‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ’ নামটার সাথে জড়িয়ে আছে বেশ কিছু ভয়াবহ স্মৃতি। তবে একটু তলিয়ে ভাবলে দেখা যাবে এই ভয়াবহ স্মৃতির মধ্যেও কিন্তু কোথাও রয়ে গেছে কিছু উজ্জ্বল দিক, কিছু প্রাপ্তি। পরবর্তী সময়ে এই প্রাপ্তিগুলোই কিন্তু আমূল বদলে দিয়েছে মানুষের ধ্যান ধারণাকে, সূচনা করেছে মানব সমাজের এক কল্যাণকর অধ্যায়। যুদ্ধের ভয়াবহ সেই সব স্মৃতির মধ্যে থেকে আমাদের অন্যতম প্রাপ্তি হলো রকেট বিজ্ঞান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এক প্রাণঘাতী অস্ত্র হিসেবে শুরু হয় রকেটের ব্যবহার। বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে দু’টো মূল শাখায় বিভক্ত হয়ে যায় রকেট বিজ্ঞান। রকেট বিজ্ঞানের একটা শাখার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়- দূরত্ব, আরেকটা শাখার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়- উচ্চতা। প্রথম শাখা থেকে জন্ম নেয় উন্নততর মারণাস্ত্র- মিসাইল। জল, স্থল, অন্তরীক্ষ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত কোনও বস্তুকে নিখুঁত ভাবে আঘাত হানার লক্ষ্যে ব্যাপ্তি ঘটতে থাকে মিসাইলের। আর দ্বিতীয় শাখা থেকে জন্ম নেয় মহাকাশ পাড়ির স্বপ্ন। উঁচুতে, আরও উঁচুতে রকেট নিক্ষেপ করাই এই শাখার লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়।
ইতিপূর্বে বায়ুমণ্ডলের উপরের স্তরের তথ্য সংগ্রহের জন্য বেলুনের উপর নির্ভর করতে হতো বিশেষজ্ঞদের। কিন্তু রকেট আবিষ্কারের পর বিজ্ঞানীরা বুঝলেন, রকেটকে উপরে দিকে উৎক্ষেপণ করে বায়ুমণ্ডলের অনেক অনেক উপরের দিকের তথ্য সহজেই সংগ্রহ করা যেতে পারে। সেই লক্ষ্যে একের পর এক রকেট উৎক্ষেপণ করতে শুরু করে বিভিন্ন দেশ। এই সমস্ত রকেটগুলোকে তখন বলা হতো ‘সাউন্ডিং রকেট’। ‘সাউন্ড’ কথাটা বিশেষ্য পদ হিসেবে ব্যবহার হলে অর্থ দাঁড়ায় ‘শব্দ’। শব্দ ছাড়াও ‘সাউন্ড’ কথাটার আরেকটা অর্থ হলো ‘জলমণ্ডল’। যেমন, ডারউইন সাউন্ড (চিলি), ইউরেকা সাউন্ড (কানাডা) ইত্যাদি। আবার বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার হলে ‘সাউন্ড’ কথাটার অর্থ হয় গভীর। যেমন, সাউন্ড নলেজ, সাউন্ড ইকনমি ইত্যাদি। এখন, জলভাগের গভীরতা মাপার জন্য শব্দ তরঙ্গ প্রয়োগের কথা তো আমাদের জানাই আছে। সেই সূত্রেই, জলমণ্ডলের বদলে বায়ুমণ্ডলের গভীরে, মানে উপরের দিকে কিছু খোঁজার জন্য যে সমস্ত রকেট ব্যবহার করা শুরু হলো তাদের ‘সাউন্ডিং রকেট’ নামে অভিহিত করা হলো।
আকারে বেশ ছোট হতো এই সাউন্ডিং রকেটগুলো। গড়পড়তা ২০ থেকে ৩০ ফুট উচ্চতার এই রকেটগুলোকে চার পাঁচ জন লোক অনায়াসে বহন করা পারতো। এই সমস্ত রকেট নির্মাণের খরচ পড়তো খুবই কম। সেইজন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বছরে ২৫-৩০টারও বেশি সাউন্ডিং রকেট উৎক্ষেপণ করতে থাকে ইউএসএ। প্রতিবার উৎক্ষেপণের পর, রকেটের ছোটখাটো ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে, রকেটের গঠনে নানান পরিবর্তন করতে