এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  প্রবন্ধ  ইস্পেশাল

  • সাত সেতুর সাতকাহন

    সহস্রলোচন শর্মা
    প্রবন্ধ | ০৫ অক্টোবর ২০২৫ | ৫৫ বার পঠিত


  • ।। ১ : চলো চলি ।।



    ১৬ শতকের কথা। জার্মান প্রভাবাধীন প্রুশিয়া রাজ্যের রাজধানী খুনিসব্যাক (Königsberg) শহরের মাঝখান দিয়ে পূব থেকে পশ্চিমে দিকে বয়ে গেছে ছোট্ট এক নদী- ফ্রিগে (Pregel)। শহরের ঠিক মাঝখানে ফ্রিগে নদীর বুকে রয়েছে ছোট্ট একটা দ্বীপ- কনাইপোফ (Kneiphof, চিত্রে A)। কনাইপোফ দ্বীপের আয়তন মাত্র ০.১ বর্গকিমি। প্রায় জনবসতিশূন্য এই দ্বীপে রয়েছে ৪০০ বছরের পুরানো এক ক্যাথিড্রল। এই ক্যাথিড্রলেই যা দু’চার জন লোক বাস করেন। জনশূন্য হলে কী হবে প্রাকৃতিক নিসর্গের নিরিখে, দ্বীপটার পরিবেশ কিন্তু ভারি মনোরম। প্রতি সন্ধ্যায় তাই এই দ্বীপে ভ্রমণ করতে আসেন শহরবাসীরা। কনাইপোফ দ্বীপের উত্তর পাড়ের নাম আলস্টাট (Altstad, চিত্রে C) আর দক্ষিণ পাড়ের নাম ফোসস্টাট (Vorstadt চিত্রে B)। কনাইপোফ দ্বীপের পূর্বে, ফ্রিগে নদীর বুকেই রয়েছে বেশ বড় আরেকটা দ্বীপ- লোমসা (Lomse চিত্রে D)।

    কনাইফফ দ্বীপের (A) সাত সেতুর (a, b, c, d, e, f, g) অবস্থান। এলা ও অয়লা ব্যবহৃত নক্সা।

    দু’পাড়ের দুই মূল ভূখণ্ড আর এই দুই দ্বীপের মধ্যে যাতায়াতের জন্য গড়ে তোলা হয়েছে সাতটা সেতু। এই সাত সেতু দিয়ে, প্রতি রবিবার, কনাইপোফ দ্বীপের ক্যাথিড্রলে প্রার্থনা করতে জমায়েত হন শহরবাসীরা। সকালের প্রার্থনা সেরে, বাড়ি ফেরার পথে, কিম্বা বিকেলে ভ্রমণের সময়ে, মজার এক খেলায় মেতে উঠেন সমবেত জনতা। খেলা মানে অবশ্য প্রচলিত কোনো খেলা নয়। খেলা মানে- হাঁটা। হাঁটার খেলা। হাঁটা মানে আবার যেরকম সেরকম হাঁটা নয়। নির্দিষ্ট শর্ত মেনে হাঁটা। প্রত্যেকটা সেতুকে একবার মাত্র ব্যবহার করে সাতটা সেতুকেই পার হতে হবে- এটাই হল হাঁটার শর্ত। মনে রাখতে হবে, কোনো সেতুকেই কিন্তু দু’বার ব্যবহার করা যাবে না। আবার, এই সাত সেতুর প্রত্যেকটাকে একবার করে ব্যবহার করতেই হবে। কোনোটা যেন বাদ না পড়ে যায়। সকাল কিম্বা বিকেল, সময় পেলেই কনাইপোফের আশেপাশের অধিবাসীরা মেতে উঠতেন এই মজার হাঁটায়। ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে থেকে শুরু করে বুড়ো বুড়ি পর্যন্ত সকলই সেই সাত সেতু পার হওয়ার অভিযানে সানন্দে সামিল হতেন। কিন্তু শর্ত মেনে কেউই আর সেই সাত সেতু পার হতে পারতেন না। কোনো না কোনো সেতু বাদ পড়ে যেত ঠিকই। নয়তো কোনো একটা সেতু দু’বার ব্যবহার করে ফেলতেন। উৎসাহী শহরবাসীদের কেউ কেউ আবার খাতা কলম নিয়ে দ্বীপ আর সেতুর অবস্থানের নক্সা এঁকে ফেলতেন। সেই নক্সার উপর হাত বুলিয়ে সমাধানের চেষ্টায় মগ্ন হয়ে থাকতেন। ঘন্টার পর ঘন্টা ভেবেও কোনো উপায় কিন্তু বার করতে পারলেন না তাঁরা। আর এটা কোনো এক দিনের ঘটনা নয়, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে কনাইপোফের সাত সেতু ভাবিয়ে গেছে স্থানীয় মানুষজনকে।

