অন্যায় কি হল না সুদর্শনের সাথে? অধিকাংশ তথ্যাভিজ্ঞ মহলই মনে করেন, হ্যাঁ, অন্যায় হয়েছে সুদর্শনের সাথে। একবার নয়, একাধিকবার। সুদর্শনের আবিষ্কৃত তত্ত্বের উপর কাজ করে অন্য বিজ্ঞানীরা নোবেল লাভ করলেও সুদর্শন রয়ে গিয়েছেন প্রদীপের নীচের অন্ধকারেই। সত্যি, এ বড়ো বেদনার। এ এক দুঃসহ ট্র্যাজেডি।
কর্মজীবনের সূচনায়, V-A তত্ত্ব তরুণ সুদর্শনের স্বপ্নভঙ্গের কারণ হলেও তা কখনোই তাঁর পরবর্তী জীবনে স্বপ্ন দেখাকে ঠেকাতে পারেনি। সুদর্শন ছিলেন এক স্বপ্ন-সন্ধানী, অক্লান্ত গবেষক। সহযোগী গবেষকদের সাথে যৌথভাবে সারা জীবনে ৫১০টা গবেষণাপত্র লিখেছেন তিনি (যার মধ্যে ৯টা স্ত্রী অধ্যাপিকা ভামথির সাথে)। এখনও ৬৫টা গবেষণাপত্র অপ্রকাশিত রয়েছে তাঁর। পদার্থবিজ্ঞানের উপর ৯টা পাঠ্যবই লিখেছেন সুদর্শন। সুদর্শন-অনুরাগী ছাত্রমহলের মতে, এই বিপুল গবেষণা পত্রের মধ্যে অন্ততপক্ষে ৭টা এমন গবেষণা পত্র আছে যার মধ্যে যে-কোনো একটার জন্য নোবেল সম্মানে ভূষিত হতে পারতেন সুদর্শন। দুঃখজনক ভাবে প্রতিবারই সেই সম্মান থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তিনি। সুদর্শনের এমনই এক নোবেল বঞ্চনার ইতিকথা—‘কোয়ান্টাম অপটিক্স’।
৬০-এর দশকের শুরুতে আলোর সংবদ্ধতা (কোহেরেন্স) ধর্মকে কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রয়োগে বিশ্লেষণ করতে শুরু করেন সুদর্শন। ইতিপূর্বে আলোকে এই ভাবে বিশ্লেষণ করেননি কেউই। সে অর্থে সুদর্শনই এই ধারার পথিকৃৎ। পদার্থবিজ্ঞানে সংযোজিত হল নতুন এক অধ্যায়—কোয়ান্টাম অপটিক্স। এই তত্ত্ব দিয়ে সদ্য আবিষ্কৃত লেসার রশ্মিকে চমৎকার ভাবে ব্যাখ্যা করা গেল। তাত্ত্বিক ভিত্তি পেল লেসার রশ্মি।
১৯৬৩ সালে কোয়ান্টাম অপটিক্স নিয়ে গবেষণার কাজ শেষ করেন সুদর্শন। পরিসংখ্যানবিদ্যার প্রয়োগে তাঁর তত্ত্বকে ব্যাখ্যা করলেন তিনি। তাঁর ব্যাখ্যা করার পদ্ধতিকে ‘ডায়াগনাল রিপ্রেজেন্টেশন’ বলে উল্লেখ করলেন সুদর্শন। এই পত্রের প্রাক্মুদ্রণ পাণ্ডুলিপির প্রতিলিপি পাঠান হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ রয় জে গ্লবারের কাছে। বর্তমানে একই রকমের গবেষণায় নিরত আছেন গ্লবার নিজেও। গ্লবারের সুচিন্তিত মতামতের আশায় তাঁর কাছে এই পত্র প্রেরণ করেন সুদর্শন। সুদর্শনের পত্র মোটেও পছন্দ হল না গ্লবারের। সুদর্শনের তত্ত্বকে সমালোচনা করলেন গ্লবার। গ্লবারের সমালোচনায় বিস্মিত হলেন সুদর্শন। কারণ, নিজের লেখায় কোনো ভুল খুঁজে পেলেন না তিনি। ১ এপ্রিল ১৯৬৩, সুদর্শনের লেখা ‘ইকুইভ্যালেন্স অব সেমিক্ল্যাসিকাল অ্যান্ড কোয়ান্টাম মেকানিক্যাল ডেসক্রিপশনস্ অব স্ট্যাটিসটিক্যাল লাইট বিমস্’ শীর্ষক ৩ পাতার রচনা প্রকাশিত হয় ফিজিক্যাল রিভিউতে। পরবর্তী কালে এই বিষয়ের উপর আরও ৬টা পেপার লেখেন তিনি।
