‘র্যান্ড কর্পোরেশনের উপদেষ্টা পদে যোগ দেওয়ায় লস এঞ্জেলেসেই থাকতে হবে এখন আমায়। র্যান্ডের উপদেষ্টা পদে এখনও বহাল আছেন মারে জেল-ম্যান। তুমি যদি মাস খানেকের জন্য একবার লস এঞ্জেলেস্ আসতে পার, তাহলে আমি জেল-ম্যানের সাথে তোমার সাক্ষাতের একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারি’—নিজের ছাত্রর উদ্দেশ্যে কথাগুলো বললেন মারশাক।
জেল-ম্যানের সাথে সাক্ষাৎ! এ তো হাতে চাঁদ পাওয়া। এমন সুযোগ কেউ ছাড়ে? নিজের গবেষণার বিষয়বস্তু নিয়ে জেল-ম্যানের সাথে আলোচনার সুযোগ! ভাবাই যায় না। যাবেন তিনি, লস এঞ্জেলেস্ যাবেন, মনে মনে স্থির করে ফেলেন সুদর্শন।
* * *
ইউএসএ-র নিউইয়র্ক প্রদেশের পশ্চিম সীমানায় অন্টারিয় হ্রদের তীরে অবস্থিত রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়। ধারে-ভারে হয়তো প্রিন্সটন, হার্ভার্ড বা এমআইটি-র মতো না হলেও, এশীয়-বংশোদ্ভূতদের কিন্তু ভারী পছন্দের এই বিশ্ববিদ্যালয়। চিন, জাপান, ভারত, পাকিস্তান থেকে প্রচুর ছাত্র পড়তে আসেন এখানে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের এইচওডি রবার্ট ইউজিন মারশাকের ছাত্রদের মধ্যেও তাই অধিকাংশ ছাত্রই এশীয়। আর তাঁর ছাত্রকুলের মধ্যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম যেন সুদর্শন। ভারতের কেরালা থেকে তাঁর আধীনে পিএইচডি করতে এসেছেন এনাকেল চ্যান্ডি জর্জ সুদর্শন যাঁকে সবাই ইসিজি সুদর্শন বলে ডাকেন। বন্ধুস্থানীয়রা আবার শুধুই সুদর্শন বলে ডাকেন তাঁকে।
কী বিষয়ের উপর পিএইচডি করতে এখানে এসেছেন সুদর্শন? তাঁর গাইড অধ্যাপক মারশাকের অত্যন্ত প্রিয় বিষয় হল ‘উইক ইন্টারেকশন’ বা ‘উইক ফোর্স’। সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে ৪ টে মৌলিক ‘ফোর্স’ বা বলের অস্তিত্বের কথা বলেছেন পদার্থবিজ্ঞানীরা। সেই ৪ বল হল—(১) অভিকর্ষীয় বল, (২) তড়িৎচুম্বকীয় বল, (৩) স্ট্রং ফোর্স (দৃঢ় বল), (৪) উইক ফোর্স (লঘু বল)। স্ট্রং ফোর্স ও উইক ফোর্স কেবল মাত্র পরমাণুর অভ্যন্তরে ক্রিয়া করে। বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি লক্ষ করছেন, বাকি তিনটে বল কিছু সাধারণ নিয়ম মেনে চললেও, উইক ফোর্সের বেলায় কিছু বেনিয়ম ঘটছে। উইক ফোর্সের এই বেয়াড়াপনাই ঘুম কেড়েছে বিজ্ঞানীদের। ইদানীং পদার্থবিজ্ঞান-মহলে আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু হয়ে উঠেছে উইক ফোর্স। মারশাক নিজেও উইক ফোর্স নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করে আসছেন। ছাত্রর গবেষণার বিষয়বস্তু হিসেবে তাই তাঁর নিদান হল–-‘উইক ইন্টারেকশন’ বা ‘উইক ফোর্স’।