    ।। ২ : সেতুর সুরতহাল ।।



    সেতুর নক্সার উপর আঙুল বুলিয়ে আপনিও কি সেই সাত সেতু পার হওয়ার খেলায় মেতে উঠলেন নাকি? তা বেশ তো, করুন না চেষ্টা। তবে তার আগে, এক ঝলকে সেই সাত সেতুর অবস্থান, নামধাম জেনে নিতে হবে না আমাদের? তো, চলুন যাওয়া যাক কনাইপোফ দ্বীপে। পরিচিত হয়ে আসি সাত সেতুর সাথে।
    খুনিসব্যাক শহরের ৮৫ কিমি পূর্বে অবস্থিত ইনস্টাবক (Insterburg) শহরের এসে মিলিত হয়েছে আঙ্গরাপা (Angrapa) ও ইন্সথু (Instruch) নামের দুটো নদী। এই দুই নদীর মিলিত জলধারাই ফ্রিগে নাম নিয়ে খুনিগসব্যাক শহরে মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে। ইনস্টাবক শহর ছেড়ে কিছুদূর যাওয়ার পর, ফ্রিগে নদী বিভক্ত হয়ে গেছে দু’টো সমান্তরাল জলধারায়। নদীর উত্তর দিকের জলধারা ‘নয়া ফ্রিগে’ (Neu Pregel) এবং দক্ষিণ দিকের ধারা ‘আল ফ্রিগে’ (alte Pregel) নামে পরিচিত। এই দুই সমান্তরাল জলধারার মাঝে ফ্রিগে নদীর বুকে জেগে আছে চার পাঁচটা বড় বড় দ্বীপ আর একদম শেষে রয়েছে পুঁচকে একটা দ্বীপ- কনাইপোফ। এই সমস্ত দ্বীপগুলোকে টপকে কনাইপোফে এসে মিলিত হয়েছে ফ্রিগে নদীর দুই ধারা। ফ্রিগে নদীর বুকে গজিয়ে উঠা এই দ্বীপগুলির অধিকাংশই জলা-জঙ্গল, জনহীন অঞ্চল। এই দ্বীপগুলোর মধ্যে কনাইপোফে আর লোমসা দ্বীপের পশ্চিমাংশেই যা মানুষজনের যাতায়াত। আর এই যাতায়াতের সুবিধার জন্যই এই অঞ্চলে তৈরী করা হয়েছে সাতটা সেতু। সেই সাত সেতুর সংক্ষিপ্ত সুরতহাল এই রকম-
    ১) খামা বুকা (Kramer Brucke, চিত্রে c)- জার্মান ভাষায় ‘বুকা’ শব্দের অর্থ ‘সেতু’ আর ‘খামা’ কথার অর্থ ‘বিক্রেতা’। ভিনদেশিরা এই সেতুকে তাই Salesman’s bridge নামে অভিহিত করে থাকেন। কনাইপোফ দ্বীপের সাথে আলস্টাট অঞ্চলের যোগাযোগ রক্ষাকারী এই সেতুটা নির্মাণ করা হয়েছিল ১২৮৬ সালে।
    ২) গুইনা বুকা (Grune Brucke, চিত্রে a)- ইংরাজি অর্থ Green bridge। কনাইপোফ ও ফোসস্টাটের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী এই সেতুটা নির্মাণ করা হয় ১৩২২ সালে। এই সেতু নির্মাণের ফলে আলস্টাট ও ফোসস্টাটের মধ্যে যোগাযোগ সহজতর হয়ে উঠে।
    ৩) খটে বুকা (Kottel Brucke, চিত্রে b)- ইংরাজিতে Slaughter bridge। কনাইপোফ ও ফোসস্টাটের মধ্যে যোগাযোগকারী এই দ্বিতীয় সেতুটা নির্মাণ করা হয় ১৩৭৭ সালে।
    ৪) স্মাইডা বুকা (Schmeide Brucke, চিত্রে d)- ইংরাজিতে Blacksmith’s bridge। কনাইপোফ দ্বীপের সাথে আলস্টাট অঞ্চলের সংযোগ রক্ষাকারী দ্বিতীয় এই সেতুটা নির্মাণ করা হয় ১৩৭৯ সালে।
    ৫) হয়েৎস বুকা (Holz Brucke, চিত্রে g)- ইংরাজি নাম Timber/Wooden bridge। লোমসা দ্বীপে অবস্থিত প্রথম সেতু। লোমসা ও আলস্টাটের সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী এই সেতুটা নির্মাণ করা হয় ১৪০৪ সালে।
    ৬) হুয়া বুকা (Hohe চিত্রে f)- ইংরাজি নাম High bridge। লোমসা দ্বীপে অবস্থিত দ্বিতীয় সেতু। লোমসার সাথে ফোসস্টাটের সংযোগ রক্ষাকারী এই সেতুটা নির্মাণ করা হয় ১৫২০ সালে।
    ৭) হুনিস বুকা (Honig Brucke চিত্রে e)- ইংরাজি অর্থ Honey bridge। লোমসা ও কনাইপোফ দ্বীপ দু’টোর সংযোগকারী একমাত্র সেতু। ১৫৪২ সালে নির্মাণ করা হয়েছিল এই সেতুটা।