থাকেন বিজ্ঞানীরা। আর এই পরিবর্তনের সাথে সাথে নিত্য নতুন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রকেট নির্মাণ করতে থাকে ইউএসএ। এই রকমই এক বিশেষ ধরণের রকেটের নাম ছিল এরোবি (Aerobee)। এরোবি গোত্রের রকেটগুলোর মধ্যেও আবার বিভিন্ন পরিবর্তন এনে তৈরি হয় এরোবি-হাই, এরোবি-১০০, এরোবি-১৫০, এরোবি-২০০ প্রভৃতি রকেট। এই সমস্ত রকেটের ভিতরে প্রচুর যন্ত্রপাতি রাখা থাকতো। উৎক্ষেপণের পর একটা নির্দিষ্ট উচ্চতায় উঠে অধিবৃত্তাকার (প্যারাবলিক) পথে আবার মাটিতে বা জলে নেমে আসতো রকেটগুলো। ১৫-২০ মিনিটের এই যাত্রা পথের মধ্যেই, রকেটের ভিতরে রাখা যন্ত্রপাতিগুলো সক্রিয় হয়ে বিভিন্ন তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করতো। পরে এই সমস্ত তথ্যগুলোকে বিশ্লেষণ করে মহাকাশ সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য ও তত্ত্ব সংযোজন করতেন বিজ্ঞানীরা।
১৯৬৪ সাল। বায়ুমণ্ডল, সূর্য, চন্দ্র, মহাকাশের নতুন তথ্য সংগ্রহের জন্য বছরভর প্রায় ৪০টা এরোবি-১৫০ রকেট উৎক্ষেপণ করে নাসা। ২৭ মে ১৯৬৪, অন্যান্য পরীক্ষা নিরীক্ষার পাশাপাশি চাঁদের এক্স-রে ছবি তোলার বিশেষ লক্ষ্য নিয়ে, স্থানীয় সময়ে সকাল সাড়ে দশটায় ইউএসএর নিউ মেক্সিকো প্রদেশের ‘হোয়াইট স্যান্ড লঞ্চিং কমপ্লেক্স’এর ৩৫ নম্বর লঞ্চিং প্যাড থেকে উৎক্ষেপণ করা হয় এরোবি-১৫০ প্রজাতির একটা রকেট। পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ২৪৫ কিমি উপরে উঠে রকেটটা। সেখান থেকে অন্যান্য তথ্যর পাশাপাশি চাঁদের এক্স-রে ছবিও তুলতে থাকে সে। অতঃপর সে নেমে আসতে থাকে পৃথিবীর বুকে।
এরোবি-১৫০-এর সংগ্রহ করা তথ্য ও ছবিগুলোকে নিয়ে বিশ্লেষণে বসলেন বিজ্ঞানীরা। এরোবির তোলা চাঁদের একটা ছবি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে চমকে উঠেন বিজ্ঞানীরা। চাঁদের এক্স-রে চিত্রে, চাঁদের ঠিক পাশেই, চাঁদের থেকেও অধিক উজ্জ্বল একটা বস্তুর এক্স-রে চিত্র ধরা পড়েছে ছবিতে। চাঁদের থেকেও উজ্জ্বল?! তা কী করে হয়? চাঁদের যে পাশের ছবিটা তুলেছে এরোবি, মহাকাশের ঠিক সেই অঞ্চলেই রয়েছে সিগনাস (Cygnus) বা বক নক্ষত্রমণ্ডল। প্রাচীনকাল থেকেই বক মণ্ডলের সাথে পরিচিত মানুষ। উত্তর গোলার্ধের ছ’টা নক্ষত্র নিয়ে লম্বা গলা বিশিষ্ট একটা বকের ছবি কল্পনা করা হয় এই নক্ষত্রলোকে। সেই সূত্রে এই মণ্ডলের নাম দেওয়া হয়েছে বক মণ্ডল। এই বক মণ্ডলে, বকের গলার দিকে রয়েছে উজ্জ্বল নীল এক তারা। আমাদের সৌরজগৎ থেকে ৭,২০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত সেই তারা সূর্যের থেকে ৩ লক্ষ গুণ বেশি উজ্জ্বল। সূর্যের থেকে ৪০ গুণ ভারী এই তারার কোনও নাম কিন্তু দেওয়া হয় নি। নামের বদলে দেওয়া হয়েছে একটা সংখ্যা- HDE 226868। ইউএসএর পেশাদার চিকিৎসক ও অপেশাদার জ্যোতির্বিদ হেনরি ড্রেপারের (Henry Draper 1837-1882) নাম ও পদবির প্রথম অক্ষর দু’টো থেকে তৈরি হয়েছে HD সংকেতটা। ১৯ শতকের প্রথম ভাগে আবিষ্কৃত হয় ক্যামেরা। শখের জ্যোতির্বিদ ড্রেপার