"অভয়া" কান্ডের এক বছর হয়ে গেল। বিচার ব্যবস্থা জনপ্রিয় হিন্দি ছবির সংলাপের "তারিখ পে তারিখ" ই হয়ে যাচ্ছে। অভয়া তাঁর কর্মস্থলে নির্যাতিতা ও খুন হয়ে ছিলেন। অত্যন্ত জঘন্য ও ঘৃণ্য ব্যাপার। যদিও বর্তমানের বাঙালি মেয়েদের অবস্থা এর থেকে কি খুব আলাদা কিছু? আমি মূলত: শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিতা চাকরি - বাকরি করা মেয়েদের নিয়েই আলোচনা করব। "বিন্দু তে সিন্ধু দর্শন" বলে একটি বাংলা প্রবাদ আছে, সেই জন্য কোনও একজনের জীবন উন্মোচিত করলে সব মেয়েদেরই প্রকৃত আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির আভাস পাওয়া যাবে। অনিচ্ছাকৃত মিলের জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। বেশ কয়েকটি পর্ব লাগবে।ফুলকি নিজেকেই সব কিছুর জন্য দোষারোপ করছিল। শুধু ই প্রার্থনা করে চলেছিল যেভাবেই হোক বাবার জ্ঞান যেন ফিরে আসে। তাঁর ই এক সহপাঠীর বর ডাক্তার তার সঙ্গে হাসপাতালেই দেখা হয়ে গেল। তিনি নিজেই এগিয়ে এসে বললেন " কেমন আছো?" আজকাল সমাজ মাধ্যমের কল্যাণে সাধারণ যোগাযোগ না থাকুক, সবাই সবার হাড়ির খবর রাখে। ফুলকি ম্লান হেসে ভালোই আছে জানালো। তারপর বাবার কথায় আসলো। তিনি মন দিয়ে সব শুনে, তাঁকে সঙ্গে করে ICU গেলেন। ভালো করে সব খোঁজ খবর নিয়ে বেড়িয়ে এসে বললেন " দেখ ওনার অবস্থার খুব শীঘ্রই কোনও পরিবর্তন হবে না, বরং অবনতি হতে পারে। কতদিন এই খরচের জায়গায় রাখবে? তার চেয়ে আমার মতে তোমাদের শহরে কোন ভালো নার্সিংহোম যেখানে ICU আছে সেখানে ভর্তি করো। কিছুটা খরচ কমবে আর তোমরাও দেখাশুনা করতে পারবে। আমাদের এখানে ICU Ambulance আছে, আমাকে ফোন করলে ডিসকাউন্ট দিয়ে বুক করে দেবো। তাহলে আজ চলি।"" নিচে নেমে সে ভাই ও সুভাষের সঙ্গে আলোচনা করলো। ওদের বন্ধুরা শহরে খবর নিতে লাগলো। শেষে ঠিক হলো যে ডাক্তার তাদের বাবা কে দেখছেন তার সাথে কথা বলে তবেই নিয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত বিকেলের দিকে তাদের শহরের একটি নার্সিংহোমে বাবাকে ভর্তি করে দেওয়া হলো। ফুলকির ৩য় কেমো টা সময় মতো নেওয়া হলো না ! সে ডাক্তার কে ফোন করে সব বলল, তার পরামর্শে পরের দিন ই ভর্তি হলো হাসপাতালে। অফিসের সেই সিনিয়র দাদা অন্যত্র বদলি হয়ে গেছেন , তিনি ফুলকিকে দেখতে এলেন। তাঁর শারীরিক অবস্থার খোঁজ খবর নেওয়ার পর বললেন " তোমার তো এখন অনেক টাকার দরকার, সেই এরিয়ারের টাকা তোমার ননদ ফেরৎ দিয়েছেন?" সে বলল "না"! তিনি বললেন "এখনই তো ফেরৎ চাওয়ার উপযুক্ত সময়।" বিকেলে হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার পথে বাবাকে দেখে আসলো। তারপর বড় ননদ কে ফোন করে বলল টাকার কথা। বড় ননদ চুপ, কোনও উত্তর দিলেন না !!