    ।। ৩ : নক্সার নবপাঠ ।।



    খুনিসব্যাক শহরের সাত সেতু পারাপারের গল্পটা বেশ জনপ্রিয় ধাঁধাঁ হিসেবে প্রচার পেতে শুরু করে। ইউরোপের বিভিন্ন শহরের অনেক উৎসাহী ব্যক্তি এই সাত সেতুর গল্পটা জানতেন। এই সাত সেতুর গল্পটা দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রুশিয়ার ডানসিস (Danzig) শহরের মেয়র খাল লিয়নহাট গটলিপ এলা-র (Carl Leonhard Gottlieb Ehler)। শহরের শাসক হলে কী হবে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও গণিতে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন এলা। তাই তিনিও খাতা কলম নিয়ে দ্বীপের নক্সা এঁকে, সেতু পারাপারের সমাধান খুঁজতে বসলেন। কিন্তু কিছুতেই কোনো সমাধানে পৌঁছতে পারলেন না।

    ১৭৩৬ সাল। খুনিসব্যাক শহরের ১০০০ কিমি উত্তরে, রাশিয়ার সেইন্ট পিটার্সবার্গ শহরের বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দ্য সেইন্ট পিটার্সবার্গ একাডেমি অব সায়েন্সেসের বেশ রমরমা অবস্থা তখন। বছর দশেক আগে এহেন একাডেমির গণিত বিভাগে যোগদান করেছেন সুইৎজারল্যান্ডের তরুণ গণিতজ্ঞ লিয়নহাট অয়লা (Leonhard Euler)। পিটার্সবার্গে আসার কয়েক বছরের মধ্যেই খুনিসব্যাক শহরবাসীর অদ্ভুত হাঁটার কথা জানতে পারেন অয়লা। তবে গল্পটাকে তেমন একটা গুরুত্ব দেন নি তিনি। তাঁর মনে হয়েছিল, এটার মধ্যে আবার চিন্তাভাবনা করার মতো কী আছে? নেহাতই সাদামাটা সমস্যা একটা। ফলে ধাঁধাঁটা একপ্রকার ভুলতেই বসেছিলেন তিনি। এদিকে ডানসিস শহরের মেয়র এলার মনে হল, খ্যাতিমান তরুণ গণিতজ্ঞ অয়লাকে একবার ‘খুনিসব্যাক ব্রিজ’ সমস্যার কথাটা জানালে কেমন হয়?

    কনাইফফ দ্বীপের সাত সেতু থেকে উৎপন্ন গ্রাফ থিয়রির নক্সা। ১৯৩৬ সালের নিবন্ধে এই ছবিটাই এঁকেছিলেন অয়লা।

    দেখা যাক, অয়লা এই সমস্যার কোনো সমাধান প্রস্তুত করতে পারেন কিনা। ৯ মার্চ ১৭৩৬, পত্র মারফৎ অয়লাকে খুনিসব্যাক ব্রিজ সমস্যার সমাধানের অনুরোধ জানিয়ে এলা লিখলেন, “... most learned Sir, if you would send us the solution, which you know well, to the problem of the seven Konigsberg bridges, together with a proof. ... . I have added a sketch of the said bridges.”।

    এলার পত্র পেয়ে খুনিসব্যাক ব্রিজ নিয়ে এবার একটু চিন্তিত হয়ে উঠলেন অয়লা। হতে পারে বিষয়টা নিতান্তই তুচ্ছ, সাদামাটা একটা ঘটনা। তবুও বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বসলেন তিনি। ক্রমেই অন্য সবার মতো তিনিও বুঝতে পারলেন, বাস্তব অভিজ্ঞতা দিয়ে এই সমস্যার কোনো সমাধানে পৌঁছনো সম্ভব নয়। সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হলে, খুনিসব্যাকবাসী তো কবেই এই সমস্যার সমাধান করে ফেলতে পারতেন। অয়লা এও বুঝতে পারলেন প্রচলিত কোনো গাণিতিক বোধ দিয়েও একে সমাধান করা যাচ্ছে না। আর এই না-পারাটাই ভাবিয়ে তুলছে তাঁকে। তাঁর ইতালিয় বন্ধু গণিতজ্ঞ জোভান্নি জাকোমো মারিননিকে (Giovanni Giacomo Marinoni) লেখা এক পত্রে তাঁর এই উপলব্ধির কথাটা জানালেন অয়লা। ১৩ মার্চ ১৭৩৬, খুনিসব্যাক ব্রিজ প্রসঙ্গে মারিননিকে তিনি জানান, “This question is so banal, but seemed to me worthy of attention in that neither geometry, nor algebra, nor even the art of counting [combinatorics] was sufficient to solve it.”।