তখন মহাকাশের দিকে সদ্য আবিষ্কৃত সেই ক্যামেরা তাক করে তুলতে থাকেন বিভিন্ন নক্ষত্রের ছবি। সারা জীবনে শতাধিক নক্ষত্রের ছবি তোলেন ড্রেপার। তাঁর চিহ্নিত করা সেই সমস্ত নক্ষত্রদের একটা তালিকাও প্রকাশ করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর সেই তালিকাকে সম্পূর্ণ রূপ দিয়ে ২,২৫,৩০০ নক্ষত্রের একটা তালিকা প্রস্তুত করা হয়। সেই তালিকাভুক্ত নক্ষত্রদের প্রত্যেকেই একটা বিশেষ সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই সমস্ত নক্ষত্রদের প্রত্যেকের ক্রমের আগে HD সূচক ব্যবহার করা হয়েছে। পরবর্তীকালে সেই তালিকায় আরও কিছু নক্ষত্রের সংযোজন ঘটানো হয়। পরবর্তী কালে সংযোজিত এই সমস্ত নক্ষত্রদের ক্রমের আগে HDE বা ‘হেনরি ড্রেপার এক্সটেনশান’ সূচক ব্যবহার করা হয়। এই HDE তালিকাভুক্ত 226868 নম্বর নক্ষত্রের ছবিটাই তুলেছে এরোবি-১৫০। HDE 226868 তো বিজ্ঞানীদের কাছে অতি পরিচিত এক নক্ষত্র। এরোবির তোলা ছবিতে HDE 226868-এর উপস্থিতি দেখে মোটেও বিস্মিত হন নি তাঁরা। চমক রয়েছে ঠিক তার পাশেই। এরোবির তোলা ছবিতে দেখা যাচ্ছে এক্স-রে আসছে দু’টো উৎস থেকে। প্রথম এক্স-রের উৎস সেই নীল নক্ষত্র HDE 226868। কিন্তু আরেকটা এক্স-রে আসছে ঠিক তার পাশ থেকে, যেখানে কোনও নক্ষত্রই নেই। নেই কোনও আলোর উৎসও। সেখানে তো কেবল অন্ধকারই অন্ধকার! সেই ঘন কৃষ্ণ অঞ্চল থেকে এক্স-রে! তা কি করে সম্ভব? বিস্মিত বিজ্ঞানীরা! আবার অসম্ভবই-বা বলা যায় কি করে? এক্স-রে ছবিতে তো কোনও বস্তুর উপস্থিতি স্পষ্ট ভাবেই ধরা পড়েছে। বিভ্রান্ত বিজ্ঞানীরা সেই অজানা বস্তুর নাম দেন CygX-1 (Cyg = Cygnus constellation, X = X-ray, 1 = First photograph)। কিন্তু কি এই CygX-1, যা থেকেও নেই? এই প্রশ্নে তোলপাড় তখন বিজ্ঞান মহল।
১৯৬৩ সাল। পৃথিবী বিখ্যাত গ্রিনিচ মানমন্দিরে তখন সদ্য চাকরি পেয়েছেন ২১ বছরের যুবক পল জিওফ্রে মুরদিন (Paul Geoffrey Murdin)। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক হওয়া মাত্রই চাকরিটা পেয়ে গেছেন তিনি। তবে ঠিক এই মুহূর্তে, চাকরি করার থেকেও মাস্টার ডিগ্রি ও পিএইচডি সম্পূর্ণ করতে একান্তভাবেই আগ্রহী তিনি। মানমন্দিরের তৎকালীন ‘অ্যাস্ট্রোনমার রয়াল’ (সর্বোচ্চ পদ) রিচার্ড ভ্যান ডার রিট উলিকে (Richard van der Riet Woolley) তাঁর ইচ্ছার কথা জানালেন মুরদিন। তিনি আরও জানান ইতিমধ্যেই ইউএসএর নিউ ইয়র্ক প্রদেশের ইউনিভার্সিটি অব রচেস্টারে উচ্চতর শিক্ষার সুযোগও পেয়ে গেছেন তিনি। তাই উচ্চশিক্ষার জন্য তাঁর ছুটি যেন মঞ্জুর করা হয়। মুরদিনের আবেন গৃহীত হয়। কর্মক্ষেত্র থেকে ছুটি নিয়ে মুরদিন এলেন রচেস্টার শহরে। সেটা ১৯৬৪ সাল। রচেস্টার শহরে পড়তে আসার সুবাদেই জ্যোতির্বিজ্ঞান জগতে আলোড়ন ফেলা সাম্প্রতিকতম সেই চর্চার বিষয়ে অবগত হলেন মুরদিন। সিগনাস এক্স-১ বস্তুটা ঠিক কি জিনিস? কি রয়েছে মহাকাশের সেই ঘন অন্ধকার অঞ্চলে? জ্যোতির্বিজ্ঞান জগতে তখন জোর গুঞ্জন, ওটা কি তবে তথাকথিত ‘ব্ল্যাক হোল’?