১৫ জুন ১৯৬৩, ফিজিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত হয় গ্লবারের গবেষণাপত্র ‘দ্য কোয়ান্টাম থিয়োরি অব অপ্টিক্যাল কোহেরেন্স’। প্রায় সুদর্শনের তত্ত্বই ব্যাখ্যা করেছেন গ্লবার। শুধু সুদর্শনের ‘ডায়াগনাল রিপ্রেজেন্টেশন’-কে গ্লবার নাম দিয়েছেন ‘পি রিপ্রেজেন্টেশন’। গ্লবার ও সুদর্শনের লেখা দুটোর মধ্যে সুদর্শনের পত্রটাই অধিক সুসংহত বলে মনে করলেন বিশেষজ্ঞমহল।
এরপর কেটে গেছে ৪০টা বছর। আলোর কোহেরেন্সের কোয়ান্টাম তত্ত্ব এখন ‘গ্লবার-সুদর্শন পি রিপ্রেজেন্টেশন’ নামে পরিচিত। ৪ অক্টোবর ২০০৫, নোবেল কমিটি ঘোষণা করে, ‘আলোর কোহেরেন্সকে কোয়ান্টাম তত্ত্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করার জন্য’ রয় জে গ্লবারকে নোবেল সম্মানে ভূষিত করা হল। পুরস্কার মূল্যের ১/২ অংশ পাবেন গ্লবার। লেসার নির্ভর স্পেক্ট্রোস্কপির জন্য জন লুইস এবং থিওডর উলফগ্যাং হাঞ্চ উভয়ই পুরস্কার মূল্যের ১/৪ অংশীদার হবেন। বাদ পড়লেন সুদর্শন।
ফের অন্যায় হল সুদর্শনের সাথে। বিস্মিত পদার্থবিজ্ঞান মহল। সুদর্শন নোবেল না পাওয়ায় ক্ষুব্ধ হলেন অনেকেই। স্থির হল প্রতিবাদপত্র পাঠানো হবে নোবেল কমিটিকে। সেই মতো লেখা হল এক চিঠি। চিঠিতে লেখা হল, “আমরা সবিনয়ে জানাতে চাই... সুদর্শনের আলোর কোয়ান্টাম তত্ত্বের মৌলিক অবদানের প্রতি উদাসীন থেকে ন্যায়ের জন্ম দিতে ব্যর্থ হয়েছে” কমিটি। ১০ জন (মূলত ভারতীয়) পদার্থবিদের সই সম্বলিত এই পত্র পাঠানো হয় নোবেল দফতরে। প্রতিবাদ জানিয়ে নোবেল দফতরে পত্র লেখেন সুদর্শনও। লিখলেন, “এই বছরের ঘোষণায় আমি প্রকৃত অর্থেই বিস্মিত এবং হতাশ।”
* * *
সুদর্শন-ঘনিষ্ঠ ছাত্রমহলের মতে, ‘নোবেল অর নো নোবেল’ দিয়ে কখনও বিদ্যাকে বিচার করেননি সুদর্শন। তিনি ছিলেন একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত। তাঁর ছাত্রমহল মনে করেন, শুধুমাত্র V-A বা কোয়ান্টাম অপটিক্সের মধ্যেই তাঁর গভীর মনীষার বিচ্ছুরণ ঘটেছে এমন নয়, তাঁর প্রস্তাবিত আরও অনেক তত্ত্বের মধ্যেই তাঁর গভীর পাণ্ডিত্যের পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁর অনেকগুলো তত্ত্বই কালোত্তীর্ণ, কালজয়ী। তাঁর এমনই এক বিস্ময়কর তত্ত্ব হল—সুপারলুমিনাল ‘ট্যাকিয়ন’ কণা।
