন্দাজে ঘাড় নাড়ায়।
বেজাতের মেয়ে তুমি, ঘেন্না করে। তবু আমার বলুর তুমি বউ, রান্না করে খাওয়াও দিকি আমাকে আজ। মরার আগে বউয়ের হাতে খেয়ে মরি।
আড়ালে নিয়ে যায় বলরাম আবিকে, আমার মায়ের উপর রাগ করনি তো? অন্য কিছু নয়, একটু টোম্যাটো রসম রান্না কর মায়ের জন্যে। অসুখের মুখে খেতে ভালো লাগবে।
খাওয়ার সময় একটু দূর থেকে হাওয়া করে আবি। মা যেন দেখতেই পায়নি, তবুও সময় নিয়ে খায়, ধীরে ধীরে খায়।সবটাই শেষ করে, হাসে না কিন্তু একটুও।
সন্ধ্যেবেলা একটু আদর করে বলরাম আবিকে, তারপর মায়ের সঙ্গে শুতে যায় আগের মতো। আমার বউটা ভালো নয় মা? – আগের মতো গলা জড়িয়ে বলরাম বলে মাকে।
কিছুক্ষণ জবাব দেয় না মা। তারপর পাশ ফেরে, বলরামের বাহুতেই তার মাথা। তারপর শুনতে পায় মায়ের ফ্যাসফেসে গলা, মোষের মতো গতর, কেমন করে জুঝবে ওর সঙ্গে রোগা ছেলেটা!
ভোরবেলা অ্যাম্বুলেন্সে বেরোয় ওরা। বেরোবার আগে হালকা গরম জলে মায়ের মুখ-হাত-পা-বুক সব মুছিয়ে দিয়েছে আবি, শাড়িটাও দিয়েছে বদলিয়ে। মা কোন কথা বলেনি, বাচ্চার মতো এলিয়ে দিয়েছে শরীর। তারপর থেকে আর কথা বলেনি।
ভর্তির আগে শুধু একবার কথা বললো মা। বলরামের সঙ্গে। এই মোষ-বউয়ের সঙ্গে জুঝবি তুই?
বলরাম বোঝে না বউয়ের সঙ্গে জুঝতে হবে কেন। সেকেণ্ড সেরিব্রাল অ্যাটাকটা হাসপাতালেই হলো পরের দিন। সঙ্গে হেমারেজ। গভীর রাতে মৃত্যু। যেন নিমেষেই হয়ে গেলো সব।
সব কাজ শেষ হলে কমলেশ বললেন, বলরামকে কলকাতায় নিয়ে আসার সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন তিনি। কলকাতার জন্যেই তো নিয়েছিলেন ওকে, সেই কলকাতাই হলো, কিন্তু অনেক মূল্য দিয়ে! বললেন, আরও এক সপ্তাহ ছুটি নাও তুমি বলরাম। তার পর জয়েন করে ফীল্ডে কাজ শুরু করো। আরও বললেন, আবিরও হবে কলকাতায় পোস্টিং। একটু সময় লাগবে। কমলেশের সেক্রেটারি লেক মার্কেটের মালয়ালি। অবিবাহিত মানুষটার রিটায়ারমেন্টের দেরি নেই। সে অবসর নিয়ে দক্ষিণেই কোথাও শেষ জীবনটা কাটাতে চায়। তার সঙ্গে মিউচুয়াল ট্রান্সফার করিয়ে দেবেন। মাস তিনেক লাগবে। আবি তো তিন মাসের ছুটিতে আছে, তার মধ্যেই হয়ে যাবে। আবি যেন মাঝে মাঝে অফিসে আসে। ফলো-আপ চাই। উনি ডেকে পাঠাবেন। দরকার হলে নিয়েও আসবেন গাড়িতে করে।
আবি বলে, আমি যদি ফিরে যাই বলরাম?
তাহলে আমিও যাব। সুব্বারাও সাহেব ঠিক ফিরিয়ে নেবেন আমাকে। আমাকে তো সন-ইন-ল বলেই ডাকেন!
তা হয় না বলরাম। তোমাকে থাকতেই হবে জিরাটে। তোমার বাবা-মা না ভেবেছিলেন জিরাটের বাড়ি একদিন অনেক বড় করবে তুমি, সাহেবি স্কুলে পড়ে অনেক বড়লোক হবে!
তুমি না থাকলে কার জন্যে করব আবি?
কার জন্যে? মায়ের জন্যে। বাবার জন্যে।
তারা কোথায়? তারা তো আর নেই।
নেই? নেই হয়তো। তবুও আছেন কোথাও একটা নিশ্চয়ই। আমি আমার মাকে দেখিনি, বাবাকেও দেখিইনি প্রায়। তবুও তো প্রতি বছর বাবার গন্ধ নিতে চলে যাই পালমেড়ু, বাবার জন্যে প্রাণ ভরে কেঁদে আসি।
আর মা?