    মারিননিকে লেখা পত্র থেকে জানা যাচ্ছে, অয়লা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছিলেন, গণিতের প্রচলিত কোনো ধারা দিয়েই খুনিসব্যাক ব্রিজের সমাধানে পৌঁছনো সম্ভব নয়। আর ঠিক এই সিদ্ধান্তটাই ক্রমাগত খুঁচিয়ে যাচ্ছিল তাঁকে। কেন সমস্যাটার কোনো সমাধান নির্ণয় করা যাচ্ছে না? দিনের পর দিন, ঘন্টার পর ঘন্টা, ভেবেই চললেন অয়লা। কিন্তু কিছুতেই কোনো সমাধান নির্ণয় করতে পারলেন না। এদিকে হাতে অনেক কাজ পড়ে আছে তাঁর। সেই সব জরুরী কাজ ফেলে কতক্ষণ আর এই সামান্য একটা ঘটনার পিছনে খাটবেন তিনি? ‘আচ্ছা ঝামেলায় পড়া গেল তো’- বিড়বিড় করে উঠেন অয়লা। মনে মনে কিছুটা বিরক্তই হয়ে উঠলেন তিনি। বিষয়টার কোনো সমাধান নির্ণয় করতে না পেরে অবশেষে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। আচ্ছা মুশকিল, সব সমস্যার সমাধান গণিতজ্ঞকেই করতে হবে? রাগে গজগজ করতে থাকেন অয়লা। আর তাঁর এই রাগটা গিয়ে পড়ল পালের গোদা মেয়র এলার উপর। ৩ এপ্রিল ১৭৩৬, এলার চিঠির প্রত্যুত্তরে অয়লা লিখলেন, “Thus you see, most noble Sir, how this type of solution bears little relationship to mathematics, and I do not understand why you expect a mathematician to produce it, rather than anyone else, for the solution is based on reason alone and its discovery does not depend on any mathematical principle.”।

    রাগের মাথায় এলাকে ক’টা ঝাঁঝাল কথা লিখে দিলেন বটে, লিখে দিলেন ‘এর আবিষ্কার (সমাধান) গণিতের উপর আদৌ নির্ভর করে না’, কিন্তু সমস্যাটা সমাধান করতে না পারার জ্বালা থেকে তো মুক্তি পেলেন না তিনি। অয়লা ভালো করেই জানেন, গণিতজ্ঞ ছাড়া আর কে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন? তাই বাইরে যতই রাগ দেখান না কেন, ভিতরে ভিতরে কিন্তু নিরন্তর ভেবে চলেছেন খুনিসব্যাক ব্রিজ সমস্যা নিয়ে। ‘আচ্ছা, এই সমস্যাটা যদি সমাধান যোগ্য নাও হয়, সমস্যাটার সাথে আর কী কী অনুষঙ্গ যুক্ত বা বিযুক্ত করলে সমস্যাটা সমাধান যোগ্য হয়ে উঠতে পারে?’- মনে মনে ভাবতে থাকেন অয়লা। চিন্তিত অয়লা ফের খাতা পেন নিয়ে বসলেন। কনাইপোফ, ফোসস্টাট, আলস্টাট আর লোমসা- চারটে অঞ্চলকে আর বড় অঞ্চল না ধরে চারটে বিন্দুর মতো বিচার করলেন। এলা বর্ণিত বর্ণানুক্রমেই সেই চা্র বিন্দুর নাম দিলেন A, B, C, D। আর এই চার অঞ্চলের সাথে যুক্ত সেতুগুলোকে লম্বা লম্বা সরলরেখা বা বক্ররেখা দিয়ে যুক্ত করলেন। এলা বর্ণিত বর্ণানুক্রমেই সেতুগুলোকে চিহ্নিত করলেন। ব্যস, হয়ে গেল গণিতের নতুন এক শাখার জন্ম- গ্রাফ থিয়রি (Graph Theory)। নিজের অজান্তেই তিনি গোড়াপত্তন করে ফেললেন গণিত তথা কম্পিউটার সায়েন্সের গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায়ের, গ্রাফ থিয়রির। নিজের প্রতিপাদ্যকে অবশ্য ‘গ্রাফ থিয়রি’ নামে অভিহিত করেন নি অয়লা। তাঁর প্রতিপাদ্যের জন্য ‘পজিশানাল জিওমেট্রি’ শব্দ যুগল ব্যবহার করেছিলেন তিনি। ‘গ্রাফ থিয়রি’ নামটার প্রবর্তন হয় আরও দেড়শ’ বছর পরে, ১৮৭৮ সালে। প্রসঙ্গত, আধুনিক গ্রাফ থিয়রি অনুসারে, খুনিসব্যাক ব্রিজ জাতীয় সমস্যাকে ‘ডাইগ্রাফ’ বলা হয়। গ্রাফের আগে যুক্ত ‘ডাই’ কথাটার অর্থ ডাইরেক্টেড। ‘ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক’এর মতো এই জাতীয় সমস্যায়, কেবলমাত্র একদিক থেকে অন্যদিকে যাওয়া যায়, কিন্ত উলট পথে আসা যায় না। বস্তুতপক্ষে, তাঁর প্রতিপাদ্যে ডাইগ্রাফ নিয়েই আলোচনা করেছিলেন অয়লা।

