"অভয়া" কান্ডের এক বছর হয়ে গেল। বিচার ব্যবস্থা জনপ্রিয় হিন্দি ছবির সংলাপের "তারিখ পে তারিখ" ই হয়ে যাচ্ছে। অভয়া তাঁর কর্মস্থলে নির্যাতিতা ও খুন হয়ে ছিলেন। অত্যন্ত জঘন্য ও ঘৃণ্য ব্যাপার। যদিও বর্তমানের বাঙালি মেয়েদের অবস্থা এর থেকে কি খুব আলাদা কিছু? আমি মূলত: শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিতা চাকরি - বাকরি করা মেয়েদের নিয়েই আলোচনা করব। "বিন্দু তে সিন্ধু দর্শন" বলে একটি বাংলা প্রবাদ আছে, সেই জন্য কোনও একজনের জীবন উন্মোচিত করলে সব মেয়েদেরই প্রকৃত আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির আভাস পাওয়া যাবে। অনিচ্ছাকৃত মিলের জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। বেশ কয়েকটি পর্ব লাগবে।
ডাক্তারের ঘর থেকে বের হওয়ার সময় বাবার চেহারা দেখে সে ভূত দেখলো ! পুরো বিধ্বস্ত কাঁধ ঝুঁকে যাওয়া এক মানুষ যাঁকে তার বাবা বলে চেনাই যাচ্ছে না !! " কি বলেন ডাক্তারবাবু?" জিজ্ঞাসা করল সে। বাবা তাঁর কথার উত্তর না দিয়ে বললেন " শিগগিরি হোটেলে চল, আজই ফ্লাইটে কলকাতায় ফিরব।" কিচ্ছুই বুঝতে পারে না সে। তারাতারি সব গুছিয়ে একটা অটো ধরে সোজা চেন্নাই এয়ারপোর্ট। সন্ধ্যার মধ্যেই কলকাতা। তারপর বাড়ি। মনের মধ্যে আশা - আশঙ্কার মেঘ। সারারাত জেগে কাটালো সে। ডাক্তার তো সহজ ইংরেজিতে তাঁর সামনেই বলেলন "The operation was very successful, don't worry, just take the medicines as prescribed and come back here after 6 months to see me." তাহলে?
পরদিন সকালে ব্যস্ত হয়ে সুভাষ এসে হাজির। তাকে দেখে ফুলকির পিত্তি জ্বলে উঠলো। তাঁর সঙ্গে কোনও কথা না বলে সরাসরি বাবার ঘরে চলে গেল। প্রায় ২০ মিনিট পর বেড়িয়ে এসে বলল " আজ সন্ধ্যেবেলায় আমার এক পরিচিত ডাক্তারের কাছে তোমাকে নিয়ে যাবো, বিকেলের মধ্যে রেডি হয়ে থেকো "। হঠাৎ এত দায়িত্ববান !!! ফুলকি সিগারেটের ছ্যাঁকায় পোড়া দাগ টায় হাত বোলালো। সুভাষ চলে যেতেই সে বাবাকে জিজ্ঞাসা করল " কি ব্যাপার বলতো? তোমরা কি আমার কাছে কিছু চেপে যাচ্ছো?" বাবা উত্তর দিলেন " না রে মা, তুই তো ওর স্ত্রী, ও তোকে একজন স্পেশালিস্ট দেখিয়ে নিশ্চিন্ত হতে চায়!" কি বলবে ফুলকি !! সে বিকেলের মধ্যেই তৈরী হয়ে রইলো। যথা সময়ে সুভাষ এক ভাড়া করা গাড়ি নিয়ে হাজির। ডাক্তারের ওখানে বেশ ভিড়। প্রায় ৮ টা নাগাদ ওদের ডাক এলো। ভিতরে যাবার সময় ডাক্তারের নেমপ্লেটে অঙ্কোলজিস্ট লেখাটা তাঁর নজর এড়ায়নি। ডাক্তার সত্যি সত্যিই সুভাষের পরিচিত, অনেকক্ষণ ধরে রিপোর্ট দেখে শেষে তাঁকে পরীক্ষার পর তিনি বললেন " আগামী কাল ই অমুক হাসপাতালে ভর্তি করে দিন, আমি বলে রাখব, প্রথমে একটা Pet C.T. Scan করে