ব্ল্যাক হোল?! ননসেন্স! বাস্তব জগতে ব্ল্যাক হোল বলে কোনও কিছুর অস্তিত্বই নেই। অস্তিত্ব থাকতে পারে না। এটা নেহাতই গণিতের একটা ফসল মাত্র। ‘ব্ল্যাক হোল’ হলো তাত্ত্বিক পদার্থবিদদের উর্বর মস্তিষ্ক প্রসূত এক কল্পনা বিলাস। এই কল্পনার না আছে কোনও বাস্তব ভিত্তি না আছে কোনও বাস্তব প্রমাণ। এমনটাই মনে করতেন সেই সময়ের অধিকাংশ বিজ্ঞানীরা। কেউ কেউ যদিও ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বের উপর ভরসা রাখতেন। তবে সেই সময়ে, ঈশ্বরে বিশ্বাস করার মতোই ব্ল্যাক হোলে বিশ্বাস করাও ছিল প্রমাণহীন একটা ধারণা মাত্র। বাস্তব জগতে কোথাও কোনও ব্ল্যাল হোলের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় নি তখনও পর্যন্ত। তাই ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান ছিলেন অধিকাংশ বিজ্ঞানীই। তাছাড়া ব্ল্যাক হোল তত্ত্বের প্রবক্তাদের মতে, ব্ল্যাক হোলের প্রবল মহাকর্ষের টানে তার আশেপাশের সমস্ত কিছুকেই শোষণ করে ফেলে। কোনও আলোক রশ্মিও নাকি সেই সর্বগ্রাসী আকর্ষণ থেকে পার পায় না। সিগনাস এক্স-১ যদি ব্ল্যাক হোলই হবে তাহলে সেখান থেকে এক্স-রে নির্গত হয় কি করে? ব্ল্যাক হোল থেকে তো কোনও আলো নির্গমন হতে পারে না। আর এই এক্স-রে নির্গমনই প্রমাণ করে, সিগনাস এক্স-১ কোনও ব্ল্যাক হোল হতে পারে না।
রচেস্টারে থাকাকালীন ‘সিগনাস এক্স-১ বনাম ব্ল্যাক হোল’ বিতর্ক সম্পর্কে অবগত হন মুরদিন। পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে পড়ার পাশাপাশি, মহাকাশ নিয়েও নিতান্তই উৎসাহী ছিলেন তিনি। ফলে সিগনাস এক্স-১ ও ব্ল্যাক হোল- দু’টো বিষয়েই সমান আগ্রহ আছে তাঁর। এই দুই বিষয়ে নিয়ে সাম্প্রতিকতম তত্ত্ব ও তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন তিনি। পাঠান্তে, ১৯৭০ সালে ইংলন্ডে প্রত্যাবর্তন করলেন মুরদিন, যোগ দিলেন গ্রিনিচ মানমন্দিরের কাজে। মুরদিন যখন ইংলন্ডে ফেরেন, সিগনাস এক্স-১ নিয়ে তখনও কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন নি কেউই। এই বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে গেলে যে আরও তথ্য প্রয়োজন তাঁদের। এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও নতুন তথ্যই এসে পৌঁছয় নি বিজ্ঞানীদের হাতে। তাই সিগনাস এক্স-১ নিয়ে নতুন কোনও ধারণাও তৈরি হয় নি। বিশ বাঁও জলেই পড়ে আছে সিগনাস। ইউএসএ থেকে ফিরে কাজে যোগ দেওয়ার পরই সিগনাস এক্স-১ নিয়ে গবেষণার কথা ভাবলেন মুরদিন। এই কাজে তাঁর সহযোগী হিসেবে পেলেন অস্ট্রেলিয় জ্যোতির্বিদ মিস্ বেটি লুইস ওয়েবস্টারকে (Betty Louise Webster)। ওয়েবস্টারকে সিগনাস এক্স-১-এর কথা জানালেন মুরদিন। জানালেন, সিগনাস এক্স-১-এর ব্ল্যাক হোল হওয়ার সম্ভাবনার কথাও। ব্ল্যাক হোলের কথা শুনে তো মুরদিনের উপর