"অভয়া " কান্ডের এক বছর হয়ে গেল। বিচার ব্যবস্থা জনপ্রিয় হিন্দি ছবির সংলাপের "তারিখ পে তারিখ" ই হয়ে যাচ্ছে। অভয়া তাঁর কর্মস্থলে নির্যাতিতা ও খুন হয়ে ছিলেন। অত্যন্ত জঘন্য ও ঘৃণ্য ব্যাপার। যদিও বর্তমানের বাঙালি মেয়েদের অবস্থা এর থেকে কি খুব আলাদা কিছু? আমি মূলত: শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিতা চাকরি - বাকরি করা মেয়েদের নিয়েই আলোচনা করব। "বিন্দু তে সিন্ধু দর্শন" বলে একটি বাংলা প্রবাদ আছে, সেই জন্য কোনও একজনের জীবন উন্মোচিত করলে সব মেয়েদেরই প্রকৃত আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির আভাস পাওয়া যাবে। অনিচ্ছাকৃত মিলের জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। বেশ কয়েকটি পর্ব লাগবে।
এবার আসা যাক তাঁর প্রেমিক(?) তথা হবু স্বামীর কথায়। ধরা যাক তার নাম সুভাষ। সে চার ভাই - বোনের মধ্যে সবার ছোট। সে কখনও তার বাবাকে দেখেনি, কারণ তিনি তার অনেক ছোটবেলাতেই তাদের ছেড়ে অন্য এক মহিলার সঙ্গে থাকেন এবং তার একটি কন্যা সন্তান ও আছে। এই পরিবারের সর্বময় কর্তা থুড়ি কর্তী তার সবচেয়ে বড় দিদি। যিনি চাকরি করে খুব অল্প বয়সেই সংসারের ভার নিজের হাতে তুলে নেন। তিনি শেষ পর্যন্ত বিয়ে থাওয়াও করেননি। মা হচ্ছেন বাড়ির যাবতীয় কাজ যেমন ঘর মোছা, রান্না করা, মায় বিছানা টাঙানো সবই করেন কারও সাহায্য ছাড়াই করে চলেন বছরের পর বছর অর্থাৎ perfect Domestic help। দিদি যখন অফিস যাবেন তখন তৈরী করা গরম গরম খাবার চাই, বোন ও দাদা এর স্কুলে যাওয়ার মোজা থেকে প্রাকটিক্যাল খাতা পর্যন্ত হাতের কাছে চাই। সুভাষ ছোটবেলা থেকে দেখে তার মনে মায়ের প্রতি সহানুভূতি তো দূর বরং এক ধরনের Business as usual মনে হয়েছে। এসবের মধ্যে দাদা পাস করে চাকরি পায়। তার উপরের দিদিও শিক্ষিকার চাকরিতে যোগ দেন। দাদা কিছু দিন পর বিয়ে করে ওই শহরেই শ্বশুরবাড়ির কাছে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে আলাদা হয়ে যায়। ছোড়দি ও বিয়ে করে অন্য শহরে স্বামীর সাথে seattle করে। সুভাষ কোনও রকমে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক টপকায় ও pass course এ বি. এ. পাস করে। এবার তো রোজগার চাই। বন্ধু বান্ধব ওই মানেরই জুটলো কয়েকজন ব্যতিক্রম ছাড়া। প্রথমে কিছুদিন প্রাইভেট টিউশনের চেষ্টা, যদিও তা বিফলে গেল। এবার শুরু হলো পার্টনারশিপে Disc এর ব্যবসা, সবে কম্পিউটার ঢুকছে। বিভিন্ন অফিসে সাপ্লাই করে যদি দাঁড়ানো যায়! কিন্তু যে কোনো ব্যবসায় সফল হতে গেলে চাই অধ্যাবসায় ও পরিশ্রম, এই দুইটি তার মন মানসিকতায় ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে বেশ কয়েকবার মদ্যপান। কথায় বলে " মদের টাকা ভূতে জোগায়"। হলোও তাই। মাঝে আঁতেল হবার একান্ত বাসনায় কখনও ডকুমেন্টারি ফিল্ম কখনও কবিতা লেখা র চেষ্টা, কিন্তু সবই ব্যর্থ হল। একমাত্র রয়ে গেল ভিতরে ভিতরে কিছুই না পাওয়ার ক্ষোভ আর তা থেকে জন্ম নিল রাগ ও প্রতিহিংসা। তার এই চরিত্র সে যার কাছ থেকেই লুকিয়ে রাখুক না কেন বড় দিদি ঠিকই জানতেন। সেই জন্য তিনি সুভাষের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিলেন। যদিও তিনি কর্তব্যের প্রতি অবিচল ছিলেন, ভাইয়ের পড়াশুনার খরচ, হাত খরচ, ব্যবসার প্রাথমিক পুঁজির যোগান মায় জনে জনে বলে ভাইয়ের জন্য একটি উপযুক্ত চাকরির সন্ধান সবই করেছেন। কিন্ত তার কোনও চেষ্টাই সাফল্যের মুখ দেখেনি। এদিকে বয়স ও বেড়ে চলল সুভাষের আর পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলল মদ্যপান। তাই নিয়ে দিদি আর ভাই এর মধ্যে নিত্য ঝগড়া যা বস্তি বাড়ীকেও হার মানায়।
এরকমই এক সময় ফুলকি তার জীবনে এলো। এতবড় লটারি তো হাতছাড়া করা যায় না!! অতএব সে লম্বা পরিকল্পনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তার বন্ধুরা তাকে পরামর্শ দিল, ফুলকি ভদ্র ঘরের মেয়ে সে যেখান সেখানে যেতে পারবে না! যদি একবার তুই শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারিস তাহলে কেল্লা ফতে!!! ১১ -১২ ক্লাসে পড়া কোনও ধারণাই ছিল না এ সম্পর্কে। তাঁর কাছে প্রেম মানে ঘুরতে যাওয়া, অহেতুক বক বক করা অথবা সামনের কোনও বিয়ে বা অন্য কোন অনুষ্ঠান বাড়িতে কি পড়বে তাই ঠিক করার ব্যাপারে ওর মতামত নেওয়া ইত্যাদি। যদিও সুভাষের পরামর্শ ফুলকির কোনও দিনই খুব একটা পছন্দ হতো না। তাও তাঁর তাকে এসব বলতে ভাল লাগতো। একদিন তাদের বাড়ি দেখাবার অছিলায় সুভাষ ফুলকিকে দুপুরবেলায় তাদের বাড়ি নিয়ে হাজির হলো। ফুলকি প্রথম অবাক হলো মার সামনে ছেলেকে বিড়ি খেতে দেখে। নূন্যতম সন্মান টুকুও নেই। ফুলকি একে প্রগতিশীল ব্যাপার বলেই ভাবলো। মা ও ততোধিক অবাক করা ব্যক্তিত্ব, অল্প কিছু কথার পরই তিনি পাশের ঘরে চলে গেলেন। আবার ফুলকি সেই প্রগতিশীলতার উদাহরণ হিসেবে ভাবলো। আবার ভাবলো সকাল থেকে হাড় ভাঙা খাটুনির পর হয়তো বিশ্রাম নিতেই গেছেন। ফুলকির আরও অবাক হওয়ার বাকি ছিল.... যখন সে দেখলো টেবিলে একটি পাত্রে উঁচু করা ভাত ও মাঝখানে গুলি খেলার পিলের মতো একটা গর্ত যার মধ্যে একটি ঝোলের তরকারি!!! এই একটি মাত্র তরকারি দিয়ে এত ভাত খাওয়া সম্ভব?? মা পাশের ঘরে চলে যেতেই সুভাষ ফুলকির সাথে ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করলো। কিছুটা সময় পরে ফুলকি তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে বলল "অনেক দেরী হয়ে গেছে তুমি এবার খেয়ে নাও, আমি চললাম"। সুভাষের কাজ হাসিল, সে নিজের ছাপ রাখতে পেরেছে। যদিও পরে ফুলকি বুঝেছিল যে ঠিক sex বলতে যা বোঝায় তা তাদের মধ্যে সেদিন হয়নি, যদিও সেটা অনেক পরে।
