"অভয়া " কান্ডের এক বছর হয়ে গেল। বিচার ব্যবস্থা জনপ্রিয় হিন্দি ছবির সংলাপের "তারিখ পে তারিখ" ই হয়ে যাচ্ছে। অভয়া তাঁর কর্মস্থলে নির্যাতিতা ও খুন হয়ে ছিলেন। অত্যন্ত জঘন্য ও ঘৃণ্য ব্যাপার। যদিও বর্তমানের বাঙালি মেয়েদের অবস্থা এর থেকে কি খুব আলাদা কিছু? আমি মূলত: শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিতা চাকরি - বাকরি করা মেয়েদের নিয়েই আলোচনা করব। "বিন্দু তে সিন্ধু দর্শন" বলে একটি বাংলা প্রবাদ আছে, সেই জন্য কোনও একজনের জীবন উন্মোচিত করলে সব মেয়েদেরই প্রকৃত আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির আভাস পাওয়া যাবে। অনিচ্ছাকৃত মিলের জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। বেশ কয়েকটি পর্ব লাগবে।
বাবাকে না জানিয়ে এতবড় সিদ্ধান্ত নিয়ে বেশ উদ্বেগের মধ্যে পড়ে গেল ফুলকি। সে ছিল উদার মনের এক মেয়ে। কোনও কাজ করার আগে তার অগ্র - পশ্চাৎ বিবেচনা করতো না। নিজের জীবনের ব্যাপারেও খুব একটা সিরিয়াস ছিল না সে। বেশ স্বচ্ছলতার মধ্যেই সে মানুষ হয়েছিল সেটাও একটা কারণ হতে পারে। এমনকি নিজের সৌন্দর্যের ব্যাপারেও সে মোটেই সচেতন ছিল না। মায়ের তৈরী করে দেওয়া দই - ব্যসন - চালের গুঁড়োর একটা প্যাক সপ্তাহে দিন দুই ব্যবহার করা, রূপচর্চা বলতে এই। চুলের যত্ন নিতে সে আরও উদাসীন, সবার কাছে আকর্ষণীয় ও ঈর্ষণীয় হলেও তাঁর কাছে মাথা ভর্তি কোকড়ানো লম্বা চুল বিরক্তির কারণ হয়েই ছিল। কোনও বিষয়েই গভীর চিন্তা করা তাঁর ধাতে ছিল না। কিন্ত সে খুব ধর্ম ভীরু ছিল। সমস্ত উপোস, শুক্রবার টক না খাওয়া, সরস্বতী পুজোর আগে কুল না খাওয়া, অষ্টমীর অঞ্জলি না দিয়ে জলস্পর্শ না করা যদিও এসবের মূল উদ্দেশ্য ছিল "তাঁকে" খুশী রাখা। কোনও অনিচ্ছাকৃত ভুল হলে যেন ক্ষমা পাওয়া যায়। একেবারেই সাম্প্রদায়িক ছিল না সে, চলার পথে মন্দির , মসজিদ, গির্জা যাই পড়ুক না কেন সেখানেই একটা প্রণাম। তাঁর বিশ্বাস ছিল "আমি যদি কোনও অন্যায় না করি, তবে আমার উপরেও কোনও অন্যায় হবে না"। শাড়ি তাঁর খুব প্রিয়, এটাও বাবার কাছ থেকেই এসেছে। সে শাড়ি পরতে খুবই ভালবাসত। তবে অবশ্যই ড্রেস কোড মেনে। আর ভালোবাসতো কোনও কসমেটিক ছাড়াই ফুল বা মালা দিয়ে সাজতে। নিজের ঈর্ষণীয় সৌন্দর্যের জন্য তাঁর কোনও অহংকার বা নাক উঁচু ভাব ছিল না। সে নিচুতলার শ্রমজীবী মানুষকে সন্মানের সঙ্গে দেখতো। এ বিষয়ে একটা ঘটনার উল্লেখ করা দরকার --- এক দিন স্কুলে যাওয়ার মাসকাবারি রিক্সায় উঠতে গিয়ে কাকুর গায়ে পা লেগে গেল, সঙ্গে সঙ্গে ধপাস করে কাকুকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম। কাকু তো হতবাক, তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। অনেক আশীর্বাদ করলেন মন থেকে। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে বাংলা সাহিত্যের চিরায়ত ও আধুনিক রচনা গো - গ্রাসে পড়তে থাকলো। শহরের একটি গ্রন্থাগারে সদস্য হয়ে নিয়মিত বই আনা ও পড়া শুরু হলো। সেখানেও বিপদ, বিবাহিত গ্রন্থাগারিক একদিন তাঁকে নির্জনে একাকি পেয়ে "প্রেম নিবেদন" করে বসলেন। ব্যাস লাইব্রেরি যাওয়া বন্ধ। কোনোদিনই ঘ্যান ঘ্যানানি টিভি সিরিয়াল তাঁকে আকর্ষণ করেনি। কিন্ত সে সিনেমা পাগল ছিল। প্রথমে বাবাকে লুকিয়ে তিন বন্ধু মিলে, পরে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এর বন্ধুদের সঙ্গে চুটিয়ে সিনেমা দেখা। সাধারণ বাঙালি পরিবার গুলির বিয়ের অনুষ্ঠানের জাঁকজমক যথেষ্ট আকর্ষণীয়। তাঁরও ছোটবেলায় "বর - বউ" খেলা ও নানান আত্নীয় স্বজনের বিয়ের অনুষ্ঠান দেখে খুবই "বউ" সাজার ইচ্ছে মনের গোপনে বেড়ে উঠেছিল। বিবাহ পরবর্তী সংসার জীবনের জটিলতা দেখা সত্বেও "বউ" সাজার আকর্ষণ বিন্দু মাত্র কমেনি। সে সাধারণ ভাবে গানের ভক্ত হলেও রবীন্দ্রসঙ্গীত তাঁর বিশেষ ভালোবাসার জায়গা ছিল।
কিন্ত রেজেস্ট্রি হওয়ার পর তাঁর মনে এক অদ্ভুত ভয় চেপে বসলো। তাঁর স্বাভাবিক উচ্ছলতায় ভাঁটা পড়লো। সুভাষের সঙ্গে দেখা করাও কমিয়ে দিল বা দেখা হলেও খুবই অল্প সময়ের জন্য অথবা ঝগড়ায় শেষ হত। সবসময় মনে হতে থাকলো যদি তাঁর সাংসারিক জীবন সুখের না হয়, তাহলে সে কি করবে? নিজের পছন্দ করা ছেলে ফলে অন্য কাউকে দোষারোপ করা যাবে না! বাড়িতে তো ফেরাই যাবে না! সে বাঁচবে কি করে? এই সময় তাঁর মাথায় সুবুদ্ধির উদয় হল, যে কোনো ভাবেই হোক একটা চাকরি যোগাড় করতে হবে। তখনও অবশ্য সরকারি চাকরির বাজার এখনকার মতো ছিল না! তবুও বেশ কঠিন প্রতিযোগিতার মধ্যেই পড়তে হতো। সে সুভাষকে তাঁর পরিকল্পনার কথা জানালো না। শুধু বলল ঘন ঘন দেখা করতে পারবে না। ইতিমধ্যেই M A এর ফলাফল ঘোষণা হলো। যথারীতি 1st Class, সহপাঠী বন্ধুরাও বলল,বাবাও বললেন এবার M.Phill করতে যাতে ভবিষ্যতে গবেষণা করা যায়। তাঁর নিজেরও খুবই ইচ্ছে ছিল আগামী দিনে গবেষণা ও শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকার। কিন্তু পরিস্থিতি সায় দিল না। তাঁকে যে ভাবেই হোক একটি চাকরি যোগাড় করতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। ধীরে ধীরে চাকরির পরীক্ষার দিন এগিয়ে এল। বাবা ছুটি নিয়ে সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। পরীক্ষা শেষ হতেই বাবা এগিয়ে এলেন ঠান্ডা জলের বোতল হাতে, এর পর প্রশ্ন " কি রে কেমন হলো"? উত্তর অস্বাভাবিক " আমার যদি না হয় তাহলে কারোর হবে না!" বাবা মেয়ের এই আত্মবিশ্বাস দেখে অবাক হয়ে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন এত মনের জোর ওকে সত্যিই কেউ আটকাতে পারবে না। ফেরার পথে কলকাতার বিখ্যাত দোকানের বিরিয়ানি ও চাপ। সে খেতে খুবই পছন্দ করতো যদিও তা পরিমাণে অল্প।নানা ধরনের শাক, ছোট মাছ মৌরলা, তেলাপিয়া ইত্যাদি। শুধু যে খেতে ভালোবাসতো তাই নয় বাবার জন্য রান্না করতে করতে হাত খুলে গেছিল। তাঁর পিসি পাশেই থাকতেন। তাঁর আবার দুই ছেলে। তিনি ওঁকে নিজের মেয়ের মতোই ভালবাসতেন। তিনিই ছিলেন ওর রান্নার গুরু। আধুনিক ভাষায় রান্নার "Trips & Tricks" তিনিই শিখিয়ে ছিলেন ওকে নিজের হাতে ধরে। ফলে সর্ষে বাটা দিয়ে পারসে যা বাবার অত্যন্ত প্রিয় তা রান্না করা তাঁর বা হাতের খেল। এর সঙ্গে পোলাও কষা মাংস ও বিভিন্ন ধরনের সকালের ও বিকেলের জলখাবার আরও অনেক কিছু তো রয়েইছে। পরিবারের অগোচরেই সে একজন পাকা রাঁধুনি হয়ে উঠেছিল। এবার চাকরির পরীক্ষার ফলাফল বের হওয়ার পালা। সকালের দৈনিক সংবাদপত্র মারফৎ খবর পাওয়া গেল রেজাল্ট বের হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরি কলকাতা যেতে হবে সেই অফিসে। আবার সেই বাবা সঙ্গে চললেন। প্রথম দিকে rank করলে কলকাতাতেই থাকা যাবে। ঠিক তাঁর কথা মতোই হলো, প্রথম ১০ জনের মধ্যে rank। সেদিন সে প্রচন্ড খুশি হলো। আর তার বাবা তাঁর থেকেও বেশি, পাড়ায় ঢুকতে ঢুকতে সবাইকে খবরটা জানিয়ে দিল। তাঁর বেশ লজ্জাই করতে লাগলো। শেষ পর্যন্ত ইচ্ছেপূরণ। একটা মানত করতে হবে। সারারাত উত্তেজনায় ঘুম এলো না, প্রথমে খুব কষ্ট হলো দাদু দেখে যেতে পারলেন না, পিসি এতটাই অসুস্থ যে তাঁকে জানালেও তিনি বুঝতে পারবেন না। এর পর প্রথম মাসের মাইনের টাকা দিয়ে সে কি করবে! বাবাকে একটা ত্সরের পাঞ্জাবী, মা কে সিল্কের শাড়ি, ভাইকে একটা জিনস্ তালিকা অনেক বড় কাজের মাসী, পিসির ছেলেরা, টুম্পা ও রুম্পা আরও অনেকে। বিকেলে প্রায় লাফাতে লাফাতে সুভাসকে যখন তাঁর জীবনের সেরা Achievement এর খবর জানালো, প্রতিক্রিয়া হলো " ওহ তাহলে তো আর তোমাকে পায় কে? তুমি তো আর আমাকে বিয়ে করবে না !!" মনে চমৎকার সব বাদাম চিবাতেচিবাতে হঠাৎ ই একটি পোকা বাদাম দাঁতে পরে গেল --- ঠিক ই রকমই অনুভূতি হল ফুলকির !!!
ক্রমশঃ
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।