    তা সে গ্রাফই হোক বা ডাইগ্রাফ, আমরা তো জানতে চাই খুনিসব্যাক ব্রিজের কী সমাধান বাতলালেন তিনি? না, খুনিসব্যাক ব্রিজের কোনো সমাধান প্রস্তুত করতে পারেন নি অয়লা। তিনি স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, খুনিসব্যাক ব্রিজ সমাধান যোগ্য নয়। কেন সমাধানযোগ্য নয় তা অবশ্য তিনি ব্যাখ্যা করে দিলেন তিনি।

    ‘Solution of a …’ নিবন্ধে খুনিব্যাক ব্রিজ নিয়ে অয়লার ছক ও সিদ্ধান্ত।

    কখন এই জাতীয় সমস্যা সমাধান করা সম্ভব ইত্যাদি বিষয় নিয়েও আলোকপাত করলেন। তাঁর প্রতিপাদ্যে, প্রথমেই তিনি মোট সেতু সংখ্যার (৭) সাথে ১ যোগ করে ৮ সংখ্যাটা নির্ণয় করে রাখলেন। এবার প্রত্যেকটা দ্বীপের সাথে যুক্ত সেতু সংখ্যা লিপিবদ্ধ করলেন। কনাইপোফ দ্বীপের সাথে যুক্ত সেতুর সংখ্যা হল ৫। এই পাঁচ সেতুকে একবার মাত্র ব্যবহার করে, ঠিক ৩ বার কনাইপোফে ঢোকা (অথবা বেরনো) সম্ভব। পাঠকরা একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন, সরাসরি কনাইপোফের সাথে যুক্ত ৫ সেতুকে (বাকি দুই সেতুকে ব্যবহার করা যাবে না) একবার মাত্র ব্যবহার করে কতবার কনাইপোফে ঢোকা যায়। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, দ্বীপে ঢোকা বা বেরনো জন্য ৫ সেতুকে ব্যবহার করে গেলেও, শুধুমাত্র দ্বীপে ঢোকার সংখ্যাটাই গণনা করতে হবে, বেরনোর সংখ্যা নয়। আবার বেরনোর জন্য, একই ভাবে ৫ সেতু ব্যবহার করে দ্বীপে ঢোকা বা বেরনো গেলেও শুধুমাত্র দ্বীপ থেকে বেরনোর সংখ্যাটাই গণনা করতে হবে, দ্বীপে ঢোকার সংখ্যা বিবেচনা করা যাবে না। অয়লা ব্যাখ্যা করে চললেন, ফোসস্টাট, আলস্টাট ও লোমসা- এই তিন অঞ্চলের প্রত্যেকটা অঞ্চলের সাথে যুক্ত সেতুর সংখ্যা হল ৩। সুতরাং ফোসস্টাট, আলস্টাট ও লোমসার তিন সেতু একবার মাত্র ব্যবহার করে ঠিক ২ বার ওই অঞ্চলে ঢোকা (অথবা বেরনো) সম্ভব। তাঁর এই পর্যবেক্ষণকে এবার একটা ছকের মাধ্যমে উপস্থাপন করলেন তিনি। ছকের প্রথম স্তম্ভে চারটে স্থানের নাম- A, B, C, D লিখলেন। দ্বিতীয় স্তম্ভে লিখলেন ওই সমস্ত স্থানের সাথে যুক্ত সেতুর সংখ্যা- ৫, ৩, ৩, ৩ এবং তৃতীয় স্তম্ভে লিখলেন হাঁটা সংখ্যা- ৩, ২, ২, ২। ছক অনুসারে মোট হাঁটা সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে ৯। যেহেতু মোট হাঁটা সংখ্যা (৯), ইতিপূর্বে ধার্য করা সংখ্যা ৮-এর থেকে বেশি হয়ে যাচ্ছে, তাই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। তিনি সিদ্ধান্ত টানেন ” … hence the required journey cannot be made.”।