তারপর কেমো স্টার্ট করে দেবে।" ফুলকি যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছিল না !!! ডাক্তারবাবু সান্ত্বনা দিলেন " Previously, there was no answer to cancer, but now the situation has changed after we have lived healthy lives for so long. But the will to survive must be strong, যদি আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করি তবে অবশ্যই তাকে দূরে রাখতে পারবো " । ফুলকির কানে কিছুই ঢুকছিল না। গাড়িতে ফিরতে ফিরতে সুভাষ বলল" এখনও দুবছর হলো না বাঁধিয়ে বসলে রাজ রোগ , আমি বাবা একটা পয়সাও খরচ করতে পারব না !!" ফুলকির উত্তর দেবার মতো মনের পরিস্থিতি ছিল না !! সে শুধু বাবার বাড়ি ফিরতে চাইলো। ফিরে সুভাষ বাবাকে বলল "ওর মুখ থেকে শুনে নেবেন"। বসার ঘরে ফুলকি আর বাবা মুখোমুখি বসলো , দুজনেই কাঁদছে। ফুলকি বলল " বাবা আমি তো জ্ঞানত কোনও অন্যায় করিনি তাহলে আমার সাথেই এইসব খারাপ জিনিষ কেন হচ্ছে বলতো?" কি বলবে বাবা ভাগ্য কে দোষ দেওয়া ছাড়া আর কি কোনও উপায় আছে??
পরদিন বাবার সাথে নির্দিষ্ট হাসপাতালে পৌঁছে গেল ফুলকি। প্রথমে scan তারপর অঙ্কোলজি বিভাগে ভর্তি। টাকা সব বাবা নয় অফিস দেবে। রাতে রাউন্ডে এলেন সেই ডাক্তার । বুঝিয়ে বললেন রোগের কথা , আর বললেন " আজ আমরা আপনাকে অল্প করে কেমো দেবো, তারপর অবজারভেশনে রাখবো , যদি সব ঠিক থাকে তাহলে আগামী কাল বিকেলেই ছুটি পেয়ে যাবেন। আমার অভিজ্ঞতা থেকে একটা কথা বলতে পারি যে যদি না ভেঙে পড়ে বাঁচার ইচ্ছে টা জাগিয়ে রাখতে পারেন তবে আমাদের চিকিৎসায় ঠিকঠাক সাড়া পাওয়া যাবে। Wish you all the best "। ফুলকি মনে মনে ভাবলো সে মোটেই ভেঙে পড়বে না। শুধু বাবার মুখ দেখলে সে নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না !! রাতের খাবারের পর একজন বয়স্ক নার্স এলেন। জিজ্ঞাসা করলেন " বাচ্চা - কাচ্চা আছে?" ফুলকি মাথা নাড়লো। এরপর এ গল্পঃ সে গল্পঃ করতে করতে হাতে একটা চ্যানেল করে দিলেন। তাই দিয়ে ওষুধ দেওয়া শুরু হতেই ফুলকির সারা শরীর জ্বলে উঠলো, অসম্ভব কষ্ট বলে বোঝানো যাবে না !!! প্রায় অচেতন হয়ে সে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল। তার মধ্যেই ভাবতে লাগলো কত ইচ্ছে ছিল তাঁর সন্তানের ছেলেই হোক বা মেয়ে খুব আদর দিয়ে মানুষ করবে। নতুন নতুন জামা কিনে দেবে, গ্রীষ্মের ছুটিতে ঠান্ডা জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবে আরও কত যে অপূর্ণ ইচ্ছে তাঁর আছে। ইচ্ছে ছিল কৌশনির মতো কোনও জায়গায় নদীর পাশে নির্জন স্থানে একটা কাঠের বাড়ির যেখানে ঘর ভর্তি রবীন্দ্রনাথের কবিতার বই আর সাউন্ড সিস্টেম এ রবি ঠাকুরের গান। কোনও ইচ্ছেই তার পূরণ হবে না !!!