রেগে খাপ্পা ওয়েবস্টার। ‘ব্ল্যাক হোল? ওহ্ রাবিশ’- ঝাঁঝিয়ে ওঠেন ওয়েবস্টার। এই সব ফালতু বিষয় নিয়ে গবেষণা করে সময় নষ্ট করতে চান না তিনি। আসলে ওয়েবস্টারও যে প্রচলিত ঘরনায় বিশ্বাস রেখে মনে করেন ওসব ব্ল্যাক হোল টোল বলে কিছু নেই। মুরদিনের প্রস্তাবের প্রত্যুত্তরে ওয়েবস্টার জানান, ওসব ব্ল্যাক হোল টোল নয়, নক্ষত্র হিসেবে সিগনাস এক্স-১ কে পর্যবেক্ষণ করতে কোনও আপত্তি নেই তাঁর। ওয়েবস্টার প্রত্যুত্তরে আপাতভাবে খুশিই হলেন মুরদিন। ব্ল্যাক হোল হোক বা না হোক, সিগনাস এক্স-১ নিয়ে পর্যবেক্ষণ তো চালু করা যাবে।
ওয়েবস্টারের সাথে জুটি বেঁধে সিগনাস এক্স-১ নিয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহে ব্রতী হলেন মুরদিন। পাঁচ মাস ধরে এক নাগাড়ে পর্যবেক্ষণ করার পর মুরদিন নিশ্চিত হলেন বিশালাকায় নীল নক্ষত্র HDE 226868 আসলে হলো একটা বাইনারি স্টার (যমজ নক্ষত্র)। দু’টো নক্ষত্রের মধ্যে একটা- HDE 226868কেই শুধু দেখা যাচ্ছে। তার সহযোগী দোসর, সিগনাস এক্স-১কে দেখা যাচ্ছে না। সেটা কৃষ্ণকায়। আলোর ডপলার এফেক্টের সাহায্যে তাঁরা দেখালেন, প্রতি ৫.৬ দিনে পরস্পরকে আবর্তন করে চলেছে এই নক্ষত্রযুগল। আবর্তন করার পথে সিগনাস এক্স-১ যখন HDE 226868-এর পিছনে চলে যাচ্ছে তখন তার এক্স-রে ক্ষরণের মাত্রা হ্রাস পাচ্ছে। কিছু পরে যখন আবার HDE 226868-এর পিছন থেকে বেড়িয়ে আসছে সে, স্বাভাবিক মাত্রার এক্স-রে বিকিরিত হচ্ছে সিগনাস এক্স-১ থেকে। সব তথ্য একত্রিত করার পর মুরদিন নিশ্চিত হন যে সিগনাস এক্স-১ আসলে একটা ব্ল্যাক হোলই। কিন্তু ওয়েবস্টার পড়লেন দ্বিধায়। সিগনাস এক্স-১কে পুরোপুরি ব্ল্যাক হোল বলে মেনে নিতে এখনও দ্বিধাগ্রস্ত তিনি। তবু দুজনে মিলে লিখে ফেললেন তাঁদের পর্যবেক্ষণ ও ফলাফলের কথা। এই নিবন্ধ এখন জন সমক্ষে তুলে ধরতে চান মুরদিন। কিন্তু সেক্ষেত্রে সমস্যা হলো তাঁদের বস, অ্যাস্ট্রোনমার রয়াল, রিচার্ড উলি। তাঁর অনুমতি না পেলে, তাঁদের গবেষণার ফসল তো বাইরে কোথাও পাঠানো যাবে না। সমস্যা রয়েছে আরও। ব্ল্যাক হোল প্রশ্নে, সহযোগী ওয়েবস্টারের থেকে আরও এক কাঠি বেশি রক্ষণশীল তাঁদের বস উলি। ব্ল্যাক হোল প্রশ্নে এতোটাই ক্ষুব্ধ ছিলেন যে রাগের চোটে ব্ল্যাক হোল শব্দটাই উচ্চারণ করতেন না তিনি। উনি বলতেন ‘ব্ল্যাক বক্স’। এহেন উলির কাছে তাঁদের লেখা নিবন্ধটা পেশ করলেন মুরদিন-ওয়েবস্টার। সেই নিবন্ধ পড়ে তো রেগে কাঁই উলি। কি সব ফালতু বিষয় প্রতিপন্ন করতে উঠে পড়ে লেগেছে এরা, এ্যাঁ? শুধু শুধু ব্ল্যাক হোল নিয়ে সময় নষ্ট করছে এরা?! যাহোক, রেগে যাওয়া সত্ত্বেও মুরদিনের লেখাটা অবশ্য পুরোটাই পড়লেন তিনি। পড়ার পর মুরদিনের পর্যবেক্ষণকে কিন্তু আর অস্বীকার করতে পারছেন না। অকাট্য প্রমাণ হাজির করেছেন মুরদিন। ঠাণ্ডা মাথায় ভাবনা