বাবার হাফুস নয়নে কান্না ফুলকিকে নতুন করে বাবাকে আবিষ্কার করতে বাধ্য করলো। বাবার পছন্দ গুলো কে রাতে শুয়ে মনে করতে লাগলো। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের অনেক খানি জায়গা দখল করে আছেন। যদিও সে বিজ্ঞানের ছাত্রী তাও। এই রবীন্দ্রনাথের প্রেম তাঁর শুরু হয়েছিল বাবার হাত ধরে। যেদিন বাবা ক্লাস এইটের ফল প্রকাশ এর পর নিয়ে গেছিলেন জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি তে। একটা কথা বার বার তাঁর মনে হয়েছিল যে সবাই রবীন্দ্রনাথকে বৃদ্ধ বয়সে এর ছবিই দেখায় কেন? অথচ যুবক রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত সুপুরুষ তাঁর চোখ দুটি যেন কথা বলে।বাবার বুকশেলফ ভর্তি নানান বই। একবার গ্রীষ্মের ছুটিতে পিছনের সারি থেকে বের করে "কামসুত্র" পড়ে ফেলল সে। আর যায় কোথায় বাবার সেকি মেজাজ, দাদু তখনও বেঁচে। পরিত্রাতা হিসেবে হাজির হলেন। পরে বললেন "অবশ্যই পড়বে তবে এখন নয়, আরও বেশ একটু বড় হও তারপর"। বাবার খুব পছন্দ ছিল শাড়ি। দারুন দারুন সব শাড়ি কিনে দিতেন মা কে, কিন্তু মা কচিত ভবিষ্যৎ সেই সব পড়তেন। সে সব সময় ভাবতো কবে বড় হবো আর ওই অসম্ভব সুন্দর শাড়ি গুলো পরবো। তবে বাবা যে মা কে মারে, অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে? তাঁর মনে পরে গেল একটা কথা.....বাবা মায়ের জন্য এক বিখ্যাত জুতো কোম্পানির থেকে বেশ দামী সামান্য হিল তোলা একটা জুতো কিনে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু মা হিল তোলা জুতো পড়েন না! অনেক ঝগড়া হলো কিন্ত এক রোখা মা কিছুতেই সেই জুতো পড়লেন না। আর বাবাও সেটা ফিরত দিলেন না। তাঁর কলেজে পড়া পরিণত মন বলল " মা ই বাবার সেন্টিমেন্টর যথাযথ সম্মান করেননি"। সঙ্গে সঙ্গে এও মনে এলো আমার ভবিষ্যত বিবাহিত জীবনে কি হবে? যদি এরকম অশান্তি হয়? যাইহোক না কেন আমি বাপের বাড়ি ফিরে আসবো না। নিজের ব্যবহার দিয়ে মানিয়ে নেব। এই পরিণত চিন্তা বাবার সঙ্গে মেয়ের দুরত্ব ঘোচাতে শুরু করলো। মায়ের করা খাবার পছন্দ না হলে ভাত ফেলে অফিসে যাওয়া একটা রেওয়াজ হয়ে গেছিল। আর অফিস থেকে ফিরতেন অগ্নিশর্মা হয়ে। ফুলকি বাবার পছন্দের খাবার বানাতে শুরু করলো। মা ও খানিকটা বিশ্রাম পেল বাবার রাগ পড়লো। ইতিমধ্যে সে কলেজ জীবন শেষ করে