পরদিন অফিসে যাওয়ার আগে সুভাষ এসে হাজির " তোমার এই হত কুচ্ছিত চেহারাতেও এত দেমাগ " এই ভাবে শুরু করলো। ফুলকি জানে তাঁকে অপমানিত ও ছোট করার কোনও সুযোগ সে হাতছাড়া করে না। বাবা আজ অসুস্থ তাই এত সাহস যে এই বাড়িতে এসে সে এভাবে তাঁকে অপমানিত করতে পারল। মা ও ভাই নীরব দর্শক জামাই এই বাড়ির জন্য যা করছে ভাবা যায় না !! ফুলকি সবই বোঝে, সে অফিসের জন্য তৈরি হতে লাগলো, সত্য এসে বসে আছে। তাঁর সামনে ২০,০০০/ টাকার বান্ডিল ফেলে সুভাষ চিৎকার করে উঠল " নাও তোমার খিদে মেটাও, যে রকম দেখতে হয়েছো ব্যবহারও সে রকম হয়েছে। তোমার টাকা লাগলে আমাকে বলতে পারতে, বড়দি কে বলতে গেলে কেন?" এমন ভাব যেন কোনও বড় শিল্পপতি!! " চিন্তা নেই বড়দি সব টাকাই দিয়ে দেবে !" কোনও কথা না বলে সে টাকার বান্ডিলটা ব্যাগে ঢুকিয়ে অফিসে রওনা দিল। দুপুরের পর বস্ অফিসে ডেকে তাঁর ও বাবার শরীরের কথা জানতে চাইলেন। পরামর্শ দিলেন প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন নেওয়ার, তাঁর চাকরির সময় ও মেডিক্লেম এর লিমিট বিবেচনা করে। এও বললেন টাকা বা অন্য কোন প্রয়োজনে তাকে জানাতে। ফুলকি ভাবলো অফিস টা যেন একটা আশ্রয়স্থল। বস্ তাঁকে তাঁর ডিটেইল আপডেট করতে বললেন। চাকরি তে যোগ দেওয়ার সময় সে অবিবাহিত ছিল, চাকরির প্রায় দুই বছরের পর বিয়ে করে।ফলে সরকারি নিয়ম অনুযায়ী তাঁর ঠিকানা, পদবী ও প্রভিডেন্ট ফান্ডের নমিনি বদল করতে হবে। কিন্তু সে এসব নিয়ে এখনই ভাবতে রাজি হলো না!! রোজই অফিস থেকে ফেরার সময় বাবাকে দেখে ফেরে। ডাক্তারদের একই কথা " একই রকম আছেন"। রাতে খাবার টেবিলে ভাই বলল " দিদি বাড়ি বিক্রি করে যা টাকা পাওয়া যায় তাই দিয়ে বাবার চিকিৎসা হয়ে যাবে কি বল?" কি বলবে ফুলকি , এর জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না!! ছোট বেলা র সব স্মৃতি এই বাড়ির আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে। সে বলল " তুই কি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিস?" ভাইয়ের বক্তব্য বাড়ি তার নামে লিখে দিলে সে বাবার পরিচিত প্রোমোটার কাকুকে দিয়ে বাজার দর থেকে বেশ বেশি টাকা পেতে পারে। তারা ধরেই নিয়েছে ফুলকির এতে কোনও অধিকারই নেই। সে যে তাঁর শেষ আশ্রয়স্থল টিও হারাবে এটাই বা কারোর চিন্তাতেই নেই। কারন বর্তমান সমাজে ধুমধাম করে মেয়ের বিয়ে দেবার পর তাঁর যেন বাবার সম্পত্তির উপর কোনও অধিকারই থাকে না। শুধু তাই নয়, সেটা চাইতে গেলে মেয়েরা যেন নিজেদের কাছেই ছোট হয়ে যায়। অথচ ছেলেরা যতই ফ্ল্যাট বা অন্য বাড়ি করে থাকুক বাবার বাড়ির উপর তাদের অধিকার স্বাভাবিক তা সে যতই টাকা তার পড়াশুনার জন্য বাবা ব্যয় করে থাকুন না কেন !!! তাঁর ভাই যে কখন এত বড় হয়ে উঠেছে সে টেরই পায়নি। বড় বাস্তব জ্ঞান সম্পন্ন তাঁর মতো Imotional fool নয়। সকালে তাঁর ঘরের দরজায় ধাক্কা দিল ভাই , কি হয়েছে? "শিগগির চল বাবার অবস্থা খারাপ"। কি করবে সে বাথরুম যাবে না রাত পোশাক বদলাবে এসব যেন তাল গোল পাকিয়ে গেল। কোন ক্রমে তৈরী হয়ে নার্সিংহোমে গেল। বাবা আর নেই।