চিন্তা করার পর একটা রফা হলো। রফা হলো- ‘ব্ল্যাক হোল’ শব্দটা বাদ দিতে হবে নিবন্ধ থেকে। বাকি প্রতিপাদ্য নিয়ে কোনও আপত্তি নেই তাঁর। ছাপা যেতেই পারে তাঁদের গবেষণা লব্ধ ফলাফল। পরবর্তীকালে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এই প্রসঙ্গে মুরদিন বলেন, "The first persuasion job we had to do was our boss, … He thought black holes were very exotic things. He was sceptical about them right from the start, and was forever asking me why it was I really thought that Cygnus X-1 was a black box (this was what he used to it, not a black hole)”। বস উলি আর সহযোগী ওয়েবস্টারের চাপে নিবন্ধ থেকে শেষ পর্যন্ত বাদ দিতে হলো ব্ল্যাক হোল শব্দটা। তবে নিবন্ধের একেবারে শেষ লাইনের শেষ শব্দ যুগলে এসে, হাঁকালেন এক ছক্কা। লিখে দিলেন, "...it might be a black hole."
০৭ জানুয়ারি ১৯৭২, নেচার পত্রিকায় পত্র আকারে প্রকাশিত হয় মুরদিন-ওয়েবস্টারের নিবন্ধ Cygnus X-1— a Spectroscopic Binary with a Heavy Companion? নিবন্ধে তাঁরা লিখলেন “A blue super giant rotating synchronously in a binary system of period 5.6 days. … a sudden drop of in intensity of X-rays from Cyg X-1 as the beginning of an eclipse of one of two x-ray components in the source.” ব্যস, বেজে গেল দামামা। এতদিন ধরে ব্ল্যাক হোলের কথা বললেও হাতেনাতে কোনও প্রমাণ জোগাড় করে উঠতে পারেন নি ব্ল্যাক হোলের প্রবক্তরা। মুরদিনের নিবন্ধ যেন তাঁদের হাতে এক শক্তিশেল যুগিয়ে দিলেন। রয়েছে, আলবৎ রয়েছে ব্ল্যাক হোল। মুরদিনের গবেষণাই তার প্রমাণ।
রয়েছে? ব্ল্যাক হোল রয়েছে? তাই নাকি? বলে উঠেন সনাতনপন্থীরা। তা রয়েছেই যদি তবে ব্ল্যাক হোল থেকে এক্স-রে নির্গত হয় কি করে? সে তো নাকি সর্বগ্রাসী! সেই সর্বগ্রাসী হাঁ-মুখ থেকে এক্স-রে নির্গত হয় কি করে? মোক্ষম প্রশ্ন বটে সনাতনীদের। নাহ্, এ ব্যাপারে সত্যি কোনও জবাব মজুত নেই ব্ল্যাক হোলপন্থীদের হাতে। এদিকে উৎসাহী জনতা কিন্তু হৈহৈ করে মাথায় তুলে নিয়েছে মুরদিনের ব্ল্যাক হোলকে। তাঁরা যেন এমনই একটা ফলাফলের প্রতীক্ষাতেই ছিলেন। তাঁরা মেনে নিয়েছেন সিগনাস এক্স-১ আদতে একটা ব্ল্যাক হোলই। অগস্ট ১৯৭৭, সিগনাস এক্স-১-এর উন্মাদনায় ভেসে, দু’টো গান বেঁধে ফেললেন কানাডিয়ান রক ব্যান্ড ‘রাশ’ (Rush)। সেই দু’টো গানের প্রথম গানের কিয়দংশ এই রকম১-
নক্ষত্রমণ্ডল বক
ওৎ পাতা রহস্য, অদৃশ্য এক
কৃষ্ণ গহ্বর
সিগনাস এক্স-১
উত্তরে ছয় তারার গান
সহোদরার শোকে মুহ্যমান
মহিমা উজ্জ্বল শেষ ঝলকে
রাতের অনুকম্পা লুটায় পলকে
অদৃশ্য সে
দূরবীন কাঁচে
অসীম দূরে
মৃত্যুঞ্জয়ী বাঁচে
কে আছো সাহসী
পার হবে সেই গহ্বর
গিলে খাবে
এক শক্তি ভয়ঙ্কর
... ... ...
