"অভয়া" কান্ডের এক বছর হয়ে গেল। বিচার ব্যবস্থা জনপ্রিয় হিন্দি ছবির সংলাপের "তারিখ পে তারিখ" ই হয়ে যাচ্ছে। অভয়া তাঁর কর্মস্থলে নির্যাতিতা ও খুন হয়ে ছিলেন। অত্যন্ত জঘন্য ও ঘৃণ্য ব্যাপার। যদিও বর্তমানের বাঙালি মেয়েদের অবস্থা এর থেকে কি খুব আলাদা কিছু? আমি মূলত: শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিতা চাকরি - বাকরি করা মেয়েদের নিয়েই আলোচনা করব। "বিন্দু তে সিন্ধু দর্শন" বলে একটি বাংলা প্রবাদ আছে, সেই জন্য কোনও একজনের জীবন উন্মোচিত করলে সব মেয়েদেরই প্রকৃত আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির আভাস পাওয়া যাবে। অনিচ্ছাকৃত মিলের জন্য আমাকে ক্ষমা করবেন। বেশ কয়েকটি পর্ব লাগবে।
বেড়ানোটা মন্দ হলো না! সুভাষের বন্ধু আরও একটি পরিবারের সঙ্গে লাটাগুড়িতে বেশ কয়েকদিন। হই হুল্লোড় হলো, যদিও সেই বন্ধুর স্ত্রীর এক ঢোকে এক গ্লাস মদ খাওয়া দেখে বেশ অবাকই হলো ফুলকি। তবে তার সাথে বেশ "তুই - তোকারি" সম্পর্কও হয়ে গেল। যত ট্রেন কলকাতার দিকে এগিয়ে আসতে লাগলো তত মন ভারী হতে লাগলো। আবার সেই একই রোজ নামতা সেই গতানুগতিক জীবন। এই সময় কেন্দ্রীয় সরকার D.A. ঘোষণা করলেন। সে বেশ কিছু টাকা এরিয়ার হিসেবে পেল। মাসের মাঝামাঝি টাকাটা ব্যাঙ্কের স্যালারি অ্যাকাউন্টে ঢুকলো। ঠিক তারপর দিন সন্ধ্যেবেলায় বড় ননদ সিঁড়ির নিচের থেকে চিৎকার করে তাঁকে ডাকতে লাগল। তারাতারি নিচে নেমে এলো। বড় ননদ সরাসরি বলল " তুই মনে হয় এরিয়ারের টাকাটা পেয়ে গেছিস ! ওর থেকে আগামীকাল ১,০০,০০০/ টাকা দিবি , আমার একটু দরকার আছে"। কোনও অনুমতি নয়, শুধু নির্দেশ। রাতে সুভাষ বাড়ি ফিরতে সবই বলল ফুলকি। উত্তর এলো " বড় দি চেয়েছে থাকলে দিয়ে দাও। ও আমাদের জন্য অনেক করেছে।" ফুলকির মুখে এসে গেছিল তোমাদের জন্য করেছে আমার জন্য তো করেনি, কিন্ত বলতে পারলো না! মা এ বাড়িতে আসার আগে বলে ছিলেন " মেয়েদের অনেক কিছু সহ্য করতে হয়"। পরদিন অফিসে যাওয়ার আগে চেক লিখে বড় ননদের হাতে দিয়ে দিল। ওর শুধু মনে হতে লাগলো বড় ননদ জানলো কি করে? অফিসের সেই সিনিয়র দাদাকে বলতে তিনিই পরিস্কার করে দিলেন। রেট্রস্পেকটিভ এফেক্ট এর কথা এতদিন রাজ্য সরকারি কর্মী ননদের অজানা থাকার কথা নয়। কি বোকা সে !!! ইতিমধ্যে গরম এসে হাজির, রাত্রিবেলা চিলেকোঠা ঘর যেন ফার্নেস! সারারাত এপাস ওপাশ করে ও একটুও ঘুমানো যায় না। কি যে কষ্ট তা বলে বোঝানো যাবে না !! এরই মধ্যে একদিন সন্ধায় বাবা এসে বললেন " চল মা আমার সঙ্গে চল"। না কেউ আপত্তি করলো না। ফুলকিও যেন বেঁচে গেল। বাবার বাড়ী থেকে ই অফিস। বাবার রিটায়ারমেন্ট এর সময় চলে এসেছে। ভাইয়ের