কি করবে ফুলকি ভেবে উঠতে পারছে না। শুধু বাবার সঙ্গে কাটানো দিনগুলি ফ্ল্যাশব্যাক এর মতো চোখের সামনে ভেসে উঠছে। বাবা শান্ত হয়ে চির নিদ্রায় শায়িত। কোনও কান্না কোন আফসোস তাঁকে স্পর্শ করতে পারছে না। সে জানে তাঁর চরম পরিণতি দেখার হাত থেকে রেহাই পেল বাবা। ধীরে ধীরে আত্মীয় স্বজন পাড়ার লোক হাজির হল তাদের বাড়িতে। সবারই মুখে একটাই কথা "যা কষ্ট পাচ্ছিলেন তার থেকে চলে যাওয়াই ভালো হলো" !! ফুলকি অবাক হয়ে মানুষ গুলোর কথা শোনে আর ভাবে কি নিষ্ঠুর এই লোক গুলো আর যে বাবা বলে কেউকে ডাকতে পারবে না এটা তাদের কাছে কোনও ব্যাপারই না। বড় বেশী বাস্তববাদী হয়ে গেছে মানুষ। সে যে সদ্য পিতৃহারা তাঁর কানে এ কথা গেলে কি হবে সে বোধ ও যেন তাদের নেই। এরাই বাবাকে শ্মশানে নিয়ে গেল, সে নিজের চোখে বাবার মুখাগ্নি দেখতে পারবে না!! সে ধর্ম ভীরু হলেও এই নিষ্ঠুর প্রথার বিরোধী। ফুলকি তাঁর মা ও মহিলারা বাড়িতে রয়ে গেলেন। পাড়ার এক বউদি নিজের থেকেই সবাইকে চা বিস্কুট খাওয়ালেন। ফুলকি অসহ্য মাথার যন্ত্রনা করছিল। মনে পড়ল সকাল থেকে ওষুধই খাওয়া হয়নি। সে চা - বিস্কুট দিয়েই ওষুধ গুলো খেয়ে নিল। কিছুটা ঠিক লাগলো। শ্মশান যাত্রীরা রাত ২:৩০ নগদ ফিরে এলো। সুভাষ ওকে বলল " সব কাগজ ভাইকে দিয়ে দিয়েছি LIC বা অফিসের কোনও ক্লেম থাকলে এইসব কাগজ কাজে লাগবে""। সবাই বড় বাস্তববাদী একজন মানুষ মারা গেছেন ২৪ ঘণ্টাও হয়নি এখনই সব হিসেব নিকেশ শুরু হয়ে গেছে। সমাজে ব্যক্তির ভূমিকা কত টুকু সেটাই আজ প্রশ্নের মুখে। আসলে পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে পুরুষরাই আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। ফলে তাঁর মৃত্যু সেই নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে পারে তাই সবাই সে ব্যাপারেই চিন্তিত হয়ে পড়েন। অনেকের আবার মৃত্যুর পর সেই পরিবার গুলি আর্থিক ভাবে দুর্বল হয়ে পরে বা ভেঙে পড়ে। এটাই পুরুষ নির্ভর সমাজের মূল সমস্যা।
তাঁকে বাদ দিয়ে ওই রাতেই ভাই ও সুভাষ শ্রাদ্ধে কোন ডেকোরেটর কোন ক্যাটারার হবে ঠিক করতে শুরু করে দিল। সবার অলক্ষ্যে ফুলকি নিজের ঘরের দরজা দিয়ে অঝোরে কাঁদতে লাগলো আর বাবার পুরানো স্মৃতি হাতড়াতে লাগলো। হঠাৎই তাঁর অনেক রাতে মনে পড়ল আগামী কাল তাঁর ৪থ কেমো নেওয়ার তারিখ।
ক্রমশঃ
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।