আইনস্টাইনের মতে, ভরযুক্ত কোনো বস্তুর পক্ষে, আলোর বেগের থেকে বেশি বেগ লাভ করা সম্ভব নয়। কারণ, সেক্ষেত্রে বস্তুর ভর শূন্যে অথবা কাল্পনিক রাশিতে পর্যবসিত হয়ে যাবে। সুদর্শন বললেন, আলো যখন সৃষ্টি হয়, তখনই সে একটা নির্দিষ্ট বেগে যাত্রা শুরু করে। এ কথা ঠিক যে আলোর থেকে কম গতিসম্পন্ন ও ত্বরণযুক্ত কোনো বস্তুর পক্ষে আলোর বেগ লাভ করা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রকৃতিতে এমন কণার অস্তিত্ব অসম্ভব নয় যা জন্ম থেকেই আলোর থেকে বেশি বেগে ধাবমান। এই জাতীয় কণার ক্ষেত্রে আলোর সর্বোচ্চ গতিসীমা অতিক্রমের প্রশ্নই উঠে না কারণ এই কণাগুলো জন্ম থেকেই আলোর থেকে বেশি বেগে ধাবমান। গণিত প্রয়োগে সুদর্শন দেখালেন, সেক্ষেত্রে এই জাতীয় কণার ভর হবে কাল্পনিক।
১৯৬০ সালে ছাত্র ভি কে দেশপান্ডের সাথে যৌথ ভাবে এই বিষয়ে গবেষণাপত্র লিখলেন সুদর্শন। এই পত্র তাঁরা পাঠালেন ফিজিক্যাল রিভিউ দফতরে। পত্রিকার তরফে তিনজন বিচারকই, সুদর্শনের প্রস্তাবিত তত্ত্বকে খারিজ করে ফেরত পাঠিয়ে দেন পত্রটা।
মে ১৯৬২, সুদর্শনের সহকর্মী ও এম পি বিলানিউক ‘আলোর থেকে দ্রুতগামী কণা’ বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেন। সুদর্শনকে তাঁর পুরোনো রচনা পরিমার্জনের কথা বলেন তিনি। তাঁরা তিনজনে মিলে একই বিষয়ের উপর নতুন এক নিবন্ধ রচনা করলেন। এবার আর ফিজিক্যাল রিভিউ নয়, এবার ‘আমেরিকান জার্নাল অব ফিজিক্স’-এ পাঠালেন তাঁদের লেখা নতুন নিবন্ধটা। অক্টোবর ১৯৬২, আমেরিকান জার্নাল অব ফিজিক্সে প্রকাশিত হল বিলানিউক-দেশপান্ডে-সুদর্শনের ৬ পাতার গবেষণাপত্র ‘মেটা রিলেটিভিটি’। এই রচনা প্রকাশের পর পাঠকমহলে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। আলোর থেকে বেশি গতিসম্পন্ন কণার প্রস্তাবে বিতর্ক ও মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় বিজ্ঞানমহলে। আলোর থেকে অধিক বেগে গতিশীল কণার অস্তিত্ব নিয়ে সেই বিতর্ক আজও জিইয়ে রয়েছে।