    এ আবার কেমন যুক্তি! ৮-এর থেকে ৯ বড় বলে সাত সেতুর সমাধান সম্ভব নয়? বিষয়টা যে খুব একটা স্পষ্ট হল না, বুঝতে পারলেন অয়লাও। বিষয়টাকে আরেকটু পরিষ্কার করে বোঝানর জন্য, ওই সাত সেতুর সাথে আরও আটটা সেতু যুক্ত করে নিলেন তিনি। তাহলে মোট সেতু সংখ্যা হয়ে দাঁড়াল ১৫। আর নক্সার ভিতরে বাড়িয়ে দিলেন দু’টো নদীও। এইবার তিনি ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন কখন এই জাতীয় সমস্যার সমাধান করা সম্ভব আর কখন এই জাতীয় সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়। গণিতের ভাষায় সমস্যাটার necessary and sufficient conditions ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলেন। অয়লার সেই বিশ্লেষণ পড়ে পরবর্তীকালের বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, সমস্যার necessary conditions চমৎকার ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন অয়লা। তবে সমস্যার sufficient conditions যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত ছিল না। পরবর্তীকালের গণিতজ্ঞরা সমস্যার sufficient conditions-কে উপযুক্ত ভাবে বিশ্লেষণ করে গ্রহণযোগ্য করে তুলেছিলেন।
    ২৬ অগস্ট ১৯৩৬, দ্য সেইন্ট পিটার্সবার্গ একাডেমি অব সায়েন্সেসের এক সভায় খুনিসব্যাক ব্রিজ নিয়ে তাঁর নিবন্ধ, Solution of a problem relating to the geometry of position পেশ করেন অয়লা। সেই সময়ে একাডেমির জনাকয়েক সদস্য ছাড়া আর কেউই অবশ্য এই নিবন্ধের কথা জানতে পারেন নি। কারণ তখনই কোথাও মুদ্রিত হয় নি এই নিবন্ধটা। পাঁচ বছর পর, ১৭৪১ সালে একাডেমির মুখপত্র Commentaries of the Petropolitan Imperial Academy of Sciences–এ (Petropolitan = city of Petrograd, জার্মান রীতিতে পিটার্সবার্গকে পেত্রোগ্রাদ বলা হয়) ছাপা হল সেই নিবন্ধটা। না, মুদ্রিত আকারে প্রকাশের সাথে সাথে অয়লার সেই নিবন্ধ নিয়ে মোটেও হৈচৈ পড়ে যায় নি। মুষ্টিমেয় কিছু গণিতজ্ঞের নজরে পড়েছিল বটে সেই নিবন্ধটা, তবে তা নিয়ে মোটেও কোনো শোরগোল পড়ে যায় নি। পড়বেইবা কী করে? গণিতের এক নতুন শাখার জন্ম হল তো সবেমাত্র। তখনই তার উপযোগিতা বোঝা যাবে কী করে? অয়লার নিবন্ধ প্রকাশের ২০০ বছর পর গ্রাফ থিয়রির উপযোগিতা অনুভূত হতে থাকে। অবশ্য এই ২০০ বছরের মধ্যে বিভিন্ন গণিতজ্ঞের হাত ধরে ধীরে ধীরে পূর্ণতা লাভ করতে থাকে গ্রাফ থিয়রি। গ্রাফ থিয়রির গুরুত্বপূর্ণ এক অধ্যায় হল ‘ম্যাপ কালারিং’। ১৮৫২ সালে বিখ্যাত ইংরেজ গণিতজ্ঞ অগাস্টাস ডি মরগ্যানের হাত ধরে সূত্রপাত হয় ‘কালারিং’ অধ্যায়ের। সমসময়ের বিখ্যাত জার্মান পদার্থবিদ ও রসায়নবিদ গুস্তাফ কির্চহফের হাত ধরে শুরু হয় গ্রাফ থিয়রির আরেক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়- ‘ট্রি’ (Tree)। ১৮৭৮ সালে ‘গ্রাফ থিয়রি’ শব্দ যুগলের প্রবর্তন করেন বিশিষ্ট ইংরেজ গণিতজ্ঞ জেমস সিলভেস্টার। সমসময়ের আরেক ইংরেজ গণিতজ্ঞ আর্থার কেইলি ট্রি ও গ্রাফ থিয়রি নিয়ে কাজ করেন। ইতিমধ্যে কম্পিউটার আবিষ্কার হলেও তখনও পর্যন্ত তার কার্যকারিতা ছিল অত্যন্ত সীমিত। ১৯৩৬ সালে অ্যালান টুরিঙের হাত ধরে উন্নততর এক যন্ত্রে পরিণত হয় কম্পিউটার। প্রকৃতপক্ষে, ঠিক এই সময় থেকেই অনুভূত হতে শুরু করে গ্রাফ থিয়রির উপযোগিতা। গ্রাফ থিয়রির সমস্ত অধ্যায় ও প্রতিপাদ্যক সুসংহত রূপ দিয়ে গ্রাফ থিয়রির উপর সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ রচনা করেন হাঙ্গেরিয় গণিতজ্ঞ দিনেস কুনিগ (Dénes Kőnig)। ১৯৩৬ সালেই প্রকাশিত হয় কুনিগের লেখা ‘থিয়রি অব ফাইনাইট অ্যান্ড ইনফাইনাইট গ্রাফ’। আর ঠিক এখান থেকেই শুরু হয় গ্রাফ থিয়রির অপ্রতিরোধ্য উড়ান। গ্রাফ থিয়রি আজ আর শুধুমাত্র কম্পিউটার সায়েন্সেরই অন্যতম অবলম্বন নয় পদার্থবিজ্ঞান, টোপোলজি, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, ভাষাবিজ্ঞান প্রভৃতি শাস্ত্রেও আবশ্যিক হয়ে পড়েছে গ্রাফ থিয়রি। গ্রাফ থিয়রি ছাড়া আধুনিক বিজ্ঞান আজ অপূর্ণ। আর ঠিক এই কথাটাই তাঁদের গানের সুরে ব্যক্ত করেছেন স্লোভাকিয়ার রাজধানী কোসিচে (Košice) শহরের পাবো ইয়োজেফ সাফারিক (Pavol Jozef Šafárik) বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও কম্পিউটার বিভাগের অধ্যাপকরা। সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ সালে Cycles and Colourings নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ষষ্ঠ কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয় স্তারা লেসনা (Stará Lesná) গ্রামে। এই কর্মশালায় গ্রাফ থিয়রির উৎপত্তি ও বিকাশ নিয়ে ১০ স্তবকের একটা গান বাঁধেন অধ্যাপক বোহদান জেলিঙ্কা (Bohdan Zelinka)। তাতে সুরদান করেন অধ্যাপক জেদনেক রিয়াচেক (Zdenĕk Ryjáček)। সেই গানের প্রথম, দ্বিতীয় ও নবম স্তবকের ভাবানুবাদ এই রকম-