পড়াও শেষ হয়নি। বাবা বেশ চিন্তিত। এদিকে সুভাষের সঙ্গে রোজ রাতে তাদের বাড়িতে গন্ডগোল হতে শুরু করেছে। স্বামী স্ত্রীর স্বাভাবিক যৌন - জীবনের বদলে নানা রকমের বিকৃত যৌন - ইচ্ছে পূরণের চেষ্টাকে বাধা দিতে দিতে ফুলকি ক্লান্ত। অনেক বুঝিয়েও কাজ হচ্ছে না। বাবার বাড়ি এসে তার হাত থেকেও সাময়িক মুক্তি পেল সে। কাকে বলবে এসব কথা!! টুম্পা, সে তো ছেলে আর বর নিয়ে রায়পুরে। বাবা মা ভাই এর কাছে পরিচিত পরিবেশে খানিকটা হালকা হলো। মা একদিন কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলেন " জামাই কি করছে?" সে যা শুনেছিল তাই বলল " ট্যুর অপারেটর এর ব্যবসা করছে "।
বেশ কিছুদিন পর বাবাই বললেন " চল তোকে বাড়ি দিয়ে আসি"। ফুলকি বলল " বাবা আমি তো বাড়িতেই আছি"। বাবার উত্তর " না রে বিয়ের পর মেয়েদের শ্বশুরবাড়িই আসল বাড়ি"। তাঁর উদার প্রগতিশীল বাবা আসলে সমাজের চালু ধারণার কথাই বলছিলেন। প্রচলিত ধারণার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর সাহস না ছিল তাঁর না ছিল ফুলকির। শ্বশুরবাড়ি ফিরে আবার রাত্রির হলেই তাঁর ভয় করতে শুরু করত। একদিন গণ্ডগোল চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেল। সে সহজে মুখ খোলার পাত্রী নয় !! সেও বলতে বাধ্য হলো " ব্লু ফিল্ম দেখে এসে যা তা বিবাহিত স্ত্রীর সঙ্গে নয় পতিতাদের সঙ্গে করতে হয়"। এর জবাব সঙ্গে সঙ্গেই পেল সে --- এখন সুভাষ বিড়ি ছেড়ে সিগারেট খাওয়া ধরেছে, জ্বলন্ত সিগারেট চেপে ধরলো তাঁর বা হাতের বাহুতে, যেখানে ছোটবেলার টিকার দাগ থাকে। মনে হল জীবন বেরিয়ে গেল!! চোখ দিয়ে জলের ধারা বাঁধ না মেনে গড়িয়েই চলেছে। ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদে, কিন্তু অনেক রাত হয়েছে। দৌড়ে বাথরুমে গিয়ে যে জল দেবে তারও উপায় নেই। চুপ করে ওই পশুর পাশেই শুয়ে রইলো সে।
৭ বছর প্রেম(?) করেও এই জানোয়ার কে সে চিনতে পারেনি ! তাঁকে এক প্রচণ্ড যন্ত্রণা আচ্ছন্ন করে ফেললো। তাঁর সঙ্গেই কেন এমন হলো? সে তো জ্ঞানত কোনও অন্যায় করেনি ? টুম্পা - রুম্পা তো বেশ সুখেই স্বামী নিয়ে সংসার করছে ? আমি তো শ্বশুরবাড়ির সবাইকে খুশী করতে চেয়েছি !! প্রতি মাসেই মাইনে পেয়ে বড় ননদ, ছোট ননদ বাড়ির কাজের কোনও না কোনও জিনিষ কিনেছি !!! শ্বাশুড়ি একা বলে তাকে নিয়ে সিনেমা দেখতে নিয়ে গিয়েছি !!! ছুটির দিন গুলোও বিশ্রাম নিই নি, নিত্য নতুন রান্না করে খাইয়েছি, নিজের হাতে কাটা বাটা সব করে যাতে অন্তত এক দিন শ্বাশুড়ি বিশ্রাম পান !!!! এমনকি সেই রান্নার প্রয়োজনীয় যা কিছু সব নিজেই কিনে এনেছি!!!!! যখন যে যা চেয়েছে দিয়েছি বিনা প্রশ্নে !!!! তবে !!!!!