সুদর্শনের নিবন্ধ প্রকাশের পর ৫টা বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেল। আলোর থেকে অধিক বেগে গতিশীল কণার অস্তিত্ব নিয়ে অনেকেই আগ্রহ প্রকাশ করছেন তখন। ২৫ জুলাই ১৯৬৭, ফিজিক্যাল রিভিউতে প্রকাশিত হয় পদার্থবিদ জেরাল্ড ফাইনবার্গের নিবন্ধ ‘পসিবিলিটি অব ফাস্টার-দ্যন-লাইট পারটিকেলস্’। এই নিবন্ধে ‘ফাস্টার-দ্যন-লাইট পারটিকেলস্’-কে ‘ট্যাকিয়ন’ নামে অভিহিত করেন তিনি। এরপর থেকে সুদর্শনের প্রস্তাবিত ‘আলোর থেকে বেশি বেগে ধাবমান কণা’ ট্যাকিয়ন নামে পরচিত হয়ে উঠে। ট্যাকিয়ন হয়ে ওঠে পদার্থবিদদের নতুন চিন্তার খোরাক। ট্যাকিয়নের অস্তিত্ব নিয়ে আজও বিতর্ক বিদ্যমান। ট্যাকিয়নের ভর যহেতু কাল্পনিক তাই এই কণার অস্তিত্ব নিয়ে অনেকেই সন্দিহান। অনেকেই আবার বলছেন এই কণার ভর মাপার জন্য আমাদের প্রচলিত পরিমাপ পদ্ধতি ও চিন্তাপদ্ধতি যথেষ্ট নয়। তাই এই কণার সন্ধানে এখনও নিরলস প্রচেষ্টা জারি রেখেছেন কেউ কেউ। তাঁদের মতে, আগামী দিনে, অনন্ত মহাবিশ্বের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যোগাযোগের একমাত্র ভরসা হল ট্যাকিয়ন। ট্যাকিয়ন নিয়ে নিজের চিন্তাকে আরও বিস্তৃত করে চললেন সুদর্শন। ট্যাকিয়ন নিয়ে ইতিমধ্যেই মোট ১১টা গবেষণাপত্র লিখে ফেলেছেন সুদর্শন। ট্যাকিয়ন কণার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়নি বলে, ট্যাকিয়ন নিয়ে নোবেল পুরস্কার পাননি কেউই। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে পদার্থবিজ্ঞান পরিমণ্ডলে আগামী দিনের নতুন দিশা দেখাবে ট্যাকিয়ন। আর সেই নতুন দিশার দিশারি হলেন সুদর্শন।
* * *
সুদর্শনের গবেষণার বিষয়বস্তুগুলো ছিল যেমন আকর্ষণীয় তেমনই উচ্চমানের। তাঁর গবেষণাগুলো আজও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক। কোনো সন্দেহ নেই, নোবেল না পেলেও, পৃথিবীর প্রথম সারির পদার্থবিদের সাথে এক পঙ্ক্তিতে আসন পাবেন সুদর্শন। পশ্চিম দুনিয়ায় রামানুজন, রমন, বোস (সত্যেন্দ্রনাথ), চন্দ্রশেখরের সাথ এক নিশ্বাসে উচ্চারিত হয় তাঁর নামও। অথচ জন্মভূমি ভারতবর্ষে তাঁর মলিন উপস্থিতি মনটাকে বিষণ্ণ করে তোলে।
সহস্রলোচন শর্মা
এর পর জয়ন্ত বিষ্ণু নার্লিকর নিয়ে এরকম একটি হবে নাকি? বা ফ্রেড হয়েল + জে ভি নার্লিকর?
রঞ্জন রায়
সুন্দর প্রস্তাব। তবে আমি প্রস্তুত নই। সুযোগ পেলে প্রস্তুতি নেবো।
ওকে। লেখা খুব ভালো লেগেছে।
সায়েন্সের লেখায় আরও টেকনিক্যাল ডিটেল চাইছি। ফিজিক্সের ক্ষেত্রে কিছুটা ম্যাথ। টার্গেট অডিয়েন্সের ক্লাস টুয়েল্ভ অব্দি বিজ্ঞানের ব্যাকগ্রাউন্ড আছে ধরে লিখলে ভালো লাগবে।
সায়ন্তন চৌধুরী, রচনাটা পড়া ও মন্তব্য করার জন্য কৃতজ্ঞ রইলাম। আপনার মতামত সাদরে গ্রহণ করলাম। তবে আলোচ্য আক্সিয়াল ভেক্টর, টেনসার ইত্যাদি দ্বাদশ শ্রেণীর পাঠ্য নয়।