এক্স-রে তার সাইরেন গান
আমার জাহাজে অমোঘ টান
চলেছি সেই ঘাতক পানে
কৃষ্ণ গহ্বর যেখানে -
নিল সকল নিয়ন্ত্রণ ...
... ... ...
মুরদিনের পর্যবেক্ষণ থেকে এটা পরিষ্কার ছিল যে সিগনাস এক্স-১ এবং HDE 226868 হলো বাইনারি স্টার। টেলিস্কোপ আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে বাইনারি স্টারের সাথে পরিচয় ঘটে মানুষের। কিন্তু সেই নক্ষত্রযুগল সম্পর্কে তখনও পর্যন্ত বড় একটা স্পষ্ট ধারণা ছিল না বিজ্ঞানীদের। এখন আমরা জানি, ৩ ধরণের বাইনারি স্টার গঠিত হয় মহাকাশে। প্রথম ধরণের বাইনারি স্টার গঠিত হয় দু’টো দৃশ্যমান নক্ষত্র (Visual binaries) দিয়ে, দ্বিতীয় ধরণের বাইনারি স্টার গঠিত হয় দুটো ব্ল্যাক হোল (black hole binary) দিয়ে আর তৃতীয় ধরণের বাইনারি স্টার গঠিত হয় একটা দৃশ্যমান নক্ষত্র এবং আরেকটা ব্ল্যাক হোল (X-ray binaries) দিয়ে। প্রথম ক্ষেত্রে, দু’টো নক্ষত্রই টেলিস্কোপের সাহায্যে দেখা যায়। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, দু’টো নক্ষত্রের কোনটাই টেলিস্কোপ দিয়ে দেখা যায় না বা এক্স-রে ক্যামেরায় ধরা পড়ে না। কারণ, ব্ল্যাক হোল থেকে তো কোনও আলোক রশ্মি বা এক্স-রে নির্গতই হয় না। একমাত্র ‘গ্রাভিটেশানাল লেস্নিং’এর সাহায্যে এদের অস্তিত্ব ধরা পড়ে। কিন্তু ‘গ্রাভিটেশানাল লেস্নিং’ নিয়ে তখনও স্পষ্ট কোনও ধারণাই ছিল না বিজ্ঞানীদের। ফলে জোড়া ব্ল্যাক হোলের ধারণা তখনও অধরাই ছিল বিজ্ঞানীদের কাছে। কিন্তু তৃতীয় ক্ষেত্রে, একটা নক্ষত্রকে খালি চোখে বা টেলিস্কোপের সাহায্যে দেখা যায় এবং তার সঙ্গী ব্ল্যাক হোলকে টেলিস্কোপ দিয়ে দেখা না গেলেও, এক্স-রে ক্যামেরায় তার ছবি ধরা পড়ে। এক্ষেত্রে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠবে, কেন, তৃতীয় ক্ষেত্রের ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব এক্স-রে ক্যামেরায় ধরা পড়ে কেন, যখন জানা আছে যে, ব্ল্যাক হোল থেকে কোনও আলোক রশ্মি বা এক্স-রে নির্গতই হয় না? আসলে এই তৃতীয় ধরণের বাইনারি স্টার সিস্টেম সম্পর্কে অনেক পরে অবগত হন বিজ্ঞানীরা। আধুনিক ধারণা মোতাবেক, তৃতীয় ধরণের বাইনারি স্টার সিস্টেমের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান নক্ষত্র থেকে বিভিন্ন গ্যাস ও বিভিন্ন পদার্থের কণা শোষণ করতে থাকে তার দোসর ব্ল্যাক হোল। খাদ্য-খাদক সম্পর্কের মতো, ব্ল্যাক হোল হলো খাদক আর দৃশ্যমান নক্ষত্র হলো তার খাদ্য। ব্ল্যাক হোলের ফাঁদে পড়ে দৃশ্যমান নক্ষত্রের গ্যাস ও কণাসমূহ ধেয়ে যায় ব্ল্যাক হোলের দিকে। তবে ব্ল্যাক হোলের গহ্বরে প্রবেশ করার আগে ব্ল্যাক হোলের চারিদিকে চক্রাকারে পাক খেতে থাকে এই গ্যাস ও কণাগুলো। ১০ লক্ষ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের থেকেও অধিক উত্তপ্ত এই গ্যাসীয়মণ্ডল থেকে কোনও আলো বিকিরিত হয় না। এই