১৯৫৬ সাল, স্যরের নির্দেশমতো, উইক ইন্টারেকশন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করলেন সুদর্শন। পড়লেন এনরিকো ফের্মি, বারনিস ওয়েল্ডন সার্জেন্ট, হিডেকি ইউকাওয়া, সাং-ডাও লি, চেন-নিং ইয়াং প্রমুখ। এই সমস্ত পদার্থবিদদের রচনা মন্ত্রমুগ্ধের মতো পড়ে চলেছেন সুদর্শন। যত পড়ছেন ততই যেন একটা ভাবনা তাঁর মাথায় চেপে বসছে। পড়ছেন যতটুকু ভাবছেন তার চেয়েও গভীরে। উইক ইন্টারেকশনের বেনিয়মের মুখে লাগাম পরাতে মনে মনে বুনে চলেছেন এক নতুন যুক্তিজাল। সময়টা ডিসেম্বর ৫৬-জানুয়ারি ৫৭। সুদর্শন এখন প্রায় নিশ্চিত, উইক ইন্টারেকশন নিয়ে মনে মনে তিনি যা ভাবছেন তা নেহাৎই ফেলনা নয়। স্যারের সাথে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা প্রয়োজন বলেই মনে করছেন তিনি। সেই মতো অধ্যাপক মারশাকের সাথে একদিন আলোচনা করলেন উইক ইন্টারেকশন প্রসঙ্গে তাঁর চিন্তাভাবনা নিয়ে। জানালেন উইক ইন্টারেকশনকে কীভাবে বিশ্লেষণ করা সম্ভব। তাঁর এই নতুন ভাবনাকে V-A বা ভেক্টর-আক্সিয়াল ভেক্টর কাপলিং নাম দিয়েছেন তিনি। সহজ কথায়, ভেক্টর ও আক্সিয়াল ভেক্টরের সমন্বয়।
পরমাণুর অভ্যন্তরে স্থিতি-গতির অবস্থাকে ব্যাখ্যা করার জন্য ৫ টা দশাকে চিহ্নিত করেছেন পদার্থবিদরা। সেই ৫ দশা হল—(১) স্কেলার (S) (২) ভেক্টর (V) (৩) টেনসার (T) (৪) আক্সিয়াল (বা সিউডো) ভেক্টর (A) (৫) সিউডো স্কেলার (P)। সুদর্শনের মতে, লঘু বলকে ভেক্টর আর আক্সিয়াল ভেক্টরের সমন্বয় (V-A) হিসেবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। মারশাকের সামনে ভেক্টর আর আক্সিয়াল ভেক্টরের সাহায্যে লঘু বলকে বিশ্লেষণ করে দেখালেন তিনি। সুদর্শনের অভিনব ব্যাখ্যায় চমৎকৃত হলেন মারশাক। এ তো বিরাট আবিষ্কার! সুদর্শনের বক্তব্যকে লিখিত রূপ দিতে বললেন মারশাক। বিষয়টাকে আরও নিঁখুত ও যথাযথ করে কীভাবে উপস্থাপন করা যায়, সেই আলোচনা শুরু করলেন তাঁরা দুজনে। কীভাবে বিষয়টাকে জনসমক্ষে উপস্থিত করা যায়, তাও ভাবতে লাগলেন মারশাক।
প্রতিবছর পদার্থবিজ্ঞানের এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে থাকে রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ। ১৯৫৭ সালের ১৫-১৯ শে এপ্রিল অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সপ্তম ‘রচেস্টার কনফারেন্স’। বিষয়: ‘হাই এনার্জি নিউক্লিয়র ফিজিক্স’। এই কনফারেন্সে নিজেরও একটা গবেষণাপত্র পড়বেন মারশাক। ফলে সুদর্শনের V-A তত্ত্ব নিয়ে বলার জন্য দ্বিতীয় সুযোগ আর পাবেন না তিনি। মারশাক ভেবে দেখছেন, অল্প সময়ের জন্য হলেও এই মঞ্চে যদি কিছু বলার সুযোগ করে দেওয়া যায় সুদর্শনকে। কিন্তু না, সুদর্শনের বক্তব্য রাখার অনুমতি সংগ্রহ করতে পারলেন না মারশাক। সুদর্শনের তো পিএইচডি শেষই হয়নি এখনও। নিয়মানুসারে, পিএইচডি না থাকলে কাউকেই বক্তব্য রাখতে দেওয়া হয় না কনফারেন্সে।