    ফ্রিগে নদীর বুকে সপ্ত সেতু
    দিয়েছে ভরিয়ে আশাতীত কিছু
    খুনিসব্যাকের প্রবীণ প্রাজ্ঞ স্থপতি
    করেছেন গঠন সেতু নয়নাভিরাম অতি।

    সায়হ্নের জনস্রোত মিশে যায় নদীতে
    নাজেহাল হয় জনতা সেতু পেরতে
    সহজ এক রাস্তার খোঁজে চিন্তাসংকুল
    পরাজিত তাঁরা, সেতুর ধাঁধাঁ অকূল।
    * * *
    প্রণতি অয়লা, গ্রাফ থিয়রির ফসল
    বিকশিত আর লালিত পল প্রতি পল
    উর্বর হল গণিত, চারণভূমি ঋদ্ধ
    আজ তার ডালপালা পুষ্পে সমৃদ্ধ।

    ।। ৪ : সংঘর্ষ ও সৌন্দর্য ।।



    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত খুনিসব্যাক অঞ্চলটা ছিল জার্মানদের অধীনে। বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন তাই মিত্রবাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়তে হয় খুনিসব্যাক শহরকে। মূলত ইংলন্ড ও রাশিয়ার বোমারু বিমান বাহিনীর প্রধান লক্ষই ছিল জার্মানের বিভিন্ন শহরের রেলপথ, বিমানবন্দর, জাহাজঘাটা, সেতু ইত্যাদির উপর পরিকল্পিতভাবে বোমা বর্ষণ করা। সেই পরিকল্পনার অঙ্গ হিসেবে খেপে খেপে, তিন চার বছর ধরে, ভারী বোমা বর্ষণ করা হয় কনাইপোফ দ্বীপের সেতুগুলোর উপর। এই বোমা বর্ষণের ফলে ধূলিসাৎ হয়ে যায় স্লটার ব্রিজ (b) ও ব্ল্যাকস্মিথস্‌ ব্রিজ (d)। নিদারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেলসম্যানস্‌ ব্রিজ (c) ও গ্রিন ব্রিজ (a)। আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় হাই ব্রিজ (f)। কিন্তু অক্ষত রয়ে যায় টিম্বার ব্রিজ (g) ও হানি ব্রিজ (e)।

    হানি ব্রিজ। ফ্রিগে নদীর ওপাড়ে কনাইপোফ (কান্ট) দ্বীপের ক্যাথিড্রল আর হানি ব্রিজের রেলিঙে ঝোলানো লাভলক।



    বিশ্বযুদ্ধের পর, ১৯৪৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত হয় খুনিসব্যাক। তারপর থেকে শুরু হয় বিভিন্ন স্থানের নামকরণের প্রশ্নে স্থানীয় জার্মান রীতিনীতির বদলে রাশিয়ান রীতিনীতিতে পরিবর্তনের পালা। ১৯৪৬ সালে রাশিয়ান বলশেভিক নেতা মিখাইও ইভানোইচ কালিনিএন (Mikhail Ivanovich Kalinin) স্মরণে খুনিসব্যাক শহরের নতুন নাম রাখা হয় কালিনিএনগ্রাদ। খুনিসব্যাক শহরের বিখ্যাত দার্শনিক ইমানুয়ে কান্ট (Immanuel Kant) স্মরণে কনাইপোফ দ্বীপের নাম রাখা হয় কান্ট দ্বীপ। একইভাবে, অক্টোবর (নভেম্বর) বিপ্লবের স্মরণে লোমসা দ্বীপের (D) নাম রাখা হয় অক্টাবস্কি (Oktyabrsky), ফ্রিগে নদী হয় ‘প্রিগলা’ (Pregolya), ইত্যাদি ইত্যাদি।

    সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীনে আসার পর কান্ট/কনাইপোফ দ্বীপের সেতুগুলোর পুনর্নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বিশ্বযুদ্ধে ধূলিসাৎ হয়ে যাওয়া স্লটার ব্রিজ (b) ও ব্ল্যাকস্মিথস্‌ ব্রিজের (d) জায়গায় নতুন করে আর কোনো সেতু নির্মাণ করা হয় নি। ফলে পূর্বতন সেই সাত সেতুর, দুটো সেতুর আজ আর কোনো অস্তিত্বই নেই। ভীষণ রকমের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সেলসম্যানস্‌ ব্রিজ (c) ও গ্রিন ব্রিজের (a) অবশিষ্টাংশকে সম্পূর্ণ রূপে ভেঙ্গে ফেলা হয়। পরিবর্তে কান্ট দ্বীপের উপর দিয়ে আলস্টাট থেকে ফোসস্টাট পর্যন্ত একটা ‘থ্রু ব্রিজ’ নির্মাণ করা হয়। নতুন এই ব্রিজের নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্রসপেক্ট লিনিনস্কি’ (Prospekt Leninskiy)। ভেঙ্গে ফেলা হয় আরেক ক্ষতিগ্রস্ত সেতু হাই ব্রিজ (f)। পরিবর্তে সেখানে নির্মাণ করা হয় নতুন সেতু উইসোকি মোস্ত (Vysokiy moct, মোস্ত = সেতু)। অক্টাবস্কি (লোমসা) ও আলস্টাটের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী টিম্বার ব্রিজটা (g) অক্ষতই ছিল। একটা প্রশস্থ হাইওয়ে দিয়ে সদ্য তৈরি হওয়া উইসোকি মোস্তের সাথে যুক্ত করা হয় এই টিম্বার ব্রিজকে। অক্টাবস্কি দ্বীপে অবস্থিত এই হাইওয়ে বর্তমানে উলিৎসা অক্টাবস্কায়া (Ulitsa Oktyabr’skaya) নামে পরিচিত। হানি ব্রিজই হল সেই সপ্ত সেতুর মধ্যে একমাত্র সেতু যা অয়লা-র আমল থেকে একই অবস্থানে একইভাবে অক্ষত অবস্থায় রয়ে গেছে। কালিনিএনগ্রাদের মানুষজনের কাছে তাই ভীষণ প্রিয় এই হানি ব্রিজ। বিশেষত এলাকার প্রমিক যুগল বড় পছন্দ করেন এই ব্রিজটাকে। ইউরোপের প্রেমিক-প্রেমিকারা মনে করেন, তালা হল সুদৃঢ় ও চিরস্থায়ী ভালোবাসার প্রতীক। তালাকে তাঁরা ‘লাভলক’ হিসেবে দেখতে পছন্দ করেন। তাঁদের ভালোবাসাকে সুদৃঢ় ও চিরস্থায়ী রূপ দিতে, বিভিন্ন ব্রিজ, গেট, সৌধের রেলিং বা গ্রিলের গায়ে একটা তালা ঝুলিয়ে দেন তাঁরা। হানি ব্রিজের রেলিঙের গায়েও এই রকম অজস্র তালা লাগান আছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো নতুন প্রেমিক যুগল তাঁদের ভালোবাসাকে চিরকালীন রূপ দিতে নতুন একটা তালা ঝুলিয়ে দেন হানি ব্রিজের রেলিঙের গায়ে। এসব জানার পড়ার পর, আমরাও বোধহয় খুনিসব্যাকের সাত সেতুর প্রেমে পড়ে গেছি, তাই না? আমরা তো চাই, আমাদের ভালোবাসাকে চিরস্থায়ী রূপ হানি ব্রিজের গায়ে একটা তালা ঝোলাতে।

    - x -

    [শেষ পাতে : মুম্বাই শহর আদতে একটা দ্বীপ। জানুয়ারি ২০২৪ সালে মুম্বাই ও নবি মুম্বাইয়ের মধ্যে অটল সেতু চালু হওয়ার পর মুম্বাই দ্বীপেও এখন সেতুর সংখ্যা সাত।]

    যে সমস্ত গ্রন্থ/পিডিএফ/সাইটের সাহায্য নেওয়া হয়েছে-
    A Bridge Too Far: The Perambulators of Königsberg (and Other Cities) By Chris Pritchard. September 2021.
    An Historical Note: Euler‘s Konigsberg Letters by Horst Sachs, Michael Stiebitz and Robin J. Wilson. England
    Leonhard Euler : Mathematical Genius in the Enlightenment by Ronald S. Calinger. Princeton University Press, 2016.
    Leonard Euler's Solution to the Konigsberg Bridge Problem by Teo Paoletti. Convergence Volume 3, New Jersey, 2006.
    Seven bridges spanned the River Pregel, Graph Theory Hymn. Lyrics by Bohdan Zelinka, Music by Zdenĕk Ryjáček.
    The Bridges of Königsberg - A Historical Perspective by Irina Gribkovskaia, Øyvind Halskau sr and Gilbert Laporte.
    The Six (or Seven) Bridges of Kaliningrad: a Personal Eulerian Walk, 2006 by R. B. Mallion, England 2007.
    The Truth about Konigsberg by Brian Hopkins and Robin J. Wilson, The College Mathematics Journal, May 2004.
    Wikipedia : a) Seven Bridges of Königsberg, b) Kneiphof and many more pages.


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • প্রবন্ধ | ০৫ অক্টোবর ২০২৫ | ৫৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক প্রতিক্রিয়া দিন