গ্যাসীয়মণ্ডলকে তাই টেলিস্কোপ দিয়ে দেখা না। তবে উত্তপ্ত এই গ্যাসীয় বলয় থেকে এক্স-রে নিঃসরণ ঘটে, যা এক্স-রে ক্যামেরায় সহজেই ধরা পড়ে। আর ঠিক এই কারণেই সেদিন এরোবি-১৫০ রকেটে রাখা এক্স-রে ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল সিগনাস এক্স-১-এর এক্স-রে চিত্র। এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন, ব্ল্যাক হোলের চারিদিক থেকে যে এক্স-রে নির্গত হয় তা কিন্তু মোটেও ব্ল্যাক হোল থেকে নিঃসৃত এক্স-রে নয়। আদতে তা হলো ব্ল্যাক হোলের বাইরে অবস্থিত উত্তপ্ত গ্যাসীয় মণ্ডলের এক্স-রে। কিন্তু সেই সময়ে তৃতীয় ধরণের বাইনারি স্টার চরিত্রে, ব্ল্যাক হোলের চারিধারে উত্তপ্ত গ্যাস বলয়ের কথা জানা ছিল না কারও। ফলে ‘ব্ল্যাক হোল থেকে এক্স-রে নির্গত হয় কি করে?’ এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর সেদিন দিতে পারেন নি কেউই।
২৩ জুলাই ১৯৯৮, স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১১টায় ফ্লোরিডার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে স্পেস শাটল কলম্বিয়ার সাহায্যে পৃথিবীর কক্ষ পথে স্থাপন করা হয় ‘চন্দ্র এক্স-রে অবসারভেটরি’কে। ‘চন্দ্র’ মূলত একটা এক্স-রে টেলিস্কোপ। ইতিপূর্বে ব্যবহৃত যে কোনও এক্স-রে গ্রাহক যন্ত্রর থেকে ১০০ গুন অধিক সংবেদনশীল এই ‘চন্দ্র’ টেলিস্কোপটা। নোবেলজয়ী আমেরিকান-ভারতীয় পদার্থবিদ সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখরের নামাঙ্কিত এই এক্স-রে পর্যবেক্ষণাগারটা ভূপৃষ্ঠ থেকে ১,৩৯,০০০ কিমি উপরে স্থাপন করে নাসা। সেই উচ্চতা থেকে মহাকাশের আরও গভীরের বিস্ময়কর তথ্য সমূহ সংগ্রহ করতে থাকে ‘চন্দ্র’। সিগনাস এক্স-১ নিয়ে সাম্প্রতিকতম এক্স-রে চিত্রও পাঠতে থাকে সে। ‘চন্দ্র’র পাঠানো সেই সমস্ত চিত্র বিশ্লেষণ করার পর বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হন, সিগনাস এক্স-১ আসলে একটা ব্ল্যাক হোলই। ততদিনে অবশ্য হকিং আর থর্নের মতো অনেকেই ‘প্রায়’ নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যে সিগনাস এক্স-১ আদতে একটা ব্ল্যাক হোলই। ‘চন্দ্র’র পাঠানো তথ্য তাঁদের সেই ‘৫%’ ফাঁকটার উপর বহু আকাঙ্ক্ষিত ‘১০০%’-এর শিলমোহর লাগিয়ে দিল। ‘চন্দ্র’র লাগানো এই শিলমোহরের সাথে সাথে যবনিকা পড়ল দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা সিগনাস এক্স-১ বিতর্কের। অবসান হয় হকিং-থর্ন বিতর্কেরও। হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত হার মানলেন হকিং। কিন্তু এই হারের মধ্যে দিয়ে এক বৃহত্তর জয় প্রতিষ্ঠা করলেন তিনি। তিনি নিজেই তো ব্ল্যাক হোল তত্ত্বের অন্যতম প্রবক্তা। তাই এটা তাঁর হার নয় বরং এটা তাঁর জয়। বাজি হেরে নিজের তত্ত্বকেই সঠিক প্রমাণ করলেন হকিং। আর বাজি হেরে যে বাজি জেতে তাকেই তো ‘বাজিগর’ বলে।