ইউনিভার্সিটিতে এসে পড়লো। এতদিন কল্পনায় যা দেখেছে তা এখন বাস্তব। উঁচু উঁচু খিলান... সব স্যুট অথবা ধুতি পাঞ্জাবি পরা অধ্যাপক আর অধাপিকারা তো অপ্সরী যাঁরা রূপে গুণে অতুলনীয়া। বেশ চলছিল বন্ধুদের সঙ্গে খলখল করে সার বেঁধে সিনেমা থিয়েটার দেখতে যাওয়া বা বিখ্যাত রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া, কোনও কারণ ছাড়াই ক্লাস ফাঁকি দিয়ে গড়ের মাঠে গোল হয়ে বসে antakshari খেলা। একদিন ছন্দ পতন হলো। ক্লাসে বসেই সে দেখলো করিডোরে সুভাষ। রাগে গা জ্বলে গেল। ক্লাস শেষ হতেই সে সুভাষকে জিজ্ঞাসা করল এখানে উপস্থিতির কারণ। সুভাষ বললো "এমনিই"। ফুলকির উত্তরটি পছন্দ হলো না। একটু চাপাচাপি করতেই ঝুলি থেকে বিড়াল বেড়িয়ে এলো "দেখছিলাম ইউনিভার্সিটি তে এসে নতুন কাউকে পাকড়ালে কিনা"। লজ্জায় অপমানে সে লাল হয়ে গেল। ছিঃ ছিঃ এরকম একটি মানুষকে সে তাঁর জীবন সঙ্গী বেছেছে। মনটা বিষিয়ে গেল। বাবার চোখ এড়ালো না "কি হয়েছে মা?" বাবা কোনও দিন তাঁকে মা ছাড়া ডাকেননি। কোনও রকমে জবাব দিয়ে সে নিজের ঘরে ছুটলো। এরপর শুরু হলো আর এক মানসিক অত্যাচার! রোজ সে যে ট্রেন এ বন্ধুদের সঙ্গে ইউনিভার্সিটি যায় ঠিক সেই ট্রেন এ সেই কম্পার্টমেন্টে সুভাষ। তারপর সারাদিন ইউনিভার্সিটির একোনো ওকোন করে ফেরার সময় আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। ফুলকির অতিষ্ঠ লাগত। ক্লাসের বান্ধবীরা বলতো " ভাগ্য করে সুভাসদার মতো ছেলে পেয়েছিস, নিজের কাজ ফেলেও সারাদিন শুধু তোর সঙ্গেই কাটায়"। ফুলকির কিন্তু দম বন্ধ হয়ে আসতো। কিন্তু কিই বা করার আছে? ফাইনাল পরীক্ষা দেবার পর তাঁর উপর পড়ল এক বাজ! সুভাষ এসে বলল " এতদিন পড়াশুনার জন্য বলিনি,এবার registry করবে চল। আমি কাগজপত্র সব রেডি করে ফেলেছি তোমার দাদা ( সেই পল সায়েন্স এর কোচিং এর শিক্ষক) সাক্ষী সাবুদ জোগাড় করে এনেছে। মাত্র ৫ মিনিটের ব্যাপার।" ফুলকির বুকে রেজাল্ট বের হবার আগে মতো চাপ যা গলার দিকে উঠে আসছে। Registry Office এ ঢোকার আগে সেই দাদাকে বলল " এসব করতেই হবে? এখন না করলে নয়?" দাদার উত্তর " সেই দুপুরে তুই ওর সাথে ঘনিষ্ট হয়েছিলি না? এখন তোর সই করা ছাড়া কোন উপায় নেই।" সে এমনিতেই একটু বেশি ঘামতো কিন্তু এই উত্তর শুনে যেন স্নান করে গেল। কাপা কাপা হাতে সই করে এল। বাড়ি ফিরে অঝোরে কাঁদলো। সারারাত ঘুমালো না। চোখের তলায় কালি। বাবা জিজ্ঞাসা করেন মা জিজ্ঞাসা করেন, কি বলবে সে? একমাত্র টুম্পাকে সে সব বলে, সে তাঁকে আশ্বস্ত করে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ক্রমশ:
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।