কিছুটা দমে গেলেন সুদর্শন। তবে হাল ছাড়েননি তাঁর শিক্ষক মারশাক। একটা উপায় মাথায় এসেছে তাঁর। এই সম্মেলনে বক্তব্য রাখবেন ইংল্যান্ডের পদার্থবিদ পল টন্টন ম্যাথিউস। ম্যাথিউসের জন্ম তামিলনাড়ুর ইরোদে। সেই সূত্রে ভারত সম্পর্কে বেশ সহানুভূতিশীল ম্যাথিউস। সুদর্শনকেও বিলক্ষণ চেনেন তিনি। সুদর্শনের নতুন ভাবনার খবরও পেয়েছেন তিনি ইতিমধ্যে। সেই সূত্র ধরেই, ম্যাথিউসকে অনুরোধ করলেন মারশাক। মারশাক বোঝালেন, নিজের বক্তব্য শেষ হবার পর, তিনি যেন সুদর্শনের V-A তত্ত্ব নিয়ে দু-চার কথা বলেন জনসমক্ষে। মারশাকের প্রস্তাবে সম্মত হলেন ম্যাথিউস। নির্দিষ্ট দিনে, যথা সময়ে এল ম্যাথিউসের বক্তব্য রাখার পালা। নিজের বক্তব্য পেশ করতে শুরু করলেন ম্যাথিউস। হায়! নিজের বক্তব্যে এতই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন সেদিন ম্যাথিউস যে শেষ পর্যন্ত সুদর্শনের কথা বলতে ভুলেই গেলেন তিনি। নিজের বক্তব্য শেষ করে নেমে এলেন মঞ্চ থেকে তিনি।
* * *
রচেস্টার কনফারেন্সের কিছুদিন পর, রচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজে ইস্তফা দিলেন মারশাক। যোগ দিলেন র্যান্ড কর্পোরেশনের উপদেষ্টার পদে। রচেস্টার থেকে চলে এলেন লস এঞ্জেলেস। তবে সুদর্শনের কথা ভোলেননি মারশাক। রচেস্টার ছেড়ে যাওয়ার আগে, সুদর্শনকে লস এঞ্জেলেস্ আসার আমন্ত্রণ জানান মারশাক। র্যান্ড কর্পোরেশনে তখন কর্মরত বিখ্যাত পদার্থবিদ মারে জেল-ম্যান। সুদর্শন যদি লস এঞ্জেলেস্ আসতে পারেন একবার তাহলে জেল-ম্যানের সাথে তাঁর আলোচনার বন্দোবস্তও করে দিতে পারবেন বলে সুদর্শনকে জানালেন মারশাক। সুদর্শনও ভোলেননি মারশাকের নিমন্ত্রণের কথা, লস এঞ্জেলেস্ যাওয়ার কথা। ভোলেননি জেল-ম্যানের সাথে আলোচনার সুযোগের কথা। সেই মতো লস এঞ্জেলেস্ যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন তিনি। ১৯৫৭ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে আমেরিকার পূব প্রান্ত থেকে পশ্চিম প্রান্তে উড়ে গেলেন সুদর্শন। গন্তব্য—লস এঞ্জেলেস্। সেই যাত্রায় তাঁর সফরসঙ্গী হলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সহপাঠী রোনাল্ড এ ব্রায়ান। সুদর্শনের লস এঞ্জেলেসে যাওয়ার উদ্দেশ্য একটাই, জেল-ম্যানকে যদি একবার শোনানো যায় তাঁর নতুন ভাবনার কথা।