পরদিন বিকেলে বাবার সঙ্গে গাড়ি করে বাড়ি ফিরল, পথে দুজনের কোনও কথা হয়নি বাড়ি ফিরে ফ্রেস হয়ে "বলাকা"র কয়েক লাইন পড়ার চেষ্টা করল। মুখটা তেতো হয়ে রয়েছে। খবর টেবিলে সে বাবাকে বলল "আমি কাল থেকে অফিস করবো"। ট্রেনে বসে ভিড় ঠেলে কি করে যাবি?? উত্তর প্রথমে অফিস যাই তারপর একটা গাড়ির ব্যবস্থা করবো। পরদিন সকালে পরিপাটি করে সেজে সে অফিস গেল। সহকর্মীরা কেউ কেউ ব্যাপারটা জানতে পেরে গেছেন। অনেক ফাইল জমা হয়ে ছিল, সে সেদিকে মন দিল। বেশ ভালই কাটলো অফিসে। বিকেলে বস্ এর কাছে গিয়ে একটা গাড়ির অনুরোধ করলো। বস্ বললেন " আপনিতো এমনিতেই গাড়ি পাবেন , ঠিক আছে আমি এখনি অর্ডার করে দিচ্ছি" ফুলকি এতটা আশা করেনি। বস্ কে ধন্যবাদ জানিয়ে লিফটে করে নিচে নেমে দেখে বাবা দাঁড়িয়ে। এদিকে সত্য নামের অফিসের এক ড্রাইভার তাঁকে দেখে বললেন"ম্যাডাম আজ থেকে আমি আপনার ডিউটি করবো বড় সাহেব তাই বলেছেন"। ফুলকি বাবাকে নিয়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। সত্যর বকবক শুনতে শুনতে বাড়ি পৌঁছে গেল।
আবার হাসপাতাল আবার কেমো, এবার অবশ্য সে শ্বশুরবাড়ি ফিরলো। বড় ননদ অনেক বোঝালেন। আবার সেই চিলেকোঠা। রাতে সুভাষ বাড়ি ফিরে বলল " আয়নায় মুখ দেখেছো? ঠিক রাক্ষুসীর মতো চেহারা হয়েছে। খুব দেমাগ ছিল না !! এবার বোঝো ঠেলা। কাল সকালে সত্যজিৎ আসবে, ওর কাছে একটা লাইফ ইন্স্যুরেন্স পলিসি করে নেবে। ও আমাকে অনেকদিন ধরেই বলছে।" সুভাষকে সে আরও গভীর ভাবে চিনতে পারল। পরদিন সেই সত্যজিৎ নামের লাইফ ইন্স্যুরেন্স এজেন্টের কাছে বাৎসরিক ৭০,০০০/ টাকার ইন্সুরেন্স পলিসি করলো। টাকাটা চেক কেটে দিয়ে অফিসে গেল সে। এই যে গাড়ি করে অফিসে যায় তাই নিয়েও অনেক কথা শুনতে হয়েছে তাঁকে। গাড়িতে বসেই কাঁচ তুলে দিয়ে মিউজিক সিস্টেমে তাঁর প্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে অফিস পৌঁছে যায়। অফিসে তাঁর বাথরুমে গিয়ে আয়নায় নিজেকে ভালোও করে দেখলো সে, অনেক চুল পরে গেছে, চামড়াও কুঁচকে গেছে কি রকম জানি বয়স ২০ বছর বেড়ে গেছে। যাক বেঁচে তো আছে সে।
এইভাবেই তৃতীয় কেমোর দিন এসে পড়ল। মায়ের সাথে কথা বলে তার আগেরদিন সে অফিস থেকে বাবার বাড়ি ফিরল। বাবা খুবই খুশি হলেন। মা তাঁর চেহারার অবস্থা দেখে লুকিয়ে রান্না ঘরে চোখের জল ফেলতে থাকলেন। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে বাবা বেড়িয়ে গেছেন। সময় মতো অফিস পৌঁছলো সে। বাবা কিছুই না খেয়ে গেছে, একটা দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। দুপুরে ক্যান্টিনে খেতে খেতে টিভি তে দেখলো তাঁর যে হাসপাতালে চিকিৎসা চলে তার সামনেই বাস দুর্ঘটনা ঘটেছে। এক বৃদ্ধ আহত। সে নিজের টেবিল এ ফিরে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তার ফোন বেজে উঠলো,উল্টো দিকে এক ভারক্কি গলার আওয়াজ, নাম জেনে নিশ্চিন্ত হবার পর তিনি বলেন তারাতারি অমুক