সেই ছ্যাঁকা খাওয়ায় জায়গাটার সে কোনও চিকিৎসা করালো না, কালো হয়ে গেল জায়গাটা। ওই কালো দাগ যতদিন দেখবে ততদিন তাঁর নিজের সিদ্ধান্তের উপর ঘৃণা হতে থাকবে !!!!! এরই মধ্যে চাকরিতে তার প্রমোশন হলো। অনেক সহকর্মী বদলি বা রিটায়ারমেন্ট করলেন, তাদের জায়গায় নতুন নতুন ছেলে মেয়েরা এলো। সুভাষেরও ট্যুর ব্যবসা করে টু পাইস কামাতে শুরু করেছে। রোজগারের সঙ্গে সঙ্গে লেকচার ও বেড়েছে। যে ছেলে তাঁর বাবার দেওয়া রেমন্ডস এর জামা কাপড় পড়ে ব্র্যান্ডেড জিনিষ পড়া শুরু, সে কিনা রেমন্ডস গ্রুপের ইতিহাস তাঁর সামনেই বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করছে। ফুলকির হাসি পায়।
একদিন অফিসের মধ্যেই অজ্ঞান হয়ে গেল সে। সহকর্মীরা তাঁকে কলকাতার এক বিখ্যাত বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করলো। খবর পেয়ে বাবা ছুটে এলেন, সুভাষের কোনও পাত্তা নেই। অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ডাক্তার জানালেন তাঁর "ওভারি তে সিস্ট হয়েছে জরুরি ভিত্তিতে অপারেশন করতে হবে"। বাবা সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলেন " ও মা হতে পারবে তো ডাক্তার বাবু ?" ডাক্তারবাবু আশ্বত্ব করলেন। পাঠক পাঠিকা দের ভেবে দেখতে বলবো ভাবুন অবস্থা মেয়ে সুস্থ হবে কিনা তা নয় তাঁর সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষ জানতে চাইছেন যে সে আর " মা" হতে পারবে কিনা ??
৮ই মার্চ নারী দিবসের সবচেয়ে বড় ট্যাগ লাইন "Women of Substance" এর নমুনা !!! যেন মা হলেই একমাত্র নারীত্ব পূর্ণতা লাভ করবে। সিদ্ধান্ত হলো 2nd Opinion নেওয়া হবে। কলকাতার এক বিশিষ্ট স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া হল, তিনিও অপারেশনের কথাই বললেন। এরপর বাবার সঙ্গে ভেলোরে যাওয়া। সেখানেই অপারেশন, ডাক্তার বললেন কদিন অপেক্ষা করে যান। ৭ দিনের মাথায় চেক আপ করতে হবে। ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর ডাক্তারবাবু বললেন অপারেশন ভালো হয়েছে। এবার বললেন " আপনার মেয়েকে বাইরে বসিয়ে আসুন , আপনার সঙ্গে কথা আছে"। বাবা তাঁকে বাইরে করিডোরে বসিয়ে ভেতরে গেলেন । এবার ডাক্তার বললেন " বায়োপসি রিপোর্ট পজিটিভ 3rd stage overy ক্যান্সার এখুনি চিকিৎসা চালু করতে হবে, সময় বিশেষ হাতে নেই"।
ক্রমশঃ
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।