মাকে পাইনি কখনো। সেদিন পেলাম। হাসপাতালে যাওয়ার আগে গরম জলে গা মুছিয়ে দিলাম, কাপড় বদলে দিলাম। দুহাতে ধরে উলটিয়ে দিয়ে পাউডার মাখালাম সারা পিঠে, কোন কথা না বলে গা এলিয়ে দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে রইল নিথর। মা পেলাম, মেয়েও পেলাম।
মা মরতে মরতেও তোমাকে মোষ বলে গেছে। ভালোবাসেনি তো।
ভালোবাসেনি? কে জানে! তুমি বাসলে কেন বলরাম?
আমি? আমি কেমন যে ভয়সা ঘিয়ের স্বাদ পেয়ে গেছি, তোমাকে ছাড়া আমি কি বাঁচব?
কে জানে, আমার সব কেমন কেমন লাগে, ভালো কী খারাপ বুঝি না। এই ঘরে যখন তুমি-আমি থাকি সেটা এক রকম। এই ঘরের বাইরের দুনিয়াটা বুঝতে পারি না বলরাম। অফিস, লোকজন, কিছুই বুঝতে পারিনা, ভালো লাগে না। কিন্তু তোমাকে ছেড়ে যাবই বা কোথায়!
৬
কাজ শুরু করল বলরাম।
কলকাতা, কিন্তু ঠিক কলকাতা নয়ও। জিরাটেই যাতে একটু বেশি সময় থাকতে পারে তাই কলকাতার আশপাশের কয়েকটা ছোটখাটো সহর মিলিয়ে বলরামকে টেরিটরি তৈরি করে দিয়েছেন কমলেশ। আজ গিয়েছিল নবদ্বীপ। ফেরার কথা পরের দিন। কিন্তু ট্যাক্সের ব্যাপারে কিছু সমস্যা হওয়ায় ওখানকার ডিস্ট্রিবিউটরকে নিয়ে আজই চলে এসেছে ও কলকাতার অফিসে। ভদ্রলোককে ডিস্ট্রিবিউশন ম্যানেজারের সঙ্গে বসিয়ে কমলেশের সঙ্গে কথা বলতে সোজা ঢুকে পড়ে ও কমলেশের ক্যাবিনে। কিন্তু কমলেশ কোথায়? চেয়ারে তো নেই। একটু দাঁড়িয়ে উল্টোদিকে ভিজিটরের চেয়ারে অবশেষে কমলেশকে আবিষ্কার করে বলরাম। তার পাশে আবি। আবি এক মনে লিখছে কিছু একটা। কমলেশ ঝুঁকে পড়ে দেখছে। তার দক্ষিণ বাহু স্পর্শ করছে আবির বাম। মনে হয় না কমলেশের এ স্পর্শ সচেতন নয়। নিঃশব্দে বেরিয়ে আসে বলরাম।
আধ ঘন্টা পর কাজ সেরে আবার ওপরে আসে সে। বাইরে সোফায় আবি। বসের দরজা বন্ধ। একটু পর বেরিয়ে আসে কমলেশ, আরে বলরাম?
সব শুনে কমলেশ ওকে আবার নবদ্বীপ ফিরে যেতে বলে পরের দিন।
পরের দিন সকালে দরজা হঠাৎ খুলে যায় কমলেশের ক্যাবিনের। কী ব্যাপার, বলরাম?
টেবিল পেরিয়ে কমলেশের সামনে চলে আসে বলরাম। তার ডান হাতটা ধরে তর্জনীটা নিজের কপালের কালো টিপ দুটোতে স্পর্শ করায়, এগুলো কী বুঝতে পারছেন?
আঙুলটা ধীরে ধীরে নড়াচড়া করে কালো দাগ দুটোর ওপর, একটু অবাক হয়। কী এগুলো বলরাম, এত শক্ত, টিউমার নাকি?
মাচ অ্যাডো আবাউট নাথিং পড়েছেন?
ঘাড় নাড়ে কমলেশ।
তাতে কিছু যায়-আসে না। মাচ অ্যাডো না পড়েও এম-এন-সির ম্যানেজারি দিব্যি করা যায়। ওগুলো আসলে শিং। শিং জানেন তো? চতুষ্পদের নয়, দ্বিপদের। শৃঙ্গী চতুষ্পদের পিঠে একটা কুঁজ থাকে। তীক্ষ্ণ ধারালো শৃঙ্গদ্বয় উপেক্ষা করে যে জড়িয়ে ধরতে পারে সেই পিঠের কুঁজ, তার পুরস্কার অন্য আর এক জোড়া! দ্বিপদ শৃঙ্গীর আহরিত জোড়া কুঁজ যদি কেউ চুরি করতে যায় তার শাস্তি জানেন?
হঠাৎ প্রচণ্ড আঘাতে কমলেশ সহ তার ঘূর্ণমান চেয়ারটা ধাক্কা খায় টেবিলে। ছিটকে-পড়া কমলেশের মাথাটা লাগে কোনায়। গলগল রক্তপাত।
শব্দ পেয়ে দৌড়িয়ে আসে অফিসের লোকজন। হাত নাড়ায় কমলেশ। কিছু হয়নি তার।