হাসপাতালে চলে আসুন আপনার বাবা বাস দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। ফুলকি এসির মধ্যে বসেও ঘেমে জল হয়ে গেল। বস্ কে জানিয়ে, লিফটে নিচে নামতে নামতে শুধুই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করল ওই লোকের কথা যেন ভুল হয় ওই ব্যক্তি যেন তাঁর বাবা না হয়। সত্য দ্রুত গতিতে গাড়ি চালিয়ে সেই হাসপাতালে নিয়ে গেল। গাড়ি পার্ক করার সময় বলল" ম্যাডাম আপনি একা যাবেন না, আমিও যাবো আপনার সঙ্গে। পার্কিংয়ের পর দুজনে চলল ইমার্জেন্সির দিকে। ডাক্তারকে নিজের পরিচয় দিতেই তিনি বলতে লাগলেন" মনে হচ্ছে ইন্টারনাল হেমারেজ, বাইরে কোনও চোট নেই। সেরিব্রাল অ্যাটাক কের চিকিৎসার পরিকাঠামো আমাদের এই হাসপাতালে নেই। অন্য কোনো ভালো হাসপাতালে নিয়ে যান।" সে দেখলো বাবা যেন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। শুধু বা হাতের তর্জনী তে কেটে গেছে, সেখানে এক জুনিয়র ডাক্তার সেলাই করছে। সে সত্যর কাছে পরামর্শ চাইলো। সত্য বলল " চলুন ম্যাডাম ওনাকে কোনও বেসরকারি বড় হাসপাতালে ভর্তি করি"। সে সত্যর কথাই শুনল বাবাকে বড় এক বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করলো। সত্য কে সে বাড়ি পাঠালো ভাই ও তার বন্ধুদের আনতে। হাসপাতালের বাইরে একটা বসার জায়গায় বসে সে নিজের ডাক্তারের কাছে ফোন করলো। তিনি জানালেন বাবা আজ তার কাছে গেছিলেন। এতক্ষণে ছবিটা পরিষ্কার হলো। বাবা দুঃখের তাড়নায় ডাক্তারবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেছিলেন। কিন্তু ডাক্তারবাবু তাঁকে আশ্বস্ত করতে পারেন নি, এইসব কথা ভাবতে ভাবতে ই দুর্ঘটনা। তাহলে কি বাবার এই অবস্থার জন্য আমিই দায়ী ?? এরই মধ্যে ভাই সুভাষ ও তাদের দুই বন্ধু এসে হাজির। সে সত্য কে বলল আপনি বাড়ি ফিরে যান , কিন্তু সে রাজি হলো না। চা খেয়ে ই সময় কাটছিল। গভীর রাতে চিকিৎসারত ডাক্তার ডেকে পাঠালেন। বললেন " দেখুন সেরিব্লামের ভিতর দিকে হেমারেজ হচ্ছে,আমরা ওষুধ দিয়ে সেটাকে আটকানোর চেষ্টা করছি। আর একটা ড্রেন করে মাথায় জমা রক্ত বাইরে বার করে দিচ্ছি। যাতে মাথার ভিতরের প্রেসার কমে। এছাড়া এই অবস্থায় খুব কিছুই করার নেই। যতক্ষণ না ওনার জ্ঞান ফেরে ততক্ষণ মেডিকেল সায়েন্স এর কিছুই করার নেই, সাপোর্ট দেওয়া ছাড়া। ভগবানকে ডাকুন।"
এই আধুনিক যুগে আধুনিক মেডিকেল সায়েন্সের চর্চার সাথে যুক্ত লোকেরাই এই অবৈজ্ঞানিক কথা অক্লেশে বলে থাকেন। 0এটাই আমাদের সমাজের বাস্তবতা। দাভোলকর, পানসারে বা গৌরি লঙ্কেশরা কি কোনও ছাপই রেখে যেতে পেরেছেন? আর বিজ্ঞান ও কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলন? মনে পড়ে রাজ্যের পশ্চিম দিকে "ডাইনি" হত্যার ঘটনা!! তা কি "অভয়া" কান্ডের চেয়ে কম কিছু লজ্জার?? এসব বিচারের ভার আমি পাঠক পাঠিকা দের উপর ই ছেড়ে দিলাম !!!!
ক্রমশঃ
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।