এর আগে কখনও লস এঞ্জেলেস্ আসেননি সুদর্শন। এ শহরে তিনি আগন্তুক। এত বড়ো শহরে সবই অচেনা তাঁর। কোথায় যে র্যান্ড কর্পোরেশনের অফিস তা খুঁজে বার করাই এক ঝক্কির কাজ। যদিওবা র্যান্ডের অফিস খুঁজে পাওয়া গেল, তো অফিসের ভিতরে প্রবেশের অনুমতি পাওয়া গেল না। বিনা পরিচয়পত্রে কাউকে ঢুকতে দেওয়া হয় না এখানে। পরিচয়পত্র?! পরিচয়পত্র কোথা থেকে পাবেন তিনি। এ তো মহা মুশকিলে পড়া গেল! তাহলে জেল-ম্যানের সাথে দেখা করবেন কী করে তিনি? অগত্যাই স্যরের সাথে যোগাযোগা করতে হল তাঁকে। সুদর্শনের আগমনের খবর পেয়ে, মারশাক নিজে গেলেন জেল-ম্যানের কাছে। তাঁর ছাত্র সুদর্শনের নতুন গবেষণার কথা জানালেন তিনি। মারশাকের বিশেষ অনুরোধ, জেল-ম্যান যেন একবার তাঁর ছাত্রের নতুন ভাবনার কথা শোনেন।
মারশাকের অনুরোধে সুদর্শনের বক্তব্য শুনতে রাজি হলেন বটে জেল-ম্যান, কিন্তু সমস্যা হল, কোনো ভাবেই অপরিচিত সুদর্শনকে অফিসের ভিতরে আনা সম্ভব নয়। ঠিক হল, অফিসের বাইরেই কোথাও না হয় দেখা করা যেতে পারে। কোনো রেঁস্তোরায় লাঞ্চের সময় কথা বলা যেতে পারে। সেই অনুযায়ী, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে, সান্তা মোনিকা অঞ্চলের একটা রেঁস্তোরায় লাঞ্চের ব্যবস্থা করা হল। জেল-ম্যান, মারশাক, সুদর্শন ও ব্রায়ান ছাড়াও সেই লাঞ্চ টেবিলে উপস্থিত ছিলেন আরও চারজন: লিওনা মার্শাল লিবি, ফিলিক্স বোহ্ম, আলডের্ট হেনড্রিক ওয়াপ্সট্রা এবং বার্থল্ড স্টেচ। এঁরা শুধু পদার্থবিদই নন, উইক ইন্টারেকশন বিশেষজ্ঞও বটে।
এই প্রথম বাইরের জগতের সামনে নিজের V-A তত্ত্বের কথা তুলে ধরতে চলেছেন সুদর্শন। তাও আবার জেল-ম্যান সমেত বাঘা বাঘা বিশেষজ্ঞদের সামনে। কিছুটা নার্ভাস বোধ করছেনই সুদর্শন। তবে এও জানেন সুদর্শন, এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবে না কোনো মতেই। জীবনে দ্বিতীয়বার আর এমন সুবর্ণসুযোগ পাবেন কি না সন্দেহ। মনে জোর এনে তাই অভ্যাগতদের সামনে নিজের ভাবনার কথা ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন সুদর্শন। সুদর্শনের বক্তব্য যত শুনছেন ততই অবাক হচ্ছেন জেল-ম্যান। চমৎকার বক্তব্য রাখছেন সুদর্শন। সুদর্শনের বক্তৃতায় উচ্ছ্বসিত জেল-ম্যান। এত চমৎকার বিশ্লেষণ! অভাবনীয়! মুগ্ধ জেল-ম্যান মনে করেন V-A তত্ত্ব দিয়ে উইক ইন্টারেকশন অনেক প্রশ্নই সমাধান করা যাবে। বিষয়টাকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দেওয়া দরকার এবার। জেল-ম্যানের প্রশংসা পেয়ে যারপর-নাই খুশি মারশাকও। V-A তত্ত্বকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিয়ে একটা ‘পেপার’ রেডি করতে সুদর্শনকে নির্দেশ দিলেন মারশাক। এই বছর সেপ্টেম্বর মাসে ইতালির পাদুয়া শহরে, ‘মেসন এবং নতুন কণাসমূহ’ নিয়ে আন্তর্জাতিক সভা বসবে। মারশাকের এবারের লক্ষ্য—পাদুয়ার আন্তর্জাতিক মঞ্চ। এই মঞ্চেই V-A তত্ত্বকে সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরতে চান তিনি।
হোক। এনাকে স্রেফ চামড়র রঙের কারণে নোবেল দেওয়া হয় নি শুনেছি।
পড়ছি ,অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে।